গিরিখাত হচ্ছে পাহাড়ের গায়ের ফাটল। তবে সাধারণ বা ছোটখাটো ফাটল নয়, বিশাল বিশাল ফাটল। এতই বিশাল যে, কিছু কিছু জায়গায় এসব ফাটল এক মাইল চওড়া হয়ে থাকে! আর এসব ফাটল কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। কোটি কোটি বছর ধরে আস্তে আস্তে তৈরি হয় এসব ফাটল বা গিরিখাত। এমনই এক পাথুরে পাহাড় আর গিরিখাতের অসম্ভব সুন্দর রাজ্য 'দ্য গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন'। এটি প্রায় অর্থাৎ এক কোটি ৭০ লাখ বছরের পুরনো। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন প্রায় ৪৪৬ কিলোমিটার লম্বা। আর কিছু কিছু জায়গায় এ গিরিখাত প্রায় কিলোমিটার পর্যন্ত চওড়া। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এ গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের গভীরতা প্রায় (৬০০০ ফুট বা ১৮০০ মিটার)! বিশাল এ গিরিখাতের মধ্য দিয়ে একটা আস্ত নদীই বয়ে গেছে, নদীটির নাম কলোরাডো।
প্রকৃতির এ অসাধারণ সৃষ্টির অবস্থান সুদূর আমেরিকায়। আমেরিকার অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত এটি। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বেশির ভাগই 'গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক'-এর মধ্যে পড়েছে। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট এ গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সংরক্ষণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পৃথিবীর ভৌগোলিক পরিবর্তনের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে এ সুবিশাল গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। তবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। বহু বছর লেগেছে এর বর্তমান অবস্থায় আসতে। তবে ঠিক কত বছর আগে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন তৈরি হতে শুরু করেছিল, সে সম্পর্কে কিন্তু ভূগোলবিদরা এখনো এক মত হতে পারেননি। তবে কিছু কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে ধরা হয় যে আজ থেকে প্রায় ১৭ মিলিয়ন বছর আগে তৈরি হয়েছিল গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। তখন কিন্তু গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেহারাও এ রকম ছিল না। শুরুতে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মধ্য দিয়ে কলোরাডো নদী বয়ে যেত। আর এই নদীর তখন অনেক শাখা-প্রশাখাও ছিল। আস্তে আস্তে সেসব নদীর পাড়ে পলি জমল। সেই পলিমাটি ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পরিণত হলো পাথরে। আর সেসব পাথরই এক সময় নদীর গতিপথ পাল্টে দিল। কেমন অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? আবার এ নদীর স্রোতেই এসব পাথর ক্ষয় হয়ে নতুন নদীপথ তৈরি হচ্ছে।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন পৃথিবীর গিরিখাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গিরিখাতও নয় কিংবা সবচেয়ে গভীর গিরিখাতও নয়। নেপালে অবস্থিত 'কালি গন্দকি জর্জ' নামক গিরিখাতটি আরও গভীর। আর অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত 'ক্যাপারটি ভ্যালি' গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়েও প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা এবং চওড়া। আর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন গিরিখাতটি বিখ্যাত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এর বিশালত্ব, দুর্গম অঞ্চল আর বিচিত্র রংয়ের পাথরে গড়া পাহাড়ের সমাবেশই একে মানুষের আকর্ষণের বস্তু হিসেবে তুলে ধরেছে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে গেলে সেখানকার বহু বছরের পুরনো বড় বড় পাথরগুলো এত সুন্দরভাবে সাজানো, যা দেখলে যে কেউই মুগ্ধ হতে বাধ্য।
আসলে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের পাথরগুলো স্তরে স্তরে সাজানো। আর এসব একেকটা স্তরকে বলা হয় 'প্লেট'। কলোরাডো নদী থেকে উৎপন্ন বলে এখানকার প্লেটগুলোকে বলা হয় কলোরাডো প্লেট। এ প্লেটগুলো তৈরি হতেও লাখ লাখ বছর সময় লেগেছে। একটু আগেই বলেছি, বেশির ভাগ ভূতত্ত্ববিদের মতে, এসব প্লেট প্রায় ১৭ মিলিয়ন বছরের পুরনো। তবে অনেকে মনে করেন, এগুলো তারও আগের। তাদের মতে, প্রায় ৪০ মিলিয়ন বা চার কোটি বছর লেগেছে পাথরের এসব প্লেট তৈরি হতে। প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয় গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সবচেয়ে নিচের স্তর। এ স্তর শীর্ষ থেকে প্রায় পাঁচ থেকে ১০ হাজার ফুট নিচে অবস্থিত। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে সবার প্রথমে কিন্তু এ স্তরটাই তৈরি হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে এই স্তর খাড়া উপরে উঠে যেতে থাকে। তৈরি করতে থাকে নতুন নতুন পাথরের স্তর। আবার কলোরাডো নদী আর এর শাখা-প্রশাখাগুলো ছিল ভীষণ খরস্রোতা। তাই এদের স্রোতের কারণে পাথর ক্ষয় হয়ে হয়ে নদীর নতুন গতিপথ তৈরি হতে লাগল, আর ক্ষয়ে যাওয়া সেসব পাথর থেকে নতুন নতুন স্তর সৃষ্টি হতে লাগল। এরপর বরফের যুগ। বরফ যুগের পরে বরফ গলে নদীতে পানির পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। ফলে নদীর স্রোতও গেল বেড়ে। এ স্রোতের কারণে পাথরের স্তর আরও দ্রুতগতিতে আরও গভীর হয়ে ক্ষয়ে যেতে লাগল। এরপর, প্রায় ৫৩ লাখ বছর আগে তৈরি হয় কলোরাডো নদীর একেবারে নিচের স্তর। ভিত্তি তৈরি হয়ে যাওয়ার ফলে কলোরাডোর স্রোত এর চারপাশের পাথরগুলোকে আরও বেশি ক্ষয় করতে থাকে। এভাবে ক্ষয় হতে হতে এ নদী বর্তমান অবস্থায় এসে পেঁৗছেছে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে কলোরাডো নদী দিয়ে ভ্রমণের সময় তুমি চারপাশের দেয়ালে পাথরের যে স্তরগুলো দেখতে পাবে সেগুলোও এরকম ক্ষয় হয়েই তৈরি হয়েছে। আর আজকের কলোরাডো নদীর যে গভীরতা, সেটিও হয়েছিল প্রায় ১২ লাখ বছর আগে।
এরপর ৩০ থেকে এক লাখ বছর আগের সময়ের মধ্যে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে ঘটল আরও পরিবর্তন। সে সময় পৃথিবীর আগ্নেয়গিরিগুলোতে ঘন ঘন অগ্ন্যুৎপাত হতো। ফলে আগ্নেয়গিরির লাভা আর ছাই এসে জমা হতো কলোরাডো নদীর তলদেশ আর পাশর্্ববর্তী এলাকায়। বছরের পর বছর এসব ছাই আর লাভা জমা হয়ে হয়ে সেগুলো ধীরে ধীরে জমে পরিণত হয় পাথরে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সবচেয়ে নতুন পাথরের স্তরগুলোই এসব লাভা আর ছাই দিয়ে তৈরি পাথরের স্তর। সমগ্র গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে মূলত ভাগ করা হয়েছে দুটি প্রধান অঞ্চলে। নর্থ রিম এবং সাউথ রিম। এ দুটি অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থার মধ্যে বেশ পার্থক্য থাকায় এদের মধ্যকার আবহাওয়া ও জলবায়ুও বেশ ভিন্ন। নর্থ রিমের স্বাভাবিক তাপমাত্রা সাউথ রিমের চেয়ে কম। কারণ নর্থ রিমের পাহাড়গুলো সাউথ রিমের পাহাড়গুলোর চেয়ে প্রায় এক হাজার ফুট বেশি উঁচু। আর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নর্থ রিমের পাহাড়গুলোর উচ্চতা গড়ে প্রায় আট হাজার ফুট ফিট। কলোরাডো নদীটি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে বয়ে গেছে। নদী তার উৎপত্তিস্থল থেকে যত দূরে যাবে এর স্রোতও তত কমতে থাকবে। তার মানে দাঁড়াল উত্তর দিকে কলোরাডো নদীর উৎপত্তিস্থল হওয়ায় সেখানে নদীর স্রোত বেশি। আর স্রোত বেশি হওয়ায় সেখানে নদী আরও বেশি পরিমাণে পাথর ক্ষয় করতে পারে। ফলে নদীতে পলি জমে আরও বেশি পরিমাণে। আর সে কারণেই নর্থ রিমের পাহাড়গুলো অপেক্ষাকৃত বেশি উঁচু। তবে দুটি অঞ্চলেই কিন্তু গ্রীষ্মকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। তবে অনেক বৃষ্টি হলেও গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে ঘুরতে গেলে গরমকালেই যাওয়া ভালো। কেননা শীতকালে সেখানে এতই বরফ পড়ে যে, নর্থ রিমে যাওয়ার রাস্তাটাই বন্ধ হয়ে যায়। আর নর্থ রিমে যেতে না পারলে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের আসল সৌন্দর্যটাই দেখা হবে না।
শুনে অসম্ভব মনে হলেও সত্যি হলো, পাথরের এ দেশেও মানুষ বাস করে। যেমন পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে এত ঠাণ্ডা আর বরফ থাকা সত্ত্বেও এস্কিমোরা বাস করে। আর এ গিরিখাতে বাস করে বিশেষ এক জাতি। তাদের নাম হচ্ছে 'পুয়েব্লো'। এরাই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের প্রাচীন অধিবাসী। ইউরোপিয়ানরা আমেরিকায় পেঁৗছার বহু আগে থেকেই তারা এ দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। এরাই প্রথম এ অঞ্চলের নাম দেয় 'অংতুপকা'। এটা পুয়েব্লোদের নিজস্ব ভাষার নাম। এ পুয়েব্লোদের কাছে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন কিন্তু একটি পবিত্র জায়গা। এমনকি তারা এ গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে তাদের তীর্থস্থান হিসেবেও গণ্য করে। পুয়েব্লো ছাড়াও গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে আরও বেশকটি জাতি বাস করে। যেমন_ 'ইয়ুমান', 'হাভাসুপাই', 'ওয়ালাপাই' প্রভৃতি জাতি। এদের সবাইকে প্রাচীন 'কোহোনিনা' জাতির বংশধর মনে করা হয়। কোহোনিনারা ৫০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ সময়ের মধ্যে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের পশ্চিম অংশে বাস করত। এ ছাড়া ৫০০- ১৪৫০ সালের মধ্য সময়ে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে 'সিনাগুয়া' নামের একটি জাতিও বাস করত, কিন্তু তারা এখন হারিয়েই গেছে। এদের কোনো বংশধরই আর বেঁচে নেই।
বিডি-প্রতিদিন
0 comments: