অধ্যায় ০২ : মায়ের সাথে সন্তানের আচরণের একটি চিত্র

মাতার অধিকার পিতার তিন গুণ

আল্লাহ তাআলা বলেন: আমি মানুষকে মাতা-পিতার সাথে সুন্দর আচরণের তাকীদ দিয়েছি। তার মা অনেক কষ্টে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে এবং বহু কষ্ট করে ভুমিষ্ঠ করেছে। গর্ভে ধারণ করা ও দুধ পান করানোর (কঠিন কাজের সময়কাল হলো আড়াই বছর)।১

তিনি আরো বলেন : আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট স্বীকার করে গর্ভে ধারণ করেছে। আর দুধ ছড়ানো হয় দুবছরের মধ্যে। এ নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।২

আবু হুরাইরা (রা) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (সা) এর দরবারে হাযির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা) আমার সুন্দর আচরণের সবচাইতে বেশী হকদার কে? তিনি বললেন: তোমার মা। সে জিজ্ঞেস করলো, এর পর কে? তিনি বললেন; তোমার মা। সে জিজ্ঞেস করলো, এরপর কে? তিনি বললেন: তোমার মা। সে পুনারায় জিজ্ঞেস করলো, তারপর কে? তিনি বললেন : তোমার পিতা।৩

বাহয ইবন হাকীম তাঁর পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি কার সাথে সবচাইতে বেশী ভাল ব্যবহার করব? তিনি বললেন: তোমার মায়ের সাথে। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কার সাথে? তিনি বললেন : তোমার মায়ের সাথে। তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন : তারপর কার সাথে? এবারও তিনি বললেন :তোমার মায়ের সাথে। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম তারপর কার সাথে? তিনি বললেন : তোমার পিতার সাথে। অত:পর পর্যায়ক্রমে নিকটতম আত্মীয়-স্বজনের সাথে।৪
মিকদাম ইবন মাদিকারাবে (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তোমাদের মায়েদের

সম্পর্কে তোমাদের উপদেশ দিচ্ছেন। অর্থাৎ তাদের সাথে সদাচারণ করার আদেশ দিচ্ছেন। একথা তিনি তিনবার বললেন। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের পিতাদের সম্পর্কে তোমাদের উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয় আল্লাহ পর্যায়ক্রমে নিকটবর্তীদের সম্পর্কে তোমাদের উপদেশ দিচ্ছেন। (সদাচারের)।১

আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন. জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি বললেন: তোমার মাতা-পিতা কি বেঁচে আছে? লোকটি বললো, হ্যাঁ, বেঁচে আছেন। তিনি বললেন :তাদের মাঝে জিহাদ করো।২

অর্থাৎ তাদের সেবা-যত্ন ও খেদমতে আত্মনিয়োগ কর। এটাই তোমার জিহাদ।

হযরত আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছি, হে আল্লাহর রাসূল! মহিলাদের ওপর সবচাইতে বেশী অধিকার কার? তিনি বললেন, তার স্বামীর। আমি বললাম, পুরুষের ওপর সবচাইতে বেশী অধিকার কার? তিনি বললেন তার মায়ের।৩



মায়ের সাথে সন্তানের আচরণের একটি চিত্র

সর্বাধিক প্রিয় আমল

হযরত ইবন আব্বাস (রা) বলেন, আল্লাহ তাআলার নিকট মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করার চাইতে অধিক প্রিয় আর কোন আমল হতে পারে তা আমার জানা নেই।

হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, কিছু দিন আবূ হুরায়রা (রা) এর মা এক বাড়ীতে এবং আবূ হুরাইরা (রা) অল্প দূরে ভিন্ন এক বাড়ীতে বসবাস করতেন। আবূ হুরাইরা (রা) যখনই বাইরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা করতেন তখন মায়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলতেন, ইয়া আম্মাজান! আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া রাহমাতুল্লাহ। তাঁর মা ভিতর থেকে বলতেন,

প্রিয় পুত্র! ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া রাহমাতুল্লাহ। অতপর হযরত আবূ হুরাইরা (রা) বলতেন, আম্মাজান, শৈশবকালে যেভাবে আপনি স্নেহ ও মায়া মমতাসহকারে আমাকে লালন-পালন করেছিলেন। তেমনিভাবে যেন আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি রহম করেন। জবাবে তিনি বলতেন, প্রিয় পুত্র! এ বৃদ্ধ বয়সে তুমি আমার সাথে যেমন সুন্দর ও সদাররণ করছো তেমনি আল্লাহ ও যেন তোমার প্রতি রহমত বর্ষণ করেন। ১

মাতা-পিতার জন্য অর্থ ব্যয় :

যেভাবে সন্তানের ওপর মাতা-পিতার অধিকার রয়েছে তেমনিভাবে সন্তানের সম্পদের ওপরও তাদের অধিকার রয়েছে।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন: (হে নবী) লোকেরা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, আমরা কি ব্যয় করবো। আপনি তাদেরকে বলে দিন, যে মালই তোমরা ব্যয় করো না কেন? তার প্রথম হকদার হলো তোমার মাতা-পিতা। ২
এক ব্যক্তি রাসূল (সা) এর নিকট স্বীয় পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বললো, তিনি যখনই ইচ্ছা করেন আমার সম্পদ নিয়ে নেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তার পিতাকে ডাকলেন। লাঠি ভর করে এক দুর্বল বৃদ্ধ হাযির হলেন। তিনি বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। বৃদ্ধালোকটি জবাব দিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এক সময় আমার এ ছেলে দুর্বল, অসহায় ও কার্পদহীন ছিল। আমি তখন ছিলাম শক্তিশালী ও বিত্তশালী ও বিত্তশালী। আমি কখনো তাকে আমার সম্পদ নিতে বাধা দেইনি। আজ আমি দুর্বল ও কাপর্দকহীন, সে শক্তিশালী ও বিত্তশালী। এখন সে তার সম্পদ আমাকে দেয় না। একথা শুনে রাসূল (সা) বললেন : তুমি এবং তোমার সম্পদ তোমার পিতার। ৩
মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করা সম্পর্কে হাসান বসরী (রা) কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন : তোমার মালিকানাধীন সম্পদ তাঁদের প্রয়োজন মাফিক ব্যয় করবে। তাঁরা যা আদেশ করেন তা যদি গুনার কাজ না হয়, তবে তা মেনে চলবে।৪



মাতা-পিতার বদলা

হযরত আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেছেন, কোন সন্তান পিতার স্নেহ-ভালবাসা, লালন-পালন এবং কষ্টের হক আদায় করতে বা তার বদলা দিতে সক্ষম নয়। তবে সে যদি তাঁকে কারো দাসরূপে পায়, অতপর তাঁকে খরীদ করে মুক্ত করে দেয়, তাহলে কিছু হক আদায় হয়।১

আবূ মূসা আশআরী (রা) থেকে বর্ণিত, একবার আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) দেখলেন, জনৈক ইয়ামেনী স্বীয় মাতাকে পিঠে বসিয়ে কাবা শরীফ তাওয়াফ করছিল এবং আবেগের সাথে এ কবিতা আবৃত্তি করছিল-

আমি তাঁর নিতান্ত অনুগত সাওয়ারী উট
যখন তাঁর সাওয়ারী ভয়ে ভাগে তখন আমি দেইনা ছুট।

অতপর সে হযরত আবদুল্লাহ (রা) কে দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি মনে করেন, আমি আমার মায়ের বদলা দিয়েছি? ইবন উমার (রা) বললেন, মায়ের বদলা! এটা তো তাঁর এক আহ শব্দের বদলাও হয়নি।২

একবার এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) এর খেদমতে হাযির হয়ে অভিযোগ করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা বদ-মেজাজী মানুষ। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : যখন তোমাকে গর্ভে ধারণা করে একাধারে নমাস সীমাহীন কষ্ট সহ্য করেছেন, তখন তো তিনি খারাপ মেজাযের ছিলেন না? লোকটি বলল, হযরত আমি সত্য বলছি, তিনি বদ-মেজাজী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন :তোমার খাতিরে তিনি যখন রাতের পর রাত জাগতেন, তোমাকে দুধ পান করাতেন, তখন সে তো তিনি বদ-মেজাযী ছিলেন না। লোকটি বলল, আমি আমার মায়ের সে সব কাজের প্রতিদান দিয়ে ফেলেছি। নবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কি সত্যিই প্রতিদান দিয়ে ফেলেছো? সে বলল, আমি মাকে আমার কাঁধে চড়িয়ে হজ্জ করিয়েছি। নবী (সা) বললেন : তুমি কি তাঁর সেই কষ্টের বদলা দিতে পারো, যা তোমার ভূমিকা হওয়ার সময় তিনি সহ্য করেছেন। ৩

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম