ইসলামের রাজনীতি
ইসলামের রাজনীতির বুনিয়াদ তিনটি মূলনীতির উপর স্থাপিত : তাওহীদ, নবুয়াত এবং খিলাফত। এ তিনটি মূলনীতিকে বিস্তৃতভাবে বুঝতে না পারলে ইসলামী রাজনীতির বিস্তারিত বিধান হৃদয়ংগম করা বড়ই কঠিন ব্যাপার। কাজেই সর্বপ্রথম আমি এ তিনটি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করব।
তাওহীদ
তাওহীদের অর্থ এই যে, আল্লাহ তায়ালা এ দুনিয়া এবং দুনিয়ার মানুষ সহ সবকিছুরই সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং একমাত্র মালিক। প্রভুত্ব, শাসন এবং আইন রচনার নিরংকুশ অধিকার একমাত্র তারই। কোন কিছু করার আদেশ দেয়া এবং কোন কাজের নিষেধ করার ক্ষমতা শুধু তারই কাছে বর্তমান। আল্লাহ তায়ালার সাথে মানুষ কাউকে শরীক করবে না। আমরা যে সত্তার দরুন বেচে আছি, আমাদের যে শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও বল-শক্তি দ্বারা আমরা কাজ করি, দুনিয়ার সকল জিনিসেরই উপর আমাদের এই যে অধিকার ও ব্যবহার ক্ষমতা প্রয়োগ করি - তার কোনটাই আমাদের উপার্জিত নয়। এর সৃষ্টি ও অবদানের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার সাথে অন্য কেউ শরীক নেই। আমাদের নিজেদের এ অস্তিত্বের উদ্দেশ্য এবং আমাদের ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তির সীমা নির্ধারণ করা আমাদের করণীয় কাজ নয়, আর না এতে অন্য কারোও একবিন্দু অধিকার আছে। এ সবকিছু শুধু সেই আল্লাহর করণীয় যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আমাদের এত শক্তি ও স্বাধীনতা দান করেছেন এবং দুনিয়ার অসংখ্য জিনিসকে আমাদের ভোগ-ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন। তাদের এ ধারণা মানবীয় প্রভুত্বকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেয়। একজন ব্যক্তি মানুষই হোক কিংবা একটি পরিবার বা একটি শ্রেণী হোক কিংবা মানুষের একটি বড় দল, একটি জাতি কিংবা সামগ্রিকভাবে সারা দুনিয়ার মানুষ হোক, সার্বভৌ্ম ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ তায়ালা, তার আদেশই হচ্ছে মানুষের জন্য একমাত্র আইন।
নবুয়াত
আল্লাহ তায়ালার এ আইন যে উপায়ে মানুষের নিকট এসে পৌছেছে, তার নাম নবুয়াত। এ নবুয়াতের ভিতর দিয়ে আমরা দু’টি জিনিস লাভ করে থাকি। এক : কিতাব - যাতে আল্লাহ তায়ালা তার নিজের আইন-কানুনের বিবরণ দিয়েছেন। দুই : সেই কিতাবের বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা - যা রাসূল (সা) আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে নিজের কথা ও কাজের ভিতর দিয়ে সুস্পষ্টরূপে পেশ করেছেন। যে মূলনীতির উপর মানুষের ধর্মীয় জীবনের ভিত্তি স্থাপিত হওয়া উচিত আল্লাহ তায়ালা সবই তার কিতাবে এক এক করে বর্ণনা করেছেন এবং রাসূল (সা) আল্লাহর কিতাবের সেই উদ্দেশ্য অনুসারে কার্যকরীভাবে জীবন যাপনের একটি পরিপূর্ণ ব্যবস্থা তৈরী করেছেন। আর তার আবশ্যকীয় ব্যাখ্যা বলে দিয়ে আমাদের জন্য একটি উজ্জল আদর্শ রূপে উপস্থিত করেছেন। ইসলামের পরিভাষায় এ দু’টি জিনিসের সমষ্টিগত নাম হচ্ছে শরীয়াত। ইসলামী রাষ্ট্র এ বুনিয়াদী নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে।
খিলাফত
এখন খিলাফতের কথা আলোচনা করা যাক। আরবী ভাষায় এ শব্দ প্রয়োগ করা হয় প্রতিনিধিত্বের অর্থ বুঝার জন্য। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ এ দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালার দেয়া স্বাধীনতা অনুযায়ী কাজ করবে। আপনি যখন কারো উপর আপনার জায়গা-জমির ব্যবস্থাপনার ভার অর্পণ করেন, তখন চারটি কথা আপনার মনে অবশ্যই বর্তমান থাকে। প্রথম এই যে, জমির প্রকৃত মালি সে নয়, - আপনি নিজে। দ্বিতীয়, আপনার জমিতে সে কাজ করবে আপনারই দেয়া আদেশ-উপদেশ অনুসারে। তৃতীয়, আপনি তাকে কাজকর্ম করার যে সীমা নির্দিষ্ট করে দেবেন, সেই সীমার মধ্যে থেকেই তাকে কাজ করতে হবে - আপনার দেয়া স্বাধীনতাকে সেই সীমার মধ্যেই তার ব্যবহার করতে হবে। আর চতুর্থ এই যে, আপনার জমিতে তাকে - তার নিজের নয়-আপনার উদ্দশ্যকে পূর্ণ করতে হবে। এ চারটি শর্ত প্রতিনিধিত্বের ধারণার মধ্যে এমনভাবে মিলে-মিশে আছে যে, ‘প্রতিনিধি’ শব্দ উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই আপনা আপনিই মানুষের মনে এটা জেগে উঠে।
আপনার কোন প্রতিনিধি যদি এ চারটি শর্ত পূর্ণ না করে তবে আপনি অবশ্যই বলবেন যে, সে প্রতিনিধিত্বের সীমালংঘন করেছে এবং সে সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে, যা ‘প্রতিনিধির’ শব্দের অর্থেই নিহিত রয়েছে। ইসলাম মানুষকে দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালার ‘প্রতিনিধি’ বলে নির্দিষ্ট করেছে। এই খিলাফত বা প্রতিনিধিত্বের ধারণার মধ্যেই উক্ত চারটি শর্ত অনিবার্য রূপে বিদ্যমান। ইসলামী রাজনীতির এ মহান আদর্শ অনুসারে যে রাষ্ট্র কায়েম হবে, মূলত তা হবে আল্লাহ তায়ালার নিরংকুশ প্রভুত্বের অধীনে মানুষের খিলাফত। আল্লাহর এ রাজ্যে তারই দেয়া আদেশ-উপদেশ অনুসারে তার নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে কাজ করে তার উদ্দেশ্যকে পূর্ণ করা হচ্ছে এ দুনিয়ায় মানুষের একমাত্র কাজ।
খিলাফতের এ ব্যাখ্যা প্রসংগে আর একটি কথা বুঝে নেয়া দরকার। তা এই যে, ইসলামের এ রাজনৈতিক মত কোন ব্যক্তি বিশেষকে কিংবা কোন পরিবার বা কোন শ্রেণী বিশেষকে ‘প্রতিনিধি’ বলে আখ্যা দেয়নি, বরং মানুষের সেই গোটা সমাজকেই এ খিলাফতের পদে অভিষিক্ত করেছে, যারা তাওহীদ ও রেসালাতের মূলনীতিগুলোকে স্বীকার করে খিলাফতের উল্লেখিত শর্তাবলী পূর্ণ করতে প্রস্তুত হবে, এমন সমাজই সমষ্টিগতভাবে খিলাফতের অধিকারী - এ খিলাফত এহেন সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের প্রাপ্য।
গণতন্ত্র
ইসলামের রাজনীতিতে এখান থেকেই শুরু হয় গণতন্ত্রের পদক্ষেপ। ইসলামী সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তিই খিলাফতের অধিকারী ও আযাদীর মালিক। এ অধিকার ও স্বাধীনতার সমগ্র মানুষই সমান অংশের অংশীদার। এ ব্যাপারে কেউ কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, কোন মানুষ অন্য কোন ব্যক্তিকে তার এ অধিকার ও স্বাধীনতার স্বত্ব হতে বঞ্চিত করতে পারে না। রাষ্ট্রের শাসন শৃংখলা বিধানের জন্য যে সরকার গঠিত হবে তা এ সমাজেরই ব্যক্তিদের মত অনুযায়ী গঠন করতে হবে। এরাই নিজ নিজ খিলাফতের অধিকার হতে এক অংশ সেই সরকারকে দান করবে। রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে তাদের মতের মূল্য অনিবার্যরূপে স্বীকৃত হবে। তাদেরই পরামর্শক্রমে গভর্ণমেন্ট চলবে। তাদের আস্থা যে ব্যক্তি লাভ করতে পারবে।
আর যে তাদের আস্থা হারাবে, সে অবশ্যই খিলাফতের পদ হতে বিচ্যুত হেত বাধ্য হবে। এ দিক দিয়ে ইসলামী গণতন্ত্র একটি পরিপূর্ণ গণতন্ত্র। একটি গণতন্ত্র যতদূর পরিপূর্ণ, পূর্ণাঙ্গ ও নিখুত হতে পারে, এটা ঠিক ততখানিই পরিপূর্ণ ও নিখুত। কিন্তু ইসলামের এ গণতন্ত্র পাশ্চাত্য গণতন্ত্র হতে মূলতই সম্পূর্ণ আলাদা। এদের মধ্যে আকার-পাতালের পার্থক্য বিদ্যমান। পার্থক্য এ দিক দিয়ে যে, পাশ্চাত্য রাজনীতি ‘জনগণের প্রভুত্বকে’ বুনিয়াদরূপে স্বীকার করে, কিন্তু ইসলাম স্বীকার করে জনগণের ‘খিলাফত’কে। পাশ্চাত্য রাজনীতিতে জনগণই হচ্ছে বাদশাহ, আর ইসলামের দৃষ্টিতে বাদশাহী একমাত্র আল্লাহর, জনগণ তার প্রতিনিধি মাত্র। পাশ্চাত্য রাজনীতিতে জনগণ নিজেরাই দেশের শাসনতন্ত্র ও আইন রচনা করে, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণকে সেই শরীয়াত বা আইনের অনুসরণ করে চলতে হয়, যা আল্লাহ তায়ালা তার রাসূলের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন।
পাশ্চাত্য রাজনীতিতে গভর্ণমেন্টের কর্তব্য হচ্ছে রাজ্যের জনগণের ইচ্ছাকে পূর্ণ করা আর ইসলামী গভর্ণমেন্ট এবং তার প্রতিষ্ঠাতা জনগণ সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যকে সার্থক করা। মোটকথা, পাশ্চাত্য গণতন্ত্র হচ্ছে আযাদ, নিরংকুশ ও বল্গাহারা প্রভৃত্ত - যার নিজ অধিকার ও স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারিতার সাথে ভোগ করে। এর সম্পূর্ণ বিপরীত - ইসলামী গণতন্ত্র হচ্ছে আল্লাহর দেয়া আইনের অনুসরণ করা। এখানে মানুষ তার অধিকার ও স্বাধীনতাকে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে তারই নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যবহার করা।
অতপর আমি তাওহীদ, রেসালাত ও খিলাফতের ভিত্তিতে স্থাপিত ইসলামী রাষ্ট্রের একটি সংক্ষিপ্ত অথচ সুস্পষ্ট চিত্র অংকন করব।
ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য
ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কুরআন শরীফে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে যে, তা সেসব মংগল ও কল্যাণময় ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করবে, বিকাশ দান করবে এবং উৎকর্ষ সাধন করবে, যে সবের অমংগল ও পাপ অনুষ্ঠানকে বাতিল করবে, পরাজিত করবে এবং নি:শেষে বিলীন করবে। মানুষের জীবনে যে সবের স্পর্শ মাত্রকেও আল্লাহ তায়ালা পসন্দ করেন না ইসলামের রাজ্যের শৃংখলা সম্মলিত ইচ্ছা-বাসনা চরিতার্থ করাও এর লক্ষ্য নয়। ইসলাম রাষ্ট্রের সম্মুখে এমন এক উচ্চতম ও উন্নততর লক্ষ্য উপস্থিত করে, যা অর্জন করা একান্তভাবে কর্তব্য। তা এই যে, আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে যে কল্যাণ ও মঙ্গলের উৎকর্ষ দেখতে চান তাকে বিকশিত ও ফুলে ফলে সুশোভিত করতে হবে। আর ধ্বংস ও উচ্ছৃংখলতার এবং এমন সমস্ত উপায়ের উৎসমুখ চিরতরে বন্ধ করতে হবে যা আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে তার এ রাজ্যকে ধ্বংস করতে পারে, তার সৃষ্টি মানব জাতির জীবন নষ্ট করতে পারে। এ লক্ষ্য উপস্থিত করার সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম আমাদের সামনে ভাল-মন্দ উভয়ের একটি সুস্পষ্ট চিত্র পেশ করেছে। তাতে বাঞ্ছিত কল্যাণ ও মংগলকে এবং অকল্যাণগুলোকে একেবারে পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে। এ চিত্র সামনে রেখে ইসলামী রাষ্ট্র প্রত্যেক যুগে এবং সকল প্রকার পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেই তার নিজ সংশোধনী প্রোগ্রাম রচনা করতে পারে।
শাসনতন্ত্র
মানব জীবনে প্রত্যেকটি শাখা-প্রশাখাতেই চারিত্রিক রীতিনীতিগুলোকে পরিপূর্ণরূপে পালন করা ইসলামের চিরন্তন দাবী। এ কারণে এটা নিজ রাষ্ট্রের জন্য এ সুনির্দিষ্ট নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, এর রাষ্ট্রনীতি নিরপেক্ষ, সুবিচার, সততা এবং খাটি ঈমানদারীর উপর স্থাপিত হবে। এটা স্বাদেশিক, প্রশাসনিক বা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার খাতিরে মিথ্যা, প্রতারণা এবং অবিচারের প্রশ্রয় দিতে কোন অবস্থাতেই প্রস্তুত নয়। দেশের অভ্যন্তরে শাসক ও শাসিতদের মধ্যস্থিত সম্পর্কই হোক, আর দেশের বাইরে অন্যান্য জাতির সাথে সম্পর্কই হোক উভয় ক্ষেত্রেই ইসলাম সততা, বিশ্বাসপরায়নতা এবং সুবিচারের জন্য সমস্ত প্রকারের স্বার্থ কুরবানী করতে প্রস্তুত। মুসলিম ব্যক্তিদের মত মুসলিম রাষ্ট্রকেও এটা এ জন্য বাধ্য করে যে, প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূর্ণ করতে হবে, লেন-দেন ঠিক রাখতে হবে এবং যা বলবে তা করতে হবে, নিজের প্রাপ্য আদায় করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের কর্তব্যকে স্মরণ করতে হবে, যা করবে তা বলবে এবং অন্যের দ্বারা তার কর্তব্য আদায় করার প্রাপ্য (হক) ভুলে যেতে পারবে না।
শক্তিকে যুলুমের কাজে ব্যবহার করার পরিবর্তে তাকে সুবিচার কায়েম করার উপায় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। পরের ন্যায্য অধিকারকে সবসময়ই হক বলে মনে করতে এবং তা আদায় করতে হবে। শক্তিকে মনে করতে হবে আল্লাহ তায়ালার আমানত এবং এ দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে তাকে প্রয়োগ করতে হবে যে, এ আমানতের পুরাপুরি হিসেব তাকে আল্লাহ তায়ালার দরবারে অবশ্যই দিতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্র পৃথিবীর বিশেষ একটা অঞ্চলে স্থাপিত হয়ে থাকলেও মানবীয় অধিকারগুলোকে সে কোন ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে সীমাবদ্ধা করে না - নাগরিকত্বের অধিকারেও নয়। শুধুমাত্র মানবতার দিক দিয়েই ইসলাম মানুষের জন্যে কয়েকটি মৌলিক অধিকার স্বীকার করে এবং সকল সময়ই সেগুলোকে পূর্ণরূপে রক্ষা করার আদেশ দেয়। সেই মানুষ ইসলামী রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে বাস করুক কিংবা এর বাইরে বাস করুক, সে মিত্রই হোক কিংবা শত্রু তার সাথে সন্ধি থাকুক কিংবা যু্দ্ধই চলতে থাকুক। মানুষের রক্ত সকল সময়ই সম্মান পাবার যোগ্য, বিনা কারণে কিছুতেই মানুষের রক্তপাত করা যেতে পারে না। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, রুগ্ন এবং আহত লোকদের উপর কোনক্রমেই আক্রমণ করা যেতে পারে না। নারীর সতীত্ব চিরদিনই সম্মানিত ও সুরক্ষণীয়, কোন কারণেই তা নষ্ট করা যেতে পারে না।
ক্ষুধার্তের জন্য অন্নের, বস্ত্রহীনদের জন্য বস্ত্রের এবং আহত কিংবা রুগ্ন ব্যক্তিদের জন্য চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রুষার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে-সে ব্যক্তি শত্রুপক্ষেরই হোক না কেন। এ কয়টি এবং এধরেনর আরো কয়েকটি অধিকার ইসলাম মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবেই দান করেছে। ইসলামী রাষ্ট্রের মূল শাসনতন্ত্রে এ সকলকে মৌলিক অধিকার বলে স্বীকার করা হয়েছে। তারপর নাগরিক অধিকারকে ইসলাম কেবল মাত্র সেসব লোকের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়নি, যারা রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে বরং প্রত্যেক মুসলমান-দুনিয়ায় যে কোন অংশেই তার জন্ম হোক না কে-ইসলামী রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে প্রবেশ করা মাত্রই এর নাগরিক হয়ে যায় এবং সেই দেশের জন্মগত নাগরিকদের সমতুল্য অধিকার তাকে দান করা হয়। দুনিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্র যত সংখ্যকই হোক না কেন এদের সব কয়টির মধ্যে নাগরিক অধিকার হবে সর্বসম্মিলিত। কোন ইসলামী রাষ্ট্রে প্রবেশ করতে হবে মুসলিম ব্যক্তির ‘পাসপোর্ট’-অনুমতি পত্রের আবশ্যক হবে না। কোন বংশীয়, জাতীয় কিংবা শ্রেণীতে বৈষ্যম ছাড়াই প্রত্যেক মুসলমান প্রত্যেকটি ইসলামী রাষ্ট্রের বড় বড় দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হতে পারবে।
যিম্মিদের অধিকার
ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে যেসব অমুসলিম বাস করে, তাদের জন্য ইসলাম কতগুলো অধিকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছ। রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে তা অবশ্য বিধিবদ্ধ থাকবে (যিম্মীর শাব্দিক অর্থ যার যিম্মা বা দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়)। ইসলামী রাষ্ট্র অমুসলিমদের জান-মাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে বলেই তারা যিম্মী নামে অভিহিত হয়। ইসলামের পরিভাষায় এরূপ অমুসলিমদেরকে বলা হয় যিম্মী। যিম্মীর জান-মাল ও মান-সম্মান সবই একজন মুসলিম নাগরিকের জান-মাল ও মান-সম্মানের মতই মর্যাদা পাবে। ফৌজদারী এবং দেওয়ানী আইনের বেলায় মুসলিম ও যিম্মীর মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। যিম্মীদের ‘পার্সনাল-ল’ অর্থাৎ ব্যক্তি স্বাধীনতায় ইসলামী রাষ্ট্র কখনও হস্তক্ষেপ করবে না। যিম্মীদের মন, ধর্মমত ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং পূজা, উপাসনার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। যিম্মী তার ধর্ম প্রচারই শুধু নয়, আইনের গন্ডির মধ্যে থেকে ইসলামের সমালোচনাও করতে পারবে।
ইসলামী শাসনতন্ত্রে অমুসলিম প্রজাদেরকে এগুলো এবং এ ধরনের আরো অনেকগুলো অধিকার দান করা হয়েছে। এ অধিকারগুলো চিরস্থায়ী। ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে তারা যতদিন থাকবে ততদিন তাদের এ অধিকার কিছুতেই হরণ করা যেতে পারে না। অন্য কোন অমুসলিম রাষ্ট্র এর অধীনে মুসলিম প্রজাদের উপর যতই যুলুম করুক না কেন, তার প্রতিশোধ হিসেবে একটা ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে এর অধীন অমুসলিম প্রজাদের উপর শরীয়াতের খেলাফ বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়। এমনকি আমাদের সীমান্তের বাইরে সমস্ত মুসলমানকে যদি হত্যাও করে ফেলা হয়, তবুও আমরা আমাদের সীমার মধ্যে একজন যিম্মীর অকারণে রক্তপাত করতে পারি না।
রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব
ইসলামী রাষ্ট্রের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার সমস্ত দায়িত্ব একজন আমীর বা রাষ্ট্র প্রধানের উপর অর্পণ করা হয়। এ আমীরকে ‘সদরে জমহুরিয়া’ বা রাষ্ট্র পরিষদের সভাপতির সমান মনে করা যেতে পারে। আমী নির্বাচনের ব্যাপারে এমন সমস্ত বয়:প্রাপ্ত স্ত্রী-পুরুষের ভোট দেবার অধিকার থাকে যারা শাসনতন্ত্রের মূলনীতিগুলোকে স্বীকার করে। আমীর (রাষ্ট্র প্রধান) নির্বাচনের মূলনীতি এই যে, ইসলামের মূল ভাবধারার অভিজ্ঞতা, ইসলামী স্বভাব-প্রকৃতি আল্লাহর ভয় এবং রাজনৈতিক প্রতিভার দিক দিয়ে যে ব্যক্তি সমাজের অধিকাংশ লোকের আস্থাভাজন হবে। এমন ব্যক্তিকেই আমীর নির্বাচন করতে হবে তারপর সেই আমীরের সাহায্যের জন্য একটি ‘মজলিশে শুরা’ বা পার্লামেন্ট গঠন করতে হবে। ‘মজলিশে শুরার’ পরামর্শ নিয়ে রাজ্যের সমস্ত শৃংখলা রক্ষা করা আমীরের কর্তব্য হবে। আমীরের প্রতি যতদিন পর্যন্ত জনগণের আস্থা থাকবে ততদিনই সে আমীর থাকতে পারবে। আস্থা হারিয়ে ফেললে তাকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। আর যতদিন তার প্রতি লোকদের আস্থা থাকবে, গভর্ণমেন্টের অধিকার ও কর্তৃত্ব তার হাতে থাকবে। আমীর এবং তার সরকারের প্রকাশ্য সমালোচনা করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
ইসলামী রাষ্ট্রে আইন রচনা করা হবে শরীয়াতের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে। আল্লাহ তায়ালা এবং তার রাসূলের সুস্পষ্ট নির্দেশ শুধু অনুসরণ ও প্রতিপালনের জন্যই। কোন আইন পরিষদ তাতে বিন্দুমাত্র রদবদল করতে পারে না কিন্তু আল্লাহ আল্লাহ এবং রাসূলের যেসব হুকুমের একাধিক অর্থ হওয়ার সম্ভাবনা হবে, তাতে শরীয়াতের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা শুধু সেসব লোকের কাজ, যারা শরীয়াতের পরিপূর্ণ দক্ষতা সম্পন্ন। কাজেই এ ধরনের কাজ ‘মজলিশে শুরা’ হতে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত সাব-কমিটির নিকট সোপর্দ করতে হবে। তারপর মানুষের দৈনন্দিন কাজ কারবারের এমন অনেক ক্ষেত্রও থাকে, যে সম্পর্কে শরীয়াত নির্দিষ্ট কোন হুকুম দেয়নি। কাজেই এ ব্যাপারে ‘মজলিশে শুরা’ দ্বীন ইসলামের নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে আইন রচনা করতে পারে।
আদালত
ইসলামী আদালত শাসন কর্তৃপক্ষের অধীন নয় ; বরং তা সরাসরিভাবে আল্লাহ তায়ালার প্রতিনিধির মর্যদায় অভিষিক্ত এবং একে আল্লাহ তায়ালরই সামনে সে জন্য জবাবদিহি করতে হবে। আদালতের বিচারকদের যদিও শাসন কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত করে ; কিন্তু এক ব্যক্তি যখন আদালতে বিচারকের পদে বসবে, তখন সে আল্লাহ তায়ালার আইন অনুসারে জনগণের মধ্যে নিরপেক্ষ ইনসাফ করবে। তার ইনসাফের হাত হতে স্বয়ং রাষ্ট্রপতিও বাচতে পারে না। বিচারকের সামনে এমনভাবে দাড়াতে হবে-যেমন করে দাড়াতে হয় রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিককে।
ইসলামের অর্থনীতি
মানুষের অর্থনৈতিক জীবনকে সত্য ও সুবিচারের বুনিয়াদে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইসলাম কয়েকটি নিয়ম এবং সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে-যেন সেই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই যাবতীয় সম্পদ উৎপাদন এবং তা ব্যয়-ব্যবহার ও আবর্তন হতে পারে। সম্পদ উৎপাদনের এবং একে সমাজের মধ্যে আবর্তিত করার কার্যকরী পন্থা কি হবে, সে সম্পর্কে ইসলাম কোনই আলোচনা করে না। কারণ তা সভ্যতার উন্নতি ও ক্রমবিকাশ এবং অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে গড়ে, আবার বদলে যায়। উৎপাদন-উপায় নির্ধারণ মানুষের অবস্থা ও প্রয়োজন অনুসারে আপনা-আপনিই হয়ে থাকে। তবে ইসলামের ঐকান্তিক দাবী এই যে, সর্বকালে এবং সকল অবস্থাতেই-মানুষের অর্থনৈতিক কাজ-কর্ম যে আকারই ধারণ করুক না কেন-ইসলামের নিয়মগুলোকে মযবুত বুনিয়াদে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং এর নির্দিষ্ট সীমা অবশ্যই রক্ষা করে কাজ করতে হবে।
জীবিকা অর্জনের অধিকার
ইসলামের দৃষ্টিতে পৃথিবী এবং অন্তর্গত সমস্ত জিনিসই আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এ জন্য পৃথিবীর ভূমি হতে নিজের জীবিকা উৎপাদনের জন্য চেষ্টা করাও প্রত্যেকটি মানুষেরই জন্মগত অধিকার। দুনিয়ার সমস্ত মানুষই এ অধিকারের ব্যাপারে সমান। কাউকে এ অধিকার হতে বঞ্চিত করা যেতে পারে না। আর এ ব্যাপারে এক শ্রেণীর লোককে অন্য শ্রেনীর উপর কোন প্রাধান্য বা অগ্রাধিকারও দেয়া যেতে পারে না। শরীয়াত অনুযায়ী কোন ব্যক্তি বা বংশ কিংবা কোন শ্রেণীকে জীবিকা অর্জনের বিশেষ কোন উপায় গ্রহণের অধিকার হতে বঞ্চিত করা, কিংবা কোন কোন পেশার দুয়ার তাদের জন্য বন্ধ করে দেয়া কিছুতেই জায়েয হতে পারে না। এরূপে শরীয়াতের দৃষ্টিতে এমন কোন বৈষম্যও সৃষ্টি করা যেতে পারে না যার দরুন জীবিকা অর্জনে কোন বিশেষ উপায় বা পন্থার উপর বিশেষ কোন শ্রেণীর বা বংশের কিংবা গোত্রের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপিত হতে পারে। আল্লাহর সৃষ্ট এ পৃথিবীতে তারই নির্দিষ্ট জীবিকা অর্জনের উপায়গুলো দ্বারা নিজের ন্যায্য অংশ আদায়ের চেষ্টা করার অধিকার সকল মানুষেরই সমানভাবে বর্তমান এবং এ চেষ্টার দ্বারা নির্বিবাদে সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকা আবশ্যক।
মালিকহীন সম্পদ
প্রকৃতির যেসব সম্পদ সৃষ্টি করা কিংবা ব্যবহার উপযোগী করার ব্যাপারে কোন মানুষের শ্রম বা যোগ্যতা ব্যয় করতে হয়নি, তা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের ভোগ করার সাধারণ অনুমতি রয়েছে। নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী তা হতে উপকৃত হওয়ার প্রত্যেকেরই অধিকার আছে। নদী ও পুকুরের পানি, জংগলের কাঠ, প্রাকৃতিক গাছ-পালার ফল, প্রাকৃতিক ঘাস ও পরগাছা, বায়ু, পানি, বন্য পশু, ভূগর্ভস্থ খনি প্রভৃতি সম্পদে কারো একচ্ছত্র ইজারাদারী স্থাপিত হতে পারে না এবং তার উপর এমন কোন বিধি-নিষেধও আরোপ করা যেতে পারে না, যার দরুন দুনিয়ার মানুষের পক্ষে তা হতে বিনামূল্যে উপকৃত হবার পথে বাধা জন্মিতে পারে। তবে যারা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে প্রকৃতির ধনভান্ডার হতে অধিক পরিমাণ সম্পদ ব্যবহার করতে চাবে, তাদের কর ধার্য করা যেতে পারে।
ব্যবহার করার নিয়ম
আল্লাহ তায়ালা মানুষের উপকারের জন্য যেসব জিনিস সৃষ্টি করেছেন, তা বিনা কাজে ফেলে রাখা কিছুতেই সংগত নয়। ‘হয় নিজে তা ব্যবহার কর, নতুবা অন্য লোককে তা হতে উপকৃত হবার সুযোগ দাও’-ঠিক এ নিয়মের ভিত্তিতে ইসলামী আইন এ ফয়সালা করেছে যে, মানুষ নিজের জমি তিন বছরের অধিককাল অনাবাদী অবস্থায় ফেলে রাখতে পারে না। সে যদি তার জমি চাষাবাদ না করে, কিংবা তার উপর কোন দালান-কোঠা নির্মাণ না করে তবে এমন কি কোন কাজেই যদি তা ব্যবহার না করে তবে তিন বছর কাল অতিবাহিত হওয়ার পর ঐ জমি পরিত্যক্ত সম্পত্তি বলে মনে করা হবে। অন্য কোন মানুষ যদি একে কোন কাজে ব্যবহার করে, তবে তার বিরুদ্ধে মকদ্দমা দায়ের করা যাবে না এবং সেই জমি অন্য একজনকে ব্যবহার করার জন্য দেয়ার অধিকার ইসলামী হুকুমাতের অবশ্যই থাকবে।
মালিকানার ভিত্তি
প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার হতে যদি কেউ নিজেই কোন জিনিস গ্রহণ করে এবং নিজের শ্রম ও যোগ্যতার দ্বারা তা ব্যবহার উপযোগী করে নেয়, তবে সেই ব্যক্তিই হবে সেই জিনিসের মালিক। যেমন কোন পতিত জমি-যার উপর এখনো কারো মালিকানা স্বত্ব স্থাপিত হয়নি-যদি কোন ব্যক্তি এতে নিজের অধিকার স্থাপন করে এবং কোন কল্যাণকর কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে, তবে তাকে কিছুতেই বে-দখল করা যেতে পারে না। ইসলামের অর্থনীতি অনুসারে দুনিয়ায় সমস্ত মালিকানা স্বত্বের সূত্রপাত এমনি করেই হয়েছে। প্রথমে যখন পৃথিবীতে মানুষের বসবাস শুরু হয়েছিল, তখন এখানকার সমস্ত কিছুই সব মানুষের সমান অধিকারের বস্তু ছিল। পরে যে ব্যক্তি যে জিনিসকে দখল করে কোন প্রকারে কার্যোপযোগী করে তুলেছে সে-ই এর মালিক হয়ে বসেছে ; অর্থাৎ কেবলমাত্র নিজের কাজেই তা ব্যবহার করার সংগত অধিকার লাভ করেছে, অন্য কোন লোক যদি সেই জিনিস ব্যবহার করতে চায়, তবে তার নিকট হতে সে ভাড়া নিতে পারবে। এটা মানুষের সমস্ত অর্থনৈতিক কাজ-কর্মের স্বাভাবিক বুনিয়াদ এ বুনিয়াদকে নিজ স্থানে প্রতিষ্ঠিত রাখাই কর্তব্য।
মালিকানার সংরক্ষণ
শরীয়াত সংগত উপায়ে দুনিয়ার কোন মানুষ যদি কিছুর মালিকানা অধিকার লাভ করে থাকে তবে অবশ্যই তা রক্ষা করতে হবে। কারো এ মালিকানা স্বত্ব শরীয়াতের দৃষ্টিতে সংগত কিনা কেবল এ দিক দিয়েই এর চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। বস্তুত শরীয়াতের দৃষ্টিতে যে সকল স্বত্ব অসংগত প্রমাণিত হবে, তাকে অবশ্য খতম করতে হবে। কিন্তু যেসব মালিকানা শরীয়াত অনুযায়ী জায়েজ হবে, তাকে নষ্ট করার কিংবা তার মালিকদের সংগত অধিকারে কিছুমাত্র হস্তক্ষেপ করার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা গভর্ণমেন্টের বা কোন আইন পরিষদের নেই। সমষ্টিগত কল্যাণ সাধনের শ্লোগান দিয়ে এমন কোন অর্থব্যবস্থা কিছুতেই কায়েম করা যেতে পারে না, যা শরীয়াত প্রদত্ত সংগত অধিকার নষ্ট করবে। সমাজের স্বাভাবিক স্বার্থ রক্ষার জন্য স্বতন্ত্রভাবে ব্যক্তিদের মালিকানার উপর স্বয়ং শরীয়াত যেসব বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে, তা হ্রাস করা যত বড় যুলুম, তাতে বৃদ্ধি করাও ঠিক ততখানিই যুলুম সন্দেহ নেই। বস্তুত স্বতন্ত্রভাবে ব্যক্তিদের শরীয়াত সংগত মালিকানার হেফাযত এবং তাদের নিকট শরীয়াতের নির্ধারিত ‘সামাজিক স্বার্থকে’ আদায় করাও ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য।
অবাধ প্রতিযোগিতার অধিকার
আল্লাহ তায়ালা তার নিজের নিয়ামত বন্টন করার ব্যাপারে সমতা রক্ষা করেননি। উপরন্তু এক শ্রেণীর লোকদের উপর এ দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। দৈহিক সৌন্দর্য, মিষ্ট কণ্ঠস্বর, স্বাস্থ্য শারীরিক শক্তি-সামর্থ, মস্তিষ্কের বুদ্ধি-প্রতিভা, জন্মগত পারিপার্শ্বিকতা এবং এ ধরনের অন্যান্য জিনিসও দুনিয়ার সকল মানুষ সমানভাবে পায়নি। জীবিকার ব্যাপারেও ঠিক এরূপ স্বাভাবিক পার্থক্য বিদ্যমান আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত প্রাকৃতিক নিয়ম ধন-সম্পদের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে পার্থক্য করতে চায়। অতএব মানুষের মধ্যে একটা কৃত্রিম আর্থিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য যতই তদবীর করা হোক না কেন, ইসলামের দৃষ্টিতে উদ্দেশ্য ও নীতির দিক দিয়ে তা সবই ভুল। ইসলাম যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তা হচ্ছে ধন-সম্পদ উপার্জনের জন্য সংগ্রাম করার সুযোগ-সুবিধার সাম্য। ইসলামের দাবী এই যে, সমাজের আইন ও প্রচলিত প্রথায় এমন কোন প্রতিবন্ধকতা কিছুতেই থাকতে দেয়া হবে না, যার দরুন মানুষ নিজ শক্তি ও যোগ্যতা অনুসারে অর্থোপার্জনের জন্য সংগ্রাম করতে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে এবং এমনসব বিরোধ বৈষম্যকেও উৎপাটিত করতে হবে, যাতে কোন শ্রেণী বংশ এবং পরিবারের জন্মগত সৌভাগ্যকে আইনের জোরে চিরস্থায়ী করে রাখা হয়? এ দু’টি পন্থায় স্বাভাবিক অসাম্যের স্থানে জবরদস্তি একটা কৃত্রিম সমতা স্থাপন করে।
এ জন্যই ইসলাম সমাজের অর্থব্যবস্থাকে এমন এক স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে চায়, যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি শক্তি পরীক্ষা করার অবাধ সুযোগ লাভ করতে পারে। কিন্তু যারা অর্থোপার্জনের চেষ্টা এবং তার পরিমাপের ব্যাপারে সমস্ত মানুষকে জোর করে সমান করে দিতে চায়, ইসলাম তাদের সাথে একমত নয়। কারণ তারা স্বাভাবিক অসাম্যকে কৃত্রিম সাম্যে পরিণত করতেই সচেষ্ট। যে অর্থব্যবস্থায় প্রত্যেকটা মানুষই অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে ঠিক সেই-স্থান হতেই যাত্রা শুরু করতে পার যে স্থানে আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন, প্রকৃতপক্ষে তাই হতে পারে একমাত্র স্বাভাবিক অর্থব্যবস্থা। মোটর নিয়ে যার জন্ম হয়েছে, সে মোটর নিয়ে যাত্রা করবে। যে শুধু দু’পা নিয়ে এসেছে, সে পদাতিক হয়েই চলবে এবং পংগু অবস্থায় যার জন্ম হয়েছে, সে অবস্থায়ই সে চলতে শুরু করবে। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মোটরের উপর মোটর ওয়ালার স্থায়ী ইজারা স্থাপিত করে এবং পংগু ব্যক্তির পক্ষে মোটর অর্জন করা অসম্ভব করে দেয়, মানব সমাজে তা সমর্থনীয় নয়। পক্ষান্তরে যে আইন এ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে জবরদস্তী করে একই স্থান হতে এবং একই অবস্থা হতে যাত্রা শুরু করতে বাধ্য করে, আর একজনের সাথে অপরজনকে চিরদিনের জন্য অবশ্যম্ভাবী রূপে বেধে রাখে তাও স্বাভাবিক ও কল্যাণকর অর্থব্যবস্থা নয়। এর ঠিক বিপরীত, স্বাভাবিক ও কল্যাণকর অর্থব্যবস্থা তাই হতে পারে, যাতে উপার্জনের জন্য প্রতিযোগিতা করার সকল মানুষেরই অবাধ সুযোগ থাকবে। যে পংগু অবস্থায় যাত্রা শুরু করেছে সে যেন নিজ শ্রম ও যোগ্যতার বলে মোটর লাভ করতে পারে এবং যে প্রথমে মোটর নিয়ে চলেছিল, পরবর্তীকালে সে যদি নিজের অযোগ্যতার দরুন পংগু হয়ে বসে তবে সে যেন পংগুই হয়ে থাকে।
সংঘর্ষের বদলে সহযোগিতা
ইসলাম সমাজ জীবনে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাকে শুধু অবাধ ও নিরংকুশ করতে চায় না ; বরং এ ক্ষেত্রের প্রতিযোগীদেরকে পরস্পরকে প্রতি নির্দয় ও কঠোর হওয়ার পরিবর্তে সহানুভূতিশীল ও সাহায্যকারী করে তুলতেও বদ্ধপরিকর। এ জন্য একদিকে এর নৈতিক শিক্ষা দীক্ষা দ্বারা মানুষের মনে তাদের অক্ষম ও জীবন সংগ্রামে পরাজিত ভাইদের জন্য নির্ভরযোগ্য আশ্রয় দেয়ার অনুকূল মনোভাব সৃষ্টি করার জন্য চেষ্টিত, অপর দিকে সে সমাজে এমন একটা মযবুত সংগঠন বর্তমান রাখার দাবী করে, যার উপর অসমর্থ ও উপায়হীন লোকদের সকল অভাব-অভিযোগ দূর করার দায়িত্ব অর্পিত থাকবে। অর্থোপার্জনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা যাদের নেই, তারা সেই প্রতিষ্ঠান হতে নিজ নিজ জীবিকা গ্রহণ করবে। যারা কালের দুর্ঘটনার আঘাতে বিপন্ন হয়ে এ প্রতিযোগিতায় ক্লান্ত হয়ে পড়বে এ প্রতিষ্ঠান তাদেরকে উঠিয়ে পুনরায় যোগ্য করে দেবে। আর এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য যাদের সাহায্যের দরকার হবে তারা এ প্রতিষ্ঠানের সাহায্য অনায়াসেই লাভ করতে পারবে।
এ উদ্দেশ্যে ইসলাম আইনত এ সিদ্ধান্ত করেছে যে, দেশের সমস্ত উদ্বৃত্ত সম্পদ হতেও শতকরা আড়াই টাকা বাৎসরিক এবং এরূপ সমস্ত পণ্যদ্রব্য হতেও শতকরা আড়াই টাকা বাৎসরিক যাকাত অবশ্যই আদায় করতে হবে। ওশর (ফসলের এক-দশমাংশ) ফরয হতে পারে এমন সমস্ত জমির উপন্ন ফসলের দশভাগের একভাগ কিংবা বিশভাগের একভাগ আদায় করতে হবে। গৃহপালিত পশুর বিশেষ একটা সংখ্যা বিশেষ সামঞ্জস্যের সাথে যাকাত হিসেবে আদায় করা হবে আর এ সমস্ত সম্পদ গরীব-ইয়াতীম এবং অভাবগ্রস্ত লোকদের সাহাযার্থে ব্যয় করা হবে। এটা এমন একটা সামাজিক বীমা-বিশেষ, যা বর্তমান থাকতে ইসলামী সমাজের কোন ব্যক্তিই জীবনের অপরিহার্য প্রয়োজন হতে বঞ্চিত হতে পারে না। কোন শ্রমজীবী ব্যক্তি উপবাস থাকার ভয়ে কারখানার মালিক কিংবা জমিদারের শোষণমূলক ও অসম্ভব শর্ত কবুল করতে কখনও বাধ্য হবে না। আর অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতায় যোগ দেবার জন্য যে শক্তি-সামর্থের আবশ্যক, কোন ব্যক্তিরই শক্তি তদপেক্ষা কম হতে পারবে না।
ব্যক্তি ও সমাজের সামঞ্জস্য
ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে ইসলাম এমন সামঞ্জস্য স্থাপন করতে চায় যাতে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র, অস্তিত্ব এবং তার আযাদী সঠিকভাবে বর্তমানা থাকতে পারে এবং সমাজের স্বার্থের জন্যও যেন তার আযাদী কোন প্রকার প্রতিবন্ধক না হয়ে বরং উপকারীই হয়। যে ধরনের রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক সংগঠন ব্যক্তিকে সমাজের মধ্যে একেবারে বিলীন করে দেয় এবং তার ব্যক্তিত্বের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য অপরিহার্য আযাদীও অবশিষ্ট রাখে না। ইসলাম তা আদৌ সমর্থন করে না। কোন দেশের সকল উৎপাদান-উপায়কে জাতীয়করণের নিশ্চিত অর্থে দেশের সমগ্র ব্যক্তিকে সমাজ স্বার্থের কঠোর বন্ধনে নির্মমভাবে আবদ্ধ করে দেয়া ইসলামে মোটেই সমর্থনীয় নয়। এমতাবস্থায় ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র বহাল থাকা তার বিকাশ লাভ করা বড়ই কঠিন এবং অসম্ভব ব্যাপার। ব্যক্তিত্ব রক্ষার জন্য যেমন রাজনৈতিক ও সামাজিক আযাদী আবশ্যক তেমনি অর্থনৈতিক আযাদীও খুব বেশী পরিমাণে জরুরী। আমরা যদি মনুষ্যত্বের মূলোৎপাটন করতে না চাই, তবে সমাজ জীবনে লোকদের এতদূর সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই দিতে হবে যাতে আল্লাহর এক বান্দা তার নিজের রুযি-রোযাগার উপার্জন করে নিজের মনের স্বাতন্ত্র রক্ষা করতে পারে এবং তার নিজের মানসিক ও নৈতিক শক্তি নিচয়কে নিজের রুচির ও ঝোক প্রবণতা অনুসারে বিকাশ করতে পারে। কন্ট্রেলের যে খাদ্যের মাপকাঠি থাকবে অন্য লোকদের হাতে তা যত প্রচুর হোক না কেন, সুখাদ্য ও সুখদায়ক কখনও হতে পারে না। কারণ তাতে মানব মনের সুষ্ঠু আযাদী ও ব্যক্তিত্বের ক্রমবিকাশ যে পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মেদবহুল দেহের বিরাটত্ব তার কিছুমাত্র পূরণ করতে পারে না।
ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ
ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্নকারী কোন সমাজ ব্যবস্থা যেমন ইসলাম সমর্থন করে না, অনুরূপভাবে ইসলাম এমন কোন সমাজ ব্যবস্থাও পসন্দ করে না যা ব্যক্তিকে সমাজ ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে নিরংকুশ আযাদী দান করে এবং তাদের নিজ নিজ প্রবৃত্তিগত স্বার্থ রক্ষার খাতিরে সমাজকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার অবাধ সুযোগ দেয়। এ দু’সীমান্তের মাঝামাঝি যে পথ ইসলাম অবলম্বন করেছে, তা এই যে, প্রথমত সামাজিক স্বার্থের জন্য ব্যক্তিকে কয়েকটি দায়িত্ব পালন করতে ও নির্দিষ্ট সীমারেখা বহাল রাখতে বাধ করা হবে। এ সীমা ও দায়িত্বগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার স্থান এটা নয়। আমি এখানে শুধু তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করব।
উপার্জনের সীমা
প্রথমে জীবিকা উপার্জনের কথাই ধরা হোক। অর্থোপার্জনের উপায় অবলম্বন করার ব্যাপারে ইসলাম যত সূক্ষ্ণ দৃষ্টির সাথে জায়েজ নাজায়েজের পার্থক্য করেছে, দুনিয়ার অন্য কোন আইন তা করেনি। যে সমস্ত উপায়ে এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির কিংবা সমষ্টিগতভাবে গোটা সমাজের নৈতিক অথবা বাস্তব ক্ষতিসাধন করে নিজের জীবিকা উপার্জন করতে পারে ইসলাম তা চিরতরে হারাম করে দিয়েছে। শরাব ও মাদক দ্রব্য প্রস্তুত করা তা বিক্রয় করা, বেশ্যাবৃত্তি, নৃত্য ও গান-বাজনার পেশা, জুয়া, দালালী, সুদ, ধোকা ও এমন ব্যবসায় যাতে এক পক্ষের লাভ নিশ্চিত এবং অপর পক্ষের লাভ অনিশ্চিত, প্রয়োজনীয় জিনিস মজুদ করে তার মূল্য বৃদ্ধি করা প্রভৃতি ধরনের সামাজিক অনিষ্ট ও ক্ষতিকর কারবার ইসলামী আইনে চিরতরে হারাম করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে ইসলামী অর্থনীতি যাচাই করে দেখলে হারাম পন্থাগুলোর একটি দীর্ঘ ফিরিস্তি সামনে উপস্থিত হবে। তার মধ্যে এমন সব উপায়ে অর্থোপার্জন করার আযাদী দান করেছে যা দ্বারা সে মানুষের অন্য কোন প্রকৃত ও কল্যাণময় খেদমত করে ইনসাফের সাথে তার পারিশ্রমিক লাভ করতে পারে।
ব্যয় সংকোচ
হালাল উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা স্বত্ব ইসলাম সমর্থন করে বটে, কিন্তু তা মোটেই সীমাহীন নয়। ইসলাম মানুষকে হালাল উপায়ে অর্জিত অর্থ-সম্পদকে ঠিক বৈধ পন্থায় ব্যয় করতে বাধ্য করে। ব্যয় সম্পর্কে ইসলাম এমন কতগুলো শর্ত লাগিয়ে দিয়েছে, যার দরুন মানুষ সাদাসিদে ও পবিত্র জীবন যাপন করার সুযোগ পূর্ণরূপে পেলেও বিলাসিতায় মোটেই অর্থ উড়াতে পারে না। কোনরূপ সীমাহীন শান-শওকত দেখাতে এবং একজন মানুষ অন্য মানুষের উপর নিজের প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারে না। কয়েক প্রকারের বাজে খরচকে ইসলামী আইনে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য প্রকারের বাজে খরচগুলোকে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা না হলেও অন্যায়ভাবে টাকা খরচ করার কাজ হতে মানুষকে বিরত রাখার ক্ষমতা ইসলামী হুকুমাতকে দেয়া হয়েছে।
ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে সমাজের অধিকার
জায়েজ উপায়ে অর্থোপার্জন ও জায়েজ পথে ব্যয় করার পর মানুষের নিকট যে অর্থ-সম্পদ উদ্বৃত্ত থাকে তা সে সঞ্চয় করতে পারে এবং আরো বেশী উপার্জনের কাজে তা নিয়োগও করতে পারে। কিন্তু এ দু’টি অধিকারের উপর কয়েকটি বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সঞ্চয় করলে ‘নেসাব’ পরিমাণের অতিরিক্ত অর্থের শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে টাকা লাগাতে হলে শুধু হালার কারবারেই নিয়োগ করতে পারে। জায়েজ কারবার নিজেও করতে পারে, নিজের মূলধন-টাকা, জমি, যন্ত্র যাই হোক না কেন-অপরকে দিয়ে তার লাভ-লোকসানের অংশীদারও হতে পারে। এ উভয় পন্থাই সংগত। এ সীমার মধ্যে থেকে কোন মানুষ যদি কোটিপতি হয় তবে ইসলামের দৃষ্টিতে তা আপত্তিকর কিছু্ই নয়, বরং তাকে আল্লাহর দানই মনে করে। কিন্তু সমাজ স্বার্থের জন্য তার উপর দু’টি শর্ত আরোপ করেছে। প্রথম, তার ব্যবসা পণ্যের যাকাত কিংবা কৃষিজাত দ্রব্যাদির এক-দশমাংশ আদায় করতে হবে। দ্বিতীয় এই যে, মানুষ তার ব্যবসায় কিংবা শিল্প অথবা কৃষিকার্যের ব্যাপারে যাদের সাথে শরীকদার হিসেবে কিংবা মজুরী দেয়া নেয়ার নিয়মে কাজ করবে, তাদের সাথে অবশ্যই ইনসাফ করতে হবে। এ ইনসাফ সে নিজে না করলে ইসলামী হুকুমাত তাকে এ জন্য বাধ্য করবে।
সম্পত্তি বন্টনের নিয়ম
উল্লেখিত সংগত সীমার মধ্যে থেকে উপার্জন ও ব্যয় করার পর যে সম্পত্তি সঞ্চিত হবে, ইসলামে তাকেও খুব বেশী দিন পর্যন্ত সঞ্চিত অবস্থায় থাকতে দেয় না, বরং তার উত্তরাধিকার নিয়মের সাহায্যে বংশ পরম্পরায় তা বন্টন করে দেয়। এ ব্যাপারে ইসলামী আইনের লক্ষ্য দুনিয়ার অন্যান্য সমগ্র আইনের লক্ষ্য হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। অন্যান্য আইন অর্জিত সম্পত্তি একেবারে পুরুষানুক্রমে চিরদিন সঞ্চিত করে রাখতে চায়। কিন্তু ইসলাম তার বিপরীত যে আইন রচনা করেছে, তাতে এক ব্যক্তির সঞ্চিত সম্পত্তি তার মৃত্যুর পরই তার নিকটাত্নীয়দের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হয়। নিকটাত্নীয় কেউ না থাকলে দূর সম্পর্কীয় আত্নীয়গণই তাদের নির্দিষ্ট অংশ অনুপাতে অংশীদার হবে। আর দূরেরও কোন আত্নীয় না থাকলে সমগ্রভাবে সমস্ত মুসলিম সমাজই তার মালিক হবে। ইসলামের এ আইন কোন বড় পুজি কিংবা বিপুল জমির মালিকানাকেই স্থায়ী অথবা অক্ষত থাকতে দেয় না। এ সমস্ত বিধি-নিষেধের পরেও যদি কারো সম্পত্তি হয় এবং তা সমাজের পক্ষে কোনরূপ ক্ষতির কারণ হয়, তবে এই শেষ আঘাতেই তাকে চূর্ণ করে দিতে যথেষ্ট।
* ইসলামী অর্থনীতি আর একটি জ্ঞাতব্য বিষয় নিম্নে প্রদত্ত হলো : ইমাম আবু ইউসুফ (র) স্বীয় গ্রন্থ ‘কিতাবুল খারাজ’-এর ‘তাউসী’ হতে উদ্বৃত করে এ হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন :
“পতিত জমি (যার কোন মালিক নেই) আল্লাহ পাক ও তদীয় রাসূলের তারপর তো তোমাদেরই। কাজেই ঐ পতিত জমির আবাদ করবে তোমরাই। কিন্তু যে ব্যক্তি স্বীয় জমি অনাবাদী ও বেকারভাবে ফেলে রাখবে, তিন বছর পরে তাতে কোন অধিকার থাকবে না।“
এ প্রসংগে ইমাম সাহেব হযরত সালেম ইবনে আব্দুল্লাহ ও ইমাম জাহবীর হাদীস উল্লেখ করে বলেন : হযরত ফারুকে আযম (রা) স্বীয় খিলাফতকালে মিম্বারে দণ্ডায়মান হয়ে উপরের উদ্বৃতিটি ঘোষণা করেন।
উপরে বর্ণিত হাদীসকে ভিত্তি করে আবু ইউসুফ (র) বলেন : “আমাদের (হানাফী মতাবলম্বীদের) নিকট ভূমি সংক্রান্ত অন্যতম বিধান এই যে, যে পতিত জমিতে পূর্ব হতে কারো মালিকানা স্বত্ব নেই, যদি কোন ব্যক্তি এটাকে কর্ষণযোগ্য ও আবাদ করে তবে তারই মালিকানা স্বত্ব বর্তাবে। অতএব যে তাকে নিজে কর্ষণ করতে পারে, অপরকে দিয়েও চাষাবাদ করিয়ে নিতে পারে অথবা স্বীয় অর্থ বিনিয়োগ করে আবাদ করে নিতে পারে। আর সে জমির উৎকর্ষতা সাধন হেতু পানি সেচ ইত্যাদি উন্নয়নমূলক কার্যও করতে পারে।” [কিতাবুল খারাজ, ইমাম আবু ইউসুফ (র)]
চতুর্থ অধ্যায় : ইসলামের রাজনীতি, রাষ্ট্র ও অর্থনীতি
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: