ওরা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে/আমার মাকে খুন করেছে/বোনকে ধর্ষণ করেছে/বাবাকে গুলী করেছে আর/আমার ভাই?/তাকে ওরা ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিয়ে/হত্যা করেছে/কারণ সে দেশকে ভালোবাসে/কোথায়?/হিরোশিমায়/জেরুসালেমে/আফ্রিকায়/বুয়েনওয়ার্ডে ..
‘‘উপরোক্ত অংশটি জহির রায়হানের পরিচালিত অসমাপ্ত শেষ ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট' এর নায়কের আর্তনাদ। কিংবা তাঁর (জহিরের) নিজেরই আর্তনাদ? এটা ছিল জহির রায়হানের নিজের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ছবি। ছবিটি শেষ করতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের পর রায়হান সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান। স্বাধীনতার পর দেশে ফেরেন। মুক্ত স্বদেশে তিনি নিখোঁজ হলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের উজ্জ্বল নক্ষত্র জহির রায়হানের খোঁজ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
‘স্পট জেনোসাইড', ‘জীবন থেকে নেয়া' চলচ্চিত্রের স্রষ্টা, ‘হাজার বছর ধরে', ‘বরফ গলা নদী' উপন্যাসের রচয়িতা ছিলেন প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান। জহির রায়হানের পরিচালিত ছবিগুলো ছিল (১) কখনও আসেনি, (২) সোনার কাজল, (৩) কাঁচের দেয়াল, (৪) বাহানা (উর্দু), (৫) সঙ্গম (উর্দু রঙ্গিন), (৬) বেহুলা, (৭) আনোয়ারা, (৮) জীবন থেকে নেয়া, (৯) লেট দেয়ার বি লাইট (অসমাপ্ত)।
জহির রায়হানের অন্তর্ধান নাকি হত্যাকান্ড? প্রসঙ্গে বেশ লেখালেখি হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় তার স্ত্রী সুমিতা ও শালিকা ববিতার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। জহির রায়হানের স্ত্রী ও প্রবীণ অভিনেত্রী সুমিতা মনে করেন জহিরকে পাকিস্তানীরা হত্যা করেছে বলে প্রচার চালিয়ে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপ দেয়ার চেষ্টা চলছে। আর শ্যালিকা ও চিত্র নায়িকা ববিতা জোর দিয়ে বলেছেন যুদ্ধের সময়ে কলকাতায় অনেকের কান্ডকীর্তি জহির জানতেন। এগুলো যাতে ফাঁস না হয়ে পড়ে, সে জন্যই তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। ঘনিষ্ঠজনদের আরো কেউ বক্তব্য দিয়েছেন তার হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। (সূত্র ঃ সাপ্তাহিক নতুনপত্র ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯)
ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। ১৯৩৪ সালের ১৯ আগস্ট নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমার মজপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। পিতা মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠা ‘মাদরাসা-ই-আলিয়া'র ফেকাহ ও আরবী দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। ঢাকার আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে অবসর নিয়েছেন। মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন প্রভাবশালী তালুকদার পরিবারের কন্যা। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে জহির রায়হান তৃতীয়। তিনি আলিয়া মাদরাসায় অধ্যয়ন করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ‘লেট দেয়ার বি লাইট' চলচ্চিত্রের কাজ অসমাপ্ত রেখে ২১ এপ্রিল কুমিল্লা হয়ে ভারতে চলে যান জহির রায়হান। সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ক্যামেরা হলো তাঁর অস্ত্র। চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির ও চিত্রনায়ক অরুণ রায়কে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ টিম গঠন করেন। পরিচালনা করেন দু'টি কালজয়ী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড' ও ‘এ স্টেজ ইন বর্ণ'। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই দুই চলচ্চিত্র বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সংগ্রামকে পরিচিত করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। এছাড়া এ সময় তিনি আরও দু'টি প্রামাণ্য চিত্র প্রযোজনা করেন। ‘লিবারেশন ফাইটারস' পরিচালনা করেন আলমগীর কবির এবং ‘ইননোসেন্ট মিলিয়ন' পরিচালনা করেন বাবুল চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের বহু দুর্লভ দৃশ্য তিনি ক্যামেরা বন্দী করেন। দুঃখের বিষয় মুজিবনগর সরকার তার প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করতো। ভারত সরকারও তার প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন ছিলেন। কারণ রাজনৈতিক মতাদর্শ। তিনি প্রথম জীবন থেকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।
আওয়ামী লীগ ও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অংশগ্রহণের উদ্যমকে উৎসাহ প্রদান দূরের কথা, রীতিমতো বাধা প্রদান করা হতো।
‘স্টপ জেনোসাইড' নির্মাণকালে অনেক সেক্টরে তাকে শুটিংয়ের জন্য প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি। নিজের ঐকান্তিক চেষ্টা, পরিশ্রম ও ইচ্ছায় প্রমাণ্য চিত্রটি সমাপ্ত হলেও ভারতীয় সেন্সর বোর্ডে তা আটকে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। বহু তদ্বিরের পর ছাড়পত্র পাওয়া যায়। ‘স্টপ জেনোসাইডে'র সেন্সর সনদপত্র যোগাড় করতে তাকে দিল্লী পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। ‘এ স্টেজ ইন বর্ণ' নির্মাণকালে ভারতে গৃহবন্দী মুজিবনগর সরকারের সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য প্রথমে অনুমতি দেয়া হয়নি। যা হোক শেষ পর্যন্ত সাক্ষাৎকার চিত্রায়িত হলেও ভারতীয় সেন্সরবোর্ড তা কেটে বাদ দেয়। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ এবং বিমান টিকিট হাতে পেলেও তাকে লন্ডন ও মস্কো যেতে দেয়া হয়নি। (সূত্র ঃ দৈনিক ইনকিলাব ২০ জানুয়ারি ২০০৩)
তখন ভারতীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য গঠিত মুজিব বাহিনীর চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন জহির রায়হান। মুজিব বাহিনী সরাসরি ভারত সরকারের অধীনে ছিল বাংলাদেশ সরকারের অধীনে নয়। যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ ও মুক্তিবাহিনীর সহায়তা দান সংক্রান্ত বিষয়ে ভারত সরকার তিনটি কমিটি গঠন করে। একটি রাজনৈতিক এবং অপর দু'টি সামরিক। ভারত সরকার এবং অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করে রাজনৈতিক কমিটি। এ কমিটির প্রধান করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান ডিপি ধরকে। অপরদিকে যুদ্ধ প্রস্তুতি সংক্রান্ত যুদ্ধ কাউন্সিলের প্রধান করা হয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ'কে। ডিপি ধরকে যুদ্ধ কাউন্সিলেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী তরুণদের নিয়ে একটি বিশেষ বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনাকে ফলপ্রসূ করে তোলার দায়িত্ব পড়ে ‘র'-এর ওপর। জেনারেল শ্যাম মানেকশ নিজেই থাকেন এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে। আর এই বাহিনী গঠনে ডেকে পাঠানো হয় বিশেষ বাহিনী তৈরীতে পারদর্শী জেনারেল উবানকে। তিনি অতি নিষ্ঠার সাথে কাজে লেগে যান।
মুজিব বাহিনীর প্রথম দলটির ট্রেনিং হয় ভারতীয় মিলিটারী একাডেমী দেরাদুন থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে পাহাড় শীর্ষের শহর তানদুয়ার ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণ শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৯ মে। আরেকটি ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয় মেঘালয়ের তুবার কাছাকাছি জাফলং-এ। প্রথম দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ২৫০ জন। ট্রেনিং শেষে এদের ভেতর থেকে ৮ জনকে করা হয় প্রশিক্ষক। পরে প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো হয়। এরাই বাকী দশ হাজার মুজিব বাহিনীর সদস্যকে প্রশিক্ষণ দান করেন। ট্রেনিং দান বন্ধ হয়ে যায় ১৯৭১ সালের ২০ নবেম্বর। মে মাসে মুজিব বাহিনীর জন্ম, কিন্তু অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ আগস্টের আগে এর অস্তিত্ব জানতে পারেননি। মুজিব বাহিনীর অস্তিত্বের কথা জানতে পেরে তাজউদ্দীন জেনারেল শ্যাম মানেশকে অনুরোধ জানান এই বাহিনীকে অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বাধীনে ছেড়ে দিতে। জেনারেল মানেকশ জানান যে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনে তৈরি করা হয়েছে এই বাহিনী। বাংলাদেশ সরকারের অধীনে দেয়া সম্ভব নয়। শেখ মুজিব বাহিনী নিয়ে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর জহির রায়হান ঢাকায় ফিরে আসেন। ফিরে এসেই শুনলেন তার অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সার ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। আদর্শস্থানীয় বড় ভাইকে হারিয়ে তিনি পাগলের মত তাকে খুঁজতে থাকেন। তাঁর উদ্যোগে বেসরকারি বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডসহ অন্যান্য ঘটনার প্রচুর প্রমাণাদি তিনি সংগ্রহ করেন এবং সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, তার সংগৃহীত প্রমাণাদি প্রকাশ করলেই অনেকের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মাটিতে আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকান্ড, বিভিন্ন হোটেলে বিলাসবহুল ও আমোদ-ফুর্তিময় জীবনযাপন, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ আওয়ামী আদর্শে বিশ্বাসহীন বাঙালিদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্র প্রভৃতির প্রামাণ্য দলিল জহির রায়হান কলকাতা থাকাকালে সংগ্রহ করেছিলেন। বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের নিখোঁজ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের ঘটনাবলী তাকে বিচলিত করে। এসব ঘটনা তাঁর পূর্বেকার রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়। তিনি নিয়মিত নামাজ-রোজা করতে শুরু করেন। পীর-আউলিয়ার মাজারকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে থাকেন। এমনকি আজমীর শরীফ পর্যন্ত গমন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ১৫ দিন পর ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কৃতী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ঘোষণা দেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পেছনে নীলনকশা উদ্ঘাটনসহ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক গোপন ঘটনার নথিপত্র, প্রামাণ্য দলিল তার কাছে আছে, যা প্রকাশ করলে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীসভায় ঠাঁই নেয়া অনেক নেতার কুকীর্তি ফাঁস হয়ে পড়বে। আগামী ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এই প্রেসক্লাবে ফিল্ম শো প্রমাণ করে দেবে কার কি চরিত্র ছিল।
জহির রায়হান আসলে কি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন তা অসম্পূর্ণ থাকলেও নেতৃস্থানীয় আওয়ামী লীগরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে আওয়ামী লীগের হাত ছিল। আর আওয়ামী লীগ সমর্থক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মরহুম অধ্যাপক ড. নীলিমা ইব্রাহিম লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউ মার্কেটে যেতে রাস্তা পার হতেই বাঁ হাতে একটা পেট্রোল পাম্প আছে। ওটার নাম আমরা দিয়েছিলাম জয় বাংলা পাম্প। স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এখানে আমাদের অনেক সংবাদ আদান-প্রদান হতো। নবেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একদিন খুব গম্ভীর মুখে ডাক্তার বললেন, চৌধুরী সাহেব আমাদের বিপদে ফেলবেন? বললাম-কেন চৌধুরী? বললেন-তোমার ভ্রাতা মুনীর চৌধুরী। আজ আমাদের চারটি ছেলে আমাকে পাম্পের পিছনে ডেকে বললো-এখনও সময় আছে, স্যারকে চলে যেতে বলেন, না হলে আমরা ওর মুখ বেঁধে নিয়ে যাবো। যথাস্থানে খবর পৌঁছানো হলো। মুনীর কিছুটা শংকিত হয়েছিলেন এবং সব সময়ে বিভাগীয় পিয়ন লুৎফরকে সঙ্গে নিয়ে চলতেন। (সূত্রঃ '৭১-এর ছাবিবশে মার্চের এ্যালবাম: স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা, নীলিমা ইব্রাহীম, দৈনিক আজকের কাগজ, ১২ চৈত্র ১৪০০)
মুক্তিযোদ্ধারা নবেম্বর মাসে মুনীর চৌধুরীকে মুখ বেঁধে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো, কারণ তিনি পাক বাহিনীর পক্ষে ছিলেন। পাক বাহিনীর রাজাকার আল-বদর আল-সামস কখনও তাদের পক্ষের লোককে হত্যা করতে পারে না। অথচ কয়েকদিন পরেই মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করা হলো। হত্যাকারী কারা? হত্যাকারী কারা এ সম্পর্কে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ পরিষ্কার বলে গেছেন।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ এমপি মরহুম এম এ মোহাইমেন লিখেছেন, ১৬ ডিসেম্বর ভোরবেলা শুনতে পেলাম ঐদিন দুপুরের পরে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজী তার সমস্ত সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। শুনে ছুটে গেলাম আট নং থিয়েটার রোডে তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য। ভাবলাম তিনি হয়তো এতক্ষণে ঢাকায় চলে গেছেন অথবা যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু গিয়ে দেখলাম তাজউদ্দীন সাহেব স্বাভাবিক পোশাকে বসে আছেন। তিনি কখন যাবেন জিজ্ঞাসা করায় বললেন তিনি যাবেন না। শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এতদিন পর দেশ স্বাধীন হচ্ছে, শত্রুবাহিনী আত্মসমর্পণ করছে, এ সময় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে থাকবেন না ব্যাপারটা আমার মোটেও বোধগম্য হলো না। কারণ জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন, শেখ মনি ও মুজিব বাহিনীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো আপনার জানা আছে। সৈন্যবাহিনী ও আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে আমি জানতে পেরেছি এই মুহূর্তে ঢাকায় অরাজক অবস্থা চলছে। ঠিক এ সময়ে ঢাকার কোন জনসমাবেশের মধ্যে আমার উপস্থিত থাকা মোটেই নিরাপদ নহে। জনতার ভিড়ের মধ্যে মুজিব বাহিনীর লোকেরা যে কোন মুহূর্তে আমাকে গুলী করে হত্যা করতে পারে, কিন্তু দোষ চাপিয়ে দেবে আল-বদর, আল-শামসের উপর এবং লোকেরাও সেটা বিশ্বাস করবে। তাই আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলছে ঢাকার অবস্থা মোটামুটি তাদের আয়ত্তে আসলে তারা আমাকে জানাবে এবং আমি আশা করি দু'একদিনের মধ্যেই আমি যেতে পারবো।' (সূত্র ঃ ঢাকা-আগরতলা-মুজিবনগর, এম এ মোহাইমেন, পাইওনীয়ার পাবলিকেশনস, ঢাকা, পৃ. ১৬০-১৬১)
নয় মাসের যুদ্ধ-মৃত্যু-নির্বাসনের বিভীষিকা পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা পায় বাংলাদেশ। যুদ্ধাক্রান্ত হলেও জাতি তখন স্বাভাবিক জীবনের জন্য উন্মুখ। চারদিকে বিজয়ের অফুরান উচ্ছবাস। তারপরও বিভীষিকা যেন কিছুটা বাকি ছিল। সেটুকুই তখন উন্মোচিত হচ্ছিল ঢাকার মিরপুরে, স্বাধীনতাযুদ্ধের শেষ ময়দানে। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি ভোর থেকেই সেখানে মৃত্যু ও জীবন, মানবিকতা ও নৃশংসতা এবং বিজয় ও পরাজয় মেশানো এক ট্র্যাজিক নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিল-আজ যেটি মিরপুর নূরী মসজিদ বধ্যভূমি। সেখানে নিখোঁজ হন জহির রায়হান। শহীদ হন প্রায় ৪০ জন সৈনিক ও ৮০ জন পুলিশসহ বেশ কিছু বিহারী।
১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি সাংবাদিক সম্মেলনের কয়েকদিন পর ৩০ জানুয়ারি রোববার সকালে এক অজ্ঞাত টেলিফোন আসে জহির রায়হানের কায়েতটুলির বাসায়। অজ্ঞাত টেলিফোনকারী জহির রায়হানকে খবর দেয় যে, মিরপুর ১২নং সেকশনে শহীদুল্লাহ কায়সার জীবিত অবস্থায় আটক আছেন। কে টেলিফোন করে তা যেমন রহস্যময় তেমনি কে টেলিফোনটি রিসিভ করেন তা নিয়েও তথ্যবিভ্রাট রয়েছে। টেলিফোন পেয়ে জহির রায়হান দুটো গাড়ী নিয়ে মিরপুরে রওনা দেন। তাঁর সাথে ছিলেন ছোট ভাই মরহুম জাকারিয়া হাবিব, চাচাত ভাই শাহরিয়ার কবির, বাবুল (সুচন্দার ভাই), আব্দুল হক (পান্না কায়সারের ভাই), নিজাম ও পারভেজ।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও দেশের নানা অঞ্চলে শত্রুর কিছু কিছু আস্তানা তখনো থেকে গিয়েছিল। এরই অন্যতম হলো মিরপুর বিহারী কলোনি। এখানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মজুদ নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কিছু সশস্ত্র সহযোগী একটি ঘাঁটি তৈরি করেছিল। আত্মসমর্পণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তারা সহাবস্থান করেছিল ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে। তৎকালীন নবীন বাংলাদেশ সরকারের তরফে সিদ্ধান্ত হয়, ৩০ জানুয়ারি এই এলাকার দায়িত্ব ভারতীয় বাহিনীর কাছ থেকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর হবে। একই দিন চলবে পুলিশের মাধ্যমে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান। সেনাবাহিনীর একটি ছোট বাহিনী সেখানে পুলিশকে সহায়তা দেবে।
এদিকে ৩০ জানুয়ারি মিরপুর ২নং সেকশনে মিরপুর থানায় পৌঁছলে সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে জহির রায়হানের টয়োটা গাড়ি (ঢাকা-ক-৯৭৭১)সহ থাকতে বলে অন্যদের ফেরত পাঠিয়ে দেন। এখানে তখন উপস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক অফিসার পান্না কায়সারের ভাই নিজামের সহপাঠী ছিলেন বলে জানা যায়। এছাড়া অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন মিরপুর থানার দারোগা আব্দুল আলীম, পুলিশ কর্মকর্তা জিয়াউল হক লোদী, করিম দারোগা, নবী চৌধুরী, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেঃ সেলিম, নায়েক সুবেদার আব্দুল মুমিন, ওয়াহেদসহ প্রায় ৪০ জন। এই দলটি মিরপুর থানা থেকে মিরপুর ১২নং সেকশনের দিকে যায় বলে জানা যায়।
তবে সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কিছু চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদ খান বীরবিক্রম। তিনি ছিলেন সেই সহযোগী বাহিনীর কমান্ডার। দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঢাকায় প্রবেশ করে ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। তখন থেকে প্রথম কয়েক দিন স্টেডিয়ামে থাকার পর তখনকার রেসকোর্স এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানই হয় তাদের অস্থায়ী ঘাঁটি। সেখানে থাকা অবস্থায়ই বিশেষ একটি দায়িত্ব পালনের নির্দেশ আসে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক জেনারেল শফিউল্লাহর কাছে।
জেনারেল শফিউল্লাহর অধীনস্থ একটি কোম্পানির কমান্ডার ২৪ বছর বয়সী তরুণ ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদের ভষায়, ‘জানুয়ারির ২৭ বা ২৮ তারিখের দিকে জেনারেল ওসমানীর তরফে নির্দেশ আসে যে, ভারতীয় বাহিনী চলে যাবে এবং তার জায়গায় অবস্থান নেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা।' তখন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল শফিউল্লাহ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ঢাকার মিরপুর এলাকার দায়িত্ব নেবে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকবে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
সেই অভিযানের অন্যতম সৈনিক আকরাম আলী। তার প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার মমিন ১২ নম্বর সেকশনের পানির ট্যাঙ্কের কাছে পজিশন নিতে বলেছিলেন। সুবেদার মমিন সৈনিকদের বলেছিলেন, তারা যেন ডিসিপ্লিন ভঙ্গ না করে। কারণ, তাদের সঙ্গে একজন সাংবাদিক আছেন। তার কথার পরই আকরাম বুঝতে পারেন তাদের সঙ্গে আসা সিভিল ড্রেসের মানুষটিই সেই সাংবাদিক-জহির রায়হান। ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদও নিশ্চিত করেন, সকালে একজন সাংবাদিক তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি জানান, ১৯৭২ সালের ২৯ অথবা ৩০ জানুয়ারির সকালে জেনারেল ইবরাহিম তাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে, জহির রায়হান মিরপুরে যাবেন। ‘সে অনুযায়ী একজন সাংবাদিক আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে আমি ধরে নেই তিনিই জহির রায়হান। অভিযান পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আর সরাসরি তার নাম জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তিনি আমাদের গাড়ি বহরের একটি জিপে করেই মিরপুরে আসেন।'
সৈনিক আকরম বলেন, ‘আমার মনে আছে ওই সাংবাদিকের পরনে কালো মতো একটা প্যান্ট ছিল। সাদা জামা এবং তার ওপর হলুদ রঙের সোয়েটার ছিল।' জহির রায়হানের মৃত্যুদৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত আকরাম বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টা কি ১১টা হবে। হঠাৎ একটা ঘণ্টার আওয়াজ শুনলাম। সঙ্গে সঙ্গেই চতুর্দিক থেকে গুলী শুরু হলো। এরপর দেখলাম পুলিশের কিছু লোক দৌড়াদৌড়ি করছে, কয়েকজন রাস্তার ওপর শুয়ে পড়েছে। তখন বুঝলাম গুলী চলছে। সিভিল পোশাকের যে লোকটা ছিলেন, উনিও দেখলাম বুকে হাত চেপে ধরে-ওখানে একটা দেয়াল ছিল, তার গায়ে পড়ে গেলেন। দেখলাম, ওনার কাপড় রক্তে ভেসে যাচ্ছে।' সেখানেই একটা দেয়াল ও খেজুর গাছের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে আকরাম দেখেন, ‘শতেক লোক' দা, ছুড়ি নিয়ে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে। তারা এসে মাটিতে পড়ে থাকা দেহগুলোকে কোপাতে কোপাতে টেনে পানির ট্যাঙ্কের পশ্চিম দিকে নিয়ে গেল। তারপর আর সেই লাশগুলো দেখেননি তিনি। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হেলাল মোর্শেদ সৈনিক আকরামকে সনাক্ত করেছেন তার সহযোগী সৈনিক হিসেবে।
একইভাবে জহির রায়হানকে ৩০ তারিখ সকালে রেসকোর্সে ও পরে মিরপুরে দেখেছিলেন সৈনিক হারুন মিয়া। ওইদিন সকালে তিনি জহির রায়হানকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিলেন। জহির রায়হানের আত্মীয় ওসমান হায়দার চৌধুরী বলেন, ২৯ জানুয়ারি আমার কায়েতটুলির বাসায় খবর পেলাম, মিরপুরে জহির রায়হানের ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের খবর পাওয়া যেতে পারে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেই এলাকার দায়িত্বে আছে।' তখনই তিনি তার বন্ধু তৎকালীন লেঃ ইব্রাহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি ছিলেন ওই রেজিমেন্টের এ্যাডজুট্যান্ট। তারা তখন অবস্থান করছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। জেনারেল ইবরাহিম জানান, তিনি যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করবেন। তিনি আমাদের পরদিন রেসকোর্সে যেতে বলেন।' সে অনুযায়ীই জনাব ওসমান শাহরিয়ার কবীর, জহির রায়হানসহ কায়েতটুলির বাসা থেকে রেসকোর্সে যান। সেখান থেকে জহির রায়হান একই সৈনিকদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন ভাইয়ের খোঁজে মিরপুরের রণাঙ্গনের দিকে। আর ফিরে আসেননি। (সূত্র: মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গনে জহির রায়হান ট্রাজেডি, ফারুক ওয়াসিফ, দৈনিক সমকাল ৩০ জানুয়ারি ২০০৭)
বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ঘটনার দিন জহির রায়হান থানায় তার যে গাড়িটা রেখে সেনাবাহিনীর লোকের সাথে ভাইয়ের খোঁজে গিয়েছিলেন সে গাড়িটি পরদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাছে পাওয়া যায়। এর তালা ছিল ভাঙা। অর্থাৎ স্বাধীনতার পর পরই বিরাজমান পরিস্থিতিতে রাজধানীর একটি থানার চত্বর থেকে পুলিশের নাকের ডগায় গাড়িটির তালা ভেঙে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখন কারা এমন দোর্দন্ড প্রতাপশালী হতে পারে, তা সহজেই বোধগম্য। এই গাড়িসমেত যে দু'যুবক ধরা পড়েছিল তাদের সূত্র ধরে এগুলো জহিরকে নিখোঁজ হবার ব্যাপারে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যেতো। কিন্তু তা করা হয়নি। যুবক দু'টি আটক থাকার কথাও জানা যায় না। ঘটনার বিবরণ একটু পূর্ব থেকেই দিতে হবে।
জহির রায়হানের রহস্যজনক নিখোঁজ হওয়ার সাথে সাথে তার ডায়েরী, নোটবুক, কাগজপত্রের ফাইল এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় চিত্রায়িত অব্যবহৃত মূল্যবান ফিল্ম ফুটেজসমূহ হারিয়ে যায়। সেই সাথে হারিয়ে যায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের তদন্ত কমিটির সমস্ত প্রামাণ্য তথ্য। বেসরকারী তদন্ত কমিটি পরবর্তীকালে কোন কাজ করেনি। আত্মীয়-স্বজন ও পত্র-পত্রিকার চাপে নিখোঁজ জহির রায়হান সম্পর্কে এটি নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত আর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। (সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম ২৮ ডিসেম্বর ২০০২)
‘জহির রায়হানের অন্তর্ধান যা ঘটেছিল সেদিন' শিরোনামে পান্না কায়সারের লেখা ছাপা হয়েছে দৈনিক ভোরের কাগজে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সংখ্যায়। তিনি লিখেছেন, ‘৩০ জানুয়ারি, ১৯৭২। সেদিন সকালে একটা ফোন এলো। ফোনটা আমিই ধরেছিলাম। ওপাশ থেকে বললো: জহির সাহেব আছেন? ধরুন বলে মেজদাকে ডেকে দিলাম। ফোনে কথা বলে মেজদা সবাইকে ডেকে বললেন, বড়দার খোঁজ পাওয়া গেছে... টেলিফোনে কি কথা হলো, কার সঙ্গে কথা হলো, মেজদা এসব কিছুই বললেন না। খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি... পর দিন হাইকোর্টের কাছে মেজদার গাড়িটা পাওয়া গেল। গাড়িটা এখানে কিভাবে এলো, কিছুই জানা গেল না... ছুটে গেলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। সত্যি কথা বলতে কি আমরা ভেবেছিলাম, বঙ্গবন্ধু নিজেই এ ব্যাপারে একটা উদ্যোগী ভূমিকা নেবেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তার সাক্ষাৎ যখন পেলাম-দেখলাম তিনি বেশ নির্লিপ্ত। তাজউদ্দীন আহমদকে ডেকে বললেন, দেখতো কি করা যায়। স্বাধীন দেশে এমন একটি লোক হারিয়ে যাবে, তা কি করে হয়। আমরা মন খারাপ করে ফিরে এলাম।'
সাংবাদিক হারুনুর রশীদ খান ৩০ জানুয়ারি ১৯৯৩ সালে দৈনিক লাল সবুজ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লিখেন জহির রায়হানের ওপর। এতে তিনি বলেছেন, ‘সেই যে নিখোঁজ হলেন, আজও আমাদের কাছে নিখোঁজ। রহস্যজনক ঘটনা আরো ঘটলো। জহির রায়হানের মরিস মাইনর গাড়িটি দরজা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গেল।' এর পরের প্যারার শুরু এভাবে-‘মজার ঘটনাটি হলো, বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে আজতক কোন সরকারই জহির রায়হানকে নিহত ঘোষণা করেনি।' তিনি লিখেছেন, ‘একটি অজ্ঞাত টেলিফোনে বলা হলো, আজমীর শরীফে যেতে এবং সেখান থেকে তিনি জানতে পারবেন শহীদুল্লাহ কায়সার কোথায় আছেন। জহির রায়হান দেরী না করে সপরিবারে চলে গেলেন আজমীর শরীফ। সেখান থেকে ফিরে এলেন খুবই খুশী মনে। কে একজন বলে দিয়েছেন, শহীদ ভাই বেঁচে আছেন, কোথায় আছেন তা তাকে ফোনে জানিয়ে দেয়া হবে। সেই কথামতো একদিন ফোনও এলো।'
জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে তার স্ত্রী সুমিতা দেবীর বক্তব্য ছিল এরূপ : ‘কলকাতায় সিনেমার টেকনিশিয়ান আর্টিস্টদের নিয়ে একটা সমিতি গঠন করেছিল জহির। জহির ছিল এই সমিতির চেয়ারম্যান, জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে ঢাকায় ফিরে প্রেসক্লাবে সে এই সমিতির পক্ষ থেকে একটা সাংবাদিক সম্মেলন করেছিল। সেখানে তার সাথে আমার দেখা হয়। নিখোঁজ হওয়ার আগে তার সাথে আরেকবার দেখা হয়েছিল। সেদিন জহির আমাকে বলেছিল ওর বাবার বাসায় যেতে। জহির তখন থাকতো ঊনত্রিশ নম্বর কায়েতটুলিতে ওর মায়ের বাসায়। আমাকে সেদিনও বাসায় যেতে বলে, কারণ বড়দাকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় তার মা অনবরত কান্নাকাটি করছিল। বাসার সবাই তখন অস্থির হয়ে আছে এই ঘটনায়। জানুয়ারির বিশ-একুশ তারিখে জহিরের সাথে আমার আবার দেখা হয়েছিল। সেটাই ছিল জহিরের সাথে আমার শেষ দেখা। আমি তখন রেডিওতে একটা অনুষ্ঠান করি। নাম ‘গ্রাম-বাংলা'। রেকর্ডিং-এর পর শাহবাগে রেডিও অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছ। জহির গাড়িতে করে কোথাও হয়তো যাচ্ছিল। আমাকে দেখে থামিয়ে দিল। আমার সাথে কথা হলো। তখন জহির আমাকে বলল, ত্রিশ তারিখের মিটিং-এ এসো, দেখা হবে। এটাই ওর মুখ থেকে শোনা শেষ কথা। আমি মিটিং-এ গিয়েছিলম ঠিকই কিন্তু জহির আসেনি। আমাদের আর দেখাও হয়নি। তখনও মনে হয় জহির আসবে না বলেই কি সেদিন সে আমাকে এভাবে আসতে বলেছিল। মিরপুর-মোহাম্মদপুরের ভেতরে শত্রুরা গোপনে অবস্থান করছিল। তাই আমি গাড়ি নিয়ে চলে যাই সোজা মিরপুর। শুধু সেদিনই নয়, আরো কয়েকবার গেছি সেখানে কখনো একা একা, আবার কখনো কাউকে নিয়েছি সাথে। পচা-গলা বীভৎস লাশ আমি ধরে ধরে দেখেছি। দু'হাতে উল্টেপাল্টে দেখেছি কোথাও জহিরের মুখ দেখা যায় কিনা। দুর্গন্ধে বমি চলে আসার মতো অবস্থা ছিল। কিন্তু আমি কি করবো। আমারতো জহিরের দরকার। আমার স্বামী জহির। আমার সন্তানের পিতা জহিরের চেহারা ঘাতকদের আঘাতে নষ্ট হয়ে যেতে আরে কিন্তু ওর হাত-পা দেখে, শরীরের সামনের অংশ দেখেও আমি বলে দিতে পারবো এটা জহির, জহির রায়হান। জহিরকে আমি অংশ অংশ করে চিনি। তন্ন তন্ন করে পাগলের মতো খুঁজেও পাইনি সেখানে। আমার বিশ্বাস জহির মিরপুরে মারা যায়নি। ঘাতকরা তাকে অন্য কোথাও হত্যা করেছে। এ বিশ্বাস এখনো আমার আছে। জহির সেদিন বাড়ি থেকে কিভাবে কেমন করে বেরিয়ে গিয়েছিল আমি দেখিনি। কারণ আমি তখন মোহাম্মদপুরে তিন ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে আলাদা থাকি। পরে আমার ননদ জহিরের ছোট বোন ডাক্তার সুরাইয়ার কাছে বিস্তারিত শুনেছি। সেদিন সকাল আটটার দিকে জহিরের কাছে একটা ফোন আসে। ফোনটা ধরেছিল সুরাইয়া নিজে। সেদিন রফিক নামে কেউ একজন ফোন করেছিল। আমরা যে রফিককে চিনতাম, তিনি ইউসিসে চাকরি করতেন। তার সাথে আমারই প্রথম পরিচয় ছিল। পরে আমিই তাকে জহিরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আজ মাঝে মাঝে মনে হয় তার সাথে জহিরের পরিচয়টা না করিয়ে দিলেও পারতাম। টেলিফোনে জহিরকে বলা হয়েছিল, আপনার বড়দা মিরপুর বারো নম্বরে বন্দী আছেন। যদি বড়দাকে বাঁচাতে চান তাহলে এক্ষুণি মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাঁচাতে পারবেন। অন্য কেউ যদি সেখানে যায় তাহলে আপনার বড়দার ডেডবডি আসবে বাড়িতে। জহির মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসতো তার ভাইকে। এ রকম ঘটনা আমার জীবনে আমি কোথাও দেখিনি। তার বড়দা হারিয়ে গেছে এই ছিল তার জন্য একটা বড় ঘটনা। টেলিফোন পেয়েই জহির রায়হান প্যান্ট পরে সাথে সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আর সেই বাড়িতে ফিরে আসেনি জহির। কোথাও ফিরে আসেনি। স্বাধীনতার পরে শত্রুমুক্ত দেশে এমনভাবে একজন মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাবে এটার অনুভূতি যে কি তা ঠিক বোঝানো যাবে না। এটা উপলব্ধির বিষয়। জহির রায়হান নিখোঁজ এই নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ লেখালেখিও হলো। একদিন বড়দি অর্থাৎ জহিরের বড় বোন নাসিমা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব বললেন, জহিরের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে। পরে নাসিমা আর কিছু বলেনি। টেলিফোন করেছিল যে রফিক, তাকে নিয়ে যখন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলো। তখন তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে পুরো পরিবারসহ আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। এই ঘটনা জহিরের নিখোঁজ হওয়ার সম্পর্কে রফিকের ভূমিকাকে আরো সন্দেহযুক্ত করে তোলে আমার কাছে। আমার একটা বিশ্বাস, জহির একদিন ফিরে আসবে আমাদের কাছে। এই বিশ্বাস আমার এখনো আছে কারণ আমিতো এমন কোনো অপরাধ করিনি যার শাস্তি আমি অথবা আমার সন্তানরা ভোগ করবে। কোনো অপরাধ করিনি বলেই তাকে তার সন্তানদের কাছে একদিন ফিরে আসতেই হবে এটা আমার বিশ্বাস। আমার ছেলেরা যখন তাদের বাবার অভাব বোধ করে তখন বেশি খারাপ লাগে। আসলে স্বাধীন দেশে তো এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। এমন হওয়া উচিতও ছিল না। শেখ সাহেবও রাজাকারদের ক্ষমা করেছেন। আজ একাত্তরের শত্রুরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তারা শাসন ক্ষমতায় বসে গেছে। আমি মনে করি পরবর্তী প্রজন্ম একাত্তরের ঘাতকদের বিচার করবেই। আমার ছেলে যদি কোনোদিন কোনো সত্যিকার রাজাকারকে হত্যা করে মরেও যায়, আমি একফোঁটা চোখের জলও ফেলবো না। কোনো মায়েরই ফেলা উচিত নয়। এই স্বাধীন দেশে অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে এখন আমরা আছি। যখন এই অবস্থা দেখি শহীদের রক্তেগড়া মাটিতে তখন অপ্রিয় হলেও মনে হয় স্বাধীনতার আগের অবস্থা কেন থাকলো না এখানে। কিংবা যুদ্ধের পরে যা হওয়ার কথা ছিল সেটা কেন হলো না। এসব দেখে-শুনে মনে হয়, কত সুন্দর দেশে, কত চমৎকার দেশে আমরা বাস করছি।' (সূত্র : দৈনিক আজকের কাগজ ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩)
দৈনিক আজকের কাগজ ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সংখ্যা ‘জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়' শীর্ষক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে ‘রাহুর কবলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি' গ্রন্থে সরকার সাহাবুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘আজকের কাগজের ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সংখ্যায় জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জহির রায়হান নিখোঁজ এই নিয়ে লেখালেখি হলে একদিন বড়দি অর্থাৎ জহির রায়হানের বড় বোন নাফিসা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব বললেন, জহিরের নিখোঁজ নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, জহির রায়হানের মতো একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা স্বাধীনতার পর নিখোঁজ হয়েছে এটা নিয়ে চিৎকার হওয়াটাই স্বাভাবিক। জহির রায়হান তার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে মিরপুরে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হন। সম্ভব তাকে হত্যা করা হয়েছিল। সুতরাং তার হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে তার আত্মীয়-স্বজন সোচ্চার হতেই পারেন। কিন্তু শেখ মুজিব কেন জহির রায়হানের বড় বোনকে ডেকে নিয়ে নিখোঁজ করে ফেলার হুমকি দিলেন। কি রহস্য ছিল এর পেছনে? তাহলে কি বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে শেখ মুজিব এমন কিছু জানতেন, যা প্রকাশ পেলে তার নিজের কিংবা আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতির কারণ হতো? আর কেনইবা তড়িঘড়ি করে জহির রায়হানের তথাকথিত হত্যাকারী রফিককে সপরিবারে আমেরিকা পাঠিয়ে দেয়া হলো? রফিক কে ছিলেন/ কি তার রাজনৈতিক পরিচয়? (সূত্র : সরকার সাহাবুদ্দিন আহমদ, রাহুর কবলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১০৮)
৯ আগস্ট ১৯৯৯ দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় জহির রায়হানের মেজো সন্তান অনল রায়হানের অভিযোগ। তিনি অভিযোগ করেন, ‘জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার এক ভুয়া তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। এই কমিটি কোনো কাজ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্যানপ্যানানি করে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এলো ...মুজিব হত্যার বিচার হচ্ছে। এই হত্যাকান্ড ঘটেছে ১৯৭৫ সালে। এর আগে জহির রায়হানসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। কই তাদের তো বিচার হলো না।'
৫ ফেব্রুয়ারি ২০০০ দৈনিক ইনকিলাবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুর যাওয়ার পর জহির রায়হান নিখোঁজ হন। জহির রায়হানের অন্তর্ধানকে হত্যাকান্ড হিসেবে বর্ণনা করে সেই হত্যাকান্ডের দায়দায়িত্ব (তাদের ভাষায়) রাজাকারদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রায় মাস দেড়েক আগে গত ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ, মেঃ জেঃ (অব.) মঈন, মেঃ জেঃ (অব.) ইব্রাহিম প্রমুখ অফিসার বলতে চেয়েছেন যে, মিরপুরে ৩০ জানুয়ারি বিহারীদের গুলীতে তিনি নিহত হয়েছেন। কিন্তু জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্য ঘাঁটতে গিয়ে এমন কিছু ব্যক্তির এমন কতগুলো চাঞ্চল্যকর তথ্যের সন্ধান পাওয়া গেল যেগুলো পড়ে শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। এসব তথ্য পাওয়া গেছে নিখোঁজ জহির রায়হানের প্রথম স্ত্রী সুমিতা দেবী, দ্বিতীয় স্ত্রী সুচন্দার ভগ্নী, চলচ্চিত্র নায়িকা ববিতা, জহির রায়হানের ভাবী আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পান্না কায়সার এবং এই সময়কার সবচেয়ে বড় ঘাদানিক নেতা শাহরিয়ার কবির প্রমুখের কাছ থেকে।
এ ছাড়াও এদের জবানীতে সত্যজিৎ রায় এবং শেখ মুজিবের যেসব উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে সেসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জহির রায়হান ৩০ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেননি। তারপরেও বেশ কয়েকদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। এদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তিনি বাংলাদেশ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেস্টনীর মধ্যেই ছিলেন। ঘটনা পরম্পরা পর্যালোচনা করলে তার মৃত্যুর দায়দায়িত্ব তৎকালীন প্রশাসনকেই গ্রহণ করতে হয় এবং (তাদের ভাষায়) রাজাকার বা দালালদের উপর কোনভাবেই চাপানো যায় না। এই সংবাদ ভাষ্যে ইনকিলাব-এর নিজস্ব মন্তব্যের পরিবর্তে উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের উদ্ধৃতি এবং মন্তব্য ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ যখন অপপ্রচার এবং উস্কানিমূলক প্রচারণার বিষবা আচ্ছন্ন তখন এসব ব্যক্তিবর্গের সেদিনের উক্তি এবং আজকের ভূমিকা মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত মানুষকে সত্যের আলোকবর্তিকা দেখাতে সাহায্য করবে।'
সেই সময়কার সরকার নিয়ন্ত্রিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সংখ্যাটি ছিল ১৯৯২ সালের ১ মে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন শাহরিয়ার কবির। তাদের সংলাপের অংশবিশেষ নিচে তুলে ধরা হলো : সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে সত্যজিত রায় শাহরিয়ার কবিরকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন,
-জহিরের ব্যাপারটা কিছু জেনেছো?
-তাকে সরিয়ে ফেলার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করে যা বুঝতে পেরেছি তাতে বলা যায়, ৩০ জানুয়ারি দুর্ঘটনায় তিনি হয়তো মারা যাননি। তারপরও দীর্ঘদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।
-স্ট্রেঞ্জ! জহিরকে বাঁচিয়ে রাখার পেছনে কারণ কি?
-সেটাই ষড়যন্ত্রের মূল সূত্র বলে ধরছি। মিরপুরে দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলে গভীর ষড়যন্ত্র মনে করার কোনো কারণ ছিল না। আমি যতদূর জানি, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা অনেক রথী-মহারথীদের জন্যই বিপজ্জনক ছিল, সে জন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন ছিল।
১৯৯২ সালেও শাহরিয়ার কবির মনে করতেন যে, জহির রায়হানকে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির পরেও দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। তাহলে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা বলুন যে, স্বাধীন বাংলাদেশে জহির রায়হানকে আটকে রাখার ক্ষমতা কাদের? বলা হচ্ছে যে, বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে জহির রায়হানের হাতে এমন কিছু তথ্য এসেছিল যেটা রথী-মহারথীদের জন্য ছিল বিপজ্জনক। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী সরকারের আমলে কারা ছিলেন রথী-মহারথী? যে বিপজ্জনক তথ্যের জন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল। সেসব তথ্য কাদের জন্য বিপজ্জনক ছিল? তাদের ভাষায় রাজাকার এবং পাকিস্তানী দালালদের রাজনীতি তো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কারা তাহলে জহির রায়হানকে সরিয়েছে?
পান্না কায়সার জহির রায়হানের বড় ভাই পরলোকগত শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী। বাংলা ১৩৯৯, ১০ জ্যৈষ্ঠ, ইং ১৯৯২ দৈনিক বাংলার বাণীতে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘কবিতা মিলনকে মিথ্যা সান্ত্বনা।' এই নিবন্ধে তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট সেলিম সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন। আলোচ্য নিবন্ধের এক স্থানে পান্না কায়সার বলেছেন, ‘৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান একটি ফোন পেয়ে মিরপুর ছুটে গিয়েছিলেন। একথা বহুবার লেখা হয়েছে, বলা হয়েছে। কিন্তু বলা হয়নি সেলিমের কথা। সেলিমও নাকি সে রকমই একটি ফোন পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদকে না বলেই জহির রায়হানের সঙ্গে মিরপুরে ছুটে গিয়েছিলেন। তারপর দু'জনের ভাগ্যে একই নিষ্ঠুর পরিণতি। দু'জনই নিখোঁজ। সেলিমের মা এ সংবাদ পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। সেলিম বঙ্গভবনের যে ঘরটিতে থাকতেন ইত্যবসরে সে ঘর থেকে সমস্ত কাগজপত্র, কাপড়-চোপড় উধাও। শহীদ সেলিমের মা অনেক কষ্ট করেও কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। রহস্য রহস্যই থেকে গেল। জহির রায়হান নিখোঁজ হবার পর বুদ্ধিজীবী হত্যার কোন রকম কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাগজগুলোর কোন হদিসই পাওয়া গেল না। পাওয়া গেলে হয়তো পরবর্তীতে তদন্ত কমিটির অন্য কেউ কাজে লাগাতে পারতেন। শহীদ সেলিমের মায়ের মতে, বঙ্গভবনের ওর ঘর থেকে যে প্রয়োজনীয় কাগজগুলো উধাও হয়েছিল সেগুলো সম্ভবত তদন্ত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রই হবে। খোদ বঙ্গভবন থেকে জিনিসপত্র উধাও হয়ে যাবে তা ভাবতেও বিশ্বাস হয় না। শহীদ সেলিম বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তের কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন একথা আমি আগ থেকে জানতাম না। আমি ছাড়া আর কেউ জানে কিনা তাও জানি না। জহির রায়হান ও সেলিমের নিখোঁজ রহস্য এখন আমার কাছে আরো রহস্যজনক মনে হচ্ছে। বুদ্ধিজীবী হত্যার যেমন ১৯৭২ সালের গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত হয়নি, তেমনি জহির রায়হান নিখোঁজ রহস্যও গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত করার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি। অথচ এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র। যে ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষের বীজ রোপণ হয়েছিল সেদিন।'
পান্না কায়সার নিজেই বলেছেন যে, খোদ বঙ্গভবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উধাও হয়ে যাবে সেটা ভাবনারও অতীত। জহির রায়হানের সাথে লেফটেন্যান্ট সেলিমও বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এ সম্পর্কিত কাগজপত্র জহির রায়হান ও সেলিম উভয়ের কাছ থেকেই উধাও হয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্টের ভবন থেকে কাগজপত্র উধাও করতে পারে কারা? রাজাকার বা পাকিস্তানপন্থীরা অবশ্যই নয়। এটা করা সম্ভব একমাত্র তাদের পক্ষে, যারা ক্ষমতার আশেপাশে ছিলেন।
‘জহির রায়হানের মৃত্যু-বানোয়াট গল্প' শীর্ষক লেখায় (দৈনিক দিনকাল ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০০) চক্ষুমান এক স্থানে লিখেছেন, ‘শাহরিয়ার কবির আর পান্না কায়সারের বক্তব্য থেকে যে বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে উঠছে, তা হচ্ছে (১) মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্বে অর্থাৎ ১৯৭১-এর ১ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর যেসব বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন তাদের হত্যা রহস্য তদন্তের কাজে ব্যস্ত ছিলেন জহির রায়হান ও লেফটেন্যান্ট সেলিম, (২) তদন্তের কাজ বহুদূর অগ্রসর হয়েছিল এবং তারা এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, যা প্রকাশ পেলে অনেক রথী-মহারথীর মুখোশ উন্মোচিত হতো, (৩) দু'জনই অজ্ঞাত ব্যক্তির টেলিফোন পেয়ে একত্রে মিরপুর গিয়েছিলেন, সম্ভবত তদন্ত কাজে সহায়ক হবে এমন তথ্যপ্রাপ্তির প্রলোভন দেখানো হয়েছিল, (৪) দু'জনের কেউই আর ফিরে আসেননি; এদিকে বঙ্গভবন থেকেই তদন্তের কাগজপত্র উধাও হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন জাগছে, ১৯৭২ সালে লীগ সরকারের শাসনামলে বঙ্গভবন থেকে জরুরি কাগজপত্র সরিয়ে ফেলার ক্ষমতা কার ছিল? যাদের সম্পর্কে বিপজ্জনক তথ্য উদঘাটিত হয়েছিল, লীগ শাসনামলের সেই রথী-মহারথী কারা হতে পারে? নিশ্চয়ই জ্বিন-ভূতেরা নয়? এখানে একটি বিষয় স্মর্তব্য যে, ১৯৭২-৭৫ এর সরকার ও প্রচার মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়, রাজাকার-আল বদরদের ওপর চাপিয়ে দেয়া ছাড়া এ ব্যাপারে তেমন কোনো অনুসন্ধানই চালায়নি; জহির রায়হান নিখোঁজ রহস্যও গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটনের তাগিদ কেউ অনুভব করেনি। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে? এ প্রসঙ্গে আরেকটু ইতিহাস টানা প্রয়োজন। শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, আনম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবেরসহ অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করলেও আওয়ামী লীগের অনুসারী ছিলেন না। এরা কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। এদের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উঠতি পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রতিভূ, চূড়ান্ত বিচারে শ্রম শোষক বা শ্রেণীশত্রু। ইসলামীপন্থী দলগুলোর দৃষ্টিতে, আওয়ামী লীগ যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী, সুতরাং বর্জনীয়। কমিউনিস্ট সংগঠন এবং বাম বুদ্ধিজীবীরা মনে করতেন, ১৯৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এটি হচ্ছে, হোক, দেশটাতো স্বাধীন হোক, অতঃপর দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হবে; আওয়ামী লীগের মতো পেটিবুর্জোয়া সংগঠন দিয়ে সমাজতন্ত্র হবে না। এখানেই ছিল আওয়ামী লীগারদের ভীতি। ষাটের দশকে আ'লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ মাঝে মাঝেই লাঠি, ছুরি নিয়ে চড়াও হতো সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ধারক ছাত্র ইউনিয়নের ওপর। মুক্তিযুদ্ধকালেও আওয়ামী লীগের এই ট্রেন্ড প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। নড়াইল-ডুমুরিয়া, বরিশালের পেয়ারা বাগান, নরসিংদী বিস্তীর্ণ অঞ্চলসহ যেখানেই বামপন্থীরা নিজস্ব সংগঠন শক্তি বিস্তৃত করে বীর বিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, সেখানেই আ'লীগের রিক্রুট করা মুক্তিযোদ্ধারা বাধা দিয়েছে, বাম মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। একই কারণে সাম্যবাদের প্রবক্তা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। এখন সবাই উপলব্ধি করছেন, আমাদের স্বাধীনতার জন্য নয় বরং শক্তিমান প্রতিবেশী পাকিস্তানকে ভাঙবার প্রয়োজনেই ভারত মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সহায়তা করেছিল। সে হিসেবে মুক্তিবাহিনী আর মুজিববাহিনী দুইয়ের পেছনেই ছিল ‘র'-এর পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মদদ। অর্থাৎ এক বৃন্তে দুই ফল। মুক্তিবাহিনী সরাসরি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতো। আর মুজিববাহিনী যুদ্ধের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের কথাও বলতো। আর এতেই লীগ নেতাদের রিক্রুট করা মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মাঝেই মুজিব বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। সমাজতন্ত্রে যাদের এতো ভীতি, বামচিন্তাকে যারা দেখতেন বিভীষিকার মতো, তারা শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরীদের মতো বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের প্রীতির চোখে দেখবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।
তারপরও ১৯৭২ সালের সদ্য স্বাধীনতার প্রবল আবেগ-উচ্ছবাসের পটভূমিতে রাজাকার আলবদর কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রচারণাটি বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিল। এখন যে সবাই অবিশ্বাস করছেন, তাও নয়। কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস করার ভিত্তিটা আওয়ামী লীগই নষ্ট করেছে। এর একটি প্রধান কারণ, নিখোঁজ জহির রায়হান সম্পর্কে তৎকালীন লীগ সরকারের আশ্চর্যজনক নির্লিপ্ততা। চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান সাধারণ মানুষ ছিলেন না। কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে পরিপুষ্ট এই মানুষটি ছিলেন যেমন প্রতিভাধর, তেমনি একরোখা, সংগ্রামী, ঋজু চরিত্রের। সুতরাং অন্যান্য বামপন্থী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মতো তিনিও যে লীগ সরকারের পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন না, তা বলাই বাহুল্য। তদুপরি এই মানুষটি ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ দুটি কাজ করেছিলেন বলে জানা যায়।
প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ভারত-প্রবাসী লীগ নেতাদের অনেকেরই কু-কীর্তি নাকি সেলুলয়েডে এবং ডায়রীতে বন্দি করে রেখেছিলেন। এ কারণে যেসব লীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধের নামে ভারতে গিয়ে পাটের ব্যবসা বা চোরাচালানে ব্যস্ত ছিলেন, যারা মদ আর মেয়ে মানুষ নিয়ে দামী হোটেলে গিয়ে ফূর্তি করেছেন, যারা বেহেড মাতাল হয়ে নর্দমার পাশে পড়ে থেকেছেন বা ভারতীয় পুলিশ কর্তৃক ধৃত হয়েছেন, তারা সবাই জহির রায়হানকে জ্যান্ত-বিভীষিকা জ্ঞান করতেন। কি জানি ওসব কু-কীর্তি যদি তিনি গ্রন্থাগারে লিপিবদ্ধ করেন, কিংবা সেলুলয়েডে বন্দি ছবিগুলো দিয়ে যদি ডকুমেন্টারি কিছু বানিয়ে ফেলেন, কি উপায় হবে? জহির রায়হানের দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্তে নিয়োজিত হওয়া। এক্ষেত্রেও যে তিনি তৎকালীন রথী-মহারথীদের মুখোশ উন্মোচনের পর্যায়ে গিয়েছিলেন, শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য থেকে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। উল্লেখিত বক্তব্য, মন্তব্য ও প্রাপ্ত তথ্যের সমীকরণ টানলে, এই সত্যই কি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে না যে, জহির রায়হান নিখোঁজ ও হত্যার পশ্চাতে তৎকালীন লীগ সরকারের একটি প্রভাবশালী অংশের কালো হাত সক্রিয় ছিল? আরো কি স্পষ্ট হয়ে ওঠে না যে, বাম বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পশ্চাতেও ওই মহলটির নেপথ্য ভূমিকা ছিল?'
0 comments: