এটি কাহিনী নয়। এটি একটি রোমাঞ্চকর ও ঈমান উদ্দীপক উপখ্যানের পরিণাম। এ উপখ্যানের সূচণা হয়েছিল ৫ই রজব ৯২ হিজরী মোতাবেক ৯ই জুলাই ৭১১ খৃষ্টাব্দে। যখন এক খৃষ্টান গভর্নর আফ্রিকা ও মিসরের আমীর মুসা ইবনে নুসাইরের দরবারে এ ফরিয়াদ নিয়ে এসেছিল যে, স্পেনের বাদশাহ রডারিক তার কুমারী কন্যার ইজ্জত হরণ করেছে আর সে এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে চায় যা মুসলমানদের সহযোগিতা ছাড়া আদৌ সম্ভব নয়। মুসা ইবনে নুসাইর তখন তারেক ইবনে যিয়াদকে আহ্বান করলেন।
ডান অংশটি মরক্কো এবং বামের অংশটি স্পেন
ঐতিহাসিক লেইন পোল, প্রফেসর দুজী ও স্যার মেকুয়েল, মুসা ইবনে নুসাইর ও জুলিয়নের যে আলাপ হয়েছিল তা তারা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। আলোচনার সারনির্যাস হলো, মুসা ইবনে নুসাইর প্রথমে জুলিয়নের কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, অবশ্য এর পিছনে যথার্থ কারণও ছিল।কারণ জুলিয়ন আর রডারিক উভয়ই ছিল খৃষ্টান, আর মুসলমান সৈন্যদের সাথে জুলিয়নের সেনাবাহিনীর কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে। তাই মুসা বিন নুসাইর এটিকে ষড়যন্ত্র মনে করছিলেন। জুলিয়ন স্পেনের সৌন্দর্য আর স্পেনের নারীদের সৌন্দর্যের প্রলোভন দেখিয়ে মুসা বিন নুসাইরকে প্রভাবিন্বিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু মুসা কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না। তখন জুলিয়ন তার রাজিকীয় তলোয়ার মুসার পায়ের নিচে অর্পণ করল এবং বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু তাতেও যখন মুসা স্পেন আক্রমনে রাজি হলেন না, তখন জুলিয়ন তার মেয়ের বেইজ্জতীর কথা প্রকাশ করল। এবার মুসা বিন নুসাইর রাজী হলেন, তার তলোয়ার কোষ্মুক্ত করলেন, কারণ ইসলাম তো সদা মজলুমদের পক্ষে।
তবে মুসা বিন নুসাইয়ের সময় বর্বররা সবচেয়ে বেশী ইসলাম গ্রহণ করে। তিনি তাদের জন্য পৃথক ও নিয়মতান্ত্রিক সেনাবাহিনী গড়ে তুলেন। তিনি প্রতিটি গোত্রে নিজে গিয়ে ইসলামী শিক্ষা ও সভ্যতা সম্পর্কে অভহিত করেন। তার প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যে মুগ্ধ হয়ে স্বল্প দিনের মাঝে সকল বর্বররা মুসলমান হয়ে যায়। এখানে বর্বরদের সম্পর্কে আলোচনা করার কারণ হলো, স্পেনে যে অভিযান প্রেরিত হয়েছিল তাতে যারা অংশগ্রহণ করেছিল তাদের অধিকাংশই ছিল বর্বর।
যাহোক মুসা বিন নুসাইর (রহ) জুলিয়নের আবেদনের ভিত্তিতে খলীফা ওলীদ ইবনে আব্দুল মালেকের নিকট স্পেন আক্রমনের অনুমতি প্রার্থনা করেন। খলীফা তাঁকে সাবধান ও সজাগ থাকার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে স্পেন আক্রমণ করার অনুমতি প্রদান করেন।
তখন মুসা ইবনে নুসাইর(রহঃ) প্রথমে টাংগের থেকে স্পেনে ছোট ছোট অভিজান পরিচালনা করেন। এ সমস্ত অভিজান পরিচালনার উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার পরিস্থিতি ও জুলিয়নের বিশ্বস্ততা যাচাই করা। এ সকল অভিজান সাফল্যমন্ডিত হলে মুসা বিন নুসাইর(রহঃ) তারেক বিন যিয়াদ(রহঃ) এর নেতৃত্বে বড় একটি আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন।
তারেক বিন যিয়াদ ছিল মুসা বিন নুসাইর এর গোলাম। তারেক বিন যিয়াদ বর্বরদের সচেয়ে সম্ভ্রান্ত ও উত্তম বংশ ডেন্ডালে জন্মগ্রহণ করেন। মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদের বিচক্ষণতা, যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে পারদর্শীতা, সততা, আরবী ভাষায় বাগ্মীতা অন্যান্য গুণাবলী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তারিক বিন যিয়াদের ইসলাম গ্রহণের পর তার এই নাম রেখেছিলেন মুসা বিন নুসাইরই। তিনি তারিকের যোগ্যতা দেখে তাকে নায়েবে সালার পদে আসীন করলেন। অবশেষে এই গোলাম পেয়ে গেলেন স্পেন অভিজানে সেনাপতির দায়িত্ব।
তারেককে যে ফৌজ দেয়া হয়েছিল তার সংখ্যা ছিল সাত হাজার। এর মাঝে কয়েকশ সোয়ারীও ছিল। তাবৎ ফৌজ ছিল বর্বর। তাদেরকে তান্জের থেকে স্পেনে পৌঁছানোর জন্য বড় চারটি জাহাজ ব্যবহার করা হয়েছিল। যখন জাহাজ নোঙ্গর তুলে নিল তখন তীরে সমবেত হাজার হাজার নর-নারী ও শিশু-কিশোর দু’হাত উপরে তুলে তাদের জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করছিল। জাহাজের পালে হাওয়া লাগার পর তা দূরে চলে যেতে লাগল। রমণীদের নয়নযুগলে অশ্রুর বান বয়ে গেল। এ সাত হাজার ফৌজের অধিকাংশের ভাগ্যেই ছিল স্পেনে দাফন। তারা আল্লাহর পয়গাম সমুদ্রের অপর পারে পৌঁছানোর জন্যে চিরতরে বিদায় হয়ে যাচ্ছিল। সে ঐতিহাসিক তারিখটি ছিল ৭১১ খৃষ্টাব্দের ৯ই জুলাই।
জাহাজে আরোহণ করার কিছুক্ষণ পর তারিক বিন যিয়াদ ঘুমিয়ে পড়েন এবং স্বপ্নে মহানবী(সাঃ) এর যিয়ারত লাভ করেন। মহানবী(সাঃ) তাকে স্পেন বিজয়ের সুসংবাদ দেন। তিনি যখন ঘুম থেকে জেগে মুজাহিদদেরকে এই সুসংবাদ দিলেন তখন মুজাহিদদের সাহস ও জজবা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
সমস্ত সৈন্য নিয়ে উপকূলের যেখানে জাহাজ ভিড়েছিল তার নাম ছিল কিপলী, পরবর্তিতে যা জাবালুত তারিক বা জিব্রাল্টার নামে প্রসিদ্ধ হয়।
তার এ নির্দেশ অনেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না, আর অনেকে এ চিন্তা করছিল, এ নির্দেশ কেবল সে সিপাহসালার করতে পারে যার মেধা-বুদ্ধি বিকৃতি ঘটেছে, কারণ তারা মনে করছিল তারা তো স্বদেশভুমি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে, এখন তারা কিভাবে দেশে ফিরবে। তখন তারিক বিন যিয়াদ স্বহস্তে তরবারী উত্তোলন করে সে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন যা আজো ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং কিয়ামত তক থাকবে। সে ভাষণের সারমর্ম ছিল, “হে বাহাদুর যুবক ভাইয়েরা! এখন পিছু হটবার ও পলায়ন করার কোন সুযোগ নেই। তোমাদের সম্মুখে দুশমন আর পশ্চাতে সমুদ্র। না পিছনে পলায়ন করতে পারবে না সামনে। এখন তোমাদের সামনে বিজয়লাভ বা শাহাদতবরণ ছাড়া আর তৃতীয় কোন পথ অবশিষ্ট নেই। আর সব দেশই আমাদের দেশ, কারণ এ সবই আমাদের আল্লাহর দেশ।”
ইবরাহিম আল ইবরাহিম মসজিদ
জাবালুত-তারেকের বর্তমান চিত্র (ইবরাহিম আল ইবরাহিম মসজিদ সহ)
তারেক বিন যিয়াদ তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে ‘জাবালে ফাতাহ’ বা জাবালে তারেক (জিব্রাল্টার) এর উপকূলে অবতরণ করেছিলেন। সেখান থেকে সবুজ উপদ্বীপ পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় তিনি উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন না হয়ে জয় করেন। কিন্তু তারপর রডারিক তার বিখ্যাত সেনাপতি থিওডমীরকে (Theodomir) বিশাল এক সেনাবাহিনী সহ তারেকের মোকাবেলা করার জন্য প্রেরণ করে। মুসলিম সেনাবাহিনীর সাথে থিওডমীরের পরপর অনেকগুলো লড়াই হয়। আর প্রতিটি লড়াইয়ে সে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এমনকি একাধারে পরাজয় বরণ করতে করতে সে সাহসহারা হয়ে পড়ে। তখন সে রডারিককে পত্রযোগে জানায় যে, “এমন এক জাতির আমি মুখোমুখী হয়েছি, যারা বড় বিস্ময়কর এক জাতি। তারা আসমান থেকে নেমে এসেছে নাকি জমিন ফুঁড়ে উঠে এসেছে তা’ আল্লাহই ভাল জানেন। এখন আপনি নিজে অকুতোভয় সেনাদের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে তাদেরকে প্রতিরোধ না করলে তাদের সাথে মোকাবেলা করা কোনভাবেই সম্ভবপর নয়।”
রডারিক তার সেনাপতির পত্র পেয়ে প্রায় একলাখ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী তৈরি করেন তারেকের সাথে মোকাবেলা করার জন্য।
এদিকে তারিক মুসা বিন নুসাইয়ের কাছে আরো সৈন্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে মুসা বিন নুসাইর আরো পাঁচ হাজার সৈন্য প্রেরণ করেন। ফলে তারিকের মোট সৈন্য সংখ্যা বারো হাজারে উপনীত হয়।
লাক্কা প্রান্তরে উভয় বাহিনী লড়াইরের জন্য মুখোমুখী হলে তারেক বিন যিয়াদ এক ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন, যে ভাষণের প্রতিটি শব্দ থেকে তারেক বিন যিয়াদের অবিচল সংকল্প, উচ্চ সাহসিকতা এবং আত্মনিবেদনের সুতীব্র আবেগ প্রকাশ পেয়েছিল।
তারেকের মুজাহিদ সঙ্গীরা পূর্ব থেকেই জিহাদীন চেতনা ও শাহাদাতের বাসনায় উন্মত্ত ছিল। তারেকের জ্বালাময়ী এ ভাষণ তাদের অন্তরে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। তারা দেহ-মনের কথা বিস্মৃত হয়ে লড়াই করেন। একাধারে আটদিন পর্যন্ত এ লড়াই অব্যাহত থাকে। এদিন গুলোতে তারা যেভাবে যুদ্ধ করছিল তা আসলেই অতুলনীয়। তাইতো কবি ইকবাল তারেক বিন যিয়াদের ভাষায় সে সমস্ত আল্লাহ-পাগল মুজাহিদদের সম্পর্কে বলেছেন-
“দিগ্বিজয়ী যোদ্ধা এসব, তোমার আজব বান্দা এঁরা,
হৃদয়ে যাঁদের দিয়েছো তুমি, তোমার প্রমের আকুলধারা।
ময়দানে যাঁরা আঘাত হানে, দরিয়ায় তুলে ঝড়-তুফান,
শৌর্যে যাঁদের পর্বতমালা, ভেঙ্গে চুরে হয় খান খান।”
পরিশেষে মুসলমানগণ আল্লাহর সাহায্য লাভ করেন এবং বিজয় তাদের পদচুম্বন করে। রডারিকের বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করে পালিয়ে যায়। রডারিক নিজেও ঐতিহাসিক এ লড়াইয়ে নিহত হয়। কোন কোন বর্ণনায় জানা যায় যে, তারেক বিন যিয়াদ নিজেই তাকে হত্যা করেন, আর কোন কোন বর্ণনামতে তার শুন্য ঘোড়া সাগরতীরে পাওয়া যায়, যে কারণে অনুমান করা হয় যে, সে সাগরে ডুবে মারা গেছে।
লাক্কা প্রান্তরের দীর্ঘ এক সপ্তাহব্যাপী বড় ধৈর্যসংকুল এই লড়াইয়ে মুসলমানদের অর্জিত বিজয় ইউরোপে মুসলমানদের অনুপ্রবেশের ভূমিকা ছিল। এ বিজয় মুসলমানদের জন্য সমগ্র ইউরোপের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। এরপর মুসলমানগণ স্পেনের সমস্ত শহর পদানত করতে করতে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকে।
তাদের সাথে তখন মুসা বিন নুসাইরও তার বাহিনী সহ যোগদান করেন। তারা স্পেনের তৎকালীন রাজধানী টলেডো (Tollido)-কেও জয় করেন।
টলেডো
তারপরেও তাদের অগ্রাভিজান অব্যাহত থাকে এমনকি তারা ফ্রান্সের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পিরনীজ পর্বতমালার পাদদেশে পৌঁছে যায়।
ঐতিহাসিক গিবন লিখেছেন, “মুসা ইবনে নুসাইর একবার ফ্রান্সের এক পাহাড়ের চূড়ায় চড়ে পুরো ফ্রান্সকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, তিনি আরব সৈন্যদের তার বাহিনীকে শামিল করে ইউরোপকে বিজয় করে কন্সট্যান্টিপোল পৌঁছবেন এবং সেখান হতে নিজ দেশ সিরিয়াতে প্রবেশ করবেন।”
কিন্তু খলিফার নির্দেশে তাদের অগ্রাভিযান থামিয়ে দিতে হয়। তা না হলে হয়ত আজ ইউরোপের ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হত। তাইতো ঐতিহাসিক গীবন লিখেছেন, “যদি ঐ মুসলমান জেনারেল সম্মুখে অগ্রসর হবার সুযোগ পেতেন, তাহলে ইউরোপের স্কুলে ইঞ্জিলের পরিবর্তে কুরআন পড়ানো হতো এবং আল্লাহর একত্ববাদ ও মুহাম্মাদের রিসালাতের সবক দেওয়া হতো। আর আজকে রোমে পোপের পরিবর্তে শায়খুল ইসলামের হুকুম কার্যকর হতো।”
এ সকল বিজয়ের পর স্পেন আন্দালুসে পরিণত হয় যেখানে মুসলমানগণ আট’শ বছর পর্যন্ত শাসন কার্য চালায়। এ সময়ে তারা এখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির অতুলনীয় প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করে। তারা এ ভূখন্ডকে পৃথিবীর সর্বাদিক উন্নত ভূখন্ডে পরিণত করেন।
কর্ডোভা
গ্রানাডা
কিন্তু যে জাতি তরবারীর ছায়াতলে এ ভূমিতে তাকবীর ধ্বনীর ফোয়ারা উৎসারিত করেছিল, যে জাতি দীর্ঘ আটশ’ বছর পর্যন্ত বিশ্ববাসীর নিকট থেকে নিজেদের দোর্দন্ডপ্রতাপের স্বীকৃতি আদায় করেছিল, তারা যখন বিলাসিতা, বাদ্য ও সঙ্গীতের তানে বিভোর হয়ে গাফলতের চিরনিদ্রায় শায়িত হল তখন এ স্বর্গভূমি তাদের হাতছাড়া হল আর সেখানে তাদের অস্তিত্বের কোন চিহ্ন সেখানে অক্ষত রইল না, যা হল অন্য আরেকটি ইতিহাস।তথ্যসূত্র-
১) জাহানে দিদাহ- শাইখুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানী (দা বা)
২) Encyclopedia of Islam
৩) wikipedia
৪) ইসলামের ইতিহাস
৫) Encyclopedia of World History
৬) History of Decline & Fall of Roman Empire and History of Christianity- Edward Gibbon
৭)Encyclopedia Britannica
লেখক : ব্লগার অগ্রপথিক...
স্পেনের মরিসকোদের (জোর করে খৃষ্টান বানানো মুসলিম) নিয়ে তিনটি উপন্যাস
স্পেনের মুসলিম পতনযুগের ঠিক কিছুটা আগের পুনর্জাগড়নের সময়কাল নিয়ে নসীম হিজাজীর উপন্যাস
- নসীম হিজাজী : ইউসুফ বিন তাশফিন
0 comments: