পূর্বের আলোচনা থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, নামাজ বর্তমানে সাধারণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। এখন যদি নামাজ যে যে কারণে ব্যর্থ হচ্ছে তা শনাক্ত করা যায় এবং মুসলমানরা যদি সে কারণগুলোর প্রতিকার করতে এগিয়ে আসে, তবে নামাজ অবশ্যই আবার তার উদ্দেশ্য সাধনে সফল হবে। যেমন তা হয়েছিল ইসলামের প্রাথমিক যুগে।
চলুন, এ ব্যাপারে বিবেক-বুদ্ধি, কুরআন এবং রাসূল সা. এর সুন্নাহ এই তিন মাধ্যমের সাহায্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছার চেষ্টা করা যাক..
নামাজ ব্যর্থ হওয়ার কারণ সম্পর্কে বিবেক-বুদ্ধির রায়
যে কর্মকাণ্ডের একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে এবং কর্মকাণ্ডটি করতে গেলে সবাইকে কিছু নির্দিষ্ট কাজ করতে হয়, তাকে আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড বলা হয়। যেমনস্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, সেনাবাহিনী ইত্যাদির শিক্ষা। নামাজেরও একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে এবং নামাজ আদায় করতে যেয়ে সবাইকে কিছু নির্দিষ্ট কাজ করতে হয়। যেমন রুকু, সিজদা, কিয়াম, কিরাত ইত্যাদি। তাই নামাজ একটি আনুষ্ঠানিক ইবাদত বা কাজ।
পৃথিবীতে মানুষ যত আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড তৈরি করেছে, সেগুলো সফল করতে হলে নিম্নের ৫টি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হয়..
প্রথমত: ঐ কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যটি জানতে হবে।
কারণ উদ্দেশ্যটিকে সামনে না রেখে কাজটি করলে, ঐ উদ্দেশ্য কখনই সাধিত হবে না।
দ্বিতীয়ত: পাথেয়কে উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম মনে করে পালন করা।
আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যটি বাদে আর যত কাজ বা অনুষ্ঠান থাকে তা হচ্ছে ঐ উদ্দেশ্য সাধনের পাথেয়
অর্থাৎ ঐ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে করণীয় কাজ বা কাজসমূহ। কেউ যদি পাথেয়কে কাজটির উদ্দেশ্য মনে করে পালন করে তাহলে কর্মকাণ্ডটির উদ্দেশ্য কখনই সাধিত হবে না।
তৃতীয়ত: কর্মকাণ্ডটির প্রতি কাজ বা অনুষ্ঠান সঠিক পদ্ধতি বা নিয়ম-কানুন মেনে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে।
চতুর্থত: কর্মকাণ্ডটির প্রতিটি কাজ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
কারণ প্রতিটি কাজ তৈরিই করা হয় কিছু শিক্ষা দেয়ার জন্যে। আর ঐ শিক্ষা গ্রহণ করলেই শুধু এমন লোক তৈরি হয়, যারা কর্মকাণ্ডটির উদ্দেশ্য সাধনের উপযোগী হয়। প্রতিটি কাজ যে যত নিষ্ঠার সঙ্গে করবে এবং তা থেকে যে যত বেশি শিক্ষা গ্রহণ করবে, সে ঐ কর্মকাণ্ডটির উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে তত বেশি উপযোগী হবে। অন্যদিকে কেউ যদি প্রতিটি কাজ খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করে কিন্তু তা থেকে দিতে চাওয়া শিক্ষাগুলো গ্রহণ না করে তবে তাকে দিয়ে কখনই কর্মকাণ্ডটির উদ্দেশ্য সাধিত হবে না।
পঞ্চমত: কর্মকাণ্ডটি থেকে নেয়া শিক্ষাগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। এটি না করলে কর্মকাণ্ডটির উদ্দেশ্য কখনই সাধিত হবে না।
চলুন এবার একটি উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাপারটি আরো একটু ভালো করে বোঝার চেষ্টা করা যাক। মেডিকেল শিক্ষা একটি আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড। কারণ মেডিকেল শিক্ষার একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে (মানুষের রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করা) এবং প্রতিটি মেডিকেল ছাত্রকে কিছু নির্দিষ্ট কর্মের মাধ্যমে এই কর্মকাণ্ডটি করতে হয়। যেমন: লেকচার রুমে গিয়ে শিকদের লেকচার শোনা, মেডিকেল বই পড়া, লাশ কাটার ঘরে গিয়ে লাশ কাটা, হাসপাতালে গিয়ে রোগী দেখা ইত্যাদি।
এখন মেডিকেল শিক্ষার কর্মকাণ্ডকে যদি প্রতিষ্ঠা বা সফল করতে হয়, তবে যে ৫টি শর্ত পূরণ করতে হবে তা হচ্ছে
প্রথমত: মেডিকেল শিক্ষার উদ্দেশ্য ভালভাবে জানতে হবে।
অর্থাৎ প্রত্যেকটি মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীকে প্রথমে এটা ভালভাবে বুঝে নিতে হবে যে, মেডিকেল শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের রোগ ভাল করার চেষ্টা করা। এ উদ্দেশ্য সামনে না রেখে যদি তারা মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শরীক হওয়ার পর ডাক্তার হয়ে বের হয় এবং ডাক্তারী করতে আরম্ভ করে তবে তার দ্বারা মানুষের তো কোন কল্যাণ হবেই না বরং অকল্যাণ হবে প্রচুর। ফলে মানুষ মেডিকেল শিক্ষার প্রতিই খারাপ ধারণা পোষণ করতে শুরু করবে।
দ্বিতীয়ত: মেডিকেল শিক্ষার পাথেয়কে উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম মনে করা। মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, মেডিকেল শিক্ষার বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ঔষধ, অপারেশনের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি হচ্ছে মেডিকেল শিক্ষার পাথেয়। কোন মেডিকেল ছাত্র যদি পাথেয়গুলোর এক বা একাধিককে উদ্দেশ্য মনে করে মেডিকেল শিক্ষা গ্রহণ করে ডাক্তার হয়, তবে তার দ্বারা মেডিকেল শিক্ষার উদ্দেশ্য কখনই সাধিত হবে না। ঐ পাথেয়গুলোকে মেডিকেল শিক্ষার উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
তৃতীয়ত: প্রতিটি ছাত্রকে মেডিকেল কলেজের সকল অনুষ্ঠান সঠিক পদ্ধতি তথা নিয়ম-কানুন মেনে নিষ্ঠার সঙ্গে করতে হবে।
চতুর্থত: প্রতিটি মেডিকেল ছাত্রকে মেডিকেল কলেজের সকল কর্মকাণ্ড থেকে দিতে চাওয়া শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
যে যত নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিটি কর্মকাণ্ড করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে, সে তত ভাল ডাক্তার হবে। অর্থাৎ সে তত ভালভাবে মেডিকেল শিক্ষার উদ্দেশ্য সাধনে সম হবে। অন্যদিকে কোন মেডিকেলের ছাত্র যদি খুব নিষ্ঠার সঙ্গে কলেজের সব অনুষ্ঠানে শরীক হল কিন্তু তা থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করল না; যেমন ধরুন সে কাসে সময় মত গেল, বসল এবং শিকদের লেকচার শুনল কিন্তু বুঝল না, লাশ কাটা ঘরে গিয়ে লাশ কাটল কিন্তু শিক্ষা নিল না, রুগী দেখল কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নিল না। এইরূপ ছাত্রছাত্রী যদি ডাক্তারী করতে যায়, তবে তার দ্বারা ডাক্তারী বিদ্যার উদ্দেশ্য সাধনের আশা করাই অন্যায় হবে।
পঞ্চমত: শিক্ষাগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে।
কোন মেডিকেল ছাত্রছাত্রী যদি উপরের পাঁচটি শর্ত পূরণ করে কিন্তু বাস্তবে শিক্ষাগুলো প্রয়োগ না করে, তবে তার সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। এটিতো দিবালোকের মতই সত্য।
যে কোন আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারেই উপরের বক্তব্য সত্য। অর্থাৎ উপরে বর্ণিত পাঁচটি শর্ত পূরণ না করে যে কোন আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড করলে তা অবশ্যই ব্যর্থ হবে। আর ঐ আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী যদি দেখেন যে, শর্তগুলো পূরণ না করে কাজটি করার দরুন তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে, তবে যারা কাজটি ঐভাবে করছেন, তাদের উপরে তিনি খুশি হবেন, এটা আশা করাও কি পাগলের প্রলাপ নয়?
সুধী পাঠক,
নামাজও একটি আনুষ্ঠানিক কাজ, আমল বা ইবাদাত। তাই বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী নামাজকে সফল করতে হলে এবং নামাজ আদায়ের নামাজের পরিকল্পনাকারী আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে হলে নিম্নের পাঁচটি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে
প্রথমত: নামাজের কুরআনে বর্ণিত উদ্দেশ্যটি জানতে হবে। যা আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন সূরা আন কাবুতের ৪৫ নং আয়াতের মাধ্যমে (পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে)
দ্বিতীয়ত: নামাজের অনুষ্ঠানটি হচ্ছে পাথেয়। অর্থাৎ অনুষ্ঠান হচ্ছে নামাজের উদ্দেশ্য সাধনের উপায়। তাই শুধু অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে নামাজকে পালন করা চলবে না।
তৃতীয়ত: নামাজের অনুষ্ঠানটি আল্লাহর জানিয়ে দেয়া ও রাসূল সা. এর দেখিয়ে দেয়া পদ্ধতি বা নিয়ম-কানুন (আরকান-আহকাম) অনুযায়ী নিষ্ঠার সঙ্গে করতে হবে।
চতুর্থত: নামাজের প্রতিটি অনুষ্ঠান থেকে আল্লাহর দিতে চাওয়া শিক্ষাগুলো বুঝে-শুনে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে হবে।
পঞ্চমত: সেই শিক্ষাগুলো নামাজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে।
আজ বিশ্ব মুসলমানদের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই উপরোক্ত পাঁচটি শর্ত পূরণ না করেই নামাজের মত আনুষ্ঠানিক ইবাদতটি পালন করছেন। আর তাই নামাজ আজ ব্যর্থ হচ্ছে অর্থাৎ নামাজ তার কাক্সিত উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে নামাজের পরিকল্পনা কর্তা মহান আল্লাহও নিশ্চয়ই তাদের উপরে দারুণ অখুশি হচ্ছেন। অর্থাৎ তাদের নামাজ কবুল হচ্ছে না। এ পর্যায়ে এসে সবাই নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, নামাজ বর্তমানে ব্যর্থ হওয়ার ব্যাপারে আমাদের বিবেক-বুদ্ধির রায় এটাই।
নামাজ ব্যর্থ তথা কবুল হওয়া না হওয়া সম্পর্কে পবিত্র
কুরআনের বক্তব্য
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ১৮ বার আদেশ আকারে এবং আরও অনেক বার অন্যভাবে নামাজ কায়েম করার কথা বলেছেন। লণীয় বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ নামাজ পড়তে না বলে কায়েম করতে বলেছেন। এই ‘কায়েম করা’ বাক্যটি দ্বারা আল্লাহ যা বুঝাতে চেয়েছেন, রাসূল সা. যে সঠিকভাবে তাঁর সাহাবীগণকে সেটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তা বুঝা যায় সাহাবীদের রা. এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অবস্থা দেখলে। পরবর্তীতে মুসলমানরা এই ‘কায়েম করা’ কথাটির সঠিক অর্থ হারিয়ে ফেলেছে, এটি নামাজ বর্তমানে ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
চলুন এখন নামাজের ন্যায় একটি আনুষ্ঠানিক কাজ বা আমল ‘প্রতিষ্ঠা করা’ কথাটির কী অর্থ হয় বা হবে সেটি বিবেক-বুদ্ধি, কুরআন ও হাদীসের তথ্যের মাধ্যমে পর্যালোচনা করা যাক
অধ্যায় ০৪ : নামাজ ব্যর্থ হওয়ার কারণ
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
1 comments:
www.amarboi.tk