বুকের সবটুকু রক্ত দিয়ে পিচঢালা কালো রাস্তাকে লাল করে শেষ পর্যন্ত নিজের শেষ নিঃশ্বাসটুকু আল্লাহর এই জমিনে বিলীন করে দিয়ে শাহাদাতের নজরানা পেশ করলেন শহীদ মাহমুদুল হোসাইন।
শহীদ মাহমুদুল হোসাইন চাটখিল পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের জমাদ্দার বাড়ির এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো: খোরশেদ আলম, মাতা ফাতেমা বেগম। তিনি ২ ভাই ২ বোনের মধ্যে ২য়।
তিনি ১ম শ্রেণী হতে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত চাটখিল তা’লিমুল কুরআন মাদ্রাসাতে পড়ালেখা করেন। তারপর ৬ষ্ঠ শ্রেণী হতে আলিম পর্যন্ত মাদ্রাসাতুদ দ্বীনিয়াতে শহীদ হওয়া পর্যন্ত অধ্যয়নরত ছিলেন।
ছোটবেলা থেকে মাহমুদুল হোসাইন ছিলেন নম্র ও ভদ্র। সবসময় হাস্যোজ্জ্বল থাকতেন। পড়াশোনার দিক দিয়ে মাহমুদুল হোসাইন ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। দাখিল পরীক্ষায় তিনি অ+ অর্জন করে মেধার জগতে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন।
শিক্ষকদের নিকট ছিলেন স্নেহভাজন। সমাজের মানুষের কাছে ছিলেন খুবই প্রিয়। সংগঠনের দায়িত্বশীলদের কাছে ছিলেন একজন আনুগত্যশীল সক্রিয় কর্মী ও বিচক্ষণ। বাতিলের সাথে ছিলেন আপসহীন।
মাহমুদুল হোসাইন
পিতা : মো: খোরশেদ আলম
মাতা : ফাতেমা বেগম
ভাই-বোন : ২ ভাই ২ বোন (ভাই-বোনের মধ্যে ২য়)
ঠিকানা : জমাদ্দার বাড়ি, ৬ নং ওয়ার্ড, চাটখিল পৌরসভা, নোয়াখালী
জন্ম : ০৬/০৬/১৯৯৭
বয়স : ১৬ বছর
সাংগঠনিক মান : সাথী
পড়াশোনা : শিক্ষার্থী (আলিম ২য় বর্ষ)
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : মাদ্রাসাতুদ দ্বীনিয়াহ, নোয়াখালী
শাহাদাতের তারিখ : ২০ নভেম্বর ২০১৩
আহত হওয়ার তারিখ : ২৮ অক্টোবর ২০১৩ বেলা ১১টায়
আঘাতের ধরণ : চাটখিল বাজারে ১৮ দলীয় জোটের ৬০ ঘণ্টা হরতালের শেষ দিনে মিছিলে পুলিশ ও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসিদের গুলিতে বুকে গুলিবিদ্ধ
শাহাদাতের ঘটনা
২৮ অক্টোবর ২০১৩। চলছে ১৮ দলীয় জোটের টানা ৬০ ঘণ্টার হরতাল। হরতালের শেষ দিনে সকাল ১১টার সময় পুলিশ ও ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষ চলাকালে ছাত্রলীগের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন মাহমুদুল হোসাইন। গুলি এসে তার বুক ছিদ্র করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে বৃষ্টির মত রক্ত বের হয়ে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়।
শহীদের সাথীরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক এই সময় মাহমুদুল হোসাইন রক্তাক্ত অবস্থায় বলেন, আপনারা আমাকে ছেড়ে দিন, আমাকে নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। আপনারা হায়েনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। একজন মুমূর্ষ রোগীর এই বক্তব্য সবাইকে স্তম্ভিত করে। জোগায় আন্দোলনের পথে অনুপ্রেরণা। নিয়ে যাওয়া হয় চাটখিল হাসপাতালে, প্রয়োজন হয় ই+ রক্তের। তখনই হাসপাতালে পাগলের মত ছুটে যান শহীদের সাথীরা। নিজের রক্ত দিয়ে মাহমুদুল হোসাইন-এর প্রাণ বাঁচানোর জন্য শুরু হলো রক্ত দেয়ার প্রতিযোগিতা।
ঢাকায় হাসপাতালে নেয়ার পর তাঁকে নেয়া হয় আইসিইউতে। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। প্রায় ১৫ দিন পর তাঁর অপারেশন করা হয়। হাসপাতালে ইমারজেন্সিতে থেকে তিনি ভুল করেননি মহান আল্লাহর নির্দেশ সালাত আদায় করতে, সালাতের সময় হলে তিনি নার্সদেরকে সময় জিজ্ঞাসা করে সালাত আদায় করতেন।
হাসপাতালে শহীদের কিছু কথা
– ভাই আমাকে একটি ইংরেজি লেখা ঘড়ি কিনে দিন যাতে করে আমি সময় দেখে সালাত আদায় করতে পারি।
– জীবনে যতটুকু ভালো কাজ করেছি তা সামান্য, আর পাপের পাল্লাটা অনেক ভারী। তবে সান্ত্বনা হলো আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও নির্ভরতা আর ইসলামী আন্দোলনকে আমি মনেপ্রাণে ভালোবাসি। তাই আজ আল্লাহর কাছে আমার চাওয়া তিনি যেন আমাকে উত্তম জাযাহ দান করেন। আমি যেন জান্নাত উপযোগী মানুষ হতে পারি।
– সবুজ এই ভূ-খণ্ডে দ্বীন কায়েমের যে বৃক্ষ রোপিত হয়েছে তা একদিন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বৃক্ষে পরিণত হবে। যে সময় লাগবে তাতে ঝরবে হাজারো পাতা আর এই ঝরা পাতাগুলো হলো একেকজন শহীদ। কিন্তু পাতাগুলো থকবে তাজা। কারণ শহীদেরা মরে না কখনো, বেঁচে থাকে আল্লাহর কুদরতে। সবাই আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন।
সর্বশেষ দীর্ঘ ২২ দিন পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আকাশ-বাতাস ভারী করে সবাইকে অশ্র“সিক্ত রেখে শাহাদাতের অমীয় পেয়ালা পান করেন শহীদ মাহমুদুল হোসাইন।
শহীদের জানাজা
কফিনে হাস্যজ্জ্বল প্রিয় মাহমুদুল হাসান ভাই |
শহীদের কফিন যখন নিজ বাড়িতে আনা হয় তখন ছিল সন্ধ্যাবেলা। হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষমান শহীদের লাশ একনজর দেখার জন্য। শহীদের বাড়িতে ভীড় জমাতে থাকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ। জানাজার নির্ধারিত সময় ছিল ২১ নভেম্বর সকাল ৮.৩০ মি:। কিন্তু প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় বাদ আসর চাটখিল দারোগার বাজারে। ফজরের নামাজের পর পরই জানাজার জন্য চাটখিল বাজারে ভীড় জমিয়ে দিল হাজার হাজার তাওহীদি জনতা।
বিকাল ৩টা থেকে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয় জানাজার পূর্ব সমাবেশ। কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় চাটখিল বাজারের প্রতিটি অলি গলি এবং বিল্ডিংয়ের ছাদের ওপরেও ছিল উপচে পড়া ভিড়। সে দৃশ্য বলে দেয় একজন শহীদের জন্য মানুষের আবেগ কতটুকু। আসরের নামাজের সময় হলো কিন্তু কফিন পোস্টমর্টেম করে এখনো আসেনি। মসজিদে পর্যাপ্ত জায়গা না পাওয়ায় রাস্তায় নামাজ আদায় করেন শহীদের সাথীরা। নামাজ শেষে শুরু হলো শ্লোগান- “নারায়ে তাকবীর/আল্লাহু আকবার, শহীদের রক্ত/বৃথা যেতে পারে না”। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হলো চাটখিলের ময়দান। শহীদ মাহমুদুল হোসাইনের কফিন কাঁধে করে নিয়ে আসা হলো জানাজার স্থানে। তখন প্রত্যেকের মুখে বিক্ষোভের ধ্বনি আর চোখে পানি।
শহীদের কফিন সামনে রেখে সর্বশেষ বক্তব্য রাখেন শহীদি কাফেলার কেন্দ্রীয় স্কুল কার্যক্রম সম্পাদক জাকির হোসাইন সেলিম। আরো বক্তব্য রাখেন সাবেক কেন্দ্রীয় বায়তুলমাল সম্পাদক ও লক্ষ্মীপুর জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মফিজুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় কার্যকরি পরিষদের অন্যতম সদস্য ও নোয়াখালী শহর সভাপতি নেয়ামত উল্লাহ শাকের। শহীদের জানাজায় ইমামতি করেন শহীদের একান্ত অভিবাবক ও চাটখিল উপজেলার জামায়াতের আমীর মাওলানা সাইফুল্লাহ।
জানাজা শেষে শহীদের কফিনসহ মিছিল নিয়ে এগিয়ে চলল শহীদের সাথীরা তাঁর জন্মস্থানের দিকে। মিছিলটি ছিল প্রায় দেড় কিলোমিটার ব্যাপী। কফিনসহ যখন বাড়ির সামনে কবরস্থানে শহীদের সাথীরা পৌঁছল তখন দেখা গেল আরেক দৃশ্য। রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে অশ্র“সিক্ত নারী-পুরুষ ও শিশুরা। সে দৃশ্যই প্রমাণ করে মাহমুদুল হোসাইন তাদের কাছে কত প্রিয় ছিলেন। অশ্র“সিক্ত নয়নে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করে তাঁর শাহাদাতের মর্যাদার জন্য দুহাত তুলে দোয়া করল তাঁর সাথীরা।
সে দিন শহীদ মাহমুদুল হোসাইনের মায়ের কথা ছিল- আল্লাহ যেন আর কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি না করেন, কারণ এই জ্বালা অনেক বড় কঠিন।
তাঁর প্রতিবেশীরা বলল, এতদিন বুঝতে পারিনি কেন এত ভালো ছিল মাহমুদুল হোসাইন। আজ বুঝতে পেরেছি মহান আল্লাহ তাঁকে শহীদ হিসাবে কবুল করবেন বলেই।
মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি- মাহমুদুল হোসাইনকে আল্লাহ শাহাদাতের মর্যাদা দান করুন। এবং তাঁরই মত আমাদেরকে দ্বীন কায়েমের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, নোয়াখালী জেলা উত্তর
0 comments: