গত তিনটি পোষ্টের মাধ্যমে একটা বিষয় পরিষ্কার যে তৎকালীন (বৃটিশ ভারত)পরিবেশে মুসলমানদের স্বকীয়তা রক্ষার জন্য যেমন নিজস্ব রাজনৈতিক প্লাটফরম প্রয়োজন ছিল,সাথে সাথে মুসলমানদের ধর্মীয় সত্তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি ডেডিকেটেড ফোর্সও দরকার ছিল।রাজনৈতিক নেতৃত্ব দানের জন্য ছিল মুসলিম লীগ,ধর্মীয় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ,তদুপরি মানুষের মাঝে ইসলামের মুল স্পিরিট জাগিয়ে সমাজ জীবনে ইসলামের পূনর্জাগরণের লক্ষ্যে ১৯২৬ সাল থেকেই মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়স রহ: এর নেতৃত্বে তাবলীগ জামাত নিন্মোক্ত ৬দফা কর্মসূচী নিয়ে ময়দানে কাজ করছিল(1);
মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) ১। ঈমান(কালেমার প্রতি পরিপূর্ন আস্থা এবং বিশ্বাস)
২। সালাত(সহিহ ভাবে নামাজ শিক্ষা)
৩। জ্ঞান অর্জন ও জিকির(জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরন করা)
৪। অপর মুসলিম ভাইকে সম্মাণ করা
৫। ইখলাস(নিয়তের পরিশুদ্ধকরণ-একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন)
৬। দাওয়াহ(দ্বীনের রাস্তায় সময় দেয়া(যেমন চিল্লা লাগানো)
সবার অবগতির জন্য জানাতে চাই যে,তাবলীগ জামায়াতের আন্দোলন অল্প কিছু দিনের মধ্যে ব্যাপক সাড়া তৈরি করে যা দেখা যায় ১৯৪১ সালে বার্ষিক গনসমাবেশে উপস্থিতি দেখে,১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসে ঐ সমাবেশে প্রায় ২৫০০০ মানুষের উপস্থিতি হয়।(2)
উপরোক্ত কর্মসূচীর আলোকে সমাজে যেখানে একটি আন্দোলন কাজ করছে সেখানে আরেকটা জামায়াত গঠনের প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিল?আর যদি গঠন করাই হয় তাহলে সমাজের কোন শুন্যস্থান পূরনের লক্ষ্যে এবং কাদেরকে টার্গেট করে নতুন এই আন্দোলন তৈরি হতে পারে??[পাঠকদের কে অনুরোধ করব এই প্রশ্নগুলো সামনে নিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছু সময় ১৯৪০ সালের কথা চিন্তা করুন]
প্রশ্নের উত্তর যারা আগের দুইটি পোষ্ট পড়েছেন তাদের কাছে পরিস্কার হওয়ার কথা। Existing দল বা সংগঠনগুলো বিভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করছে ঠিকই কিন্তু পরিপূর্ন নয়।কারোর মধ্যেই একসাথে ধর্মীয় সংস্কার,পশ্চিমা অপসংস্কৃতির প্রভাব থেকে সমাজকে রক্ষা করার, দ্বীমুখী শিক্ষার মাঝে সেতু বন্ধন এবং সর্বোপরি ইসলামকে আল্লাহ প্রদত্ত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার বাসনা কোন দলের মাঝেই ছিলনা।
এই শুন্যস্থানকে পূরণ করার লক্ষ্যেই একটি জামায়াত বা দল গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বিশ্লেষন ১৯৪১ সালে তরজমানুল কুরআনে মাওলানা মওদূদী 'জামায়াতে ইসলামীর গঠন' শীর্ষক এক প্রবন্ধ লেখার ফলে সমমনা লোক প্রবন্ধের ব্যাখ্যা দাবী করে মাওলানাকে পত্র লিখতে থাকেন। তার জবাবে এপ্রিল মাসের তর্জমানুল কুরআনে বলা হয় যে, যারা উক্ত প্রবন্ধে বর্ণিত পদ্ধতিতে কাজ করতে চান তাঁরা আপন আপন জায়গায় কাজ শুরু করতে পারেন এবং সংগে সংগে যেন তাঁদের নাম তরজমানুল কুরআন অফিসে পাঠিয়ে দেয়া হয় যাতে করে একে একটি সম্মেলনে রূপ দেয়ার পথ বেরোয়।
এভাবে দেড়শ' লোকের একটি তালিকা তৈরী করা হয়। এবং এ তালিকা অনুযায়ী ২৫ শে আগষ্ট মুবারক পার্কে অবস্হিত তর্জমানুল কুরআন কার্যালয়ে তাদেরকে উপস্হিত হওয়ার জন্যে দাওয়াতনামা পাঠানো হয়। তদানুযায়ী সারা ভারত থেকে ৭৫ জন ইসলামী ব্যক্তিত্ব লাহোরে উপস্হিত হন। সম্মেলনের কাজ ২৬শে আগষ্ট সকাল আটটায় শুরু হয় এবং ২৯শে আগষ্ট পর্যন্ত চলে। এ সম্মেলনেই জামায়াতে ইসলামী গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। (3)
দলের পরিচয় দিতে গিয়ে মাওলানা মওদুদী:দলের সদস্যদেরকে ঈমানের দিক দিয়ে সুদঢ় ও অবিচল হতে হবে এবং আমলের দিক দিয়ে হতে হবে প্রশংসনীয় মানের।কারণ তাদেরকে সভ্যতা সংস্কৃতির ভ্রান্ত ব্যবস্থা ও রাজনীতির বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ করতে ঘোষণা করতে হবে এবং এ পথে আর্থিক কুরবানী থেকে শুরু করে কারাদন্ড এমনকি ফাঁসির ঝুঁকি নিতে হতে পারে (4)
যাদের নিয়ে জামায়াত গঠিত হলো: জামায়াত ইসলামী গঠনের সময় বিভিন্ন মতাদর্শের আলেমের সমন্বয় দেখা যায়। এ মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে,৬ জন আলেম এসেছিলেন মাদ্রাসাতুল ইসলাহ থেকে,৪ জন ছিলেন দেওবন্দী আলেম,৪ জন নদভী আলেম এবং ২ জন এসেছিলেন আহলে হাদীস থেকে।
কয়েকজন হাই প্রোফাইল আলেম:
১।মাওলানা মনজুর নোমানী, স্বক্ষেত্রে যিনি উজ্জ্বল।উপমহাদেশে হাদীস আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত এবং তাবলীগ জামায়াতের উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল।
২। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, ভারতীয় উপমহাদেশের আরেক নক্ষত্র।সমসাময়িক আলেমদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
হাসান আলী নদভী।
৩। মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী,তিনিও সমসাময়িক স্কলার ছিলেন।
আমীন আহসান ইসলাহী
৪।মুহাম্মদ ইবনে আলী কাকওয়ারী
বিভিন্ন School of thought থেকে আগত উলামাদের নিয়ে জামায়াত গঠিত হওয়ার ফলে জামায়াত তখন এককেন্দ্রীক সংগঠন হতে পারেনি।দলে কারোরই একক কতৃত্ব তৈরি হওয়ার সুযোগ ছিলনা।কারন প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে ছিলেন যথেষ্ঠ প্রভাবশালী ।(5)
আমীর নির্বাচন: ৭৫ জন উলামার সমন্বয়ে গঠিত সমাবেশ থেকে আমীর নির্বাচন করা সহজ ছিলনা।সর্বোপরি, যেখানে বিভিন্ন মতাদর্শের প্রসিদ্ধ আলেমের উপস্থিতি ছিল,সেখান থেকে নেতা নির্বাচন ছিল খুবই কঠিন।মাওলানা মনজুর নোমানী, আমীন আহসান ইসলাহী সহ আরো কয়েকজন আলেমের ব্যাপারেও যথেষ্ঠ সংখ্যক মতামত ছিল।সব শেষে যেহেতু জামায়াত ছিল মাওলানা মওদুদীর মানস পুত্র ও চিন্তার ফসল তাই মুহাম্মদ ইবনে আলী কাকওয়ারী ও মাওলানা মওদুদীর মধ্যে প্রতিদন্ধীতায় মাওলানা মওদুদী প্রথম আমীর নির্বাচিত হন। সবার মনে রাখা উচিত Their mandate was not religious; they simply chose the best manager among them to lead the party (6)
আমীর নির্বাচিত হওয়ার প্রদত্ত ভাষনে মাওলানা মওদুদী;
"যারা জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করবে তাদের প্রত্যেকের এ কথা ভাল করে বুঝে নেয়া দরকার যে, জামায়াতে ইসলামীর সামনে যে কাজ রয়েছে তা যেমন তেমন কাজ নয়।দুনিয়ার নীতি নৈতিকতা, রাজনীতি, সভ্যতা সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রতিটি বস্তু পরিবর্তন করে দিতে হবে।খোদাদ্রোহিতার উপর যে ব্যবস্থা দুনিয়ায় কায়েম রয়েছে তা বদলিয়ে খোদার আনুগত্যের উপর তা কায়েম করতে হবে।এ কাজে সকল শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ও প্রতিটি পদক্ষেপের পূর্বে প্রত্যেককে ভালো করে বুঝে নিতে হবে যে সে কোন কন্টকময় পথে পা বাড়াচ্ছে" (7)
পরিশেষে বিজ্ঞ পাঠকের কাছে একটা প্রশ্ন রেখে শেষ করতে চাই, প্রতিষ্ঠাকালীন জামায়াতে বিভিন্ন মতাদর্শের আলেমদের উপস্থিতি দেখা গেলেও বর্তমানে এর অনুপস্থিতি কেন???
পরের পর্বে থাকবে জামায়াতের লক্ষ্য,উদ্দেশ্য ও কর্মসুচী নিয়ে বিস্তারিত।
0 comments: