অধ্যায় ০৫ : প্রকাশ্য আহবান ও জুলুম নির্যাতন

প্রকাশ্য আহবান
কেটে গেলো তিনটি বছর। নবীর নেতৃত্বে গড়ে উঠলো একটি ছোট সংগঠন। এবার আল্লাহ নির্দেশ দিলেন-
যেই বিষয়ে তুমি আদিষ্ট হচ্ছো তা প্রকাশ্য উচ্চ কন্ঠে ঘোষণা কর। (সূরা আল-হিজর:৯৪)
মুহাম্মাদ (সা) কাবার নিকটবর্তী সাফা পাহাড়ে উঠে জোরে আওয়াজ দিলেন ইয়াসাবা-হাহ।
কোন বিপদ দেখলে উঁচু স্থানে উঠে আরবগণ এই সাংকেতিক কথা উচ্চারণ করতো। সংকেত বাণী শুনে লোকেরা দৌড়ে আসতো। মুহাম্মাদ (সা) এর মুখে এই সংকেত বাণী শুনেও তারা ছুটে এলো। সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে মুহাম্মাদ (সা) বললেন,
শোন, আমি তোমাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদাত করার আহ্বান জানাচ্ছি এবং মূর্তি পূজার পরিণাম থেকে তোমাদেরকে বাঁচাতে চাচ্ছি। তোমরা যদি আমার কথা না মান, তাহলে তোমাদেরকে এক কঠিন শাস্তি সম্পর্কেও সতর্ক করে দিচ্ছি।
মুশরিক কুরাইশরা অসন্তষ্ট হয়। গোসসা প্রকাশ করতে করতে তারা সেই স্থান ত্যাগ করে। এই প্রকাশ্য আহবান শুনার পর মক্কায় দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। মুখে মুখে এই কথা আলোচিত হতে থাকে। এরি মধ্যে মুহাম্মাদ (সা) একদিন আবদুল মুত্তালিব খান্দানকে এক ভোজ সভায় দাওয়াত দেন। আবু তালিব, হামজা, আব্বাস প্রমুখ সেই ভোজ সভায় আসেন। খাওয়া শেষে মুহাম্মাদ (সা) দাঁড়িয়ে বলেন,
আমি এমন কিছু নিয়ে এসেছি যা দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য যথেষ্ট। এই বিরাট বোঝা বহনে কে আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছেন? সবাই নিশ্চুপ। কারো মুখে কোন কথা নেই। বালক আলী ইবনু আবি তালিব রাসূলের সেই প্রশ্নের জবাব দিলেন, আমি আপনার সহযোগিতা করতে থাকবো।
কেটে গেলো আরো কিছু দিন। মুহাম্মাদ (সা) গেলেন কাবার নিকটে। ঘোষণা করলেন-আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। মুশরিকেরা নবীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হারস ইবনু আবীহালাহ (রা) তাঁর সাহায্য এগিয়ে আসেন। মুশরিকদের তলোয়ারের আঘাতে তিনি শহীদ হন। আল্লাহর অনুগ্রহে মুহাম্মাদ (সা) নিরাপদে রইলেন।
বিরোধিতা
আল্লাহর রাসূল (সা) মক্কার প্রতিটি ঘরে ইসলাম গ্রহণের আহবান পৌঁছাতে থাকেন। মুশরিকরা তাঁকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করা। গালমন্দ দিতে থাকে। বানোয়াট কথা ছড়িয়ে তাঁর সততা সম্পর্কে লোকদের মনে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। তাঁকে পাগল বলা হয়। কবি ও যাদুকর বলা হয়। লোকরা যাতে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে না পারে তার জন্যে পাহারা বসানো হয়।
চাপ প্রয়োগ
কুরাইশদের বিরোধিতা চলতে থাকে। ফলে লোকদের মনে ইসলাম সম্পর্কে জানার কৌতুহল সৃষ্টি হয়। গোপনে লোকেরা নবীর সাথে দেখা করতে আসে। তাঁর হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করে ঘরে ফেরে। মুশরিকরা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আবু তালিব ইসলাম গ্রহণ করেননি। কিন্তি তিনি মুহাম্মাদ (সা) সহযোগিতা করতেন। একদিন কুরাইশদের একদল তাঁর কাছে গিয়ে হাজির। তারা বললো,
তুমি সরে পড়, আমরা ব্যাপারটা চিরদিনের জন্যে মিটিয়ে ফেলি। নয়তো তুমি তাকে বুঝিয়ে ঠিক কর।
একদিন আবু তালিব মুহাম্মাদ (সা) এর নিকট কথাটা পাড়লেন। বলিষ্ঠ কন্ঠে নবী বললেন, আল্লাহর কসম, ওরা যদি আমার এক হাতে চাঁদ ও অন্য হাতে সূর্য এনে দেয়, তবুও আমি আমার কর্তব্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হবো না।
প্রলোভন
কুরাইশ সরদারা এবার নতুন ফন্দি আঁটলো। একটি প্রস্তাবসহ উৎবা ইবনু রাবিয়াকে পাঠানো হলো আল্লাহর রাসূলের (সা) কাছে। উৎবা বললো, মুহাম্মাদ, তুমি কি চাও? মক্কার শাসন কর্তৃত্ব চাও? কোন বড়ো ঘরে বিয়ে করতে চাও? অনেক ধন সম্পদ চাও? আমরা এই সব তোমাকে দিতে পারি। মক্কা তোমার অধীন করে দিতে পারি। অন্য কিছু চাইলে তা দিতে পারি। কিন্তু তুমি এই কাজে থেকে বিরত হও।
উত্তরে আল্লাহর রাসূল (সা) আল কুরআনের এ বাণী পড়ে শুনালেন-
হা-মীম, এটি দায়াময় মেহেরবান আল্লাহর নিকট থেকে নাযিলকৃত। এটি এমন কিতাব যার আয়াতসমূহ অতীব স্পষ্ট ও প্রাঞ্জ-আরবী ভাষার কুরআন-তাদের জন্য, যারা জ্ঞানবান। সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শকারী। কিন্তু তাদের অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা শুনে ও শুনে না। তারা বলে, তুমি আমাদেরকে যেই জিনিসের দিকে ডাকো তার প্রতি আমাদের দিলের উপর আবরণ পড়ে রয়েছে। আমাদের কান বধির হয়ে গেছে এবং আমাদের ও তোমাদের মাঝে একটা পর্দা আড়াল হয়ে গিয়েছে। তুমি তোমার কাজ কর, আমরা আমাদের কাজ করতে থাকবো।
হে নবী, এই লোকদেরকে বল, আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ। আমাকে ওহীর মাধ্যমে বলা হচ্ছে যে তোমাদের ইলাহ একমাত্র ইলাহ। অতএব তোমরা তাঁর অভিমুখী হয়ে থাক, তাঁর নিকট ক্ষমা চাও এবং মুশরিকদের ধ্বংস সুনিশ্চিত যারা যাকাত দেয় না ও আখিরাতের প্রতি অবিশ্বাসী। যারা ঈমান আনলো ও নেক আমল করলো তাদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন পুরষ্কার রয়েছে।
হে নবী, তাদেরকে বল, তোমরা কি সেই সত্তার কুফরী করছো ও অন্যদেরকে তার সমকক্ষ বানাচ্ছো যিনি পৃথিবীকে দুদিনে সৃষ্টি করেছেন? তিনিই তো রাব্বুল আলামীন। তিনি পৃথিবরীর বুকে উপর থেকে পাহাড় গেড়ে দিয়েছেন এবং এতে বরকতসমূহ সংস্থাপন করেছেন। তিনি এতে সব প্রার্থীর জন্যে প্রত্যেকের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী পরিমিত খাদ্য সামগ্রী সঞ্চিত করে রেখেছেন।
এই সব চারদিনে সম্পন্ন করা হলো। অতঃপর তিনি আসমানের দিকে লক্ষ্য আরোপ করলেন। তা তখন শুধু ধোঁয়া ছিলো। তিনি আসমান ও যমিনকে বললেন, অস্তিত্ব ধারণ কর ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছয়। উভয় বললো, আমরা অস্তিত্ব ধারণ করলাম অনুগতদের মতোই। তখন তিনি দুনিনের মধো সাত আসমান বানিয়ে দিলেন এবং প্রতি আসমানে বিধি-বিধান ওহী করা হলো। আর দুনিয়ার আসমানকে আমি প্রদীপসমূহ দ্বারা সুসজ্জিত করলাম এবং একে পূর্ণভাবে সুরক্ষিত করলাম। এই সব কিছুই এক মহাপ্ররাক্রমশালী বিজ্ঞ সত্তার পরিকল্পনা। এখন এই সব লোক যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তাদেরকে বল: আমি তোমাকে তেমনি ধরনের সহসা ভেঙ্গে পড়া আযাবের ভয় দেখাচ্ছি যেমন আদ ও সামুদের উপর নাযিল হয়োছিলো। সূরা হামীম আস সাজাদা : ১-১৩
উৎবা এই বাণী শুনে অভিভূত হয়ে পড়ে। তার মন বলে উঠে যে এ সত্যিই আল্লাহর বাণী। মুদ্ধ হয়ে ফিরে গেলো সে কুরাইশ সরদারদের কাছে। সে বললো, মুহাম্মাদ যেই বাণী পেশ করছে তা কবিত্ব নয়, অন্য কিছু। তাকে তার নিজের অবস্থার উপরই ছেড়ে দেয়া উচিৎ। সে যদি আরবের উপর বিজয়ী হতে পারে তাতে তোমাদেরও সম্মান বাড়বে। আর তা না হলে আরব তাকে ব্যর্থ করে ছাড়বে।
কুরাইশ সরদারগণ তার এই পরামর্শ গ্রহণ করেনি।
যুলুম-নির্যাতন
মুশরিক শক্তি এবার ইসলামী সংগঠনের অন্তভূক্ত ব্যক্তিদের উপর শারীরিক নির্যাতন চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। খাববাবকে (রা) তাঁর মনিব জ্বলন্ত কয়লার উপর শুইয়ে দেয়। এক ব্যক্তি তাকে পা দিয়ে চেপে ধরে রাখে। বিলালকে (রা) তার মনিব মরুভূমির গরম বালুর উপর শুইয়ে রেখে বুকে পাথর চাপা দেয়। আম্মারকে (রা) পিটিয়ে পিটিয়ে বেহুঁশ করে দেয়া হয়। নানাভাবে মুসলিমদের উপর নির্যাতন চলতে থাকে। সেই নির্যাতনের শিকার হলেন অনেক পুরুষ। অনেক নারী।
হাবশায় (ইথিওপিয়া) হিজরাত
ইসলামী দাওয়াতের পঞ্চম বছর। কুরাইশদের অত্যাচার বেড়েই চলেছে। মুসলিমদের জন্য মক্কায় পরিস্থিতি জাহান্নমের মতো হয়ে উঠে। আল্লাহর রাসূল (সা) একদল মুসলিমকে হিজরাতের নির্দেশ দেন। পনর জনের একটি দল তৈরী হয়। এঁদের মধো চারজন ছিলেন মহিলা। বন্দরে তাঁরা একটি জাহাজ পেয়ে যায়। লোহিত সাগরের ঢেউ ঠেলে তাঁরা পৌছেন হাবশায়। আত্মীয়-স্বজন, ধরদোর ও ধনসম্পদ ত্যাগ করে ঈমান নিয়ে তাঁরা হাবশায় নাজাসী আসহামার কাছে প্রতিনিধি দল পাঠায়। প্রতিনিয়িরা মুসলিমদেরকে তাদের হাতে তুলে দেবার জন্য নাজাসীকে অনুরোধ জানায়। নাজাসী মুসলিমদের বক্তব্য শুনেন। তাঁর মনে বিশ্বাস জন্মে যে ঈসা (সা) যেই নবীর আগমনের কথা বলেছিলেন তিনি এসে গেছেন। নাজাসী মুসলিমদেরকে নিরাপদে তাঁর দেশে থাকার অনুমতি দেন। পরে তিনি নিজেও মুসলিম হন।
কুরাইশদের সমাবেশে মুহাম্মাদ (সা)
ইসলাম প্রচারের পঞ্চম বছর। মাহে রামাদান। কাবার কাছে কুরাইশদের এক সমাবেশ। মুহাম্মাদ (সা) উঠে দাঁড়ালেন। পেশ করলেন একটি ভাষণ। সেই ভাষণটি ছিলো আল কুরআনের সূরা আন-নাজম।
কারো মুখে রাসূল ছিলো না। মন্ত্র মুদ্ধের মতো সবাই তা শুনছিলো। ভাষণ শেষ হলো। মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করলেন। সংগে সংগে গোটা জন-সমাবেশ সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। মুশরিক কুরাইশদেরও সেই ভাষণ শুনে এতোই মুদ্ধ হয়েছিলো যে যন্ত্রচালিতের মতো তারা মুহাম্মাদে (সা) অনুকরণে সিজদাবণত হয়।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম