ভারত ভাগের পর জামায়াত এবং প্রথম রাজনৈতিক পরীক্ষা অতপরঃজামায়াত অধ্যয়ন-৭


১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর মাওলানা মওদুদীর নেতৃত্বে জামায়াতের বড় অংশটা পাকিস্তানে চলে যায়।৬২৫জন সদস্যের(রুকন)মাঝে ২৪০জন ভারতে থেকে যান মাওলানা আবুল লাইয়াছ ইসলাহীর নেতৃত্বে যিনি নিজে একজন নামকরা আলেমে দ্বীন ছিলেন এবং ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জামায়াতের আমীর ছিলেন (1)। এখান থেকে বলে নেয়া ভাল, জামায়াতের ইতিহাস বাস্তবিক কারনেই দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে যায় এবং যেহেতু মুল জামায়াত পাকিস্তান ভিত্তিক ছিল আমাদের আলোচনা মুলত ঐ কেন্দ্রিকই হবে।ভারত জামায়াতের কার্ক্রম নিয়ে আলাদা পোষ্ট দেয়ার ইচ্ছা রয়েছে।

মাওলানা মওদুদী চেয়েছিলেন জামায়াত আরো কিছু দিন আদর্শিক ধারায় থাকুক অর্থাৎ আগের পোষ্টে বর্ণীত কর্মসূচী অনুসারে লোক তৈরির কাজ চলতে থাকুক কিন্তু ভারত ভাগের পর পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক,রাজনৈতিক অবস্থা জামায়াতের দৃষ্টি অনেকটা রাজনীতির দিকে নিয়ে যায়।

প্রেসার গ্রুপ হিসেবে জামায়াত

দেশভাগের পর জামায়াত মুলত পাকিস্তানের সংবিধানকে সত্যিকার অর্থে ইসলামিক করার লক্ষ্যে ক্যাম্পেইন শুরু করে।মাওলানা মওদুদী তথা জামায়াতের যুক্তি ছিল যেহেতু দেশ ভাগ হয়েছে ইসলামের নামে সেহেতু সংবিধান শরিয়া মোতাবেক হবে এটাই স্বাভাবিক।এই লক্ষ্যে জামায়াত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জনপ্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ এবং জনসাধারনে এর গুরুত্ব বুঝানোর লক্ষ্যে ব্যাপক গনসংযোগ শুরু করে। মাওলানা মওদুদী এই বিষয়ে তখন সংবিধান ও রাষ্ট্র নিয়ে কয়েকটা বইও লিখেন।১৯৪৮ সালে মাওলানা মওদুদী লাহোর ল কলেজে মুল ৪দফা দাবী পেশ করেন(2);

১। সার্বভৌমত্ব হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর,রাষ্ট্র শুধু আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতার ব্যবহার করে থাকে
২। শরিয়া হবে জমীনের বেসিক আইন
৩।শরিয়ার সাথে সাংঘর্ষিক আইন যেগুলো রয়েছে সেগুলো ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন করতে হবে এবং ঐ ধরনের কোন আইন ভবিষ্যতে পাশ করা যাবেনা।
৪। ক্ষমতার ব্যবহার করতে যেয়ে রাষ্ট্র ইসলাম প্রদত্ত সীমা অতিক্রম করবেনা।

মানুষ যখন ইসলামিক সংবিধানের লক্ষ্যে আওয়াজ তুলে সরকার ভয়ে মাওলানা মওদুদীকে পাবলিক সেইফটি আইনের আওতায় গ্রেফতার করে এবং তাকে ২০ মাস জেলে বন্দি করে রাখে।যাই হউক,বলতে গেলে উপরোক্ত প্রস্তাব অনুসারেই ১৯৪৯সালের ১২ই মার্চ গনপরিষদে সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে Objective Resolution(আদর্শ প্রস্তাব)গৃহীত হয় (3)।উক্ত আদর্শ প্রস্তাবই পরবর্তিতে পাকিস্তানের সংবিধান রচিয়তাদের সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে ১৯৫৬, ১৯৬২,১৯৭২ এবং ১৯৭৩(4)।
মাওলানা মওদুদীর মতে আদর্শ প্রস্তাব পাশের ফলে পাকিস্তান একটি ইসলামী রাষ্ট্রের shape(কাঠামো)নিয়েছে।এটা আদর্শ প্রস্তাব নয় বরং বাস্তবতা হচ্ছে, যারা ইসলাম অনুসারে জীবন যাপন করতে চায় সেসমস্ত মানুষের অপ্রত্যাশিত দাবীর মুখে সরকারকে সে প্রস্তাব গ্রহন করতে বাধ্য হয়েছে সেই বৈশিষ্টই পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে (5)।সাংগঠনিকভাবে জামায়াতের এই অর্জন জামায়াতকে আশাহ্নিত করে ফলে দেখা যায় ১৯৫১ সালে জামায়াত আরো ব্যাপক ভিত্তিক কর্মসূচী নির্ধারণ করে।১৯৫১ সালে প্রণীত জামায়াতের ঐতিহাসিক ৪ দফা(6);
১। পারসোনাল যোগাযোগ, লেকচার,সেমিনার এবং গনমাধ্যমের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের চিন্তার পরিশুদ্ধকরণ ও পুনর্গঠন।
২। প্রশিক্ষিত করার লক্ষ্যে মানুষকে সংগঠনভুক্ত করা
৩। সমাজের পূনর্গঠনের লক্ষ্যে কম মুল্যে অথবা বিনা মুল্যে সাস্থ্য সেবা দেয়া, গ্রামে-গন্জে রাস্তাঘাট ও ব্রিজের তৈরি,বয়স্কও শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা,গনমানুষের জন্য এলাকায় এলাকায় বিনামুল্যে পাঠাগার তৈরি এবং গরীব মানুষদেরকে সাহায্য করন।
সাংবিধানিক ধারায় ইসলামের আলোকে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত সরকার ব্যবস্থার পূনর্গঠন,যেমন;সরকারের সাথে আলোচনা,সকল প্রকার সহগামী বিষয় নিয়ে প্রচারণার মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহন ও জোট গঠন

এই প্রথম রাজনীতি জামায়াতের কর্মসুচীর অন্তর্ভুক্ত হলো তবে তা ছিল সবচেয়ে least Priority(7)।মাওলানা মওদুদীর ভাষায় এটা খুবই লজ্জার যে মুসলমানরা রাজনীতিকেই একমাত্র তাদের উদ্দেশ্য মনে করে এবং ধর্মের ভূমিকাকে করে অগ্রাহ্য(8)।

আদর্শ প্রস্তাব পাশ হওয়ার ফলে জামায়াত সেমিনার,জনসংযোগ এবং জোড় লবিং শুরু করে জাতীয় পরিষদের নেতাদের সাথে কিন্তু সে অনুসারে ইসলামিক সংবিধান প্রণয়নে সরকার গড়িমসি করতে থাকে। ফলে জামায়াত নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে।

নির্বাচনে প্রথম পরীক্ষা

১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত পান্জাব প্রাদেশিক নির্বাচনে জামায়াতের ইতিহাসে অন্যতম ঘটনা ও নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহনের জন্য চিন্তার রাজ্যে নতুন যাত্রা।এই নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত বলার সুযোগ এখানে নেই তবে কিছু বিষয় যা না বললেই নয় তা উল্লেখ করছি।প্রথম কথা হচ্ছে এটা ছিল আদর্শবাদী দল হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামী শরীয়ার আলোকে, সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীর প্রথম পরীক্ষা।

প্রার্থী নির্বাচন

জামায়াত প্রথাগত দলগুলোর মত প্রভাবশালীদেরকে নমিনেশন না দিয়ে বিকল্প এক পদ্ধতিতে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়।জামায়াত নিজ থেকে কোন প্রার্থীর নাম ঘোষনা না করে প্রত্যকে এলাকায় ৫৩জন সদস্যের সমন্বয়ে পণ্ঞায়েত(voter council) গঠন করে ১৩৯০ টি এলাকায় এবং তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয় সালিহ ও আদর্শ প্রস্তাব বাস্তবায়নে কাজ করার যোগ্য প্রার্থী মনোনয়নের জন্য।জামায়াত তারপর ঐ সমস্ত মুত্তাকী প্রার্থীদের জন্য প্রচারণা চালায়। জামায়াত এটা পরিষ্কার করে যে, তারা কোন দুনিয়াবী স্বার্থের জন্য নির্বাচন করছেনা রবং এই সুযোগে পাকিস্তানকে ইসলামাইজ করার চিন্তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া (9)।
জামায়াত খুবই সততার সাথে নির্বাচনী প্রচারণা চালায় কারো। কারন ১৯৪১ সালে মাওলানা মওদুদী বলেছিলেন; Demonstration and agitation, flag waving, slogans, uniforms and petitions, resolutions and addresses, impassioned speeches and emotional writing, and similar things, which are the heart and soul of nationalist or others movements, will prove deadly for the Islamic movement. You do not need to capture your audience through impassioned speeches, writings and demonstration...but you must kindle the light of Islam in your hearts and as such, change those around you. (10)

অন্যদের মত কারো বিরুদ্ধে কোন রকম অপপ্রচার না চালিয়ে, মিথ্যা তথ্য না দিয়ে, তথ্যের কোন রকম বিকৃতি ছাড়াই ১৯৫০ সালের জুলাই মাস থেকে আবদুল জব্বার গাজীর নির্দেশনায় প্রচারণা চালায় জামায়াত।সর্বমোট ১৯২ টি নির্বাচনী সিটের মধ্যে থেকে ৫৩ জন প্রার্থীর জন্য জামায়াত প্রায় ৮ মাস লাগাতার প্রচারণার কাজ করে।(11)

The ফলাফল এবং তারপর

নির্বাচনের ফলাফল ছিল খুবই হতাশাব্যন্জক।জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের মধ্যে মাত্র একজন সৎ লোক নির্বাচিত হয়েছেন,মাওলানা মহিউদ্দিন লাখাবী (12)। এই ফলাফল জামায়াতের rank and file এর ভিতরে তুমুল আলোড়ণ তৈরি করে এবং শুরু হয় soul searching।অনেকেই অনুধাবন করেন যেভাবে অন্যদলগুলো ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ও সকল প্রকার অনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে নির্বাচন করে জামায়াতের পক্ষে কোন দিনও শান্তিপূর্ণভাবে ও নৈতিকতা ঠিক রেখে নির্বাচনে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়।তারা তীব্রভাবে জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহনের বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং উপরে বর্ণিত ৪দফা অনুসারে শিক্ষা সমাজ সংস্কার ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে কাজ চালু রাখার ব্যাপারে মত দেন (13)।

এই পরিস্থিতি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলার মধ্য দিয়েই জামায়াত সংবিধান ও ইসলামী শাসনতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য জোড় প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। ডক্টর ইসরার আহমেদের মতে দেশ ব্যাপী তীব্র গন আন্দোলন তৈরির লক্ষ্যেজামায়াতের কর্মসূচী মুলত দুই দফায় পরিণত হয় (14);

১। নতুন গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ইসলামিক আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রে রুপান্তরের লক্ষ্যে একটি ব্যাপক ভিত্তিক আন্দোলন তৈরি করা
২। রাজনৈতিক নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী পরিবর্তন আনা যাতে করে রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ইসলামের খেদমতে ব্যবহার করা যায়

ডক্টর ইসরার আহমেদ মাওলানা মওদুদীর কঠোর সমালোচনা করেন জামায়াতের কাজকে শুধুমাত্র মুসলমানদের মাঝে সীমাবদ্ধ করে ফেলা এবং জামায়াতকে ইসলামের নামে একটি জাতীয়তাবাদী দলে রুপান্তর করার জন্যে(15)।
১৯৫১ সালের নির্বাচন পরবর্তী জামায়াতের আভ্যন্তরীণ মতবিরোধ গুলো ভালভাবে নিষ্পুত্তি করার আগেই ১৯৫৩ সালে কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা মওদুদীকে মিথ্যাভাবে জড়িয়ে ২৫ মাসের জেল দেয়া হয়।ফলে সমস্যা ধানা বাঁধতে থাকে যা একটা পর্যায়ে বড় আকার ধারণ করে জামায়াতকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনায় নিয়ে যায়।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম