গনতন্ত্রের জন্য মৌলিক আদর্শের সাথে আপোষঃজামায়াত অধ্যয়ন-১৩

"ইসলাম" ও "গনতন্ত্র" দুইটি শব্দ কি সমার্থক? না বিপরীতমুখি?এই থিওরিটিকাল বিতর্কে যাওয়ার অবকাশ এই পোষ্টে নেই।খুবই সহজ ভাষায় বলব "Democracy" is a western terminology যার অন্তর্নিহিত দর্শন হচ্ছে "মানুষ একটি পরিপূর্ণ সত্তা" আর তাই শাসন ব্যবস্থায় মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলনই হচ্ছে গনতন্ত্র।

অক্টোবর ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে ক্ষমতা দখল করে নেন।আইয়ুব খানের শাসন পাকিস্তানের মেরুদণ্ডকে একরকম ভেঙ্গে দেয় বলা যায়।তার প্রায় দশ বছরের শাসন আমলে জামায়াত ইসলামি একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।এই সময়ের ঘটনা প্রবাহ এত ব্যাপক যে এই পোষ্টে বা আরো কয়েক পোষ্টেও পরিপূর্ণভাবে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। যেহেতু আমাদের আলোচনার ফোকাস হচ্ছে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে,তাই যেখানে যেখানে জামায়াতের আদর্শিক ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় ঠিক ততটুকুই আলোচনায় আনার চেষ্টা করেছি।

শুরুতে দেখি আইয়ুব খান কে ছিলেন,তার পরিচয় দিতে গিয়ে “Clash of Civilisation” খ্যাত স্যামুয়েল হান্টিংটন বলেন; More than any other political leaders in a modernising country after Wold War II, Ayub Khan came closest to filling the role of a Solomon or Lycurgus, or ‘Great Legislator’ on the Platonic or Rousseauian Model(1)

গোলাম আযম সাহেবের জীবনে যা দেখলাম(২য় খন্ড)পড়লে দেখা যায় মার্শাল ল কিভাবে জামায়াতের খাতায় কিছুটা সফলতা নিয়ে আসে!১৯৫৮ সালের শেষ দিকে মার্শাল ল কায়েমের ফলে সকল রাজনৈতিক দলের সাথে জামায়াতের অফিসেও তালা ঝুলে কিন্তু ওনার একাউন্ট অনুসারে তখনই জামায়াতের সবচেয়ে বেশি কাজ(আদর্শ প্রচারে)হয়েছে যা পরবর্তিতে আইয়ুব বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলনে ভাল ফলাফল দেয়।কিন্তু মার্শাল ল তুলে নেয়ার পরপরই আইয়ুব খান ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য "Modernist Approach" নিয়ে একদিকে ইসলামকে ব্যবহার করেছেন অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গুলোকে সেকুলার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী নিয়েছেন।উপরোক্ত কাজের বিরোধীতায় জড়িয়ে পরে জামায়াত।

মুসলিম পারিবারিক আইন

১৯৬১ সালে আইয়ূব খান মুসলিম পারিবারিক আইনে ব্যাপক পরিবর্তন আনে।তাতে বিবাহ বিষয়ক ও জন্মনিয়ন্ত্রনের কর্মসূচী সহ বহু সেকুলার উপাদানের সমন্বয়ের কারনে জামায়াত Family Law Ordinance(FLO) কে অনিসলামিক ঘোষনা দিয়ে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে (2)।জামায়াত সেক্রেটারি মিয়া তোফায়েল মোহাম্মদ FLO কে প্রতিরোধ করার জন্য লাহোরে অন্যান্য উলামাগনকে একত্রিত করার উদ্যেগ নেন ১৯৬১ সালের মার্চে (3)। এই সমস্যার সুরাহা না হতেই জামায়াতের সামনে আরেকটা ইস্যু এসে হাজির হয়।

সংবিধান পূনস্থাপনের আন্দোলন

১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচিত হয়।প্রফেসর মমতাজ আহমেদের মতে যা কিনা ছিল mainly a collection of modern secular laws for the administration of a Westminster-type parliamentary democracy with board Islamic ideology as its guiding but nonbinding factor.কিন্তু আশ্চার্যজনক হল,জামায়াত এটাকে অল্প কিছু পরামর্শের প্রস্তাবনা দিয়ে "ইসলামিক"সংবিধান বলে প্রশংসা করে এবং মেনে নেয়।(4)

আইয়ূব খান ১৯৬২সালে নতুন সংবিধান প্রনয়ন করেন এবং ইসলামিক রিপাবলিক পাকিস্তান থেকে "ইসলামিক" শব্দটি বাদ দেন।জামাতের দাবীর অন্যতম একটি দাবি ছিল ১৯৫৬ সালে প্রণীত সংবিধানের পূনপ্রতিষ্ঠা করন।১৯৬২ সালের আগষ্টে জামায়াত শুরা নতুন সংবিধানকে প্রত্যাখ্যান করে এবং গনতন্ত্র পূনপ্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়ে দাবি পাশ করে।(5)

এই সকল বিষয় বিবেচনায় নিলে দেখা যায় আইয়ুব খানের শাসন আমলে জামায়াতের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। জামায়াত শুরু থেকেই প্রচন্ড চাপে রাখে সরকারকে, মিছিল,মিটিংয়ে আন্দোলন জটিল আকার ধারন করে একটা সময়।

জামায়াতকে বে-আইনী ঘোষণা

সাইয়েদ ভেলী রেজা নাসর জানান যে,পাকিস্তান তথ্য মন্ত্রনালয় ১৯৬১-৬২ সালে জামায়াতকে রাষ্ট্রবিরোধী বর্ণনা করে রিপোর্ট দেয় এবং মিসরের গামাল নাসর যেভাবে ইখওয়ানকে মোকাবেলা করেছেন জামায়াতকেও সেভাবে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তাব করে (6) কারন জামায়াত গনতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবার সাথে সাথে আইয়ুব খাঁর ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদ করত।সরকার মিশরের মত এতটা হার্ড লাইনে না গেলেও ১৯৬২ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পর থেকে গনতান্ত্রিক আন্দোলন চলাকালে ১৯৬৪ সালের জানুয়ারী মাসে একমাত্র জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনী ঘোষণা করে। মাওলানা মওদুদী সহ প্রায় অধিকাংশ শুরা সদস্য, সর্বমোট ৬০ জন জামায়াত নেতাকে জেলে আটক করা হয়। ৯মাস পর সুপ্রীম কোর্ট রায় দেয় যে,জামায়াতকে বে-আইনী ঘোষণা করাটাই বে-আইনী হয়েছে।(7)

স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গনতান্ত্রিক ঐক্য

২০ জুলাই ১৯৬৪ সালে জামায়াত প্রতিনিধিগন ঢাকায় খাজা নাজিম উদ্দিনের বাসভবনে আওয়ামী লীগ,মুসলিম লীগ(কাউন্সিল),নেজামে ইসলাম পার্টি,ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে বসেন।বৈঠকে ৫টি দলের সমন্বয়ে Combined Opposition Party(COP) নামে একটি ঐক্যমত্য গঠন করা হয় এবং ৯দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।(8)

আদর্শের সাথে বড় ধরনের আপোষ

নির্বাচনে অংশগ্রহনের জন্য COP যে ৯টি বিষয় নিয়ে মেনিফেস্টু তৈরি করে,মজার ব্যাপার ছিল মুসলিম পারিবারিক আইন বাদে ঐ মেনিফেস্টুতে ইসলামের কোন রেফারেন্সই ছিলনা!(9) ওস্তাদ খুররাম মুরাদের নেতৃত্বে নেগোশিয়সেন টিম ঐ সময় জামায়াতের অনেক নীতির সাথেই আপোষ করে। জামায়াত শুধু মেনুফেস্টুর ৯ টি বিষয়ই নয় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন মিস ফাতিমা জিন্নাহ কে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মেনে নেয়, যা নিয়ে সমগ্র পাকিস্তানের উলামাগন ক্ষেপে যান।

এটাই হচ্ছে জোটবদ্ধ রাজনীতির চিত্র, সেখানে নিজের আদর্শের সাথে কমপ্রোমাইজ করে হলেও রাজনীতির স্বার্থে অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। জমিয়ত-আল-উলামা মিস ফাতিমা জিন্নাহর বিরুদ্ধে ফতওয়া ইস্যু করে। শুধু তাই নয় ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ৬০০ আলেম নিয়ে সারা পাকিস্তান সুন্নি ও তাবলিগী সমাবেশ থেকে একটি রেজুলিউশান করে ঘোষনা দেয়া হয় যে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে একজন মহিলা নির্বাচন এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করা হারাম। (10)

আইয়ূব খান এই পরিস্থিতির সূবর্ণ সুযোগ নেন,তিনি ওয়াদা করেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে Family Ordinance কে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পরিবর্তন করবেন(11)!ফলে গনতন্ত্রের জন্য এত দিনের আন্দোলনের হাওয়া বিপরীত দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করল।জামায়াতের জন্য এই ঘটনা ছিল সবচেয়ে বেশি বিব্রতকর কারন ১৯৫০ সালে মিস ফাতেমা জিন্নাহ কোন এক কারনে পাব্লিক appearance এ আসলে জামায়াতই তখন একজন মহিলা হিসেবে ঐ ধরনের সমাবেশে আসার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে তীব্র সমালোচনা করে!!(12)

মাওলানা মওদুদী ও জামায়াতের ব্যাখ্যা

• মাওলানা মওদুদী এবং কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ ঘোষনা করে “Unusual Situation” এ দেশের প্রধান হিসেবে মহিলার প্রার্থীতা শরীয়ত বিরোধি নয়।(13)
• মাওলানা আরো বলেন স্বৈর শাসনের ফলে মানুষ যে অত্যাচার ও নিপীরণের স্বীকার তা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যেই মুলত জামায়াত মহিলার প্রার্থীতা মেনে নিয়েছে(14)
• গোলাম আযম সাহেব তার বইতে উল্লেখ করেন জামায়াতের একটি প্রতিনিধি দল পাকিস্তানের মুফতিয়ে আযম মাওলানা মুহাম্মদ শফীর রায়ও নিয়ে ছিলেন এটা উল্লেখ করে যে মিস ফাতেমা জিন্নাহ দেশকে স্বৈর শাসন থেকে গনতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে নির্বাচন করার জন্য রাজী হয়েছেন এবং নির্বাচিত হলে ১বছরের মধ্যে নতুন নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দিবেন।অন্তর্বর্তীকালীন এই ব্যাবস্থাকে নারী নেতৃত্ব কায়েম করা হচ্ছে বলা যায়না।(15)

যাই হউক, "পুরুষ হওয়া ছাড়া আইয়ূব খানের আর কোন গুণ নেই,মহিলা হওয়া ছাড়া ফাতেমা জিন্নাহর আর কোন দোষ নেই" মাওলানা মওদুদীর এই স্লোগান সবাইকে কনভিন্স করতে পারেনি।অন্যন্য আলেমগন বিভিন্ন ফতওয়াতো দিয়েছেনই সাথে সাথে এক পর্যায়ে আইয়ূব খানকে সাপোর্ট করে তার পক্ষে প্রচারণা শুরু করেন, ফলে গনতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলাফল উল্টো রাস্তায় রওয়ানা হতে থাকে।।জামায়াতের ভিতরেও এই বিষয় নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়।

তৎকালীন জামায়াতের এই যুক্তিগুলোকে সামনে নিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে দেখা যায়,প্রায় একই ধরনের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালের আগে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ২০০১ সালের পূর্বে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জোট গঠন করার ব্যাখ্যাও এমনই দেয়া হয়েছিল(16) যার জাস্টিফাই করতে গিয়ে আমাদের মত সাধারণ কর্মীরা কত যে হুদাইবিয়া তৈরি করে ফেলেছি.... এখনো করছি দৈনন্দিন!

আমার জিজ্ঞাসা, পলিটিক্স করতে গেলে কম্প্রোমাইজ করতে হবে এটাই স্বাভাবিক,এটাই যেহেতু বাস্তবতা সেখানে এজাতীয় বিষয়কে জাষ্টিফাই করতে কুরআন-হাদীসকে টানার দরকারটা কি?
Why not we stop justifying everything in the name of Hikma? rather thought & argument can be justify & defend in the name of Politics....... very simple!

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম