অধ্যায় ১১ : দ্বীন ও শরীয়ত

দ্বীন ও শরীয়াত

এ যাবত আমি যা কিছু বলেছি , তা হচ্ছে দ্বীন সম্পর্কে কথা । এখন আমি হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর শরীয়াত সম্পর্কে কথা বলব। তবে সবার আগে জেনে নিতে হবেঃ শরীয়াত কাকে বলে , আর শরীয়াত ও দ্বীনের মধ্যে পার্থক্য বা কি ?

দ্বীন ও শরীয়াতের পার্থক্য

পূর্ববর্তী অধ্যায়সমূহে বলা হয়েছে যে , সকল নবীই ইসলামের শিক্ষা নিয়ে এসেছেন, আর দ্বীন ইসলাম হচ্ছেঃ আল্লাহর সত্যিকার পয়গাম্বারগণের শিক্ষা অনুযায়ী আল্লাহর সত্তা , তাঁর গুণরাজি এবং আখেরাতের পুরস্কার ও শাস্তির প্রতি ঈমান পোষণ করা , আল্লাহর কিতাব সমূহকে মেনে নেয়া, সব মনগড়া পথ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর কিতাসমূহের নির্ধারিত পথকেই সত্য বলে উপলব্ধি করা , আল্লাহর পয়গাম্বরগণের আনুগত্য করা এবং সবকিছুকে ছেড়ে তাঁদেরই অনুসরণ করা। ইবাদাতে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ও শরীক করা যেতে পারে না। এ ঈমান ও ইবাদাতের নাম হচ্ছে দ্বীন এবং সকল নবীর শিক্ষার মধ্যেই একে শামিল করা হয়েছে।
এ ছাড়া আর একটি জিনিস হচ্ছে শরীয়াত । ইবাদতের পদ্ধতি , সামাজিক রীতিনীতি , পারস্পরিক লেন -দেন ও সম্বন্ধ রাক্ষার বিধান , হালাল হারাম ,জায়েয- নাজায়েযের সীমা প্রভৃতি শরীয়াতের মধ্যে শামিল । এসব বিধান সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা গোড়ার দিকে বিভিন্ন কওমের অবস্থা বিবেচনা করে নিজ পয়গাম্বরদের মারফতে বিভিন্ন শরীয়াত প্রেরণ করেছিলেন , যাতে প্রত্যেক কওমকে আলাদা আলাদা করে সদাচরণ , সভ্যতা ও সচ্চরিত্রের শিক্ষা দিয়ে অভ্যস্ত করে এক বৃহ্ত্তর আইনের আনুগত্য করার জন্য তৈরী করে তোলা যায়। মানুষকে তৈরী করে তোলার একাজটি যখনসম্পূর্ণ হল তখন আল্লাহ তা’য়ালা হযরত মুহাম্মাদ (সা) কে পাঠালেন সেই বৃহত্তর বিধান দিয়ে, যার প্রত্যকটি ধারা তামাম দুনিয়ার জন্য প্রযোজ্য। এখন দ্বীন তো সেই একই থাকলো , যা পূর্ববর্তী নবীরা শিখিয়ে গেছেন , কিন্তু পূর্ববর্তী সব শরীয়াতই বাতিল হয়ে গেল। তার পরিবর্তে কায়েম হল এমন এক শরীয়াত, যাতে সকল মানুষের জন্য ইবাদাতের পদ্ধতি , সামাজিক রীতিনীতি পারস্পরিক আদান প্রদান সংক্রান্ত আইন- কানুন এবং হালাল হারামের সীমা সবই একসাথে বিধিবদ্ধকরা হয়েছে।

শরীয়াতের বিধান জানার মাধ্যম

শরীয়াতে মুহাম্মাদীর নীতি ও বিধান বুঝার জন্য আমাদের সামনে দু’টি মাধ্যম রয়েছে । প্রথম হচ্ছে কুরআন মাজীদ , আর দ্বিতীয় হাদীস। কুরআন মজীদ সম্পর্কে সকলেই জানেন যে , তা হচ্ছে আল্লাহর কালাম এবং তার প্রতিটি শব্দ আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। হাদীস বললে বুঝায় সেসব বর্ণনা, যা রাসূলে করীম (সা) থেকে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। রাসুলুল্লাহ (সা) এর সারা জীবনই ছিল কুরআনের ব্যাখ্যা । নবী হওয়ার সময় থেকে শুরু করে তেইশ বছর কাল তার জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত কেটেছে মানুষকে শিক্ষা ও পথ নির্দেশ (হেদায়াত ) দানের কাজে এবং আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জী অনুযায়ী জীবন যাপনের পদ্ধতি তিনি মানুষকে শিখিয়ে গেছেন তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে । তাঁর এ কর্মব্যস্ত জীবনে তাঁর সংগী নর- নারী ,তাঁর স্বজনগণ ও সহধর্মিনীগণ যত্ন সহকারে তাঁর প্রতিটি কথা শুনতেন, প্রতিটি কাজের উপর নযর রাখতেন এবং যে কোন সমস্যা তাদের সামনে হাযির হলে তাঁর কাছ থেকে শরীয়াতের বিধান সম্পর্কে নির্দেশ গ্রহণ করতেন। কখনো তিনি বলতেনঃ অমুক কাজ কর এবং অমুক কাজ কর না। যারা সেখানে হাযির থাকতেন তারা তাঁর নির্দেশ যত্ন সহকারে শিখে নিতেন। এমনি কখনো তিনি কোনকাজ এক বিশেষ পদ্ধতিতে করতেন। যারা দেখতেন তারা তা মনে করে রাখতেন এবং যারা দেখতেন না তাদেরকেও তারা বলে দিতেন যে, নবী করীম (সা) অমুক কাজ অমুক পদ্ধতিতে করেছেন। আবার কখনো কোন ব্যক্তি রাসূলে করীম (সা) এর সামনে কোন কাজ করতেন , তিনি হয় চুপ থাকতেন নয় তো তা অনুমোদন করতেন, অথবা নিষেধ করতেন। এ ধরনের কথাগুলো মানুষ সংরক্ষিত করে রেখেছে । এমনি যেসব কথা তাঁর সংগী নর -নারীদের কাছ থেকে মানুষ শুনছে, কেউ তা মুখস্থ করে রেখেছে আবার কেউ তা লিখে রেখেছে । এবং যার কাছ থেকে কথাটি তাদের কাছে এসেছে তার নামও স্মরণ রেখেছে । ক্রমে ক্রমে এসব বর্ণনা পুস্তককারে সংগৃহীত হয়েছে। এমনি করে এক বিরাট হাদীস সংগ্রহ গড়ে উঠেছে। এসব হাদীস সংগ্রাহকদের মধ্যে ইমাম মালিক (র) , ইমাম বুখারী (র) , ইমাম মুসলিম (র) , ইমাম তিরমিযী (র) , ইমাম আবু দাউদ (র) , ইমাম নাসায়ী (র) , ইমাম ইবনে মাজাহ (র) কর্তৃক সংগৃহীত হাদীসের কিতাবসমূহ অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বলে ধরে নেয়া হয়েছে।

ফিকাহ

কুরআন ও হাদীসের বিধান সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সাধারণ লোকদের সুবিধার জন্য আইনসমূহ বিস্তারিত ভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁদের লিখিত গ্রন্থরাজিকে বলা হয় ‘ফিকাহ’ । যেহেতু প্রত্যেক মানুষই কুরআন শরীফের সবগুলো সূক্ষ্ম তত্ত্ব বুঝে উঠতে পারেনা এবং প্রত্যকটি মানুষ হাদীস সংক্রান্ত বিদ্যায় এতটা পারদর্শী নয় , যাতে নিজেরা শরীয়াতের বিধান বুঝে নিতে পারে, তাই ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ বছরের পর বছর মেহনত করে , চিন্তা গবেষণা করে ‘ফিকাহ’ শাস্ত্র প্রণয়ন করেছেন। দুনিয়ার মুসলমান তাদের সে কল্যাণকর কার্যের প্রতিদান কখনো দিতে পারবে না। তাঁদের মেহনতের ফলে আজ কোটি কোটি মুসলমান কোনরূপ ক্লেশ স্বীকার না করে শরীয়াতের আনুগত্য করে যাচ্ছে এবং আল্লাহ ও রাসূলের বিধান উপলব্ধি করতে তাদের কোন অসুবিধাই হচ্ছেনা।

গোড়ার দিকে বহু ধর্মনেতা নিজ নিজ পদ্ধতিতে ‘ফিকাহ’ শাস্ত্র প্রণয়ন করে গেছেনঃ কিন্তু শেষ পর্যন্ত 'ফিকাহ' সংক্রান্ত চারিটি তরীকা দুনিয়ার স্বীকৃতি লাভ করছে এবং আজ দুনিয়ার মুসলমান সবচেয়ে বেশী করে তাঁদের আনুগত্য করে যাচ্ছেঃ

একঃ ইমাম আবু হানিফা(র) কর্তৃক রচিত ফিকাহ । এর রচনায় ইমাম আবু ইউসুফ (র) ইমাম মুহাম্মাদ (র) , ও ইমাম যুফার(র) প্রভৃতি কতিপয় বড় বড় ওলামার সহযোগিতা ছিল । একে হানাফী ফিকাহ বলা হয়।

দুইঃ ইমাম মালেক (র) কর্তৃক রচিত ফিকাহ । একে বলা হয় মালেকী ফিকাহ ।

তিনঃ ইমাম শাফেয়ী (র) কর্তৃক রচিত ফিকাহ । এর নামকরণ হয়েছে শাফেয়ী ফিকাহ ।

চারঃ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) কর্তৃক রচিত ফিকাহ । একে বলা হয় হাম্বলী ফিকাহ।

এ চার রকমের ফিকাহ হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) এর পর দু’শো বছরের মধ্যে রচিত হয়েছিল। তার মধ্যে যেটুকু পারস্পরিক বৈষম্য দেখা যায় , তা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। বিভিন্ন লোক যখন কোন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন অথবা তার তাৎপর্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন, তখন তাঁদের গবেষণা ও সবাই সত্যানুসন্ধিৎসু , সদুদ্দেশ্যপ্রনেদিত ও মুসলমানদের সত্যিকার কল্যাণকামী ধর্মনেতা ছিলেন , তাই সকল মুসলমান এ চার রকমের ফিকাহকেই সত্যশ্রিত বলে মেনে নিয়েছে।

অবশ্যি জেনে রাখা দরকার যে, একই ব্যাপারে মাত্র একই তরীকার আনুগত্য করা যেতে পারে; চার বিভিন্ন তরীকার আনুগত্য করা চলতে পারে না। এ কারণে বেশীর ভাগ ওলামার মত এই যে , মুসলমানদের এ চার তরীকার যে কোন একটির অনুগত্য করা প্রয়োজন। এ ছাড়া আর এক শ্রেণীর ওলামা বলে থাকেন যে , কোন বিশেষ ফিকাহর আনুগত্য করার প্রয়োজন নেই। আলেমদের আন্তরিকতা সহকারে কুরআন ও হাদীসের বিধান বুঝে নেয়া প্রয়োজন , আর যারা এলেমের অধিকারী নন, তাদের কর্তব্য হচ্ছে তাদের আস্থাভাজন কোন আলেমের আনুগত্য করা । এদেরকে বলা হয় আহলে হাদীস । এরা ও উপরিউক্ত চার শ্রেণীর মতই সত্যাশ্রয়ী।

তাসাউফ

ফিকাহর সম্পর্ক হচ্ছে মানুষের প্রকাশ্য কার্যকলাপের সাথে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই যে , আমাকে যেভাবে , যে পদ্ধতিতে কোন কাজ করার বিধান দেয়া হয়েছে , সঠিকভাবে তা করছি কিনা। যদি তা সঠিকভাবে পালন করে থাকি , তাহলে মনের অবস্থা কি ছিল, তা নিয়ে ফিকাহর কিছু বলার নেই। মনের অবস্থার সাথে যার সম্পর্ক সে জিনিসটিকে বলা হয় তাসাউফ। যেমন ,কেউ সালাত আদায় করছে সেখানে ফিকাহ কেবলমাত্র এতটুকুই দেখছে যে, সে ঠিক মত ওযু করল কিনা, কেবলার দিকে মুখ করে দাঁড়াল কিনা, সালাতের সবগুলো অপরিহার্য শর্ত পালন করল কিনা, সালাতের মধ্যে যা কিছু পড়তে হয় তা সে পড়লো কিনা এবং যে সময়ে যে কয় রাকায়াত সালাত নির্ধারিত রয়েছে, ঠিক সেই সময়ে তত রাকায়াত পড়ল কিনা। যখন এর সবগুলো শর্ত পালন করা হল ,তখন ফিকাহর দৃষ্টিতে তার সালাত পূর্ণ হয়ে গেল। কিন্তু এক্ষেত্রে তাসাউফ দেখে যে, এ ইবাদাত তার দিলের অবস্থা কি ছিল ? সে আল্লাহর দিকে নিবিষ্টচিত্ত ছিল কিনা ? তার দিল পার্র্থিব চিন্তা ভাবনা থেকে মুক্ত ছিল কিনা ? সালাত থেকে তার অন্তরে আল্লাহর ভীতি , তাঁর হাযির নাযির থাকা সম্পর্কে প্রত্যয় এবং একমাত্র তাঁরই সন্তোষ বিধানের আকাংখা পয়দা হয়েছিল কিনা? এ সালাত তার আত্মাকে কতটা পরিশুদ্ধ করেছে ? তার চরিত্র কতটা সংশোধন করেছে ? তাকে কতটা সত্য সাধক ও সৎকর্মশীল মুসলিম করে তুলেছে ? সালাতের সত্যিকার লক্ষের পথে যেসব বিষয়ের সম্পর্ক রয়েছে, একজন লোক তার যতটা পরিপূর্ণতা হাসিল করল , তাসাউফের দৃষ্টিতে সালাত ততটা বেশী পূর্ণতা লাভ করেছে। আর সে দিক দিয়ে যতটা দূর্বলতা থেকে যাবে , তারই জন্য তার সালাতকে ও ততটা দুর্বল ধরা হবে। এমনি করে শরীয়াতের যেসব বিধি- বিধান রয়েছে , তার সবকিছুকেই ফিকাহ কেবল এতটুকুই দেখে যে , যে হুকুম যেভাবে পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেই হুকুম ঠিক সেই পদ্ধতিতে পালন করা হল কিনা । অন্যদিকে তাছাউফ দেখে সেই হুকুম পালনের ব্যাপারে তার মধ্যে কতটা আন্তরিকতা , সৎসংকল্প ও সত্যিকার আনুগত্যের মনোভাব বর্তমান ছিল।

একটি দৃষ্টান্ত থেকে এ দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারা যায়। যখন কোন বিশেষ ব্যক্তি কারো সাথে সাক্ষাত করে তখন সে দু’টি দৃষ্টিভংগিতে তার প্রতি নযর করে। এক হচ্ছেঃ লোকটি পূর্ণাংগ ও স্বাস্থ্যবান কিনা ;অন্ধ , কানা , খোড়া তো নয়। লোকটি শুশ্রী বা কুশ্রী ; তার পরিধান ভালকাপড় চোপড় , না ময়লা জীর্ণ কাপড় , দ্বিতীয় হচ্ছেঃ তার চরিত্র কি ধরনের , তার স্বভাব ও অভ্যাস কিরূপ , তার জ্ঞান-বুদ্ধি কি প্রকারের। সে আলেম না জাহেল , সৎ না অসৎ । এর মধ্যে প্রথম নযরটি হচ্ছে ফিকাহর নযর , আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাছাউফের নযর। বুন্ধুত্বের জন্য যখন কোন লোককে কেউ পসন্দ করতে চেষ্টা করবে, তখন তারা ব্যক্তিত্বের দু’টি দিক যাচাই করে দেখতে হবে। তার ভেতর ও বাইরের দু’টি দিকই সুন্দর হোক এ হবে তার আকাংখা । এমনি করে ইসলামের যে বাঞ্ছিত জীবনের পরিপকল্পনা করা হয়েছে , তাতে বাইরের ও ভিতরের উভয়বিধ বিশ্বাসের দিক দিয়ে শরীয়াতের বিধি বিধানের আনুগত্য করতে হবে। কোন ব্যক্তির বাইরের আনুগত্য আছে অথচ অন্তরের আনুগত্যের প্রাণবস্তু নেই। তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে সুন্দর চেহারার মৃত ব্যক্তির মত। আবার যে ব্যক্তির কার্যকলাপে যাবতীয় সৌন্দর্য মওজুদ রয়েছে অথচ বাইরের আনুগত্য সঠিকভাবে করা হচ্ছেনা, তার তুলনা চলে ঐ ব্যক্তির সাথে , যে অত্যন্ত শরীফ ও সৎকর্মশীল অথচ শারীরিক দিক দিয়ে কুশ্রী ও বিকলাংগ।

এ দৃষ্টান্ত থেকে ফিকাহ ও তাসাউফের পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝতে পারাযায়। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় , পরবর্তী যামানায় যেখানে জ্ঞান ও চরিত্রের বিকৃতি হেতু বহুবিধ অনাচার জন্ম লাভ করেছে সেখানে তাসাউফের পবিত্র রূপকেও বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। বিভ্রান্ত জাতিসমূহের কাজ থেকে ইসলাম বিরোধী দর্শনের শিক্ষা লাভ করে মানুষ তাকে তাসাইফের নামে ইসলামের মধ্যে দাখিল করে নিয়েছে। কুরআন ও হাদীসে যার অস্তিত্ব নেই , এমনি বহু বিচিত্র ধরনের বিশ্বাস ও কর্মপদ্ধতি তারা তাসাউফের নামে চালিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের লোকের ধীরে ধীরে নিজেদের শরীয়াতের আনুগত্য থেকে মুক্ত করে নিয়েছে। তাঁদের মতে তাসাউফের সাথে শরীয়াতের কোন সম্পর্ক নেই। এখানে আর ভিন্নতর জগত বিরাজ করছে। সুফীদের আইন ও নিয়ম পদ্ধতির আনুগত্য করার প্রয়োজন কি ? জাহেল সুফীরাই এ ধরনের মত পোষণ করে থাকে ; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্তিপ্রসূত । শরীয়াতের বিধি -বিধানের সাথে সম্পর্ক থাকবেনা , ইসলামে এমন কোন তাসাউফের স্থান নেই। কোন সুফীরই সালাত ,সওম, হজ্জ ও যাকাতের আনুগত্য থেকে মুক্তি লাভের অধিকার নেই। সমাজ জীবন নৈতিক দায়িত্ব , চরিত্র , পারস্পরিক আদান-প্রদান , অধিকার কর্তব্য ও হালাল-হারামের সীমানা সম্পর্কে আল্লাহ ও রাসূল যে নির্দেশ দিয়েছেন কোন সুফীরই সেই নিয়মের বিরোধী কার্যকলাপের অধিকার নেই। যে ব্যক্তি সঠিকভাবে রাসূলুল্লাহ (স্) এর আনুগত্য করে না এবং তাঁর নির্ধারিত কর্মপদ্ধতির অনুসরণ করেনা, মুসলিম সুফী বলে পরিচয় দেয়ার যোগ্য সে নয়। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাঁর রাসূলের প্রতি সত্যিকার প্রেমই হচ্ছে তাসাউফ এবং প্রেমের দাবী হচ্ছে এই যে , কেউ যেন আল্লাহর বিধান ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত না হয়। ইসলামী তাসাউফ শরীয়াত থেকে স্বতন্ত্র কিছু নয়; বরং শরীয়াতের বিধানসমূহকে সর্বাধিক আন্তরিকতা ও সৎসংকল্প সহকারে পালন করা এবং অন্তরের ভিতরে আল্লাহর প্রেম ও ভীতির সঞ্চার করার নামই হচ্ছে তাসাউফ।

শরীয়াতের বিধি -বিধান

এ সর্বশেষ অধ্যায়ে আমি শরীয়াতের নীতি ও বিশেষ বিশেষ বিধান সমূহের কথা বলব। তা থেকে বুঝতে পারা যাবে, ইসলামী শরীয়াত কিভাবে মানুষের মনকে সুষ্ঠু সুন্দর বিধানের অনুগত করে দেয় এবং সে বিধানগুলো কতটা জ্ঞানগর্ভ।

শরীয়াতের নীতি

প্রত্যেকেই নিজের অবস্থা সম্পর্কেই চিন্তা করলে বুঝতে পারে যে , সে বহুবিধ শক্তি নিয়ে দুনিয়ায় এসেছে এবং তার ভিতরের প্রতিটি শক্তির দাবী হচ্ছে এই যে , সে তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাবে। তাদের মধ্যে বুদ্ধি বৃত্তি , ইচ্ছা , আকাংখা বাকশক্তি , দৃষ্টিশক্তি , শ্রবণশক্তি , রসাস্বাদন ক্ষমতা , হাত -পা পরিচালনার ক্ষমতা , ঘৃণা ও ক্রোধ , প্রীতি ও আকর্ষণ ,ভীতি ও প্রলোভন রয়েছে কিন্তু এর কিছুই নিরর্থক নয়। তাদের প্রয়োজনের চাহিদা মেটাবার জন্য এসব জিনিস দেয়া হয়েছে । আল্লাহ দুনিয়ার মানুষকে যেসব শক্তিদান করেছেন , মানুষ সঠিকভাবে তার সদ্ব্যবহার করলে তার উপর নির্ভর করবে তাদের দুনিয়ার জীবন ও তার সাফল্য।

আরো দেখতে পাওয়া যাবে যেসব শক্তি মানুষের মধ্যে দেয়া হয়েছে সেই সংগে তা কাজে লাগাবার মাধ্যমও দেয়া হয়েছে । সবার আগে রয়েছে মানুষের দেহ ; তার মধ্যে জরুরী যন্ত্রপাতি সবই মওজুদ রয়েছে। তারপর পারিপার্শ্বিক দুনিয়া যাতে প্রত্যেক ধরনের সংখ্যাতীত মাধ্যম আগে থেকেই তৈরী হয়ে আছে। মানুষের সাহায্যের জন্য রয়েছে তার একই জাতীয় মানুষ । তার খেদমতের জন্য রয়েছে জানোয়ার , গাছপালা , খনিজ দ্রব্য , যমীন -পানি , হাওয়া , তাপ আলো, আরো এমন সংখ্যাতীত জিনিস। আল্লাহ এসব কিছু পয়দা করেছেন এ জন্য যে মানুষ তাদেরকে কাজে লাগাবে এবং জীবনযাপন করার জন্য তাদের থেকে সাহায্য গ্রহণ করবে।

এবার আর একটি দিক বিবেচনা করা যাক। যেসব শক্তি মানুষকে দেয়া হয়েছে তাদের কল্যানের জন্য দেয়া হয়েছে, ক্ষতির জন্য নয় । তা কাজে লাগাবার সঠিক পন্থা হবে , তাই ,যাতে কেবল কল্যাণই লাভ হবে, কোন ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে না। অথবা ক্ষতি হলেও তা যথাসম্ভব কম হবে। যুক্তি অনুসারে অন্যবিধ পন্থায় তা ব্যবহার করলে ভুল হবে। কেউ নিজে যদি এমন কোন কাজ করে যাতে তার নিজেরই ক্ষতি হয় , তা হলে অবশ্যি ভুল। যদি কেউ তার নিজস্ব শক্তিকে এমনভাবে কাজে লাগায়, যাতে অপরের ক্ষতি হয় , তা হলে তা হবে ভুল। কোন শক্তি অপব্যবহার করে যদি কেউ আল্লাহর দেয়া উপায়- উপাদানের অপচয় করে, তবে তাতেও ভুল করা হবে। প্রত্যেকেই যুক্তি ক্ষমতা এ সাক্ষ্যই দেবে যে , সকল প্রকার ক্ষতিকে এড়িয়ে চলতে হবে এবং তা স্বীকার করতে হবে তখনই, যখন তাকে এড়িয়ে চলা কোন ক্রমেই সম্ভব হয়না অথবা তার পরিণাম কোন বৃহত্তর কল্যাণের সম্ভাবনা থাকে।
এরপর আরো সামনে এগিয়ে চলা যাক । দুনিয়ায় দু’রকমের লোক দেখা যায়। এক ধরনের লোক ইচ্ছা করে তাদের কোন কোন শক্তিকে এমনভাবে কাজে লাগায়, যাতে সেই শক্তি তাদের নিজেদের অন্য কোন শক্তির ক্ষতিসাধন করে বা অন্যেরা তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথবা তাদেরকে দেয়া উপায় -উপাদানের অপব্যবহার করে; অথচ সেইসব জিনিস তাদেরকে দেয়া হয়েছিল নিছক কল্যাণের জন্য অপচয়ের জন্য নয়। অপর শ্রেণীর লোকেরা ইচ্ছা করে তেমন করে না, কিন্তু তাদের অজ্ঞতা বশত ভুল হয়ে যায়। প্রথমোক্ত দলের লোকরা হচ্ছে দুস্কৃতিকারী এবং তাদেরকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য প্রয়োজন হয় আইন ও বিধানের । অপর যে শ্রেণীর লোক আজ্ঞতা হেতু ভুল করে, তাদের জন্য প্রয়োজন এমন শিক্ষা ব্যবস্থা , যাতে তারা নিজস্ব শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাবার নির্ভুল পন্থা উপলব্ধি করতে পারে।

আল্লাহ তা’য়ালা যে শরীয়াত তার পয়গাম্বরের মারফতে প্রেরণ করেছেন , তাতে এ প্রয়োজন মিটানো হয়েছে । দুনিয়ার মানুষের কোন ক্ষমতাকে বিনষ্ট করার , কোন স্বাভাবিক আকাংখাকে দমিত করার অথবা মানুষের অনুভুতি ও আবেগকে নিশ্চিহ্ন করার কোন উদ্দেশ্যই তাতে নেই। শরীয়াত মানুষকে কখনো বলে নাঃ দুনিয়াকে বর্জন কর ,উপবাস ও বিবস্র হয়ে পাহাড়ে জংগলে জীবন অতিবাহন কর , আত্মার দাবী অস্বীকার করে নিজেকে কষ্ট সাধনায় নিক্ষেপ কর, জীবনের সকল স্বাচ্ছন্দ্য --সকল সুখকে নিজের জন্য হারাম করে দাও । শরীয়াত কখনো এ শিক্ষা দেয় না । এ হচ্ছে আল্লাহর তৈরী শরীয়াত এবং আল্লাহই এ দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন মানুষের স্বাচ্ছন্দের জন্য । কি করে তাঁর কারখানা ধ্বংস করে দিতে চাবেন ? মানুষের ভিতরে কোন শক্তিই তিনি নিরর্থক -- অপ্রয়োজনে দান করেননি। কোন কাজে লাগানো যাবেনা এমন জিনিস তিনি যমীন আসমানে কোথাও তৈরী করেননি। তিনি তো এ-ই চান যে , দুনিয়ার এ কারখানা পূর্ণ উদ্যমে চলতে থাকবে , মানুষ তার প্রত্যেকটি শক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগাবে ; দুনিয়ার প্রত্যেক জিনিস থেকে পূর্ণ কল্যাণ লাভ করবে এবং যমীন আসমানের যত রকম উপায় -উপকরণ নির্ধারিত হয়ে আছে ,তার সবকিছুকে সে সঠিকভাবে ব্যবহার করবে ; উপরোক্ত এধরনের অজ্ঞতা ও দুস্কৃতি দ্বারা তারা নিজেদের ও অপরের ক্ষতি সাধন করবে না।

আল্লাহ শরীয়াতে সকল বিধান ও তৈরী করে দিয়েছেন এ উদ্দেশ্যে । যা কিছু মানুষের জন্য অকল্যাণকর শরীয়াতে সেগুলো হচ্ছে হারাম (নিষিদ্ধ)আর যা কিছু কল্যাণকর , তা হচ্ছে তালাল (বৈধ), যে কাজ করে মানুষ নিজের বা অপরের ক্ষতি সাধন করে শরীয়াতে তা নিষিদ্ধ। তার পক্ষে যা কিছু কল্যাণকর এবং যাতে অপরের কোন ক্ষতি নেই, এমনি সবকিছু করার অনুমতি দেয়া হয়েছে শরীয়াতে । তার সকল আইন এ নীতির উপর তৈরী হয়েছে , যাতে দুনিয়ার মানুষ তার সকল আকাংখা ও প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে এবং নিজস্ব কল্যাণ সাধনের জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টার অধিকার লাভ করে ; উপরন্তু এ অধিকার থেকে তাকে এমনভাবে কল্যাণ লাভ করতে হবে যাতে অজ্ঞতা বা দুস্কৃতি হেতু সে অপরের অধিকার বিনষ্ট না করে। অধিকন্তু যতটা সম্ভব তাকে অপরের সাহায্য ও সহযোগিতা করতে হবে। যেসব কাজে একদিকে কল্যাণ ও অপর দিকে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে শরীয়াতের নীতি হচ্ছে বৃহত্তর কল্যাণের জন্য ক্ষুদ্রতর ক্ষতিকে স্বীকার করে নেয়া এবং বৃহত্তর ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য ক্ষুদ্রতর কল্যাণকে বিসর্জন দেয়া।

যেহেতু কোন জিনিস বা কোন কাজ কতটা কল্যাণকর বা অকল্যাণকর সেই সম্পর্কে প্রত্যেক যুগের প্রত্যেকটি মানুষ সমভাবে অবগত হতে পারে না, তাই সৃষ্টির সকল রহস্য জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ মানুষের পরিপূর্ণ জীবনের জন্য দিয়েছেন এক নির্ভুল বিধান। এখান থেকে বহু শতাব্দী আগে এ বিধানের বহুবিধ কল্যাণকর দিক মানুষের উপলব্ধির সীমানায় আসেনি ; কিন্তু বর্তমানের শিক্ষার ক্রমোন্নতি সেই সব রহস্যকে অবগুন্ঠন মুক্ত করেছে। তার বহুবিধ কল্যাণকর দিক মানুষ এখনও বুঝে উঠতে পারছেনা; কিন্তু যতই জ্ঞানের ক্রমোন্নতি হতে থাকবে, ততই সেই রহস্য মানুষের কাছে প্রকাশ হতে থাকবে। যারা নিজস্ব দুর্বল ও অপরিণত জ্ঞান বুদ্ধির উপর নির্ভর করে থাকে , তাঁরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভুল ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত থাকার পর শেষ পর্যন্ত এ শরীয়াতের কোন না কোন বিধানকে মেনে নিতে বাধ্য হয় ; কিন্তু যারা আল্লাহর রাসূলের উপর নির্ভর করেছে , তারা জাহেরী ও অজ্ঞতার অনিষ্ট থেকে রেহাই পেয়েছে , কেননা তার কল্যানকর দিক সম্পর্কে তার জ্ঞান থাক অথবা না -ই থাক , সকল অবস্থায়ই তারা আল্লাহর রাসূলের প্রতি বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে সঠিক ও নির্ভুল জ্ঞানের ভিত্তিতে রচিত আইনের আনুগত্য করেছে।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম