আগেই বলেছি মাওলানা মনজুর নোমানী ছিলেন একই সাথে দেওবন্দী লিডার, স্কলার এবং সাংবাদিক, তিনি আল-ফুরকান নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।তিনি ছিলেন জামায়াতের প্রথম ৩জন নায়েবে আমীরের একজন।জামায়াত গঠনের পর তিনি তার পত্রিকার মাধ্যমে জামায়াত গঠনের লক্ষ্যও উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে থাকেন, সাথে সাথে মাওলানা মওদুদীর মত তিনিও ভারতের বিভিন্ন অণ্ঞলে সফর করে সেমিনার করে,মসজিদ,কলেজ মাদ্রাসায় জামায়াতের কার্যক্রম নিয়ে বক্তব্য দিয়ে মানুষকে জামায়াতের দিকে আহবান জানাতে থাকেন।
ফলে জামায়াতের মেম্বারশীপ বৃদ্ধি হতে থাকে।১৯৪৫ সালে জামায়াতের রুকন সংখ্যা দাড়াঁয় ২২৪ এবং এর মধ্যে ৪০% ই হচ্ছে উলামা যারা বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন।এ সকল উলামাদের অনেকেই নিজেদেরকে মাওলানা মওদুদীর চেয়ে বেশি ধার্মিক বলে মনে করতেন বলে জানা যায় তবুও উলামাদের উপস্থিতির কারণে জামায়াতের নন-উলামা মেম্বারগন সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতেন,তারা সবাই কুরআন-হাদীসের জ্ঞান অর্জনের একটা ভাল সুযোগ পেয়ে যান।
ভাঙ্গনের সুত্রপাত:
আমরা এই সিরিজের ৪র্থ পর্বে জেনেছি যে, জামায়াতের আমির নির্বাচনের সময় মাওলানা মওদুদীকে নির্বাচন করা হয়েছিল কারন জামায়াতের আইডিয়া তার মাথা থেকে এসেছিল।ঐ সময়েই আরো কয়েকজন যোগ্যতা সম্পন্ন লোক ছিলেন যারা তাকওয়ার দিক থেকে মাওলানা মওদুদীর চেয়েও যোগ্য বলে মনে করা হত।মাওলানা মনজুর নোমানী তাদের অন্যতম একজন।জামায়াত গঠনে মাওলানা মওদুদীর পর তার অবদান সবচেয়ে বেশি বলা যায়।নোমানী তার বইয়ে বারবার বলার চেষ্টা করছেন যে আমীর হওয়ার কোন ইচ্ছায়ই তার ছিলনা রবং দুইবার যখন তাকে এই প্রস্তাব দেয়া হয়(এমনকি একবার মাওলানা মওদুদী নিজে)তিনি তা গ্রহনে অপারগতা প্রকাশ করেন,তার ভাষ্য ছিল তিনি এত বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য যোগ্য নন।যাই হউক, তিনিই কিছু দিন পরে মাওলানা মওদুদীর নেতৃত্ব নিয়ে চ্যালেন্জ করা শুরু করেন।তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুবর মাওলানা আমিন আহসান ইসলাহির মতে মাওলানা মনজুর নোমানী নিজেকে জ্ঞান ও তাকওয়ার দিক থেকে মাওলানা মওদুদীর চেয়ে superior বলে মনে করতেন।(1)
এখানে মাওলানা মনজুর নোমানীর সাথে আমিন আহসান ইসলাহির সম্পর্ক কেমন ছিল তা বলা দরকার অন্যথায় তাবলীগ অথবা দেওবন্দী অনুসারীগন আমাকে bias(পক্ষপাতিত্ব)বলতে পারেন।
ইসলাহির সাথে নোমানীর সাক্ষাতকারের এক জায়গায় নোমানী তার বইতে উল্লেখ করেন, ইসলাহী তাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন; “ভাই!পরিষ্কার কথা হল যে, আমি মাওলানা মওদুদী সাহেবকে জানিনা,তোমাকেই জানি।যদি মাওলানা মওদুদী সাহেব আগামীতে কোন ভূল পথে পরিচালিত হন,তখন আমি তো আল্লাহর কাছে তোমাকেই ধরে পেশ করে বলব যে, এর নিকট জিজ্ঞেস করুন।কেননা ইনিই আমার জিম্মাদার"।নোমানী সাহেব অবশ্য একে রসিকতা হিসেবে মনে করেছিলেন”(2)
যে বিষয়ে মতানৈক্য:
পাঠানকোটের যে জায়গা থেকে জামায়াতের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের অনেকেই সেখানে হিজরত করেন।অনেকেই তাদের চাকরি ছেড়ে চলে যান,ফলে অর্থ সংকটেই চলছিল দিনকাল।ঐ সময় মাওলানা মওদুদী আলাদা বাসা নিয়ে এবং তার খেদমতের জন্য একজন চাকর সহ থাকতেন।এই ব্যাপারটা অনেকে মাওলানা মজনুর নোমানীর দৃষ্টি আকর্ষন করেন (3)।সাথে সাথে আরও কয়েকটা বিষয় তাকে জানানো হয় যে, বেগম মওদুদী তার ঘরের চাকরের সামনে পর্দা করেননা!সবচেয়ে বড় যে অভিযোগ ছিল মাওলানা মনজুর নোমানীর নিজের তা হল,মাওলানা মওদুদীর ছোট "দাড়ি"!যা তার মতে রাসুলের সুন্নতের বরখেলাপ। নোমানীর মতে জামায়াত গঠনের আগে মাওলানা মওদুদী তাকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি দাড়ি বড় করবেন(it was kinds of conditional আনুগত্য),কিন্তু ৬মাস পরে মজলিশে শুরার ২য় বৈঠকেও তিনি তার কোন পরিবর্তন না দেখে হতাশ হয়ে পড়েন মাওলানা মওদুদীর ব্যাপারে(4)।
জামায়াত সদস্যদের অর্থসংকট নিরসনের লক্ষ্যে তিনি মাওলানা মওদুদীর পত্রিকা "তরজুমানুল কোরআন" এবং আরেকটি আলোড়ণ সৃষ্টিকারী বই "রিসালাহ-ই-দীনিয়াত" এর রয়ালিটি ছেড়ে দেয়ার দাবী জানান, কিন্তু মাওলানা মওদুদী বলেন এই বইগুলো জামায়াত গঠনের পূর্বেই প্রকাশিত হয়েছে,যেমন রিসালাহ-ই-দীনিয়াত প্রকাশ পায় ১৯৩২ সালে।(5)
মাওলানা মনজুর নোমানী কিছুদিন পর পাঠানকোট ছেড়ে চলে যান এবং তার সমসাময়িক ঘনিষ্ঠ আলেমদের সাথে এই ব্যাপারে পরামর্শ করেন।এই বিষয়গুলো জামায়াতের ভিতর ব্যাপক গুনজন সৃষ্টি করায় ১৯৪২ সালের অক্টোবরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মজলিশে শুরার বৈঠকে উৎথাপন করা হয়।
মজলিশে শুরায় আলোচিত বিষয়:
মাওলানা মনজুর নোমানীর ভাষায় মজলিশে শুরার বৈঠকে যেসব বিষয় নিয়ে কথা হয় তা ছিল এরকম; প্রথমে মাওলানা মওদুদী সাহেব এ বিষয়টি প্রকাশ করলেন যে বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি কোন কোন রুকনের পূর্ণ আস্থা নেই।অতঃপর তিনি নিজের পক্ষ থেকে কতিপয় প্রস্তাব পেশ করলেন।তন্মধ্যে সম্ভবত নিন্মোক্ত প্রস্তাব ছিল(6);
• যদি মজলিস অনুমোদন করে,তবে তিনি পদত্যাগ করবেন এবং তার পরিবর্তে অন্য একজন আমীর মনোনীত করা হবে।
• দ্বীতিয় প্রস্তাব, আমীরের পরিবর্তে দু'চার জন রুকনের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করা এবং
• তৃতীয় প্রস্তাবটি ছিল, বর্তমানে একক নেতৃত্বের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা হবে।পুরো জামায়াতের কোন একক আমীর থাকবেনা;বরং যে সব লোক আমাদের দাওয়াতের সাথে ঐক্যমত পোষণ করবে,তারা নিজেদের সুবিধামত বিশ্বাসের ভিত্তিতে ইউনিট কায়েম করবে এবং প্রত্যেক ইউনিট নিজেদের মধ্যে যাকে ভাল মনে করে, আমীর করে নিবে।
অন্য আরেক সোর্সে জানা যায়, মাও:মনজুর নোমানী ও তার সাপোর্টার যারা ছিলেন তারা উপরোক্ত প্রস্তাবনার সাথে জামায়াতকে ভেঙ্গে দেয়ারও প্রস্তাব করেন কিন্তু শুরা ঐ প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিলনা (7)।নোমানীর মতে মাওলানা মওদুদী সাহেব ঐসব প্রস্তাব মজলিসের সামনে এমন ভাবে পেশ করেন যে, অন্যান্যদের অন্তর সম্পর্কে তো আমার জানা নেই,তবে অন্ততঃ তার ভাব-ভঙ্গিতে আমি পরিষ্কারভাবে অনুভব করতে পারি যে, তিনি প্রতিটি প্রস্তাব পেশ করার সময় মজলিসের রুকন বা সদস্যদের মানসিকভাবে তৈরী করে নিচ্ছিলেন,তারা যেন এ সব প্রস্তাবের প্রত্যেকটিকে জামায়াত এবং জামায়াতের মহৎ ও পবিত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের জন্য ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্নক মনে করেন এবং নিশ্চিতরুপে এগুলো প্রত্যাখান করে বসেন(8)।
যাই হউক, মজলিসে শুরা মাওলানা মওদুদীর পক্ষেই যায়, ফলে মাওলানা মনজুর নোমানীর সাথে মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী,মা:জাফর ফুলওয়ারী(নায়েবে আমীর)এবং কামরুদ্দিন খান(ঐ সময়ের সেক্রেটারী জেনারেল)জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেন(9)। The defectors were few in number, but significant in status.(10)
পদত্যাগের পর মাওলানা মনজুর নোমানী তার পত্রিকা আল-ফুরকান এর মাধ্যেমে প্রচারণা চালাতে থাকেন এবং মাওলানা মওদুদীর ভূল ত্রুটি নিয়ে কঠোরভাবে সমালোচনা করে লেখা লেখি করতে থাকেন।এমনকি এটাও জানা যায় তিনি মজলিশে শুরার অন্যান্য মেম্বারদেরকেও পদত্যাগের পরামর্শ দিতে থাকেন।মাওলানা আমিন আহসান ইসলাহিকে পরামর্শ দিলে তিনি জবাব দেন "I am not fanatical enough to jeopardize the future of Islam over the length of Mawdudi's beard."(11) [অর্থাৎ, আমি এতটা কট্টর নই যে মওদুদীর দাড়ির সাইজের কারনে ইসলামের ভবিষ্যতকে ক্ষতির মুখে ছেড়ে দেব]
এখানে একটা বিষয় পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই, মাওলানা মনজুর নোমানী ও মাওলানা হাসান আলী নদভী দেওবন্দী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন। তাবলীগ জামায়াতও দেওবন্দেরই প্রোডাক্ট এবং ওনারা দুই জনই তাবলীগ জামায়াতের বড় মুরুব্বি ছিলেন।তাদের মাধ্যমেই জামায়াতের আদর্শিক বিরোধীতা সেই শুরু থেকে তাবলিগ জামায়াত ও বর্তমান কওমী মাদ্রাসার মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।
إِنَّ اللّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَواْ وَّالَّذِينَ هُم مُّحْسِنُونَ
আল্লাহতো তাদের সংগে রয়েছেন যারা তাকওয়া সহকারে কাজ করে এবং ইহসান অনুসারে আমল করে(নাহল:১২৮)
এই ভাঙ্গন মাওলানা মওদুদীকে সংগঠনের শৃঙ্খলার ব্যাপারে সতর্ক করে তোলে, ফলে দেখা যায় পরবর্তিতে জামায়াতকে তিনি কেডার(স্তর)ভিত্তিক সংগঠনে পরিণত করেন।
0 comments: