উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্যে ২০০৯ সালের ২৫ আগস্ট বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ও বাংলাদেশে নিযুক্ত তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির একটি বৈঠকের আলোচ্য বিষয়গুলো উঠে এসেছে। বৈঠকের দু’দিনের মাথায় ২৭ আগস্ট মরিয়ার্টি এক তারবার্তায় এর বিষয়বস্তু ওয়াশিংটনে পাঠান।
তারবার্তায় বলা হয়েছে, ওই বৈঠকে মরিয়ার্টিকে ফারুক খান বলেন, আওয়ামী লীগকে ভালোমত সরকার পরিচালনা করতে হবে, অন্যথায় আমাদের জেলে যেতে হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ভালোমত সরকার পরিচালনা করে আমরা আবার ক্ষমতায় না আসতে পারলে অপর সরকারের আমলে আমাদের জেলে যেতে হবে। এ সময় আবার ক্ষমতায় আসতে সরকারকে তিনটি পরামর্শ দেন তিনি। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, জ্বালানি ঘাটতি দূর করা এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে দূরে
থাকা—শেখ হাসিনাকে এই তিন বিষয় মাথায় রেখে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে ফারুক খান বলেন, এভাবে কাজ না করলে আমরা ক্ষমতা হারাব আর আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় এসে আমাদের জেলে পাঠানোর অজুহাত খুঁজবে।
এদিকে মরিয়ার্টির পাঠানো অপর এক তারবার্তার উদ্ধৃতি দিয়ে উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের ২৪ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত ভয়াবহ বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের ব্যর্থতার অভিযোগ এবং সেনা কর্মকর্তাদের আপত্তির কারণে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানকে বিদ্রোহসংক্রান্ত তদন্ত সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর পরই এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন নিষ্ক্রিয় হয়ে যান।
বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানকে দায়িত্ব দেয়া প্রসঙ্গে তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ওয়াশিংটনে প্রেরিত তারবার্তায় মন্তব্য করেন, খুব সম্ভবত বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যর্থতার কারণে তার বিরুদ্ধে অনেক সেনা কর্মকর্তা যে আপত্তি তুলেছিলেন তারই ফলে ফারুক খানকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ফারুক খান একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। সেনানিবাসগুলোতে সে কারণেই তার গ্রহণযোগ্যতা আছে। মরিয়ার্টি আরও মন্তব্য করেন, ফারুক খানের আরেকটি পরিচয়—তিনি প্রধানমন্ত্রীর এলাকা গোপালগঞ্জের একটি আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও তার ঘনিষ্ঠদের একজন।
বিদ্রোহের সময় ‘ব্যক্তিগত সফরে’ যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন তত্কালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ ওরফে সোহেল তাজ। সরকার ও দেশের জন্য এমন বিপর্যয়কর একটি পরিস্থিতিতেও সেই ব্যক্তিগত সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে না আসায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন সোহেল তাজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে তার ওপর যথেষ্ট ক্ষুব্ধ ছিলেন। উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তারবার্তায় তা জানা গেছে। দেশে ফেরার পর সে সময়ের মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টিকে দেরিতে দেশে ফেরার ব্যাপারে সোহেল তাজ বলেন, একটি পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই তিনি সফর সংক্ষিপ্ত করতে পারেননি। তার এক আত্মীয়ের হার্টের অপারেশন ছিল। তাছাড়া নিজের চিকিত্সার কারণেও তাজ দেশে ফিরতে পারেননি বলে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানান। সেই বৈঠকে সোহেল তাজকে বেশ অসুস্থ দেখাচ্ছিল বলেও ওয়াশিংটনে পাঠানো তারবার্তায় মরিয়ার্টি জানান।
তারবার্তায় সেই বৈঠকে উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের প্রসঙ্গও এনেছেন মরিয়ার্টি। তিনি ওয়াশিংটনকে জানান, বৈঠকের সময় সোহেল তাজ ও সাহারা খাতুন দু’জনই উপস্থিত ছিলেন। বেশিরভাগ কথাই বলছিলেন সোহেল তাজ। তবে মরিয়ার্টি লক্ষ্য করেন, তাজের প্রায় সব কথাতেই যেন ইচ্ছাকৃতভাবে বিরোধিতা করছিলেন সাহারা।
বিডিআর বিদ্রোহের সময় পিলখানায় ঢুকেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি এক বৈঠকে তার কাছে সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। সেই ব্যাপারটিও উঠে এসেছে উইকিলিকসের ফাঁস করা গোপন তারবার্তায়। সাহারা খাতুন বলেন, তিনি পিলখানায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত প্রায় সাত-আটশ’ বিদ্রোহীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। বারবার নির্দেশ দেয়ার পর প্রায় শ’খানেক বিদ্রোহী বিডিআর জওয়ান তার কাছে এসে অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন। সাহারা খাতুন মরিয়ার্টিকে বর্ণনা দেন, কীভাবে তিনি পিলখানার ভেতর থেকে সেনা কর্মকর্তাদের আটকে পড়া অসহায় পরিবারগুলোকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। সাহারা খাতুন বলেন, তিনি একজন বন্দি সেনা কর্মকর্তাকে বিদ্রোহীদের হাত থেকে উদ্ধার করে বাইরে নিয়ে আসেন। বিদ্রোহীরা সেই সেনা কর্মকর্তাকে তার হাতে তুলে দিতে চাচ্ছিল না। তারা বলছিল, এই সেনা কর্মকর্তা তাদের ওপর অতীতে অনেক অত্যাচার চালিয়েছেন। জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিদ্রোহীদের ধমক দিয়ে বলেন, ‘আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। উনি যদি কোনো অপরাধ করে থাকেন তার বিচার আমি করব, তোমরা নয়, তাকে ছেড়ে দাও।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, তিনি পিলখানার ভেতর থেকে যে পরিবারগুলোকে উদ্ধার করেছিলেন তাদের মধ্যে পুলিশের তত্কালীন মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদের মেয়েও ছিলেন।
0 comments: