৭. রাসূল (সাঃ)-এর আন্দোলনের বিভিন্ন যুগ ও স্তর
ক) রাসূল (সাঃ)-এর আন্দোলনের দুটো যুগঃ১. মাক্কী যুগ- প্রথম ১৩ বছর । এটা সংগ্রাম যুগ ,লোক তৈরীর যুগ বা ব্যক্তি গঠনের যুগ ও নির্যাতনের যুগ ।
২. মাদানী যুগ- হিজরাতের পর ১০বছর। এটা বিজয় যুগ ,সমাজ গঠনের যুগ ,রাষ্ট্র পরিচারনার যুগ ও সশস্ত্র মোকাবেলার যুগ ।
খ) মাক্কী যুগের বিভিন্ন স্তরঃ
তাফহীমুল কুরআনে সূরা আল আনয়ামের ভূমিকায় এর বিস্তারিত আলোচনা আছে।
১. ব্যক্তিগতভাবে বা গোপনে (আন্ডার গ্রাউন্ড ) দাওয়াত ও সংগঠনের সময়কাল ৩ বছর ।
২. প্রকাশ্যে দাওয়াত--বিরোধীদের বিদ্রুপ ও অপপ্রচার এবং নির্যাতনের প্রাথমিক অবস্থার সময়কাল-২ বছর ।
নবুওয়াতের ৫ম বছর রজব মাসে পয়লা কিস্তিতে ১৬ জন (৪ জন মহিলাসহ ) হাবসায় হিজরাত করেন । ২য় কিস্তিতে ১৫ জন মহিলা ও ৮৮ জন পুরুষ হিজরাত করেন।
৩. বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার ও নির্যাতন কাল ৫ বছর । নবুওয়াতের ৭ম থেকে ৯ম বছর পূর্ণ ৩ বছর রাসূল (সাঃ) এর নিজ বংশ ‘বনী হাশিম ’ সহ ‘শে’বে আবু তালিব ’ নামক উপত্যকায় কঠোর বন্দী দশা । ১০ম বছরে রাসূল (সাঃ) -এর চাচা আবু তালিব ও বিবি খাদিজা (রাঃ) ইন্তেকাল করেন ।
৩. মাক্কী যুগের শেষ ৩ বছর চরম বিরোধিতা , নিষ্ঠুর নির্যাতন ,এমনকি রাসূল(সাঃ) - কে হত্যার চেষ্টা চলে। এ ৩ বছরে প্রত্যেক হজ্জের সময় মদীনা থেকে আগত লোকেরা ইসলাম কবুল করতে থাকেন। পয়লা বছর ৬জন , ২য় বছর ১২জন বাইয়াত হন (১ম বাইয়াতে আকাবা ) এবং শেষ বছর ৭৫ জন বাইয়াত হন (২য় বাইয়াতে আকাবা )।
গ) মাদানী যুগের বিভিন্ন স্তর -মোট ১০ বছর ।
১. বদর যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত- ১ বছর ৬ মাস ।
২. বদর থেকে হোদায়বিয়ার সন্ধি পর্যন্ত -৪ বছর ২মাস ।
৩. মক্কা বিজয় পর্যন্ত -১ বছর ১০ মাস ।
৪. মক্কা বিজয়ের পর ২ বছর ৬ মাস।
৮. মাদানী যুগের বড় বড় ঘটনার সময়কাল
১. হিজরাত-১২ রবিউল আউয়াল ১ হিজরী জুময়ার দিন মদীনায় পৌঁছেন।
২. বদর যুদ্ধ - রমযান ২য় হিজরী
৩. ওহুদ যুদ্ধ -শাওয়াল ৩য় হিজরী
৪. বানূ নাযীরের বিরুদ্ধে অভিযান রবিউল আউয়াল ৪র্থ হিজরী।
৫. খন্দকের যুদ্ধ (আহযাব )- শাওয়াল ৬ষ্ঠ হিজরী
৬. হোদায়বিয়ার সন্ধি ও বাইযাতে রিদওয়আন- যিলকাদ ৬ষ্ঠ হিজরী।
৭. খায়বার যুদ্ধ - মুহাররাম ৭ম হিজরী ।
৮. মক্কা বিজয় -রমযান ৮ম হিজরী ।
৯. হুনাইনের যুদ্ধ- শাওয়াল ৯ম হিজরী।
১০. তাবুকের যুদ্ধ- রজব ৯ম হিজরী ।
১১. বিদায় হজ্জ - যিলহজ্জ ১০ম হিজরী।
৯.মাক্কী সূরার বৈশিষ্ট্য (হিজরাতের পূর্বে অবতীর্ণ)
ক) প্রথম দিকের সূরার বৈশিষ্ট্যঃ
১. রাসূলকে দেয়া বিরাট দায়িত্ব পালনের উপযোগী উপদেশ।
২. জীবন ও জগত সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন ও সঠিক বিশ্বাস সৃষ্টির চেষ্টা , ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষাকে বিভিন্ন ভাবে পেশ করা ---তাওহীদ ,রিসালাত ও আখিরাতের বেশি চর্চা।
৩. মানুষের ঘুমন্ত বিবেক ও নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করে চিন্তাশক্তিকে সত্য গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা ।
৪. প্রাথমিক সূরাগুলোর ভাষা স্বচ্ছ, ঝর্ণাধারার মত ঝরঝরে , ছোট ছোট ছন্দময় আয়াত ; অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী , সহজে মুখস্ত হবার যোগ্য ,অতি উন্নত সাহিত্য ।
খ) মাক্কী সূরা ব্যক্তি গঠনের হেদায়াতপূর্ণ ---তাতে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের আইন বিধান নেই । শুধু শেষ দিকে সমাজ গঠনের ইংগিতমূলক কথা ‘ম্যানিফেস্টো ’ আকারে আছে । অতীতে বিভিন্ন জাতির নিকট নবীর আগমন ---নবীর প্রতি জনগণের আচরণের ভিত্তিতে তাদের উথান পতনের বর্ণনা (ইতিহাস জানার জন্য নয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য)।
গ) কাফির ও মুশরিকদের বিরোধিতার বিভিন্ন অবস্থায় ধৈর্যের উপদেশ বিরোধিতার জবাব ও মোকাবেলা করার পন্থা।
১০.মাদানী সূরার বৈশিষ্ট্যঃ হিজরাতের পর অবতীর্ণ সূরা --- মক্কায় নাযিল হলেও মাদানী হিসাবে গণ্য
১. দীর্ঘ সূরা (অধিকাংশ),২. সমাজ গঠনের বিধান,
ক) ফৌজদারী আইন ,উত্তরাধিকার বিধান , বিয়ে -তালাক , যাকাত ও ওশর ইত্যাদির নিয়ম কানুন ।
খ) দল ,রাষ্ট্র , সভ্যতা ও সামাজিকতার ভিত্তি,
গ)মুনাফিক ,কাফির , যিম্মি , আহলে কিতাব , যুদ্ধমান শত্রু ও সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ জাতির প্রতি আচরণ।
ঘ) জয় -পরাজয় , বিপদ- শান্তি , নিরাপত্তা ভীতি ইত্যাদি অবস্থায় মুসলমানদের কর্তব্য ।
১১. কুরআনের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য
ক) কুরআনের বাচনভংগীঃ--একটি বিপ্লবী আন্দোলনের উপযোগী
--সমর্থকদের উদ্দীপিত করার মত সম্মোহক
--বিরোধীদের প্রতিহত করায় বলিষ্ঠ
--বিপ্লবী নেতার ঝংকারময় ভাষণ
--মন - মগজ বুদ্ধি - বিবেককে উদ্বুদ্ধ করার মতো এবং ভাবাবেগের প্লাবন সৃষ্টি করার যোগ্য ।
--দরদী মন দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করার মতো আবেগ ও আবেদনময় আহবান ।
খ) কুরআনে কেন একইকথা বার বার উল্লেখ করা হয়েছেঃ
১. আন্দোলনের বিশেষ এক অধ্যায়ে যেসব কথা মন- মগজে বসান দরকার তা বারবারই বলা দরকার।
২. বারবার একই ভাষা বা শব্দে,নতুন ভংগীতে ও আকর্ষণীয় পদ্ধতীতে একটি কথাকে পূর্ণরূপে হজম করাবার জন্যই বলা হয়েছে।
৩. আল্লাহর গুনাবলী, তাওহীদ ,রিসালাত ,আখিরাত ,কিতাব ,ঈমান ,তাকওয়া ,সবর , তাওয়াক্কুল ইত্যাদি এমন গুরুত্বপূর্ণ যে এ সবের পুনরূক্তি ব্যাপক হওয়াই স্বাভাবিক এবং আন্দোলনের সকল স্তরে এর প্রয়োজন।
গ) কুরআন হলো ব্লু- প্রিন্ট বা ইসলামী বিধানের নীল নকশা । আল্লাহর তৈরী এ নীল নকশা অনুযায়ী ইসলামের বিরাট সৌধ গড়ার দায়িত্ব যে ইঞ্জিনিয়ারকে দেয়া হয়েছে তিনিই হলেন রাসূল (সাঃ)। তিনি কুরআনে দেয়া পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করে ইসলামের পরিপূর্ণ রূপ প্রকাশ করেছেন ।
১২. মাক্কী ও মাদানী সূরার সংখ্যা
ক) মোট ১১৪টি সূরার মধ্যে ১৭টি সূরা সম্পর্কে মতভেদ দেখা যায় । এর মধ্যে ৫টি সূরা নিয়ে ব্যাপক মতভেদ আছে । বাকী ১২টির মধ্যে অধিকাংশের মতে ৪টি মাদানী ও ৮টি মাক্কী ।১. যে ৫টি সূরা সম্পর্কে ব্যাপক মতভেদ আছে --- আল বাইয়েনাহ (৯৮), আল আদিয়াহ (১০০), আল মাউন (১০৭), আল ফালাক (১১৩ ) ও আন নাস (১১৪)।
২. অধিকাংশের মতে যে ৪টি সূরা মাদানীঃ
আর – রাদ(১৩), আর- রাহমান (৫৫), আদ- দাহর (৭৬) ও আল যিলযাল (৯৯)।
৩. অধিকাংশের মতে যে ৮টি সূরা মাক্কীঃ
আত- তীন (৯৫) , আল কদর (৯৭), আত- তাকাসুর (১০২), আল- আসর (১০৩),আল কুরাইশ (১০৬), আল কাউসার (১০৮),আল কাফিরুন (১০৯) ও আল ইখলাস(১১২)।
খ) তাফহীমুল কুরআনে সূরাগুলোর ভুমিকায় মাওলানা মওদূদী (রঃ) সুরাসমূহের নাযিল হবার সময় নিয়ে যে গবেষণামূলক আলোচনা করেছেন তাতে মাত্র ২৫টি সূরা মাদানী বলে প্রমাণিত হয় । সে হিসেবে ১১৪- ২৫=৮৯টি সূরাই মাক্কী বলে সাব্যস্ত হয়। অবশ্য তিনি তাফহীমে ৫৫ও ৯৯নং সূরার শিরোনামে মাদানী লিখেছেন ----যদিও গবেষণার মাক্কী প্রমাণ করেছেন । আবার ১০নং সূরার শিরোনামে মাক্কী লিখেও গবেষণায় মাদানী প্রমাণ করেছেন । কিন্তু তাঁর তরজমায়ে কুরআন মজীদে ১৩ ও ৭৬নং সূরার শিরোনামে মাদানী লিখেছেন।
গ) অধিকাংশের মতে ,২৮টি মাদানী সূরা এবং ৮৬টি মাক্কী সূরা । মাওলানা মওদূদী তাফহীমে ২৭টি এবং তরজমায়ে কুরআনে মজীদে ২৯টি সূরার শিরোনামে মাদানী লিখেছেন ।
ঘ) কুরআনের শেষ দু পারায় অধিকাংশ মাক্কী সূরা রয়েছে। ২৯ পরার ১১টি সূরার সবই মাক্কী এবং আমপারার ৩৭ টির মধ্যে ৩৪টিই মাক্কী । মোট ৮৯টি মাক্কী সূরার ৪৫টি শেষ দু পারায় এবং বাকী ৪৪টি সমগ্র কুরআনে ছড়িয়ে আছে।
ঙ) কতক সূরার প্রথম ভাগ মাক্কী হওয়ায় পরবর্তী অংশ মাদানী হওয়া সত্ত্বেও মাক্কী হিসেবে পরিচিত । যেমন সূরা মুযযাম্মিল ।
0 comments: