ষড়যন্ত্র প্রথম দিন থেকেই
কোন বিপ্লবই শত্রু-মুক্ত নয়। প্রতিটি বিপ্লবের পরই শুরু হয় প্রতিবিপ্লবের প্রবল প্রচেষ্টা। বিপ্লব ঘটে প্রতিষ্ঠিত একটি সরকারকে হটিয়ে। বিপ্লবের পর পরাজিত শক্তি ও তার দেশী-বিদেশী মিত্ররা কখনই নীরবে বসে থাকে না। কারণ, বিপ্লবের ফলে তাদের প্রতিষ্ঠিত কায়েমী স্বার্থ বিপদে পড়ে। ফলে সে স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রতিবিপ্লব শুরু হয় বিপ্লবের প্রথম দিনটি থেকেই। তাছাড়া যে স্বৈরাচারি হুসনে মোবারককে হটিয়ে মিশরে বিপ্লব সংঘটিত হলো সে ছিল ইসরাইল ও পাশ্চাত্যের অতি বিশ্বস্ত মিত্র। গাজায় যখন ইসরাইলী বাহিনী অতি বর্বর ভাবে ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছিল তখন সে হত্যাযজ্ঞ থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা ফিলিস্তিনীদের হুসনে মোবারক মিশরে ঢুকতে দেননি। মিশর সরকারের পক্ষ থেকে তারা কোনরূপ সহানুভূতিও পায়নি। তাঁর সে নির্মম আচরণটি পশ্চিমা মহলে সেদিন প্রচন্ড ভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। তবে ইসরাইল ও পাশ্চাত্যের পক্ষে সে বর্বর খেলাটি হুসনী মোবারক সেদিন একা খেলেননি। তাঁর সাথে ছিল দেশের বিশাল প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিচারকবাহিনী, তাঁবেদার মিডিয়া ও হুসনে মুবারকের নিজ দলের বিশাল কর্মিবাহিনী। মুবারক আজ অপসারিত হয়েছে বটে তবে বাঁকিরা অক্ষত রয়ে গেছে। তাদের হাতে রয়ে গেছে বিপুল অর্থ ও সামরিক-বেসামরিক শক্তি। রয়ে গেছে দেশের বাইরে বিশাল বিদেশী মিত্ররাও। ফলে অভাব নেই সেদেশে প্রতিবিপ্লব ঘটাতে আগ্রহী হবে এমন লোকের।
সাম্প্রতিক প্রেসেডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ইখওয়ানুল মুসলিম দলের প্রার্থী জনাব ড. মুহাম্মদ মুরসী। দেশটির ইসলামপন্থিদের জন্য এ এক বিশাল বিজয়। এ বিজয় টিকে থাকলে তা শুধু মিশর নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেহারা পরিবর্তনে বিরাট প্রভাব ফেলবে। সেটি যেমন ইসলামপন্থিগণ বুঝে তেমনি ইসলামের শত্রু পক্ষও বুঝে। এ বিপ্লব প্রচণ্ড প্রভাব ফেলবে আরব-ইসরাইল সম্পর্কের উপর। কারণ, সমগ্র আরব জগতে জনসংখ্যায় এ দেশটি সর্ব বৃহৎ। দেশটির হাতে রয়েছে আরব বিশ্বের সর্ববৃহৎ সেনাবাহিনী। রয়েছে এলাকার সর্ববৃহৎ বুদ্ধিজীবী বাহিনীও। দেশটি পরিচিত আরব বিশ্বের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রভূমি কেন্দ্রভূমি। আরবী ভাষায় সবচেয়ে বেশী বই প্রকাশিত হয় এবং সবচেয়ে বেশী সিনেমা নির্মিত হয় মিশরে। বহুলক্ষ মিশরীয় ছড়িয়ে রযেছে সমগ্র আরব জগত জুড়ে। বলা যায়, মিশরই হলো সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল ইঞ্জিন। এক সময় আরব জগতে আরব জাতিয়তাবাদ এবং সেক্যুলারিজমের জোয়ার শুরু হয়েছিল এখান থেকেই। সে জোয়ার এখন থেমে গেছে, এখন শুরু হয়েছে ইসলামী জাগরণ। হাসানূল বান্না, শহীদ কুতুব, মহম্মদ কুতুবের ন্যায় মনিষীদের লিখনী ও কর্মের মাধ্যমে শুধু আরবগণ নয় সমগ্র মুসলিম বিশ্ব নব জাগরণের প্রেরণা পেয়েছে। এতদিন তারা নানা ভাবে নির্যাতীত হয়েছেন, এবং কারারুদ্ধ হয়েছে তাদের চেতনা ও প্রতিভা। ফলে কোন কালেই তা সমগ্র শক্তি নিয়ে প্রকাশের সুযোগ পায়নি। অথচ একটি চেতনা যখন একটি বিশাল রাষ্ট্রের প্রশাসনের সহায়তা পায় তখন তা রাষ্ট্রজুড়ে বিপ্লব ঘটাতে বিপুল বল পয়। একারণেই বিনীন্দ্র রজনী শুরু হয়েছে ইসলামের শত্রু পক্ষের। ইসলামপন্থিদের বিজয়ের বিরুদ্ধে এজন্যই শুরু হয়েছে ব্যাপক ষড়যন্ত্র। সে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবেই ড. মুরসীর নিবার্চনী বিজয়ের আগেই তার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে মিশরীয় সামরিক বাহিনীর বাহিনীর জেনারেলরা। মিশরের সাবেক সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট শুধু সেদেশের রাষ্ট্রপ্রধানই নন, সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কও। সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়োগ দানের ক্ষমতা এতকাল ছিল একমাত্র প্রেসিডেন্টের। যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে সেটিই নিয়ম। কিন্তু সে অধিকার এখন মিশরের প্রেসিডেন্টের হাতে নাই। সেনাবাহিনী-প্রধান জেনারেল তানতাবি সে ক্ষমতাটি নিজের হাতে রেখে দিয়েছেন। অর্থাৎ সেনাবাহিনী এখন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। তাদের বেতন, প্রমোশন, কার্যকলাপ বা ক্ষমতার উপর প্রেসিডেন্টের কোন ক্ষমতাই নাই। প্রেসেডেন্ট নির্বাচনের আগে বিলুপ্ত করা হয়েছে পার্লামেন্ট। কারণ বিপ্লব-পরবর্তী পার্লামেন্ট নির্বাচনে নিরুংকুশ সংখ্যাগরিষ্টতা পেয়েছিল ইখওয়ান। কিন্তু ইখওয়ানের সে বিজয়কেও হাইজ্যাক করেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। পার্লামেন্ট নির্বাচনকে এ বিচারকগণ অবৈধ ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ দেশের কোটি কোটি জনগণ ভোটের মাধ্যমে যে রায়টি দিল সেটি বিচারকদের রায়ে বাতিল হয়ে গেল। লক্ষ্য একটাই, সেটি ইখওয়ানকে শক্তিহীন করা।
আভ্যন্তরীণ শত্রুর দখলদারি
মিশরে বিপ্লব আসলেও বাস্তবতা হলো দেশটি এখনো সামরিক বাহিনী, আমলাবাহিনী ও বিচারকবাহিনীর হাতে অধিকৃত। পার্লামেন্টের নির্বাচনে জনগণ ভোট দিলেও সে ভোটের ফলাফলকে ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে। কারণ বিচারকবাহিনী সে নির্বাচনের বৈধতা দেয়নি। পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর জনগণ ভোট দিয়েছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের হাতে সামরিক বাহিনী এখনও তাঁর প্রাপ্য ক্ষমতা ছাড়েনি। তাই দেশটিতে প্রতি বিপ্লব রীতিমত শুরুই হয়ে গেছে। তবে কোন দেশে বিপ্লবকে ব্যর্থ করার উদ্যোগ এই প্রথম নয়। আজ মিশরে যা ঘটছে প্রায় ৬০ বছর আগে পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একই ভূমিকায় নেমেছিল সেদেশের সামরিক বাহিনী, আমলা বাহিনী, বিচারক বাহিনী এবং সে সাথে সেক্যুলার রাজনৈতিক বাহিনী। বহু মুসলিম দেশে এরূপ নাটক বহু বার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখানে নাটকের নট-নটিরা যেমন এক, তেমনি অভিন্ন হলো তার প্রযোজক-পরিচালকগণ। সেসব নাটকের অভিনয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সাম্রাজ্যবাদী শত্রুদেরও। পাকিস্তানের ইতিহাস থেকে সামরিক-বেসামরিক বাহিনী ও বিচারকবাহিনীর এরূপ অধিকৃতির কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। মিশরের প্রতিবিপ্লবীদের ভূমিকা বুঝতে সেটি সহায়ক হবে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র রূপে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য এক বিশাল বিজয়। এটি ছিল ইসলামের পক্ষে এক বিশাল আদর্শিক, নৈতীক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব। ভাষা ও ভূগোলের ভিন্নতা ভুলে বাঙালী, বিহারী, পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি, বেলুচ এক পতাকা তলে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং সর্ব বৃহৎ এ মুসলিম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। মুসলিম ইতিহাসে প্যান-ইসলামিক ভাতৃত্বের এ ছিল এক গৌরবময় নজির। সে সাথে বিস্ময়কর নজিরও। এ বিজয়টি ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যকামী বর্ণ হিন্দুদের বিরুদ্ধে। বিজয় ছিল মুসলিম নামধারি জাতিয়তাবাদী সেক্যুলারিস্ট জাহেলদের বিরুদ্ধেও। এসব শত্রুপক্ষের কেউই সেদিন উপমহাদেশে পাকিস্তান নামে কোন মুসলিম দেশ চায়নি। উপমহাদেশের মুসলমানগণ আবার এক সিভিলাইজেশনাল ফোর্স হিসাবে বেড়ে উঠুক সেটিও তারা চায়নি। কিন্তু মুসলমানদের একতার বলে যখন বিপ্লব ঘটেই গেল তখন তার বিরুদ্ধে লাগাতর ষড়যন্ত্রও শুরু হয়ে গেলে। এবং ষড়যন্ত্রের শুরুটি শাসনতন্ত্র রচনা নিয়ে। তখন শত্রুর কৌশল হয়ে দাঁড়ায়, শাসনতন্ত্রের নানা খুটিনাটি বিষয়ে বিভেদ গড়া। অবশেষে শাসনতন্ত্র গড়া নিয়ে পাকিস্তানই ভেঙ্গেই যায়।
লক্ষ্যণীয় হলো, মিশরের ষড়যন্ত্রকারিরাও আজ একই পথ ধরেছে। ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক শত্রুদের দখলদারি পাকিস্তানের উপর থেকে শেষ হলেও তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী, আমলাবাহিনী ও বিচারকবাহিনীর দখলদারি শেষ হয়নি। বরং সেনাপল্লি, আমলাপল্লি এবং আদালত পল্লিগুলি ছিল পাশ্চাত্যের সেক্যুলার ধ্যানধারনার অভয়-অরণ্য। সমগ্র দেশ থেকে সেগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। দেশজুড়ে গণতন্ত্র ও ইসলামের পক্ষে হাওয়া বইতে শুরু হলেও সেনাপল্লি, আমলাপল্লি এবং আদালত পাড়াতে তা ছিল না। বরং সেনা-অফিসার ও আমলাদের ক্লাবে চলতো মদ্যপান ও নাচগানসহ সেক্যুলার সংস্কৃতির চর্চা। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝিতে মহম্মদ আলী বোগরা যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি তখন পাকিস্তানের গণপরিষদ একটি শাসনন্ত্র তৈরীর কাজ প্রায় সমাধা করেই ফেলেছিল। সে মুহুর্তে ঘাতক হামলাটি আসে আমলা থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন জনাব গোলাম মহম্মদের পক্ষ থেকে। তিনি শুরু থেকেই ছিলেন ব্রিটিশের আমলা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেবাই ছিল তার একমাত্র কাজ। পাকিস্তানের পক্ষে উপমহাদেশের মুসলমানগণ যখন রাস্তায় নেমেছেন এবং হিন্দু সন্ত্রাসীদের হামলার মুখে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান বলে যখন নারা লাগিয়েছেন তখন কিন্তু গোলাম মুহাম্মদের মত আমলারা একটি বারের জন্যও রাস্তায় নামেননি। ফলে পাকিস্তানের মূল সমস্যাটি বুঝার সামর্থ তাদের ছিল না। দরদও ছিল না। গণপরিষদ যে কত কষ্টের ফসল এবং তার গুরুত্ব যে কত বিশাল সে সমঝবুঝ তার ছিল না। ফলে এক কলমের খোঁচায় তিনি পাকিস্তানের গণপরিষদরেক বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। মুহুর্তের মধ্যে ক্ষমতাহীন করে দেন দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে। তাঁর সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফরিদপুরের মৌলবী তমিজুদ্দীন খান মামলা দায়ের করেছিলেন। কিন্তু গোলাম মহম্মদের পক্ষ নেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জাস্টিস মুনির। গণপরিষদের বিলুপ্তি ঘোষণাকে তিনি সঠিক বলে রায় দেন। জনগণের নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বেসামরিক আমলা ও আদালত সেদিন একাকার হয়ে যায়। এরপর ১৯৫৬ সালে নিজামে ইসলাম দলের চৌধুরি মুহাম্মদ আলী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি তখন সরকারি ও বেসরকারি উভয় দলের সম্মতিতে পালামেন্টারী প্রথার শাসনতন্ত্র রচিত হয়। সে শাসনতন্ত্রের অধিনে আওয়ামী লীগ নেতা সহরোয়ার্দী প্রধানমন্ত্রিও হযেছিলেন এবং বলেছিলেন শাসতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮% শায়ত্বশাসন দেয়া হয়েছে বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্ত সে শাসনতন্ত্র দেশের সামরিক আমলাদের ভাল লাগেনি। কারণ তারা ছিলেন ঔপনেবেশিক ব্রিটিশদের হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সবচেয়ে কট্ট্রোর সেক্যুলার। ১৯৫৬য়ের শাসনতন্ত্রে বিধিবদ্ধ ছিল পাকিস্তান হবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র, এর কোন আইনই কোরআন ও সূন্নাহর বিরুদ্ধে হতে পাররে না। ফলে মদ্যপায়ী জেনারেলদের পক্ষে সে সংবিধান মেনে নেয়া অসম্ভব ছিল। ফলে জেনারেল এস্ককেন্দার মির্জা ১৯৫৬য়ের সে সংবিধানকে বিলুপ্ত করেন এবং সামরিক শাসন জারি করে হাতে দেশের দখলদারি নেন। শাসনতান্ত্রিক ভাবে তখনই দেশটিকে পঙ্গু করা হয়। জেনারেল এস্ককেন্দার মির্জাকে হটিয়ে পরে আসেন জেনারেল আ্ইয়ুব খান। তিনি চালু করেন তাঁর ১১ বছরের স্বৈরাচারি শাসন। একই নাটক বার বার অনুষ্ঠিত হয়েছে তুরস্কে। সে দেশে ইসলামী চেতনাধারি নাজিম উদ্দীন আরকানের প্রধানমন্ত্রিত্ব সেদেশের সেক্যুলার জেনারেলগণ মেনে নিতে পারেনি। তাঁকে শুধু গদি থেকেই শুধু হঠায়নি, তাঁকে দীর্ঘকাল কারারুদ্ধও করেছে। এবং নিষিদ্ধ করেছে তাঁর দলকে। সে নিষিদ্ধকরণকে বৈধতা দিয়েছে দেশের আদালত। শুধু তাই নয়, জনসভায় মুসলিম জাগরণমূলক একটি কবিতা পাঠের অপরাধে আদালত কারাবাসে পাঠিয়েছে তুরস্কের আজকের প্রধানমন্ত্রী জনাব রজব তৈয়ব আরদোগানকে। ইসলামের বিরুদ্ধে বিচারকগণও যে কতটা অবিবেচক এ হলো তার নমুনা। মুসলিম ইতিহাসের দেশধ্বংসী বড় বড় অপরাধগুলো তাই চোরডাকাতদের হাতে হয়নি। রাস্তার সন্ত্রাসীদের হাতেও হয়নি। বরং হয়েছে সেনাবাহিনী, বিচারকবাহিনী ও আমলাবাহিনীদের হাতে। মনে হচ্ছে আজকের মিশরে সেটিই শুরু হয়েছে। মিশরের বর্তমান ঘটনাবলিকে বুঝার জন্য পাকিস্তান ও তুরস্কের ইতিহাস জানাটি এজন্যই জরুরী।
শত্রুশক্তির খলিফা
মুসলিম দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদী শত্রুদের মূল লক্ষ্যটি নিছক অর্থনৈতিক শোষন নয়, রাজনৈতিক দখলদারিও নয়, বরং ইসলামকে একটি সিভিলাইজেশনাল ফোর্স রূপে বেড়ে উঠতে না দেয়া। ক্লাশ অব সিভিলাইজেশনে তথা সভ্যতার সংঘাতে এভাবেই শত্রুপক্ষ ইসলামের পরাজয় ও নিজেদের বিজয়কে এভাবেই নিশ্চিত করতে চায়। তাদের সে স্ট্রাটেজীকে অব্যাহত রাখতে তারা যেমন মুসলিম দেশগুলি দখল করেছে তেমনি সেসব অধিকৃত দেশে নিজেদের অনুগত বিশাল খলিফা বাহিনীও গড়ে তুলেছে। সেসব বাহিনীর লোকদের লাগাতর প্রশিক্ষণও দিয়েছে। সেটি যেমন সেনাবাহিনীতে, তেমনি বিচারকবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে। মুসলিম দেশগুলিতে তারাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অতি বিশ্বস্থ সেবক। পাকিস্তানের ইতিহাসে আমলা গোলাম মোহাম্মদ, জেনারেল আইয়ুব খান এবং জাস্টিট মুনির এরা হলো এ তিন বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম সারির লোকের নমুনা। তাদের চেতনা রাজ্যের মূল বৈশিষ্ঠ হলো দুটিঃ এক. তারা ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্য, দুই, তারা কট্ট্রোর সেক্যুলার। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের সেক্যুলার প্রভূর চেয়েও তারা সেক্যুলার। আইয়ুব খান তাই মুসলমানদের পারিবারিক আইনে হাত দিয়েছিলেন। বিবাহ এবং মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির বন্টনে ইসলামের যে শরিয়তি বিধান তাতে তিনি পরিবর্তন আনেন।। অথচ ইসলাম বিরোধী এমন গর্হিত কাজটি ব্রিটিশেরাও করেনি। ভারতের সাম্প্রদায়িক হিন্দু শাসকেরাও করেনি। মুসলিম দেশগুলিতে ব্রিটিশ শাসকবর্গ যে শুধু শাসন ও শোষন চালিয়েছে তা নয়, এমন ধরনের বিশ্বস্থ তাঁবেদার গড়তেও বিপুল বিণিয়োগ করেছে। এ দাস শ্রেণীর সেবাদাস চরিত্রে সামর্থ বাড়াতে তাদের অনেককে যেমন অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজে নিয়ে গেছে তেমনি অনেককে স্যান্ডহার্স্টেও নিয়ে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাদের সেখানে লালনপালন হয়েছে মদ ও নাচগানপূর্ণ সেক্যুলার সংস্কৃতিতে। মুসলিম দেশেও তারা অনুরূপ সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। তাদের পিছনে এমন বিণিয়োগের লক্ষ্যটিই সুস্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত করেছিলেন মিশরে বিট্রিশ শাসনের প্রতিনিধি লর্ড ক্রোমার। তিনি বলেছিলেন, মুসলিম দেশগুলীতে সেক্যুলার চেতনার একটি শাসক শ্রেণী গড়ে না উঠা পর্যন্তু মুসলিম দেশগুলোর স্বাধীনতা দেয়ার প্রশ্নই উঠেনা। পাকিস্তানের গোলাম মুহাম্মদ, ইস্কেন্দার মির্জা, আইয়ুব খান, জাস্টিস মুনির, তুরস্কের কামাল পাশা এবং মিশরের হুসনে মোবারক এবং জেনারেল তানতাবি বস্তুত সে শ্রেণীরই লোক। মুসলিম দেশের আজকের ব্যর্থতা মূল কারণ এ দাসশ্রেণী। কারণ, তারা লাগাতর খেলে চলেছে তাদের প্রভূদের বিজয়ী করার লক্ষ্যে। তাদের কারণে মুসলমানদের শুধু পরাজয়ই বাড়ছে।
মিশরে পাশ্চাত্য শক্তির খলিফাগণ এখন তাই করছেন যা ইসলাম ও মুসলিম শক্তিকে দমিয়ে রাখার জন্য জরুরী। এতকাল দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় দল ইখওয়ানুল মুসলিমীনকে বেআইনী ঘোষনা দিয়ে রাজনীতির ময়দানে ঢুকতে দেয়নি। রাজনীতিকে তারা ব্যবহার করেছে নিছক নিজেদের ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার রূপে। এখন যখন বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে ইখওয়ানুল মুসলিমীন রাজনীতিতে পা রাখার সুযোগ পেল তখন সে দলটিকে নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাহীন রাখার চেষ্টা করছে। তবে আশাপ্রদ দিক হলো, মিশরের জনগণ সেটি বুঝে। মিশর এখন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের পাকিস্তান নয়, তেমনি আশির বা নব্বইয়ের দশকের তুরস্কও নয়। সেদেশের জনগণ আভ্যন্তরীণ দুষমনদের অতি নিষ্ঠুর দখলদারি দেখেছে। সেটি যেমন রাজ ফারুক ও জামাল আব্দুন নাসেরের আমলে, তেমনি আনোয়ারুস সাদাত ও হুসনে মোবারকের আমলে। তাই তাহরির ময়দানের দখলদারি তারা ছাড়েনি। রাজপথে জনগণের এ প্রবল দখলদারির কারণেই নির্বাচনের রায়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারিরা সফল হতে পারিনি। মুহম্মদ মুরসীকে নির্বাচিত প্রেসেডেন্ট রূপে ঘোষণা দিতে দেরীতে হলেও অবশেষে রাজি হয়েছে।
নতুন গোলপোষ্ট
তবে বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দেয়ার লক্ষ্যে ইসলামের ঘরের শত্রুদের পাশাপাশি বিদেশী শত্রুগণও বসে নাই। মিশর, তিউনিসিয়া, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যা কিছু ঘটে গেল তা নিয়ে পাশ্চাত্যের শাসকবর্গ আদৌ খুশি নয়। কারণ তাদের বন্ধুদের ঘরে আগুণ লেগেছে। তিউনিসিয়ার বিন আলী, মিশরের হুসনে মোবারক, ইয়েমেনের সালেহ তাদের দীর্ঘ দিনের পরিক্ষীত আপন লোক। তাদের বিদায় নিতে হয়েছে। তাদের নিজেদের বাড়া ভাতে যেন ছাই পড়েছে। এ বিপ্লবের ফলে ক্ষমতা বেড়েছে জনগণের। পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র-প্রেম যে নিছক মেকী সেটি অনেকের কাছে পূর্ব থেকেই জানা থাকলেও সেটি এখন আরো সুস্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রতি সামান্যতম দরদ থাকলে পঞ্চাশের দশকে তারা ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কেন সামরিক বিপ্লব ঘটাবে? এবং তার স্থলে বিতাড়িত মুহাম্মদ রেজা শাহকে কেন আবার বাদশাহ রূপে বসাবে? চিলির নির্বাচিত আলেন্দের বিরুদ্ধেই বা কেন সামরিক জান্তাকে সমর্থণ দিবে?
নির্বাচনী রায়কে পাশ্চোত্যের শাসক ও নীতি নির্ধারকেরা তখনই মানতে রাজী যখন সে নির্বাচনে তাদের তাঁবেদারগণ বিজয়ী হয়। পাশ্চাত্যের বন্ধুদের পরাজয় হলে পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র-প্রেম তখন কর্পুরের ন্যায় উড়ে যায়। তখন গণতন্ত্রের গোলপোষ্টই পাল্টে ফেলে। তাদের গণতন্ত্র-প্রেম তখন নানা বাহানায় হাওয়ায় হারিয়ে যায়। সেটিই ফুটে উঠেছে গত ২৭ই জুন তারিখে লন্ডনের “দি ইভেনিং স্টান্ডার্ড” নামক একটি দৈনিকে প্রকাশিত ব্রিটেনের সাবেক প্রধাণমন্ত্রী মি. টনি ব্লেয়ারের লেখা এক প্রবন্ধে। উক্ত প্রবন্ধে টনি ব্লেয়ার লিখেছেন,“But it must now reinforce the idea that democracy is a way of thinking, not just of voting.” অর্থঃ “এ ধারণাটিকে অবশ্যই বলিষ্ঠ করতে হবে যে গণতন্ত্রের অর্থ শুধু ভোটদান নয় বরং চিন্তা-চেতনার একটি ধরণ।” কি মহা আবদার! কি অদ্ভূদ ব্যাখ্যা! টনি ব্লেয়ার তার প্রবন্ধে যে চিন্তা-চেতনার ধরণের কথাটি বলেছেন সেটি নিশ্চয়ই ইসলামি চিন্তা চেতনা নয়, ইসরাইল ও পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী নীতির বিরোধীতাও নয়। বরং সেটি হতে হবে পাশ্চাত্যের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের। সমর্থণ করতে হবে আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিনসহ সকল দেশে তাদের দখলদারি নীতির। সে আনুগত্যের চেতনাটি থাকলে পাশ্চোত্যের কাছে প্রিয় হওয়ার জন্য কি নির্বাচনেরও প্রয়োজন আছে? নির্বাচন না দিয়েও সৌদি বাদশাহ, জর্দানের রাজা, মরক্কোর বাদশাহ, কাতার-কুয়েত-দুবাইয়ের শাসকেরা কি পাশ্চাত্যের কাছে কম প্রিয়? অথচ মিশরে যখন একটি আন্তর্জাতিক মানের সুষ্ঠ নির্বাচন হলো সে নির্বাচনকে তারা গণতন্ত্র বলতে রাজী নয়। ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমদি নেজাদ বা ভিনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো সাভেজ যত বিপুল ভোটেই নির্বাচিত হোক না কেন সেটিকেও তারা মানতে রাজি নয়। এখন শর্ত যোগ করেছে গণতন্ত্রের অর্থ শুধু ভোটদান নয়, সে ভোটদানে জনগণের মতামতের প্রতিফলনও নয়, বরং সে ভোটদানের মধ্য দিয়ে এমন এক চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটতে হবে যা টনি ব্লেয়ারে মত পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী চেতনার লোকদের কাছে গ্রহণযোগ্য। ফলে একটি মুসলিম দেশে সুষ্ঠ নির্বাচন যতবারই অনুষ্ঠিত হোক না কেন এ মানদণ্ডে ইসলামি চেতনাধারিদের পক্ষে কোনদিনও কি গণতন্ত্রি হওয়া সম্ভব? নিজেদের আগ্রাসী লক্ষ্য পূরণে পাশ্চাত্য যে কতটা নীতিশূণ্য, বিবেকশূণ্য ও নির্লজ্জ্য এ হলো তার নমুনা।
টনি ব্লেয়ারের এ মতামতকে তুচ্ছ জ্ঞান করার কোন উপায় নাই। তিনি শুধু ব্রিটিশ রাজনীতিতেই নয়, পাশ্চাত্য রাজনীতিতে অতি বিখ্যাত ব্যক্তি। ইরাকের উপর হামলা এবং সে দেশটির ধ্বংসের মূলে বহু নেতা ও জেনারেল থাকলেও তার মূল রূপকার হলেন দুই জন। একজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, এবং অপরজন প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এই টনি ব্লেয়ার। বহু ব্রিটিশের কাছে তিনি একজন যুদ্ধাপরাধী। জর্জ বুশ তাঁর প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায়ের পর খামোশ হয়ে গেছেন। কিন্তু ব্লেয়ার এখনও সরব। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফিলিস্তিনী বিষয়ে আজও তিনিই হলেন পাশ্চাত্যের সম্মিলিত পক্ষের প্রধান দূত। তিনি দূতালী করতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে বার বার ঘুরছেন। তার লক্ষ্য আগ্রাসী ইসরাইলকে আরবদের কাছে গ্রহনযোগ্য করা। বলা যায়, পাশ্চাত্যের আগ্রাসী রাজনীতির তিনিই হলেন প্রধান প্রতিনিধি। ফলে তাঁর বক্তব্যকে পাশ্চাত্যের রাজধানীগুলোর নীতি নির্ধারকেরা যে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে? তাঁর নিবদ্ধে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট তা হলো, মধ্যপ্রাচ্যের বিপ্লব নিয়ে তিনি খুশি নন। বরং মহাচিন্তিত। হারাম হয়ে গেছে তাঁর ঘুম। তাই উক্ত প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “One thing, however, is for sure. It has huge consequences for us in the West. This is not just about oil and energy. .. But the security issues alone, arising out of this upheaval, are momentous”. অর্থঃ “একটি বিষয় অতি সুনিশ্চিত। পাশ্চাত্যে আমাদের জন্য (মধ্যপ্রাচ্যের এ বিপ্লব) বিশাল প্রভাব ফেলবে। সেটি শুধু তেল বা জ্বালানির ক্ষেত্রে নয়। শুধু মাত্র নিরাপত্তার ক্ষেত্রেই এ বিপ্লব-উদ্ভূদ পরিস্থিতির ফলাফলটি হবে অতি ব্যাপক।”
টনি ব্লেয়ারের হুমকি
বিপ্লব পরবর্তী পরিস্থিতির মোকাবেলায় মি. ব্লেয়ার পাশ্চাত্যকে যথাযত পলিসি ও স্ট্রাটেজী প্রণোয়নের আহবান জানিয়েছেন এবং লিখেছেন, “So my point is very simple: we have to have a clear policy and strategy with which to confront this challenge. We have to recognise our interests are dramatically engaged and respond accordingly. If, as seems likely, Muslim Brotherhood governments continue to emerge, we have to accept the result and work with them. But we should do so with no illusions and without abrogating our responsibility to argue the case for true democracy”. টনি ব্লেয়ার এখানে মধ্যপ্রাচ্যে বিপ্লব এবং সে বিপ্লবের পর নির্বাচনে ইখওয়ানূল মুসলিমীনের ন্যায় ইসলামপন্থিদের বিজয়কে একটি চ্যালেঞ্জ রূপে চিত্রিত করেছেন। একদিকে যেমন নির্বাচনি ফলাফলকে মেনে নেয়ার কথা বলেছেন অপর দিকে সত্যিকার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় পাশ্চাত্যের প্রতি পলিসি প্রণয়োনের কথাও বলেছেন। কথা হলো “সত্যিকার গণতন্ত্র” বলতে মিষ্টার ব্লেয়ার কি বুঝাতে চান? তবে কি মিশরের নির্বাচন এবং সে নির্বাচনে মুহাম্মদ মুরসীর বিজয় সত্যিকার গণতন্ত্র নয়? আর সে বিজয়কে যদি সত্যিকার গণতন্ত্র বলতে তাঁর আপত্তি থাকে তবে সে নির্বাচনে বিজয়ীদের প্রতি তাঁর কি শ্রদ্ধাবোধও আছে? আর শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে সে নির্বাচনে বিজয়ী প্রেসিডেন্টের সাথে তিনি সুসম্পর্কই বা গড়ে তুলবেন কি করে? তাহলে নতুন সরকারের সাথে কাজ-কায়বার চালিয়ে যাওয়ার যে কথাটি বলেছেন সেটি কি নিছক মিশরবাসীকে ধোকা দেয়ার জন্য?
টনি ব্লেয়ার ও তাঁর পাশ্চাত্যের মিত্রগণ মধ্যপ্রাচ্যের বিপ্লবে নিরপেক্ষ নন। মিশরে তাদেরও একটি পক্ষ রয়েছে এবং ঘনিষ্ট মিত্রও রয়েছে। নিজেদের সে সেক্যুলার পক্ষ ও মিত্রদের চিনতে টনি ব্লেয়ার ভূল করেননি। তাদের পরাজয়ে তিনি যে দুঃখী এবং তাদেরকে একাকী ছেড়ে দেয়া যে পাশ্চাত্যের জন্য ঠিক হবে না সে পরামর্শটিও তিনি উক্ত প্রবন্ধে রেখেছেন। তিনি লিখেছেন, “Remember that in Egypt, yes, the Muslim Brotherhood won a majority. But the outcome was close. There are a lot of worried liberal-minded people there who believe in more secular democracy as we do in the West. They shouldn’t be forgotten.” অর্থঃ “স্মরণ করুন যে, মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড সংখ্যাগরিষ্টতা পেয়েছে। কিন্তু ফলাফলটি অতি কাছাকাছির। সেখানে রয়েছে উদার মনের বহু মানুষ যারা সেক্যুলার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে –যেমনটি আমরা পাশ্চাত্যে বিশ্বাস করি। তাদেরকে ভূলে থাকা যাবে না।” অর্থাৎ কারা তাদের নিজেদের লোক টনি ব্লেয়ার সে বিষয়টি গোপন রাখেননি। হুসনে মোবারকের দীর্ঘকাল শাসনে এবং পাশ্চাত্যের অর্থে প্রতিপালিত শত শত এনজিওদের হাতে গড়ে উঠা বিপুল সংখ্যক সেক্যুলারিস্টদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে পাশ্চাত্য তাদের নিজেদের লড়াইটি লড়তে চায়। সে লড়াইটি ইসলামের বিরুদ্ধে। সেক্যুলারিষ্টরা তাদের ফুট সোলজার তথা পদসৈনিক। ফলে বিপ্লবের বিরুদ্ধে এবং তাদের পক্ষে লড়তে রেডিমেড একটি গ্রুপ রীতিমধ্যেই সেখানে এখন দু’পায়ে খাড়া।
পাশ্চাত্যের দেশগুলি এখন এক অর্থনৈতিক মহা দুর্যোগের শিকার। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের চলমান বিপ্লবগুলিকে মিষ্টার ব্লেয়ার দেখছেন পাশ্চাত্যের জন্য আরেক দুর্যোগ রূপে। বিপ্লব-উদ্ভুদ এ দুর্যোগ মোকাবেলাকে তিনি একই রূপ গুরুত্ব দিয়ে জরুরী ভাবে মোকাবেলার জন্য পাশ্চাত্যবাসীর প্রতি আহবান জানিয়েছেন। নিবন্ধের সর্বশেষ তিনটি লাইনে মিষ্টার ব্লেয়ার যা লিখেছেন তা মধ্যপ্রাচ্যের বিপ্লবীদের জন্য অতিশয় চিন্তার বিষয়। কারণ তাতে বিপ্লবের বিরুদ্ধে যেমন সুস্পষ্ট হুমকি রয়েছে, তেমনি রয়েছে পাশ্চাত্যের পক্ষ থেকে লড়াই শুরুর অঙ্গিকার। তিনি লিখেছেন, “So we have to be engaged in this struggle over the region. We’re busy enough with our economic woes. But this challenge is equally daunting and equally urgent”. অর্থঃ “অতএব এলাকার উপর এ লড়াইয়ে আমাদের লিপ্ত হতে হবে। অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট ব্যস্ত। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বিপ্লব-উদ্ভুদ এ চ্যালেঞ্জটিও সমভাবে বিপদজনক এবং সমভাবে জরুরী।”
ফলে প্রতিবিপ্লবের লক্ষ্যে পাশ্চাত্যের পক্ষ থেকে যে বিপুল বিনিয়োগ বাড়বে, নানা রূপ ষড়যন্ত্র হবে এবং বিপ্লবের বিরুদ্ধে ব্যাপক যুদ্ধও যে শুরু হবে সেটি আর গোপন বিষয় নয়। ইরান বিপ্লবের পরও শত্রুপক্ষ বসে বসে আঙুল চুষেনি। বরং লাগাতর ষড়যন্ত্র করেছে, অবশেষে ইরাকের ঘাড়ে অস্ত্র রেখে দীর্ঘ ৮ বছর ব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও চাপিয়ে দিয়েছে। পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ এমনকি সাদ্দামের হাতে মারাত্মক রাসায়নিক অস্ত্রও তুলে দিয়েছে। ইরানীদের বিরুদ্ধে ইরাককে মদদ জোগাতে সাবেক মার্কিন ডিফেন্স সেক্রেটারি ডোনাল্ড রাম্সফিল্ড প্রেসেডেন্ট রিগ্যানের সরকারি প্রতিনিধি রূপে বাগদাদে সাদ্দাম হোসেনের দরবারে গিয়ে হাজির হয়েছেন। একই কারণে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে আফগানদের উপর। তাই মধ্যপ্রাচ্যের বিপ্লবীদের সামনে এখন দু’টি পথ। একটি পাশ্চাত্যের সেক্যুলার দর্শনকে কবুল করে আনুগত্যের পথ, অপরটি ইসলামের পতাকা হাতে নিয়ে লাগাতর লড়াইয়ের পথ। একটি পাশ্চাত্যকে খুশি করার পথ, অপরটি আল্লাহকে খুশি করার পথ। দেখবার বিষয় হলো, মিশরের এবং সেসাথে মধ্যপ্রাচ্যের বিপ্লবীরা কোন পথটি বেছে নেয়।
লেখা : ফিরোজ মাহবুব কামাল (ছবি: ইন্টারনেট)
0 comments: