অধ্যায় ০৬ : ইসলাম গ্রহণ : হামযা ও উমর , শিয়াবে আবু তালিব, তায়েফ গমন

হামজার ইসলাম গ্রহণ
ইসলাম প্রচারের ৬ষ্ঠ বছর। মুসলিমদের উপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। একদিন আবু জাহেল আল্লাহর রাসূলের (সা) সংগে দুর্ব্যবহার করে। সেই সময় হামজা ছিলেন শিকারে। শিকার থেকে ফিরে এসে তিনি এই ঘটনা শুনতে পান। মুহাম্মাদের (সা) প্রতি দুর্ব্যবহার। এটা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারলেন না। শিকারের তীর ধনুক তখনো তাঁর হাতে। এইগুলো নিয়েই তিনি ছুটলেন কাবার দিকে। আবু জাহেলকে পেলেন ওখানে। তীব্র ভাষায় বকলেন তাকে। তারপর ঘোষণা করলেন, আমিও ইসলাম গ্রহণ করলাম।
উমারের ইসলাম গ্রহণ
উমার ছিলেন কট্টর ইসলাম-বিরোধী। একদিন তিনি মুহাম্মাদ (সা) কে উত্যক্ত করার জন্য বের হন। আল্লাহর রাসূল (সা) কাবার নিকট সালাত আদায় করছিলেন। সালাতে তিনি আল্লাহর বাণী পড়ছিলেন। উমার নিকটে দাঁড়িয়ে তা শুনতে থাকেন। তাঁর মনে দোলা লাগে। তিনি সরে পড়েন সেখান থেকে। মন আবার কঠিন করে নেয়।
একদিন তিনি আল্লাহর রাসূল (সা) কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে বের হন। পথে এসে শুনেন তাঁর বোন ফাতিমা ও তাঁর স্বামী মুসলিম হয়ে গেছেন। উমার ভীষণ রেগে যান। সোজা এসে পৌঁছেন বোনের বাড়ী। তাঁরা তখন আল্লাহর বাণী পড়ছিলেন। উমারকে দেখে তাঁরা তাড়াতাড়ি আল কুরআনের অংশটুকু লুকিয়ে ফেলেন। তোমরা নাকি বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করেছো? বলেই উমার ভগ্নিপতিকে মারতে শুরু করেন। ফাতিমা স্বামীর সাহায্য এগিয়ে আসেন। উভয়ে আহত হন। শরীর থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকে তাজা খুন। তাঁরা বলেন, আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। তোমার কোন অত্যাচরই আমাদেরকে এই পথ থেকে সরাতে পারবে না। এবার উমার জানতে চাইলেন তাঁর কি পড়ছিলেন। ফাতিমা আল কুরআনের অংশটুকু তাঁর হাতে দিলেন। এতে সূরা ত্বা-হা লিখা ছিলো। তিনি পড়তে শুরু করেন।
আমিই আল্লাহ। আমি ছাড়া আর কোন ইলাহা নেই। অতএব আমারই ইবাদাত কর এবং আমার স্মরণের জন্য ছালাত বা নামায কায়েম কর। সূরা তা-হা : ১৪।
এই আয়াত পর্যন্ত পড়ার পর উমারের মনে ইসলামের আলো জ্বলে উঠলো। তিনি বলে উঠলেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
আল্লাহর রাসূল (সা) তখন দারুল আরকামে। উমার সোজা সেখানে গেলেন। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেলেন, কেন এসেছো, উমার? তিনি জবাব দিলেন, ইসলাম গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে। মুহাম্মাদ (সা) বলে উঠলেন আল্লাহু আকবার। সমম্বরে মুসলিমরা বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবার। এটাও ইসলামী দাওয়াতের ৬ষ্ঠ বছরের ঘটনা।
শিয়াবে আবু তালিবে আটক
উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণের পর মুসলিমরা কাবার চত্বরে প্রকাশ্যভাবে ছালাত আদায় করতে শুরু করে। এতে বেশ হাংগামা হয়। কিন্তু মুশরিকরা মুসলিমদেরকে ছালাত আদায় করার সুযোগ দিতে বাধ্য হয়। এতে কুরাইশ সরদারদের রাগ চরমে উঠে। তারা ভাবলো, বানু হাশিমের সহযোগিতাই মুহাম্মাদ (সা) এর শক্তির উৎস।তাই বানু হাশিমের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সকলে মিলে বানু হাশিমকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়। বয়কট চুক্তি অনুযায়ী সবাই বানু হাশিমের সাথে মেলা মেশা বন্ধ করে দেয়। তাদের কিছু কেনা ও তাদের নিকট কিছু বেচা বন্ধ হয়ে যায়। খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। বলা হলো, হত্যার জন্য মুহাম্মাদকে তাদের হাতে তুলে না দেয়া পর্যন্ত এই বয়কট চলতে থাকবে।
আবু তালিব বানু হাশিমের লোকদেরকে নিয়ে শিয়াবে আবু তালিব নামক গিরি সংকটে আশ্রয় নেন।
আবু লাহাব ছাড়া বানু হাশিমের মুসলিম-অমুসলিম সকল সদস্যই মুহাম্মাদ (সা) এর সঙ্গী হন। আটক অবস্থায় তাঁদেরকে থাকতে হয় তিনি বছর।
এই তিন বছরে তাঁদেরেক দু:সহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। খাদ্যাভাবে অনেক সময় গাছের পাত ও ছাল খেতে হয়েছে। শুকনো চামড়া চিবিয়ে চিবিয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণের চেষ্টা করতে হয়েছে। পানির অভাবে অবর্ণনীয় কষ্ট পেতে হয়েছে।
তিন বছর পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই বন্দীদশা থেকে তাঁদের মুক্তির পথ করে দেন। বানু হাশিম খান্দানের এই নিদারুণ দু:খ-কষ্ট দেখে একদল যুবকের মন বিগলিত হয়। তারা এই বন্দীদশা থেকে তাঁদের মুক্তির পথ করে দেন। বানু হাশিম খান্দানের এই নিদারুণ দু:খ-কষ্ট দেখে একদল যুবকের মন বিগলিত হয়। তারা এই অমানুষিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। তাদের মধ্যে ছিলো মুতইম ইবনু আদি, আদি ইবনু কাইস, যামআহ ইবনুল আসওয়াদ, আবুল বুখতারী, জুহাইর এবং হিশাম ইবনু আমর। তারা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে আবু জাহালের নিষেধ অমান্য করে বানু হাশিমকে মুক্ত করে আনে। এটা ছিলো নবুয়াতের নবম সনের ঘনটা।
দুইজন আপনজনের ইন্তিকাল
শিয়াবে আবু তালিবের বন্দীদশা বুড়ো আবু তালিবের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে দেয়। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার কয়েকদিন পরই তাঁর ইন্তিকাল হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিলো ৮৭ বছর। এর কিছুদিন পরই রাসূলের প্রিয়তমা জীবন সংগিনী খাদীজাতুল কুবরা ইন্তিকাল করেন। আবু তালিব ও খাদিজার (রা) ইন্তিকালে মুশরিকরা উল্লাসিত হয়। এবার তারা মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর সাথীদের উপর চরম অত্যাচার শুরু করে।
তাইফ গমন
মক্কার সত্য সন্ধানী মানুষেরা ইসলামী সংগঠনে এসে গিয়েছিলো। নতুন কোন লোকই আর ইসলামী দাওয়াত কবুল করেছিলো না। আল্লাহর রাসূল (সা) সিদ্ধান্ত নেন, তাইফ গিয়ে ইসলাম প্রচার করতে হবে।
তাইফে তখন অনেক ধনী ও প্রভাবশালী লোক বাস করতো। মুহাম্মাদ (সা) তাদের কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানান। এই সব প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁর কথায় কান দিলো না। কেউ কেউ তাঁকে খুব বিদ্রূপ করে। তারা মুহাম্মাদের (সা) পিছনে শহরের গুন্ডাদের লেলিয়ে দেয়।
গুন্ডাদল নবীর পিছু নেয় ও তাঁর প্রতি পাথরের টুকরা নিক্ষেপ করতে থাকে। আল্লাহর রাসূলের (সা) সারা শরীর রক্তাক্ত হয়ে যায়। শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে তাঁর স্যান্ডেলে জমা হয়। এক সময় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে তিনি আশ্রয়ের জন্য একটি বাগানে ঢুকে পড়েন। আল্লাহর রাসূল (সা) তাইফবাসীর নিকট ইসলাম পেশ করেন। চরম লাঞ্চনা ও উৎপীড়ন ছাড়া তিনি আর কিছুই পাননি। আদ্দাস নামক একজন খৃষ্টানক্রীতাদেসের ছাড়া কেউ তাঁর আহ্বানে সাড়া দেননি।
বহিরাগতদের মধ্যে ইসলাম প্রচার
প্রতি বছর হজ্ব হতো মক্কায়। আরবের সব অঞ্চল থেকে লোক আসতো সেখানে। আবার বিভিন্ন মওসুমে মেলা নানাস্থানে। সেই গুলোতেও আসতো অনেক লোক। আল্লাহর রাসূল (সা) তাদের মাঝে ছুটে যেতেন। লোকেদেরকে আল কুরআনের বাণী শুনাতেন। কারো কারো অন্তরে সত্যের আলো জ্বলে উঠতো। তারা ইসলাম গ্রহণ করে নিজের এলাকায় ফিরে যেতো। এইভাবে ইসলামের আহবান মক্কার বাইরে পৌঁছাতে থাকে।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম