অধ্যায় ০৩ : অমুসলিম মাতা-পিতার প্রতি আচরণ

সন্তানের ইসলাম গ্রহণ করার পরও যদি মাতা-পিতা কুফর ও শিরকের পংকিলতায় নিমজ্জিত থাকে এবং তাকে কুফরীতে ফিরে আসতে বাধ্য করে, তবে কোনক্রমেই তাদের কথা মানা ও তাদের আনুগত্য করা যাবে না। কেননা আল্লাহর নাফরামানীমূলক কাজে কোন মানুষের আনুগত্য করা হালাল নয়। তবে অবশ্যই মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার ও সদাচারণ করে যেতে হবে।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :
মাতা-পিতা যদি আমার কাউকে শরীক করার জন্য তোমার ওপর চাপ প্রয়োগ করে যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই- তাহলে অবশ্যই তাদের আনুগত্য করবে না এবং দুনিয়ার জীবনে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহবস্থান করবে। আর তাদের আনুগত্য করবে যারা আমার দিক প্রত্যাবর্তনকারী।১: সূরা লুকমান : ১৫।

মাতা-পিতা সন্তানকে কুফরী করার জন্য যত কঠিন চাপ প্রয়োগ করুক না কেন, তাদের কথা মানা ও তাদের আনুগত্য করা যাবে না। তবে তাদের সাথে অবশ্যই সদ্ব্যবহার ও সুন্দর আচরণ করে যেতে হবে।
আবু বকর (রা) এর কন্যা আসমা (রা) বলেন, রাসূল (সা) এর যুগে আমার মা মুশরিক অবস্থায় আমার নিকট এসেছিলেন। আমি রাসূল (সা) এর নিকট আরয করলাম, আমার নিকট আমার মা এসেছেন, তিনি ইসলাম থেকে বিমুখ রয়েছেন। আমি কি তাঁর সাথে সদ্ব্যবহার করব? তিনি বললেন ; হ্যাঁ মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করো।২ : সহীহ আল বুখারী, ২খ পৃ. ৮৮৪; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল যাকাত ২ খ. পৃ. ৬৯৬।

হযরত আবূ হুরাইরা (রা) মুসলমান হওয়ার পরও দীর্ঘদিন যাবত তাঁর মা শিরকে নিমজ্জিত ছিলেন। তিনি মাকে সর্বদা শিরকের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করতেন এবং ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিতেন। আর তাঁর মাও সর্বদা অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। তা সত্বেও আবূ হুরাইরা গ্রহণ করার দাওয়াত দিতাম। একদিন আমি তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি রাসূল (সা)

সম্পর্কে আমাকে এমন কিছু কথা শুনালেন, যাতে আমার অন্তর বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। আমি ক্রন্দনরত অবস্থায় রাসুলের খেদমতে হাযির হয়ে আরয করলাম, হে আল্লাহ রাসূল! আমি সব সময় আমার মাকে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকি, তিনি সব সময় তা অস্বীকার করতে থাকেন। আজ আমি তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি রাগান্বিত হয়ে আপনার শানে বেয়াদবী করে বসেন এবং আপনাকে গালমন্দ করেন। আমি তা সহ্য করতে পারিনি। আপনি আল্লাহর দরবারে দুআ করুন, যেন তিনি আবূ হুরাইরার মাকে হেদায়াত নসীব করেন। রাসূল (সা) দুআ করলেন :হে আল্লাহ! আপনি আবূ হুরাইরার মাকে হেদায়াত করুন। আমি নবী (সা) এর দুআর সুসংবাদ নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমি বাড়ী পৌঁছে দেখি ঘরের দরজা বন্ধ। তিনি আমার পায়ের শব্দ শুনে ভেতরে থেকে বললেন, আবূ হুরাইরা, অপেক্ষা করো । আমি পানি পড়ার শব্দ শুনে ভেতর থেকে বললেন, আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, তিনি তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে দোপাট্টা পরিধান করে উড়না পরা ছাড়াই দরজা খুলে দিলেন। অত:পর বললেন; আবূ হুরাইরা! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর বান্দা ও আল্লাহর রাসূল (সা)। আমি আনন্দে ক্রন্দনরত অবস্থায় রাসূল (সা) এর খেদমতে হাযির হয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল আমি আপনাকে সুসংবাদ শুনাতে এসেছি। আল্লাহ তাআলা আপনার দুআ কবুল করেছেন। তিনি আবূ হুরাইরার মাকে হেদায়াত নসীব করেছেন। একথা শুনে তিনি খুশী হলেন এবং আল্লাহ প্রশংসা ও গুনগান করলেন এবং আমাকে নসীহত করলেন।

এরপর আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি দুআ করুন যেন আল্লাহ আমাকে ও আমার মাকে সকল মুমিনের প্রিয় বানিয়ে দেন। রাসূলল্লাহ (সা) দুআ করলেন : ইয়া আল্লাহ! আবূ হুরাইরা ও তার মায়ের প্রতি ভালোবাসা সকল মুমিনের অন্তরে সৃষ্টি করে দিন। এ দুআর পর সে মুসলমানই আমাকে দেখেছে অথবা আমার কথা শুনেছে সেই আমাকে ভালোবেসেছ।১ : সহীহ মুসলিম, ফাযায়িল অধ্যায়, অনু: আবু হুরাইরা (রা) এর ফযীলত। হাদীস নং ২৪৯১।


দুধ মায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন

হযরত আবূ তুফায়েল (রা) বলেন, আমি দেখলাম, নবী (সা) জিয়রানা নামক স্থানে গোশত বন্টন করেছিলেন। এমন সময় একজন মহিলা এসে সরাসরি নবী (সা) এর নিকটে চলে গেলেন। তিনি তাঁর জন্য নিজের চাদর বিছিয়ে দিলেন। অত:পর ভদ্র মহিলাটি তার ওপর আসন গ্রহণ করলেন। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি লোকদের কাছে জানতে চাইলাম, ইনি কে? তারা বললেন, ইনি হচ্ছেন রাসূল (সা) এর দুধ মা-হযরত হালীমা সাদিয়া (সা)। তিনি তাঁকে দুধ পান করিয়েছিলেন। (১। আবূ দাউদ, ৪ খ, পৃ. ৩৩৭।)


পিতার আনুগত্য

হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) বলেন, আমার বিবাহ বন্ধনে এমন একজন মহিলা ছিল যাকে আমি ভালোবাসতাম। অথচ আমার পিতা উমার (রা) তাকে অপছন্দ করতেন। একদিন তিনি আমাকে বললেন, তুমি তাকে তালাক দাও। আমি তালাক দিতে অস্বীকার করলে উমার (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) কে বিষয়টি অবহিত করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে বললেন : তাকে তালাক দাও এবং তোমার পিতার আনুগত্য করো। আমি তাকে তালাক দিলাম।২ : আবূ দাউদ, আদব, অনু: বিররুল ওয়ালিদাইন, ৪ খ, পৃ. ৩৩৫; আল মুস্তাদরাক, কিতাবুল বির ওয়াস সিলা, ৪ খ, পৃ. ১৫২।

একব্যক্তি হযরত আবু দারদা (সা) এর নিকট এসে বলল, আমার পিতা আমাকে অনেক পীড়াপীড়ি করে বিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনি আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আমার সে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার জন্য। আবু দারদা (সা) বলেন, আমি তোমাকে এ কথা বলতে পারবো না যে, তুমি তোমার পিতা-মাতার নাফরমানী করো এবং এ কথাও বলব না যে, তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দাও। তবে তুমি চাইলে আমি তোমাকে একটি হাদীস শুনাব যা আমি রাসূল (সা) এর কাছে থেকে শুনেছি। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, পিতা জান্নাতের শ্রেষ্ঠ দরজা, তুমি যদি চাও, তাহলে একটাকে ভেঙ্গে ফেলতে পারো। < আত-তারগীব ওয়াত তাবহীব, ৩ খ, পৃ. ৩১৬-৩১৭; ফাতহুর রব্বানী; ১৯ খ, পৃ. ৩৮>

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম