অধ্যায় ০৫ : মাতা-পিতার নাফরমানী

মাতা-পিতার নাফরমানী

আল্লাহ তাআলা বলেন : তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উহ শব্দটি বলবে না এবং তাদেরকে ভৎসনা করবে না। বরং তাদের সাথে সম্মান ও শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলবে এবং বিনয় ও নম্রতসহকারে তাদের সামনে নত হয়ে থাকবে। আর এ দুআ করতে থাকবে : হে আমার প্রতিপালক। তাঁদের উভয়ের প্রতি রহম করো, যেমন তাঁরা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।১

ব্যাখ্যা : মাতা-পিতার সেবযত্ন ও আনুগত্য করা এবং সবসময়ই তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করা ওয়াজিব। তবে মাতা-পিতা বার্ধক্যে উপনীত হলে তাঁরা সন্তানের সেবা-যত্নের প্রতি অধিক মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন এবং সন্তানের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। অপরদিকে বার্ধক্যের চাপে মানুষের মেজায রুক্ষ ও খিটখিটে হয়ে যায়। এবং বিবেক বুদ্ধিও কম-বেশী লোপ পায়। ফলে তাঁরা অবুঝ শিশুর মতো দাবী দাওয়া পেশ করতে থাকে, যা পূরণ করা সন্তানের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। তখন সন্তানের পক্ষ থেকে সামান্য বিমুখতাও তাঁদের অন্তরকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। পবিত্র কুরআন এসব অবস্থায় মাতা-পিতার সন্তুষ্টি ও তাঁদের সুখ-শান্তি বিধানের আদেশ দেয়ার সাথে সন্তানকে তার শৈশবকাল স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, আজ মাতা-পিতা যতটুকু তোমার মুখাপেক্ষী, এক সময় তুমি তাঁদের এর চাইতেও বেশী মুখাপেক্ষী ছিলো। তখন তাঁরা যেমন অন্তরকে আরাম-আয়েশ হারাম করে তোমার চাওয়া-পাওয়া ও বাহানা পূরণ করেছিলেন, তোমার অবুঝ কথাবার্তাকে স্নেহ মমতার আবরণ দ্বারা ঢেকে নিয়েছিলেন, তেমনি তাঁদের মুখাপেক্ষিতা ও অসহায়ত্বের দু:সময়ে তাঁদের অবদানের কথা স্মরণ করে ঋণ পরিশোধ করা ও তাঁদের সেবা-যত্ন করা এবং তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করা তোমাদের অপরিহার্য কর্তব্য।
--------------------------------------------------------------------------------------------

আলোচ্য আয়াতসমূহে মাতা-পিতার বার্ধক্যে উপনীত হওয়া সম্পর্কিত কতিপয় আদেশ দান করা হয়েছে।

এক: তাঁদেরকে উহ শব্দটিও বলবে না। অর্থাৎ তাঁদের কথা শুনে সামান্যতম বিরক্তি প্রকাশ পায়, এমন ধরনের কোন শব্দ উচ্চারণ করবে না। তাঁদের কথা যতই অযৌক্তিক ও কর্কশ হোক না কেন।

দুই: মাতা-পিতার মর্যদার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কথা-বার্তা বলার সময় তাদের মান-সম্মানের প্রতি খেয়াল রেখে কথা বলতে হবে। তাঁদের অযৌক্তিক দাবী ও রুক্ষ মেজায হাসিমুখে সইতে হবে। কোন সময় বিরক্ত হয়ে এমন কোন কথার উচ্চারণ করা যাবে না, যাতে তাঁরা সামন্যতমও মনে কষ্ট পায় এবং যা তাঁদের মান-সম্মানের পরিপন্থী হয়।

তৃতীয় : এ আদেশে মাতা-পিতার সাথে কথা বলার আদব শিক্ষা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাঁদের উভয়ের সাথে পরম ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতির সাথে নত ও বিনম্র স্বরে কথা বলতে হবে।

চার : মাতা-পিতার সামনে নিজেকে অক্ষম এবং নত ও বিনম্রভাবে পেশ করতে হবে। মাতা-পিতার প্রতি, পূর্ণ আন্তরিকতা, মায়া-মমতা এবং ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে নিজেকে ছোট করে তাঁদের সামনে হাজির হতে হবে।

পাঁচ :পঞ্চম আদেশ, মাতা-পিতার সন্তুষ্টি ও সুখ-শান্তি ষোল আনা নিশ্চিত করা মানুষের সাধ্যাতীত। কাজেই সাধ্যানুযায়ী চেষ্টার সাথে সাথে তাঁদের জন্য দুআ করতে হবে, তিনি যেন মেহেরবানী করে তাঁদের সকল মুশকিল আসান করে দেন এবং তাঁদের সব ধরনের কষ্ট দূর করে দেন। সর্বশেষ আদেশ হচ্ছে, মাতা-পিতার মৃত্যুর পরও তাঁদের জন্য অব্যহতভাবে দুআ করে যেতে হবে।১
পবিত্র কুরআনে এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন: অত:পর বালকটির ব্যাপার-তার মাতা-পিতা ছিল ঈমানদার। আমি আশাংকা করলাম, সে অবাধ্যতা ও কুফুর দ্বারা তাদেরকে প্রভাবিত করবে। অত:পর আমি ইচ্ছা করলাম, তাদের শাসনকর্তা তাদেরকে তার চাইতে পবিত্র ও ভালোবাসায় শ্রেষ্ঠতম একটি সন্তান দান করুন।২

ব্যাখ্যা :হযরত খিযির (আ) যে বালকটিকে হত্যা করেন, তিনি তার স্বরূপ এই বর্ণনা করেন যে, তার প্রকৃতিতে কুফর ও মাতা-পিতার অবাধ্যতা নিহিত ছিল। তার মাতা-পিতা ছিল সৎকর্ম পরায়ণ। আমার আশাংকা ছিল যে, ছেলেটি বড় হয়ে
--------------------------------------------------------------------------------------------
১। মুফতী মুহাম্মাদ শফী মাআরিফুল কুরআন। অনু: মাও মহিউদ্দীন খান পৃ. ৭৭২-৭৭৩
২। সূরা আল কাহাফ : ৮০-৮১
--------------------------------------------------------------------------------------------

তার মাতা-পিতাকে বিব্রত করবে এবং কষ্ট দেবে। সে কুফরে লিপ্ত হয়ে মাতা-পিতার জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াবে।১

আল্লাহ তাআলা বলেন : যে ব্যক্তি স্বীয় মাতা-পিতাকে বলে, ধিক তোমাদের প্রতি, তোমার কি আমাকে খবর দিচ্ছো, আমি আবার পুনরুত্থিত হবো, অথচ আমার পূর্বে বহু লোক গত হয়ে গেছে? আর (তার) মাতা-পিতা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলে, তোমার ধ্বংস (অনিবার্য)। তুমি ঈমান আনো। নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য।২

ব্যাখ্যা : এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মাত-পিতার অবাধ্য সন্তানদের বর্ণনা দিয়েছেন, যারা মাতা-পিতার অবাধ্য হয় এবং আল্লাহ ও পরকালকে অস্বীকার করে। তারা যদি ঈমানদার মাতা-পিতার আনুগত্য না করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার না আনে, তবে তাদের ধ্বংস অর্থাৎ ইহকালে নানা ধরনের বিপদাপদ ও কষ্ট কঠোরতা এবং পরকালে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া অপরিহার্য।৩

জঘন্যতম পাপ

আবদুর রহমান ইবন আবূ বাকরা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাহ বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে সবচাইতে বড় কবীরা (জঘন্যতম) গুনাহ সম্পর্কে অবহিত করবো না। একথা তিনি তিন বার বললেন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, কেন নয়, অবশ্যই করবেন, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, আল্লাহর তিনি বললেন: আল্লাহর সাথে শিরক করা, মাতা-পিতার নাফরমানী করা। তিনি হেলান দিয়ে বসা ছিলেন, অত:পর সোজা হয়ে বসে বলতে লাগলেন, (খুব ভালো করে শোন) মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। তিনি বার বার একথা বলতে থাকেন। অবশেষে আমরা (মনে মনে) বললাম, হায়! তিনি যদি চুপ হয়ে যেতেন।৪

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাহ আমর ইবন হাযম (রা) এর মাধ্যমে ইয়েমেনবাসীদের নিকট একখানা পত্র প্রেরণ করেছিলেন। তাতে তিনি তাদেরকে
--------------------------------------------------------------------------------------------
১। মাআরিফুল কুরআন (অনু: মাও : মহিউদ্দীন খান)
২। সূরা আল-আহকাফ : ১৭
৩। দেখুন, মুহাম্মাদ আলী সাবূনী, সাফওয়াতুত-তাফসীর, ৩ খ, পৃ. ১৯৬
৪। সহীহ আল-বুখারী, আদব, অনু : ৬, মাতা-পিতার নাফরমানী কবীরা গুনাহ; সহীহ মুসলিম ঈমান, অনু সবচাইতে বড় কবীরা গুনাহসমূহ বর্ণনা, ১ খ, পৃ. ৯১, নং ৮৭, আরো দ্র: তিরমিযী।
--------------------------------------------------------------------------------------------

সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন : কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার নিকট সবচাইতে বড় কবীরা গুনাহ হবে ১. আল্লাহর সাথে শরীক করা, ২. অন্যায়ভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করা, ৩. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা, ৪. মাতা-পিতার নাফরমানী করা। ৫. সতী সাধ্বী মহিলার ওপর অপবাদ দেয়া, ৪. যাদু শিক্ষা করা, ৭. সুদ খাওয়া ও ৮. ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা।১

আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস (সা) বলেন, নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাহ বলেছেন, কবীরা গুনাহসমূহ হচ্ছে,

১. আল্লাহর সাথে শরীক করা,
২. মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া,
৩. মানুষ হত্যা করা ও
৪. মিথ্যা শপথ করা।২

হযরত তাইসালা ইবন মাইয়্যাস (রা) বলেন, আমি একটি সাহায্যকারী দলের সদস্য ছিলাম। সেখানে আমি কিছু গুনার কাজ করে ফেলেছি। সেটাকে কবীরা গুনাহ বলেই আমি ধরে নিয়েছিলাম। ইবন উমার (রা) এর নিকট বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি বললেন, তুমি যে সব গুনার কথা বলছো, তা কি কি? আমি বললাম, তা হচ্ছে এই এই। ইবন উমার (রা) বললেন,এগুলো কবীরা গুনাহ নয়। কবীরা গুনাহ হচ্ছে নয়টি।

১. আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করা,
২. অন্যায়ভাবে কোন মানুষ হত্যা করা,
৩. যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা,
৪. সতী সাধ্বী নারীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়া,
৫. সুদ খাওয়া,
৬, অন্যায়ভাবে ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা,
৭. মাসজিদুল হারাম-এ হারামকে হালাল মনে করা,
৮. কাউকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা ও বিদ্রুপ করা ও
৯. মাতা-পিতার নাফরমানীর মাধ্যমে তাঁদেরকে কাঁদানো।

তাইসালা (রা) বলেন, হযরত ইবন উমার (রা) আমার মধ্যে ভয়-নীতি ও আতঙ্ক দেখে বললেন, তুমি কি জাহান্নামে প্রবেশ করাকে খুব ভয় করছো? আমি বললাম, জি হ্যাঁ। তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান্নাতে যেতে চাও? আমি বললাম হ্যাঁ, যেতে চাই। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, তোমার মাতা-পিতা বেঁচে আছেন কি? আমি বললাম, আমার মা বেঁচে আছেন। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ করে বলছি, তুমি যদি তাঁর সাথে নম্রভাবে কথা বল এবং তাঁর ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করো, তাহলে তুমি অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে, যতক্ষণ না তুমি কবীরা গুনাহে লিপ্ত হবে।৩

--------------------------------------------------------------------------------------------
১. আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ৩ খ, পৃ. ৩২৭; সহীহ ইবন হিব্বান বরাত,
২. সহীহ আল-বুখারী, শপথ ও মানত, অনু:মিথ্যা শপথ, নং. ৬৬৭; সহীহ মুসলিম, ইমান, অনু: কবীরা গুনাহসমূহে বর্ণনা, ১. খ, পৃ. ৯১, নং ৮৮
৩। নাদরাতুন নাঈম, ১০ খ, পৃ. ৫০১৬; তাফসীর আত-তাবারী-বরাত,
--------------------------------------------------------------------------------------------

হযরত আনাস (সা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কবীরা গুনাহের কথা বলা হলে তিনি বলেন: কবীরা গুনাহ হলো- আল্লাহর সাথে শরীক করা ও মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া।১

আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোন ব্যক্তির নিজের মাতা-পিতাকে গালি দেয়া অন্যতম কবীরা গুনাহ। সাহাবীগণ বললেন, কোন লোক কি নিজের মাতা-পিতাকে গালি দেয়। তিনি বললেন: হ্যাঁ, দেয়। কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির পিতাকে গালি দেয়, প্রত্যুত্তরে সেও তার পিতাকে গালি দেয়। অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি অন্যের মাকে গালি দেয়, এর উত্তরে সেও তার মাকে গালি দেয়।৩

হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর নামে গরু যবাই করে, যে ব্যক্তি জমির সীমানার বদলে দেয় এবং যে ব্যক্তি নিজের মাতা-পিতাকে গালি দেয়, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি লানত (অভিসম্পাত) করেন।৪

যে পিতাকে অভিমাপ দেয় তার ওপর আল্লাহ তাআলার অভিশাপ
হযরত আবূ তুফায়েল আমির ইবন ওয়াসিল (রা) বলেন, আমি হযরত আলী (রা) এর নিকট ছিলাম। তখন জনৈক ব্যক্তি এসে তাঁকে বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
--------------------------------------------------------------------------------------------
২. সহীহ আল বুখারী, আদব, অনু: মাতা-পিতার নাফরমানী করা কবীরা গুনাহ; সহীহ মুসলিম ঈমান, অনু: কবীরা গুনাহর বর্ণনা, ১, খ. পৃ. ৯২, নং ৮৮; আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ৩ খ. পৃ. ৩২৬
৩। সহীহ মুসলিম প্রাগুক্ত; তিরমিযী, বিরওয়াস সিলা, অনু: মাতা-পিতার নাফরমানী করা, ২ খ, পৃ. ১২, আল ইহসান বি-তারতীবে সহীহ ইবন হিব্বান, ১ খ, পৃ. ৩১৬
৪। সহীহ আল বুখারী, আদব, অনু: মাতা-পিতাকে গালি দিবে না, ২ খ, পৃ. ৮৮৩, নং ৫৯৭৩; আবু দাউদ, আদব, অনু: মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করা, ৪ খ, পৃ. ৩৩৬, নং ৫১৪১
১। আল ইহসান, ৬ খ, পৃ. ২৯৯; আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ৩খ, পৃ. ৩৩১

--------------------------------------------------------------------------------------------

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি আপনাকে এমন কোন কথা বলেছেন, যা অন্য কাউকে বলেননি? বর্ণনাকারী বলেন, তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে এমন কোন কথা বলেননি, যা তিনি অন্যকে বলেননি। তবে তিনি আমার নিকট চারটি বিষয় বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! সে চারটি বিষয় কি? তিনি বললেন, তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি পিতাকে অভিশাপ দেয়, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অভিসম্পাত করেন। যে ব্যক্তিগাইরুল্লাহর নামে পশু জবাই করে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অভিসম্পাত করেন। যে ব্যক্তি দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু সৃষ্টি করে এবং যে ব্যক্তির জমির সীমানা বদলে দেয়, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অভিসম্পাত করেন।১

আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা সপ্ত আসমানের ওপর থেকে সাত প্রকার লোকের ওপর অভিসম্পাত করেন। তাদের মধ্যে থেকে এক শ্রেণীর লোকের ওপর তিনবার অভিসম্পাত করেন। অপর প্রত্যেক শ্রেণীর প্রতি একবার করে অভিসম্পাত করেন যা তাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেন : যারা লূত (আ) এর জাতির ন্যায় অপকর্ম করে তারা অভিশপ্ত। যারা লূত (আ) এর জাতির ন্যায় অপকর্ম করে তারা অভিশপ্ত। যারা গাইরুল্লাহর নামে যবাই করে তারা অভিশপ্ত। যারা মাতা-পিতার অবাধ্য তারা অভিশপ্ত।২
--------------------------------------------------------------------------------------------
১. সহীহ মুসলিম, আদাহী, অণু: গাইরুল্লাহর নামে যবাই করা হারাম, ৩ খ, পৃ. ১৫৬৮, নং ১৯৭৮ আল মুস্তাদরাক, বির ওয়াস সিলা, ৪ খ, পৃ. ১৫৩; নাদরাতুন নাঈম, ১০ খ, পৃ. ৫০১৫
২. আল মুস্তাদরাক, হুদূদ, ৪ খ, পৃ. ৩৫৬; আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ৩ খ, পৃ. ৩৩০
৩. ফাতহুর রাব্বানী, ১৯ খ, পৃ. ২৮৪, আত-তারহীব, ৩ খ, পৃ. ৩২৭
--------------------------------------------------------------------------------------------


অবাধ্য সন্তানের জন্য জান্নাত হারাম

অবাধ্য সন্তানের জন্য জান্নাত হারাম

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তিন শ্রেণীর লোকের জন্য আল্লাহ তাআলা জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। ১. মাদকাসক্ত ব্যক্তি, ২. মাতা-পিতার নাফরমান ব্যক্তি ও ৩. অসৎ স্ত্রীর স্বামী যে নিজের পরিবারে দুষ্কর্মের সমর্থন করে।৩
--------------------------------------------------------------------------------------------
আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, চার শ্রেণীর লোককে জান্নাতে প্রবেশ করতে না দেয় এবং জান্নাতের নিয়ামত উপভোগ করতে না দেয়া আল্লাহ তাআলার হক বা অধিকার। ১. মদ্যপায়ী, ২. সুদখোর , ৩. অন্যায়ভাবে ইয়াতীমের মাল ভক্ষণকারী এবং ৪, মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান। ১

অবাধ্য সন্তান জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না :

আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পাঁচশত বছরের রাস্তা থেকে জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। (কিন্তু তিন ব্যক্তি জান্নাতের সুঘ্রাণ পাবে না) ১. যে ব্যক্তি দান করে খোঁটা দেয় ২. মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, (অথ্যাৎ যে সন্তান-পিতাকে কষ্ট দেয় তাদেরকে অসন্তুষ্ট রাখে ও ৩. যে ব্যক্তি মদপানে অভ্যস্থ।২

হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা) বলেন, আমরা এক জায়গায় এক হয়েছিলাম, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে আমাদের মাঝে এসে বললেন, হে মুসলিম জনসমষ্টি! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখো। কেননা সম্পর্ক অটুট রাখার চাইতে দ্রুত কবুল যোগ্য সওয়াবের কাজ আর নেই। আর তোমরা বাড়া-বাড়ি সীমালংঘন করা থেকে দূরে থাকো। সীমালংঘন করার চাইতে দ্রুত শাস্তিযোগ্য অপরাধ আর নেই। তোমরা মাতা-পিতার নাফরমানী করা থেকে দূরে থাকে কেননা এক হাজার বছরের রাস্তা থেকে জান্নাতের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। আল্লাহর কসম! মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, বৃদ্ধ ব্যাভিচারী এবং গর্বভরে টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারী জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না...........।৩

হযরত ইবন উমার (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তিন শ্রেণীর লোকের প্রতি কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। ১. মাতা-পিতাকে কষ্টদানকারী অবাধ্য সন্তান, ২. পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী ও ৩. দাইয়্যূস। আর তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতের প্রবেশ করবে না। ১. মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, ২. মদপানে আসক্ত ব্যক্তি, ও ৩. দান করে খোঁটাদানকারী।৪
--------------------------------------------------------------------------------------------
১. আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ৩ খ, পৃ. ৩২৮ : (আল মুস্তাদরাক বরাত)
২. আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ৩ খ, পৃ. ৩২৭ (তারাবানী জামে আস সগীর, বরাত)
৩. আত-তারগীব ওয়াত তাবহীব, ৩ খ, পৃ. ৩২৯-৩৩০; তাবারানী, আল আওসাত, বরাত
৪. নাসাঈ, অধ্যায় ; যাকাত, অনু ; ৬৯; দান করে খোঁটা দানকারী;

মায়ের সাথে নাফরমানীর শাস্তি :

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আবূ আওয়া (রা) বলেন, আমরা নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে বলল, একজন যুবকের মুমূর্ষ অবস্থা। লোকজন তাকে (কালিমা) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়ার উপদেশ দিচ্ছে, কিন্ত সে পড়তে পারছে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন : এ ব্যক্তি কি নামায আদায় করতো? সে বলল, জী হ্যাঁ। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে (যুবকটির উদ্দেশ্যে) রওয়ানা করলেন। আমরাও তাঁর সাথে চললাম। তিনি যুবকের কাছে গিয়ে তাকে কালিমা পড়ার তালকীন দিলেন অর্থাৎ বললেন : কেন কি হয়েছে? লোকটি বলল, সে তার মায়ের সাথে নাফরমানী করত। নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন : তার মা কি জিবীত আছে? লোকেরা বলল, হ্যাঁ, জীবিত আছেন। তিনি তাঁকে ডেকে আনার নির্দেশ দিলেন। তার বৃদ্ধ মাতা আসলে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, একি তোমার ছেলে? বৃদ্ধা বলল, হ্যাঁ, আমার ছেলে। তিনি বৃদ্ধাকে বললেন, তুমি কি মনে করো, যদি একটা ভয়ংকর আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হয় এবং তোমাকে বলা হয়, যদি তুমি ছেলের জন্য সুপারিশ করো তাহলে তাকে এ আগুন থেকে নিষ্কৃতি দেয়া হবে। অন্যথায় তাকে এ আগুনে ফেলে পুড়িয়ে মারা হবে। এ অবস্থায় তুমি কি সুপারিশ করবে? বৃদ্ধা বলল, জি, হ্যাঁ, সুপারিশ করব। একথা শুনে নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : তাহলে তুমি আল্লাহ ও আমাকে সাক্ষী রেখে বলো, তুমি তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে বলছো। বৃদ্ধা বলল, হে আল্লাহ! আমি তোমাকে এবং তোমার রাসূলকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আমার কলিজার টুকরা সন্তানের প্রতি রাজী হয়ে গেছি। তখন নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুবকটির প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, বলো লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহাদাহু লা-শারীকা লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু (সন্তানের প্রতি মায়ের সন্তুষ্টির বরকতে যুবকটির মুখ খুলে গেলো এবং তৎক্ষনাত) সে কালিমা পাঠ করল। নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রশংসা করলেন আর বললেন : সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমার অসিলায় এ যুবককে জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে নাজাত দিয়েছেন।১
--------------------------------------------------------------------------------------------
১. আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ৩ খ, পৃ. ৩৩৩. আরো দ্র. মুসনাদে আহমদ ও তারাবানী;

নাফরমান সন্তানের ধ্বংস অনিবার্য :

হযরত আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা মিম্বারের কাছে এসো জামায়েত হও। আমরা সকলে মিম্বারের কাছে এসে জামায়েত হলাম। তিনি মিম্বারের প্রথম ধাপে আরোহান করে বললেন: আমীন। দ্বিতীয় ধাপে আরোহন করে পুনরায় বললেন আমীন। তৃতীয় ধাপে আরোহন করে আবারো বললেন : আমীন। তিনি মিম্বার থেকে অবতরণ করার পর আমরা তাঁর নিকট আরয করলাম, আজ আমরা আপনার কাছ থেকে এমন কিছু কথা শুনেছি যা ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি। তিনি বললেন, জিবরাঈল (আ) (এইমাত্র) আমাকে এসে বললেন, সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যে রমযান মাস পেয়েছে, অথচ তার গুনাহ মাফ হয়নি। আমি বললাম আমীন (আল্লাহ কবুল করুন)। আমি দ্বিতীয় ধাপে আরোহণ করলে তিনি (জিবরাঈল)(আ) বললেন: সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যার সামনে আমার নাম উচ্চারণ করা হলো, অথচ সে দরূদ পড়ল না। আমি বললাম : আমীন। আমি মিম্বারের তৃতীয় ধাপে আরোহণ করলে জিবরাঈল (আ) বললেন, সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যে মাতা-পিতা উভয়কে অথবা তাঁদেরকে কোন একজনকে পেল, কিন্তু তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালো না। আমি বললাম : আমীন।২

ব্যাখ্যা : বৃদ্ধ বয়সে মানুষ দ্রুত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। শরীর ক্রমাগত শক্তিহীন, দুর্বল ও নিস্তেজ হতে থাকে। কর্মদক্ষতা ও আত্ম নির্ভরশীলতা হারিয়ে ফেলে। এমনকি এক পর্যায়ে চলা-ফেরা করার ক্ষমতা ও তাঁদের থাকে না। তখন দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব তাঁদেরকে গ্রাস করে ফেলে। ফলে তাঁরা পরনির্ভরশীল তথা সন্তান-সন্ততির ওপর পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অপর দিকে বার্ধক্যের চাপে ও
======================================================
১. সহীহ মুসলিম, সদ্ব্যবহার, অনু: ৩, যে ব্যক্তি বৃদ্ধা মাতা-পিতাকে পেয়েও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারেনি তার নাক ধুলি মলিন হোক, ৪ খ, পৃ. ১৯৭৮, নং. ২৫৫১
২. আল-মুস্তাদরাক, ৪. খ. পৃ. ১৫৪; নাদরাতুন নাঈম, ১০ খ, পৃ. ৫০১৪; আল ইহসান বি-তারতীবে সহীহ ইবন হিব্বান ১ খ, পৃ. ৩১৫

চতুর্মুখী রোগ যাতনায় তাঁদের মেজায খিটখিটে, কথা-বার্তা কর্কশ, আচার-আচরণ রূঢ় হয়ে যায়। এ সময়টা হয় মানুষের জন্য চরম দুর্দিন। বান্দার এ অসহায় ও দুর্দিনে আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি বিশেষ করুণায় হাত প্রসারিত করেন এবং দয়া ও রহমতের দ্বার তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। ফলে সন্তানের জন্য মাতা-পিতার সন্তুষ্টিকে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁদের অসুন্তুষ্টিকে আল্লাহর অসুন্তুষ্টি হিসাবে পরিগণিত করা হয় এবং তাঁদেরকে সন্তানের জন্য জান্নাত ও জাহান্নাম হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ মাতা-পিতার এ কঠিন মুহূর্তে তাঁরা যে সন্তানের প্রতি সন্তুষ্ট হন আল্লাহ তাআলা ও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তার জন্য জান্নাতের ফায়সালা করে দেন।

পক্ষান্তরে যে সন্তান তার অস্তিত্ব, জন্ম, শৈশব ও কৈশোর জীবনে তার জন্য মাতা-পিতার কষ্ট ও তার প্রতি মাতা-পিতার অবদানকে অবলীলাক্রমে ভূলে যায় এবং মাতা-পিতার এ চরম অসহায় অবস্থায় তাঁদের সেবা-যত্নে আত্নোনিয়োগ করার পরিবর্তে তাঁদের অবাধ্য হয় এবং তাঁদের নাফরমানী করে ও তাঁদের মনে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অসন্তুষ্ট ও রাগান্বিত হয়ে তার জন্য জাহান্নামের ফায়সালা করে দেন।

বৃদ্ধা মাতা-পিতাকে বা তাদের কোন একজনকে পেয়েও যারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারেনি তারা ধ্বংস হোক-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ কথাটা জিবরাঈল (আ) বললেও এ কথাটা জিবরাঈল (আ) হচ্ছেন বানী বাহক মাত্র। আল্লাহ তাআলার এ ফায়সালার প্রতি জিবরাঈল (আ) এর পূর্ণ সমর্থন ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আল্লাহর এ ফায়সালাকে বিআ বাক্যে গ্রহণ করেছেন। বরং তিনি এর সাথে পূর্ণ একাত্ম হয়ে এ ফায়সালা কার্যকরী করার জন্য আমীন বলে আল্লাহর কাছে দুআ করেছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মাতের প্রতি অত্যন্ত রহমদিল ছিলেন। উম্মতের শাস্তির কথা শুনে তিনি বিচলিত হয়ে পড়তেন। উম্মতের ইহকাল ও পরকালীন সুখ-শান্তি ও কল্যাণ সাধন করাই ছিল তাঁর নবুয়তী জীবনের মিশন। তা সত্বেত্ত মাতা-পিতার নাফরমান এবং তাঁদের মনে কষ্ট দানকারী সন্তানের ধ্বংসের জন্য তিনি বদদুআ করেছেন। কাজেই তাদের ধ্বংস অনিবার্য। তবে যদি তারা তওবা করে এবং নিজেদের ভূল শিকার করে মাতা-পিতার পায়ে ক্ষমা চেয়ে নেয়। তাঁদের সেবা-যত্নে আত্মনিয়োগকরে তাঁদের সন্তুষ্টি অর্জন করে। আর মাতা-পিতা মারা গেলে নিজেদের কৃত অপরাধের জন্য আল্লাহর দরবারে খালেসভাবে তওবা করে, মাতা-পিতার জন্য দুআ ও দান-সাদাকা করতে থাকে এবং মাতা-পিতার পক্ষের আত্মীয়-স্বজনের সাথে ও মাতা-পিতার বন্ধু-মহলের সাথে সদ্ব্যবহার করতে থাকে, তাহলে আশা করা যায় যে, তারা অনিবার্য ধ্বংস থেকে রেহাই পাবে।


মায়ের বদদুআ

ইসলাম পূর্ব একটি ঘটনা

আবু হুরাইরা (রা) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :......জুরাইজ নামে একজন নেককার ও বুযুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সব সময় খানকায় ইবাদতে মাশগুল থাকতেন। একদিন তাঁর মা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য আসলেন। তখন তিনি নামায আদায় করছিলেন। মা তাঁকে ডাকলেন, হে জুরাইজ! তিনি মনে মনে বললেন, হে আল্লাহ! একদিকে আমার মা, অপরদিকে আমার নামায, এই বলে তিনি নামাযে মাশগুল হয়ে গেলেন। তাঁর মা ফিরে চলে গেলেন। দ্বিতীয় দিন তাঁর নামাযরত অবস্থায় তাঁর মা এসে ডাক দিলেন, হে জুরাইজ! তিনি আবারও চিন্তা করলেন, হে আল্লাহ! একদিকে আমার মা, অপরদিকে আমার নামায (কি করে মার সাথে কথা বলি)। অত:পর তিনি নামাযে মাশগুল হয়ে গেলেন। তাঁর মা গত দিনের মতো ফিরে চলে গেলেন। তৃতীয় দিনও মা এসে দেখেন, জুরাইজ নামায আদায় করছে। তিনি ডাক দিলেন, হে জুরাইজ! তিনি মনে মনে বললেন, হে আল্লাহ! একদিকে আমার মা, অপরদিকে আমার নামায, নামাযের মধ্যে কি করে জবাব দেই। তিনি চুপ রইলেন, অত:পর নামাযে মাশগুল হয়ে গেলেন। এতে তাঁর মা মনে খুব কষ্ট পেলেন এবং রাগান্বিত হয়ে বদদুআ করলেন, হে আল্লাহ! চরিত্রহীন ব্যভাচারী নারীর চেহারা না দেখিয়ে তাকে মৃত্যু দিও না। এ বদদুআ করে নিরাশ হয়ে তিনি সেখান থাকে প্রস্থান করলেন।

ইতিমধ্যে বানী ইসরাঈল লোকদের মাঝে জুরাইজ ও তাঁর ইবাদত বন্দেগীর কথা আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। এমন সময় এক অনিন্দ সুন্দরী ব্যভিচারী মহিলা লোকদেরকে বললো, তোমরা যদি মনে করো, তাহলে আমি তাঁকে পাপ কাজে ফাঁসিয়ে দেই। এরপর সে জুরাইজের খানকায় উপস্থিত হলো এবং তাঁকে অপকর্মের আহ্বান জানাতে লাগল। কিন্তু জুরাইজ তার প্রতি বিন্দুমাত্রও দৃষ্টিপাত করেননি। সে জুরাইজ থেকে নিরাশ হয়ে জুরাইজের খানকায় যাতায়াত করত একন এক রাখালের কাছে গিয়ে নিজেকে তার সামনে পেশ করে দিল। রাখাল তার ষড়যন্ত্রের শিকার হলো। মহিলাটি গর্ভবতী হলো, অত:পর একটি বাচ্চা প্রসব করল, আর প্রচার করতে লাগল, বাচ্চাটি জুরাইজ কর্তৃক ভূমিষ্ঠ হয়েছে। মহিলাটির এ অপপ্রচার শুনে লোকেরা জুরাইজের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর খানকার সামনে জড়ো হলো। তাঁকে খানকা থেকে টেনে হেঁচড়ে বের করে তার খানকাটি ভেঙ্গে ফেললো এবং তাঁকে প্রহার করতে লাগল।

জুরাইজ তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে তোমাদের? তারা বলল, তুমি এ নষ্টা ব্যভিচারিনী মহিলার সাথে ব্যভিচার করেছো। আর তোমার মাধ্যমে তার একটি সন্তানও ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তিনি লোকদেরকে বললেন, ঠিক আছে, শিশুটি কোথায়, তাকে নিয়ে এসো। অত:পর তাকে আনা হলো। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, আমি (দুরাকাআত) নামায আদায় করি।
নামায শেষ করে তিনি নবজাতক শিশুটির পেটে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করলেন, বল, তোর পিতা কে? (শিশুটি কয়েক দিনের হলেও আল্লাহ তার যবান খুলে দিয়েছেন) সে বললো, ওমুক রাখাল আমার পিতা। একথা শুনে জুরাইজের প্রতি লোকদের ভক্তি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেলো, তারা তাঁকে চুমু দেয়া শুরু করল, তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলো এবং বললো, তোমার এ খানকা আমরা সোনা দিয়ে নির্মাণ করে দেব। তিনি বললেন, না, তার প্রয়োজন হবে না। যেভাবে ছিল সেভাবে মাটি দ্বারা নির্মাণ করে দাও। তাই করা হলো।

মুসলিম অপর বর্ণনা এসেছে, জুরাইজের মা যদি ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার বদদুআ করতেন তাহলে তিনি অবশ্যই ব্যভিচারে লিপ্ত হতেন।১

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম