জহির রায়হান অন্তর্ধান নাকি হত্যাকান্ড? -২



‘জহির রায়হানের অন্তর্ধান যা ঘটেছিল সেদিন' শিরোনামে পান্না কায়সারের লেখা ছাপা হয়েছে দৈনিক ভোরের কাগজে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সংখ্যায়। তিনি লিখেছেন, ‘৩০ জানুয়ারি, ১৯৭২। সেদিন সকালে একটা ফোন এলো। ফোনটা আমিই ধরেছিলাম। ওপাশ থেকে বললো: জহির সাহেব আছেন? ধরুন বলে মেজদাকে ডেকে দিলাম। ফোনে কথা বলে মেজদা সবাইকে ডেকে বললেন, বড়দার খোঁজ পাওয়া গেছে... টেলিফোনে কি কথা হলো, কার সঙ্গে কথা হলো, মেজদা এসব কিছুই বললেন না। খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি... পর দিন হাইকোর্টের কাছে মেজদার গাড়িটা পাওয়া গেল। গাড়িটা এখানে কিভাবে এলো, কিছুই জানা গেল না... ছুটে গেলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। সত্যি কথা বলতে কি আমরা ভেবেছিলাম, বঙ্গবন্ধু নিজেই এ ব্যাপারে একটা উদ্যোগী ভূমিকা নেবেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তার সাক্ষাৎ যখন পেলাম-দেখলাম তিনি বেশ নির্লিপ্ত। তাজউদ্দীন আহমদকে ডেকে বললেন, দেখতো কি করা যায়। স্বাধীন দেশে এমন একটি লোক হারিয়ে যাবে, তা কি করে হয়। আমরা মন খারাপ করে ফিরে এলাম।'

সাংবাদিক হারুনুর রশীদ খান ৩০ জানুয়ারি ১৯৯৩ সালে দৈনিক লাল সবুজ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লিখেন জহির রায়হানের ওপর। এতে তিনি বলেছেন, ‘সেই যে নিখোঁজ হলেন, আজও আমাদের কাছে নিখোঁজ। রহস্যজনক ঘটনা আরো ঘটলো। জহির রায়হানের মরিস মাইনর গাড়িটি দরজা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গেল।' এর পরের প্যারার শুরু এভাবে-‘মজার ঘটনাটি হলো, বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে আজতক কোন সরকারই জহির রায়হানকে নিহত ঘোষণা করেনি।' তিনি লিখেছেন, ‘একটি অজ্ঞাত টেলিফোনে বলা হলো, আজমীর শরীফে যেতে এবং সেখান থেকে তিনি জানতে পারবেন শহীদুল্লাহ কায়সার কোথায় আছেন। জহির রায়হান দেরী না করে সপরিবারে চলে গেলেন আজমীর শরীফ। সেখান থেকে ফিরে এলেন খুবই খুশী মনে। কে একজন বলে দিয়েছেন, শহীদ ভাই বেঁচে আছেন, কোথায় আছেন তা তাকে ফোনে জানিয়ে দেয়া হবে। সেই কথামতো একদিন ফোনও এলো।'

জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে তার স্ত্রী সুমিতা দেবীর বক্তব্য ছিল এরূপ : ‘কলকাতায় সিনেমার টেকনিশিয়ান আর্টিস্টদের নিয়ে একটা সমিতি গঠন করেছিল জহির। জহির ছিল এই সমিতির চেয়ারম্যান, জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে ঢাকায় ফিরে প্রেসক্লাবে সে এই সমিতির পক্ষ থেকে একটা সাংবাদিক সম্মেলন করেছিল। সেখানে তার সাথে আমার দেখা হয়। নিখোঁজ হওয়ার আগে তার সাথে আরেকবার দেখা হয়েছিল। সেদিন জহির আমাকে বলেছিল ওর বাবার বাসায় যেতে। জহির তখন থাকতো ঊনত্রিশ নম্বর কায়েতটুলিতে ওর মায়ের বাসায়। আমাকে সেদিনও বাসায় যেতে বলে, কারণ বড়দাকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় তার মা অনবরত কান্নাকাটি করছিল। বাসার সবাই তখন অস্থির হয়ে আছে এই ঘটনায়। জানুয়ারির বিশ-একুশ তারিখে জহিরের সাথে আমার আবার দেখা হয়েছিল। সেটাই ছিল জহিরের সাথে আমার শেষ দেখা। আমি তখন রেডিওতে একটা অনুষ্ঠান করি। নাম ‘গ্রাম-বাংলা'। রেকর্ডিং-এর পর শাহবাগে রেডিও অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছ। জহির গাড়িতে করে কোথাও হয়তো যাচ্ছিল। আমাকে দেখে থামিয়ে দিল। আমার সাথে কথা হলো। তখন জহির আমাকে বলল, ত্রিশ তারিখের মিটিং-এ এসো, দেখা হবে। এটাই ওর মুখ থেকে শোনা শেষ কথা। আমি মিটিং-এ গিয়েছিলম ঠিকই কিন্তু জহির আসেনি। আমাদের আর দেখাও হয়নি। তখনও মনে হয় জহির আসবে না বলেই কি সেদিন সে আমাকে এভাবে আসতে বলেছিল। মিরপুর-মোহাম্মদপুরের ভেতরে শত্রুরা গোপনে অবস্থান করছিল। তাই আমি গাড়ি নিয়ে চলে যাই সোজা মিরপুর। শুধু সেদিনই নয়, আরো কয়েকবার গেছি সেখানে কখনো একা একা, আবার কখনো কাউকে নিয়েছি সাথে। পচা-গলা বীভৎস লাশ আমি ধরে ধরে দেখেছি। দু'হাতে উল্টেপাল্টে দেখেছি কোথাও জহিরের মুখ দেখা যায় কিনা। দুর্গন্ধে বমি চলে আসার মতো অবস্থা ছিল। কিন্তু আমি কি করবো। আমারতো জহিরের দরকার। আমার স্বামী জহির। আমার সন্তানের পিতা জহিরের চেহারা ঘাতকদের আঘাতে নষ্ট হয়ে যেতে আরে কিন্তু ওর হাত-পা দেখে, শরীরের সামনের অংশ দেখেও আমি বলে দিতে পারবো এটা জহির, জহির রায়হান। জহিরকে আমি অংশ অংশ করে চিনি। তন্ন তন্ন করে পাগলের মতো খুঁজেও পাইনি সেখানে। আমার বিশ্বাস জহির মিরপুরে মারা যায়নি। ঘাতকরা তাকে অন্য কোথাও হত্যা করেছে। এ বিশ্বাস এখনো আমার আছে। জহির সেদিন বাড়ি থেকে কিভাবে কেমন করে বেরিয়ে গিয়েছিল আমি দেখিনি। কারণ আমি তখন মোহাম্মদপুরে তিন ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে আলাদা থাকি। পরে আমার ননদ জহিরের ছোট বোন ডাক্তার সুরাইয়ার কাছে বিস্তারিত শুনেছি। সেদিন সকাল আটটার দিকে জহিরের কাছে একটা ফোন আসে। ফোনটা ধরেছিল সুরাইয়া নিজে। সেদিন রফিক নামে কেউ একজন ফোন করেছিল। আমরা যে রফিককে চিনতাম, তিনি ইউসিসে চাকরি করতেন। তার সাথে আমারই প্রথম পরিচয় ছিল। পরে আমিই তাকে জহিরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আজ মাঝে মাঝে মনে হয় তার সাথে জহিরের পরিচয়টা না করিয়ে দিলেও পারতাম। টেলিফোনে জহিরকে বলা হয়েছিল, আপনার বড়দা মিরপুর বারো নম্বরে বন্দী আছেন। যদি বড়দাকে বাঁচাতে চান তাহলে এক্ষুণি মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাঁচাতে পারবেন। অন্য কেউ যদি সেখানে যায় তাহলে আপনার বড়দার ডেডবডি আসবে বাড়িতে। জহির মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসতো তার ভাইকে। এ রকম ঘটনা আমার জীবনে আমি কোথাও দেখিনি। তার বড়দা হারিয়ে গেছে এই ছিল তার জন্য একটা বড় ঘটনা। টেলিফোন পেয়েই জহির রায়হান প্যান্ট পরে সাথে সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আর সেই বাড়িতে ফিরে আসেনি জহির। কোথাও ফিরে আসেনি। স্বাধীনতার পরে শত্রুমুক্ত দেশে এমনভাবে একজন মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাবে এটার অনুভূতি যে কি তা ঠিক বোঝানো যাবে না। এটা উপলব্ধির বিষয়। জহির রায়হান নিখোঁজ এই নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ লেখালেখিও হলো। একদিন বড়দি অর্থাৎ জহিরের বড় বোন নাসিমা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব বললেন, জহিরের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে। পরে নাসিমা আর কিছু বলেনি। টেলিফোন করেছিল যে রফিক, তাকে নিয়ে যখন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলো। তখন তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে পুরো পরিবারসহ আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। এই ঘটনা জহিরের নিখোঁজ হওয়ার সম্পর্কে রফিকের ভূমিকাকে আরো সন্দেহযুক্ত করে তোলে আমার কাছে। আমার একটা বিশ্বাস, জহির একদিন ফিরে আসবে আমাদের কাছে। এই বিশ্বাস আমার এখনো আছে কারণ আমিতো এমন কোনো অপরাধ করিনি যার শাস্তি আমি অথবা আমার সন্তানরা ভোগ করবে। কোনো অপরাধ করিনি বলেই তাকে তার সন্তানদের কাছে একদিন ফিরে আসতেই হবে এটা আমার বিশ্বাস। আমার ছেলেরা যখন তাদের বাবার অভাব বোধ করে তখন বেশি খারাপ লাগে। আসলে স্বাধীন দেশে তো এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। এমন হওয়া উচিতও ছিল না। শেখ সাহেবও রাজাকারদের ক্ষমা করেছেন। আজ একাত্তরের শত্রুরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তারা শাসন ক্ষমতায় বসে গেছে। আমি মনে করি পরবর্তী প্রজন্ম একাত্তরের ঘাতকদের বিচার করবেই। আমার ছেলে যদি কোনোদিন কোনো সত্যিকার রাজাকারকে হত্যা করে মরেও যায়, আমি একফোঁটা চোখের জলও ফেলবো না। কোনো মায়েরই ফেলা উচিত নয়। এই স্বাধীন দেশে অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে এখন আমরা আছি। যখন এই অবস্থা দেখি শহীদের রক্তেগড়া মাটিতে তখন অপ্রিয় হলেও মনে হয় স্বাধীনতার আগের অবস্থা কেন থাকলো না এখানে। কিংবা যুদ্ধের পরে যা হওয়ার কথা ছিল সেটা কেন হলো না। এসব দেখে-শুনে মনে হয়, কত সুন্দর দেশে, কত চমৎকার দেশে আমরা বাস করছি।' (সূত্র : দৈনিক আজকের কাগজ ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩)

দৈনিক আজকের কাগজ ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সংখ্যা ‘জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়' শীর্ষক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে ‘রাহুর কবলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি' গ্রন্থে সরকার সাহাবুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘আজকের কাগজের ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সংখ্যায় জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জহির রায়হান নিখোঁজ এই নিয়ে লেখালেখি হলে একদিন বড়দি অর্থাৎ জহির রায়হানের বড় বোন নাফিসা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব বললেন, জহিরের নিখোঁজ নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, জহির রায়হানের মতো একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা স্বাধীনতার পর নিখোঁজ হয়েছে এটা নিয়ে চিৎকার হওয়াটাই স্বাভাবিক। জহির রায়হান তার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে মিরপুরে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হন। সম্ভব তাকে হত্যা করা হয়েছিল। সুতরাং তার হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে তার আত্মীয়-স্বজন সোচ্চার হতেই পারেন। কিন্তু শেখ মুজিব কেন জহির রায়হানের বড় বোনকে ডেকে নিয়ে নিখোঁজ করে ফেলার হুমকি দিলেন। কি রহস্য ছিল এর পেছনে? তাহলে কি বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে শেখ মুজিব এমন কিছু জানতেন, যা প্রকাশ পেলে তার নিজের কিংবা আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতির কারণ হতো? আর কেনইবা তড়িঘড়ি করে জহির রায়হানের তথাকথিত হত্যাকারী রফিককে সপরিবারে আমেরিকা পাঠিয়ে দেয়া হলো? রফিক কে ছিলেন/ কি তার রাজনৈতিক পরিচয়? (সূত্র : সরকার সাহাবুদ্দিন আহমদ, রাহুর কবলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১০৮)

৯ আগস্ট ১৯৯৯ দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় জহির রায়হানের মেজো সন্তান অনল রায়হানের অভিযোগ। তিনি অভিযোগ করেন, ‘জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার এক ভুয়া তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। এই কমিটি কোনো কাজ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্যানপ্যানানি করে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এলো ...মুজিব হত্যার বিচার হচ্ছে। এই হত্যাকান্ড ঘটেছে ১৯৭৫ সালে। এর আগে জহির রায়হানসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। কই তাদের তো বিচার হলো না।'

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম