উইকিলিকসের তথ্য : চুক্তির দুই বছর আগেই হাসিনা জানান
কাজ পাবে কনোকো
রপ্তানি ও তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির বিতর্কিত বিধান রেখেই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কম্পানি কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে গত ১৬ জুন বঙ্গোপসাগরের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকের গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলন উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) করে সরকার। অথচ এর দুই বছর আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কনোকোকে ওই কাজ দেওয়া হবে বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধের কারণে অন্য ছয়টি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলনের কাজ আপাতত দেওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২০০৯ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় নিযুক্ত তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি এ কথা দেন।
২০০৯ সালের ২৮ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে জেমস এফ মরিয়ার্টির পাঠানো এক গোপন তারবার্তায় এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি বিকল্পধারার গণমাধ্যম উইকিলিকস অন্য অনেক তারবার্তার সঙ্গে এটিও প্রকাশ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে মরিয়ার্টি বলেছিলেন, বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে উদ্গ্রীব হয়ে আছে কনোকো-ফিলিপস। বঙ্গোপসাগরের আটটি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য সর্বনিম্ন দর প্রস্তাব করেছে কম্পানিটি। কিন্তু সরকার মার্কিন এ কম্পানিকে কাজ দেওয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। তখন শেখ হাসিনা রাষ্ট্রদূতকে আশ্বস্ত করে বলেন, সরকার আপাতত কনোকো-ফিলিপসকে বঙ্গোপসাগরের দুটি ব্লকের গ্যাস উত্তোলনের কাজ দেবে। বাকি ছয়টি ব্লকের জন্য নতুন দরপত্র আহ্বান করা হবে। ওই ছয়টি ব্লকের কাজ না দেওয়ার ব্যাপারে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রদূতকে বলেছিলেন, সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বিরোধের কারণে এখনই সব ব্লকের কাজ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যাপারে পরে 'ভিন্ন কৌশল' নেওয়ার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। তবে ওই ভিন্ন কৌশল সম্পর্কে তিনি ভেঙে বলেননি।
চলতি বছর ১৬ জুন পেট্রোবাংলা ও কনোকো-ফিলিপসের মধ্যে ওই চুক্তি সই হওয়ার পর মরিয়ার্টি বলেছিলেন, 'শেভরন, জিই, কনোকো-ফিলিপসের মতো মার্কিন কম্পানিগুলো গ্যাস ও জ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত আছে।' তিনি দাবি করেছিলেন, কনোকো-ফিলিপসের সুখ্যাতি স্বয়ংসম্পূর্ণর্। বিশ্বের তৃতীয় সর্ববৃহৎ সমন্বিত জ্বালানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কনোকো-ফিলিপস এই দুই সামুদ্রিক ব্লকে হাইড্রোকার্বন (জীবাশ্ম জ্বালানি) অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে অত্যাধুনিক কারিগরি দক্ষতা নিয়ে আসবে।
চুক্তি স্বাক্ষরকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও কনোকো-ফিলিপসকে দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন; কিন্তু অনুসন্ধানে এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে পাওয়া গেছে ভিন্ন চিত্র। প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রেই অনেকবার দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। উইকিপিডিয়া সূত্র মতে, কনোকো-ফিলিপসের বড় ধরনের দুর্ঘটনার মধ্যে রয়েছে ২০০৪ সালের ১৩ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের ডালকো প্যাসেজে তেল ছড়িয়ে পড়া, ২০০৬ সালের ৩ মে কানাডার এডসন থেকে ২৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের একটি গ্যাসকূপে বিস্ফোরণ এবং আলাস্কার কুপারুক তেল ক্ষেত্রে বিস্ফোরণ।
বারবার দুর্ঘটনা ঘটানোর দায়ে কম্পানিটিকে একাধিকবার সতর্ক করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ। ২০০৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০১০ সালের শুরু পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ওএসএইচএ) ১১৮ বার পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা ভঙ্গ করার অভিযোগের নোটিশ পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে কনোকো-ফিলিপস। ৮৬২ বার নোটিশ পেয়ে প্রথম স্থানে আছে বিপি এবং ১২৭ বার নোটিশ পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে কনোকো।
কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে অসম চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি হরতালসহ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। আরো বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন এ চুক্তির নিন্দা ও চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়েছিল।
কনোকো-ফিলিপসকে ৮০ শতাংশ গ্যাসের মালিকানা, তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রি ও রপ্তানির বিধান রেখে ওই চুক্তি করা হয়। পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মডেল পিএসসি ২০০৮-এর অধীনে সাগরের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ব্যাপারে কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে প্রাথমিক সমঝোতা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে এটি অনুমোদন হয়। তবে মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় চলতি বছরের ২৩ মে।
হিসাবের চেয়ে দ্বিগুণ বিবিয়ানার গ্যাস : ওই বৈঠকেই মরিয়ার্টি বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক কম্পানি শেভরন কাজ করছে ওই গ্যাসক্ষেত্রে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, ওই গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ রয়েছে দুই ট্রিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে পাঠানো তারবার্তায় ওই গ্যাসক্ষেত্রে ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। মরিয়ার্টি তাঁর সরকারকে জানান, পেট্রোবাংলার হিসাবের চেয়ে ওই গ্যাসক্ষেত্রের প্রকৃত মজুদ দ্বিগুণ।
0 comments: