অধ্যায় ০৫ : জীবনবোধ সাহিত্য ও প্রগতির পথ

জীবনবোধ ও সাহিত্য

আমরা যদি চারদিকে তাকিয়ে দেখি,তবে দেখব যে, আমাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্নই রয়েছে। কিন্তু সেই পরিমাণে আমাদের মধ্যে আত্মোপলদ্ধি নিতান্ত স্বল্প পরিকলক্ষিত হয়। আমরা যদি এই কথা সম্যক উপলদ্ধি করতে পারি, তবে আশা করা যায়, সাহিত্যের এই নিরাশ্রয়, নিরাবলম্বন এতিম অবস্থা ঘুচে যাবে। মূল্যবোধের ব্যাপারে পরাশ্রয়ী না হয়ে নিজস্ব জীবনবোধের উপর ভিত্তি করে, ভৌগলিক পরিবেশ ও ইতিহাসকে স্বীকার করে সংগঠনমূলক ও সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনা করা নিছক পুনরুজ্জীবনের (revivalism) ব্যাপার নয়, যদি তার মধ্যে সুষ্ঠু সমাজচেতনা,মূল্যবোধ ও সাহিত্যিক প্রতিশ্রুতি থাকে। অনেকে বলেন, আমাদের সাহিত্য ও আমাদের ভিত্তি যে ইসলামী হবে, তা তো স্বত:সিদ্ধ ব্যাপার, তা নিয়ে এত বকা-বিতন্ডা কেন? কথাটা সরল মনের পরিচায়ক। কিন্তু সত্যিকারভাবে আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামী জীবনদর্শনের প্রকৃত রূপ সম্পর্ক ও বিচিত্র সমস্যাকে ইসলামের মারফত মুকাবিলা করার ব্যাপারে সুষ্ঠু ধারণা কতজনের আছে? তই এ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট জ্ঞানদান কারার অবকাশ শেষ হয়ে যায়নি। কোন জাতি নিজস্ব জীবনবোধকে উপেক্ষা করে প্রগতির পথে বা উজ্জ্বলতাময় সাহিত্যের দিকে অগ্রসর হতে পারে না। সাহিত্য যা প্রাণবন্ত, তা একান্তভাবে একটি বিশেষ সংস্কৃতির বা যুগধর্মের ব্যাপারে নয়, তবু তা সব সময়েই প্রকাশ পায় একটি সংস্কৃতি ও যুগধর্মের মাধ্যমে। একে কেউ অস্বীকার করতে পারে না।

আমাদের সহিতসংকট খন্ডিত জীবনদর্শনের প্রত্যক্ষ ফল। ইংরাজী সাহিত্য চসারের পর তথাকথিত ধর্মের কড়াকড়ি যেমন প্রকৃত ধর্ম ও জীবনদর্শনকে খন্ডিত করেছিল, তেমনি বিজ্ঞানমূখিতার বাড়াবাড়ির ফলে আজ মানুষ খন্ডিত দর্শনের দাস হয়ে পড়েছে। ফলে সাহিত্যিক মন তার স্বভাবধর্ম থেক বিচ্যুত হয়েছে। গোটা বস্তুসত্তা ও মানবসত্তা প্রতিষ্ঠিত না করলে মহৎ সাহিত্য হয় না। সমগ্র সার্থক সাহিত্যের পেছনে যে অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য, আদর্শ, দর্শন ও জীবনবোধ থাকে, তার সম্পর্কে ধোঁয়াটে ধারণা সাহিত্যের উৎকর্ষের পক্ষে মারাত্মক হয়ে উঠেছে।

এ সম্বন্ধে টলস্টয় তাঁর Art শীষক বইতে লিখেছেন : (Ox, Univ. Press, 1924, P-375) It does not, however, need much experience to perceive that man cannot live with chaos that results when they have on sure chart or general theory by which to steer their course through life. In other words a man is material or spiritual, he has always more or less a religious perception.

আমাদের যে নিজস্ব জীবনবোধ রয়েছে, তার সুষ্পষ্ট সাহিত্যিক রূপ দিতে পারলে জীবনের আনন্দ ও সাধারণ সত্যের উপলদ্ধি বাদ দিতে হবে না। কারণ আমাদের জীবনদর্শন শুধু বৈশিষ্ট্যের উপলদ্ধিতে নয়। বৈশিষ্ট্যের মাঝেও সম্ভব বৈচিত্রের সমারোহ। দুনিয়ার সব জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্যের জ্ঞানাহরণের জন্য ইসলামী জীবনদর্শনের রয়েছে অফুরন্ত প্রেরণা। আর ইসলামে যদি কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, তা নীতিগত-স্বার্থপরতা, নিপীড়ন ও চরমাবাদের বিরুদ্ধে তৌহীদ ও মানবিকতার উদ্ধোধন, বুদ্ধির শাসন বা যুক্তির বিরুদ্ধে জোহাদ নয়।

আধুনিক মুসলিম বাংলা সাহিত্য ঊনবিংশ শতাব্দীর শতাব্দীর শেষ থেকে শুরু, কিন্তু তা বহুলাংশে হিন্দু সাহিত্যের অনুকৃতি মাত্র। মুসলিম সাহিত্যের এই অনুকরণপ্রিয়তা দূর করে নিজস্ব সাহিত্য গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক সাহিত্য অনুবীক্ষণী মনোবৃত্তি ও স্নায়বিকতার ফলে ক্ষণিকার আর কণিকার বিশ্লেষণ ও গতি-প্রাণালী নিয়ে ব্যস্ত। এই সাহিত্য আক্সমিকভাবে অস্পষ্ট জিনিস প্রতিভাত হয়েছে, কিন্ত তা মানুষের সহজ প্রবৃত্তি ও প্রকৃতি চিত্রিত করতে চায়নি। সাহিত্যের এই অস্বাভাকি বিকৃত অবস্থ দূর করে সুস্থ সবল জীবনের সহজ প্রকাশ ফিরিয়ে আনতে হবে। একে তো অজ্ঞানতা, অশিক্ষা-কুশিক্ষার কুয়াসা আমাদের জীবন ও জীবনবোধের আসল রূপ সম্পর্কে একটা ঘোলাটে ভাব তৈরী করেছে; তাছাড়া ইসলামী সমাজও আমাদের দেশে কায়েম হয়নি। কাজেই সাহিত্য, তমদ্দুন ও সমাজের সঙ্গে আমাদের জীবনদর্শনের অতীত, বর্তমান ও ভিবষ্যত যোগসূত্র সম্পর্কে স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন ধারণা গঠনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে অপরিসীম। বাঙালী মুসলিমের যে স্বতন্ত্র মানসিকতা, হৃদয়বৃত্তি, সুখ-দু:খ ও আশা-আকাঙ্খা এবং সংস্কৃতিচেতনা রয়েছে, তার ফলে হিন্দু সাহিত্যিকের লেখা সাহিত্যে কিঞ্চিত আনন্দ পাই, কিন্তু সেখানে আমরা নিজেদেরকে খুঁজে পাইনা। বাংলাদেশের সাহিত্য মুসলিম জনসাধারণের মূল্যবোধ, কৃষকের জীবন, ধ্যান-ধারণা, আচার-ব্যবহার ও কিসসা-কাহিনী তৌহীদের বাণী ও সংস্কারকে রূপ দেয়াই হবে সংগত ও শোভন। সাহিত্য মুসলিম রূপ লাভ করেও তার বিশ্বজনীন রূপ অক্ষুন্ন রাখতে পারে। এই কথাটি বুঝতে না পেরে আমরা যে সাহিত্য রচনা করেছি, কিন্তু হাটের-মাঠের ও খাঁটি-মাটির মানুষের সাক্ষাত বড় একটা পাইনি, সংগ্রামী মুসলিমের সন্ধান পাইনি। জাতীয় জীবন ও আদর্শ বিস্মৃত হলে, তথাকথিত সাহিত্যিকের হাতে হয় সাহিত্যের অনাবৃষ্টি। দেশের জনগণের জীবনবোধের প্রতি অশুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে অগ্রসর হলে আমাদের সাহিত্যিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। নিজের প্রতি অশ্রদ্ধা দৃষ্টি নিয়ে কেউ প্রগতির পথে পা বাড়াতে পারে না। আত্মপরিচয়েই জাতি আত্মশক্তি ও আত্মপ্রত্যয় লাভ করে। জীবনের ধরাছোঁয়ার বাইরে নিছক কল্পনা নিয়ে সাহিত্য রচিত হতে পারে না। শুধু কল্পনা নিয়ে সাহিত্য রচিত হওয়ায় আমাদের সাহিত্য কৃত্রিম হয়েছে ও মানুষের মনের গভীরে রেখাপাত করতে পারেনি। আমাদের সাহিত্য শুধু বৃদ্ধির দীপ্তি থাকলেই চলবে না, সহানুভূতি ও বাস্তবতা এ দুটোকেই একসঙ্গে পাওয়া চাই। যার মধ্যে থাকবে সীমাহীন বৈচিত্র, এক কথায় জীবনের সমগ্র রূপটি।

অনেক বলেছেন যে, বাঙালী মুসলমান আগে মানুষ তারপর আর কিছু বা আগে বাঙালী তারপর মুসলমান। আবার কেউবা বলেন, আগে মুসলমান তারপর বাঙালী। সত্য কথা হলো, সে আগে মানুষ বলেই বুদ্ধিমত্তা ও জীবনবোধ (ধর্ম) তার অবিচ্ছেদ্দ্য গুণ। সে বাংলাদেশেরও বাসিন্দা; সেজন্য একসঙ্গেই সে মানুষ, মুসলমান ও বাঙালী। এই তিনটিকে আলাদা করার যোগ্য নেই। আর ইসলামী জীবনদর্শন তার মানুষ্যত্ব ও বাঙালীত্ব স্বীকার করে নিয়ে তাকে নৈতিকতা সুবিচার ও মানবিকতার দিকে আহবান করে। কোনক্রমেই তার মনুষ্যত্ব, বাঙালীত্ব মুসলমানত্ব আলাদা করা যায় না। এই হিসাবে প্রত্যেকটি মানুষি তৃজ অর্থাৎ তিনবার জন্মলাভ করে। সে মানুষ যে কোন জীবনবোধের অনুসারী ও কোন একটি দেশের বাসিন্দা।

আমাদের শিল্প-সাহিত্য যেমন একদিকে স্বতস্ফূর্ত, পরিচ্ছন্ন ও পরিপূর্ণ হবে, তেমনি তা আমাদের জীবনবোধ দ্বারাও শান্তি, সুসংহতি সুমিতি, সংযম ও সর্বাঙ্গীণতা লাভ করবে। তবেই আমাদের সাহিত্য স্বগৌরবে ও সৃষ্টিতে প্রোজ্জল হতে পারবে। অবশ্য জগতের সব দেশের সাহিত্য থেকে অনুবাদ করে আমাদের নিজের করে নেয়া দোষের তো নয়ই, আমাদের জীবনদর্শন মতে ইবাদতের শামিল বলে মনে করা হয়। সত্য কখনো এক জাতির একচেটিয়া নয়। (রিসালতের ) ।

ইকবাল, নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের সাথে মুসলিম সংস্কৃতির সম্পর্ক আরোচনা করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। রবীন্দ্রনাথ যে মূলত হিন্দুর ঐতিহ্য নিয়ে তাঁর সাহিত্য রচনা করলেন, তাতে তিনি কম রেনেসাঁ আনেননি। আর নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলিম দুটোকেই টেনেছেন- তা কিন্তু ধির মাছ না ছুই পানি গোছের। নজরুলের ভেতরে দেখতে পাই উদগ্র স্পৃহা, উজ্জল গতি ও মানবতার জয়গান। তাই নজরুল সাধারণ মানুষের আপনার কবি। সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধি ও উৎপীড়ন-জর্জরিত সমাজের উপর তাঁর নির্মম কষাঘাত। তিনি যখন যা নিয়ে লিখেছেন, তাতেই মেতে উঠেছেন। তিনি যখন যা নিয়ে লিখেছেন, তাতেই মেতে উঠেছেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মিলন ঘটাতে পারেনি। সেজন্য তাঁর পার্থিব সুরটি ক্ষুণভঙ্গুর। হিন্দুরা তাকে জাতীয় কবি হিসাবে মনে করে না। মুসলমানেরা তাঁকে রেনেসাঁর অগ্রদূত বলে মনে করেন। কিন্তু ইসলামী সংস্কৃতির পরিপূর্ণ ছাপ (রবীন্দ্রনাথের মত হিন্দ সংস্কৃতির ছাপ) নজরুলের মেলে না। কারণ ইসলামী সংস্কৃতিতে তাঁর অন্তপ্রেরণাই ছিল সামান্য। হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির মাঝে অগণিত জাতি ও সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে-তবু তাদের নিজস্ব হিন্দত্ব ও মুসলমানত্ব বরাবর ঠিকই আছে। আরবী-ফারসী শব্দের সার্থক ব্যবহার থাকলেও তৌহীদবাদের পূর্ণ বিকাশ নজরুলে মেলা ভারা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথে আধুনিক হিন্দু-বাঙালী জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে বৈদিক সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ আছে। সেখানেই তার সার্থকতা। তাই বলে রবীন্দ্রনাথ যে মুসলিমের অপাঠ্য তা বলছি না।

আবার নজরুলে যা পরোক্ষা ও ভাবপ্রবণ ইকবালে তা মূখ্য, স্পষ্ট ও জলন্ত দীপ্ত। নজরুলে সমাজদৃষ্টি আছে কিন্তু তা ইকবালের মত এতটা একাত্ম ও নিবিড় নয়। নজরুল সাহিত্য মুসলিম মানসকে গতিশীল করেছে কিন্ত তার সাংস্কৃতির চেতনাকে পূর্ণত্বে পৌছাতে পারেনি। মুসলমানের নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের কাউকেই জীবনবোধের দিক থেকে পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে পারেনি। নজরুল হিন্দু-মুসলিম ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে সৃষ্ট একখানি বিরাট তরঙ্গ, একটি বিপ্লবী স্ফুলিংগ, উল্কার মত। তিনি মুসলিম রেনেসাঁর আগমনী গেয়েছেন, প্রত্যক্ষভাবে মুসলিম রেনেসাঁর কবি নন। কিন্তু ইকবালকে মুসলমানেরা গ্রহণ করেছেন একান্তরূপে। কারণ তিনি মুসলমানের মর্ডান সাদী বা রুমী। তবে বাঙালী মুসলিম আজ অবধি মুসলিম রবীন্দ্রনাথের সন্ধান পায়নি।

বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা কি হবে, সে সম্পর্কে দুএকটি কথা বলা ভাল মনে করি। আমাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্য ও সাহিত্য যে মূলত গ্রামীণ হবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। জনগণের বোধম্য ভাষাই এই সাহিত্য রূপ পাবে। তাদের জীবনের প্রত্যক্ষ অনভূতি ও প্রতিচ্ছবি তাদের জবানিতে প্রকাশিত হওয়া চাই। সাহিত্য হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃষ্টান একসঙ্গে মিশেছে। কিন্তু সবার উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তৌহীদবাদ। আমাদের সাহিত্য যে ভাষা প্রচলিত আছে, তাকে যেমন বাদ দেয়া যায় না, তেমনি হুবহু অনুসরণ করাও নিরাপদ নয়। আমাদের বাড়ীতে, দহলিজের কথাবার্তায় যে ভাষা স্বতই ফুটে ওঠে, সেই ভাষার সঙ্গে চলতি সাহিত্যিক ভাষার এক সহজ সমন্বয়েই আমাদের নিজস্ব নতুন সাহিত্যিক ভাষার জন্ম হবে (অবশ্য এ জন্য আমাদের ভাষাকে অযথা আরবী-ফারসী শদ্ব দ্বারা ভারাক্রান্ত করতে বলছি না)। ছোট গল্প, নাটক কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধের মাধ্যমে এই ভাষাকে চালু করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকেও যথাসম্ভভ এ ভাষার প্রচলন করার প্রয়োজন। সিনমা ও রেডিও মারফত এ ভাষাকে জনপ্রিয় করারও বিস্তৃত অবকাশ রয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিচালনায় সন্ধানী দৃষ্টি রাখলে এ কাজ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। কেবলমাত্র কুরআন শরীফ পড়বার ব্যবস্থা করলেই চলবে না। গোড়া থেকেই সম্ভবমত ও শ্রেণীমত ইসলামের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও তমুদ্দনিক রীতি মাতৃভাষার সাহায্য বাধ্যতামূলকভাবে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষার্থীর মনে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান থাকলে জ্ঞানের সমগ্র শাখাই ইসলামী শিক্ষার আওতায় পড়বে ও ইসলামী শিক্ষা বলে পরিগণিত হবে। এজন্য তথাকথিত মাদ্রাসা শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার ব্যবধান তুলে দিত হবে।

সংগীত, চারুকলা ও চলচিত্র সম্পর্কে তথাকথিত ধর্মধারীরা অতি বাড়াবাড়ি করেছেন। হযরত (সা) এর কথা ও জীবনীর সবটুকু (সুবিধামত অংশবিশেষ নয়) যদি আমরা বিশ্লেষণ করে দেখি, তবে দেখব যে, তিনি গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর মত শিল্প-কলা পরিহার করতে বলেননি। তিনি স্বয়ং সংগীত ও সৌন্দর্যপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু সংগীত যখন মানুষকে কর্মহীন, অলস, সমাজবিরোধী ও নীতিজ্ঞানহীন করে দেয় তখনই তিনি সংগীতের ক্ষেত্রে আপত্তি তুলেছেন। আমরা এই বাড়াবাড়িকেই সাধারণ নিয়ম ধরে ................................
পরিকল্পনা। শিল্পের অনুপুস্থিতিতে মানব-জীবন দু:সহ। তবে ইউরোপের মত যে কোন আর্টকেই মেনে নেয়া যায় না।

শিল্প মানুষের আচারকে সুসংহত করে, মানুষের মনের ঐশ্বর্য প্রকাশ করে, সামাজিক সম্পর্ককে সুষ্ঠ ও সুসংহত করে, মানব-জীবনের বিভিন্ন দিকে রশ্মিপাত করে, ব্যক্তিত্বকে প্রসারিত করে ও সামাজিকভাবে সৃষ্টি করে। শিল্প আমাদের জীবনদার্শ প্রচারের এক বিরাট হাতিয়ার। শিল্পের মারফত আমরা আমাদের জীবনবোধকে মানুষের মনের পরতে পরতে পৌঁছে দিত পারি। ইসলামী সমাজ গঠনে শিল্পকলার ভূমিকা কোনদিনই অস্বীকার করা যায় না।


সাহিত্য প্রগতির পথ

সাহিত্য প্রগতির অন্যতম প্রধান অন্তরায় মুসলিম জনগণের অহেতুক রোমান্টিক মনোভাব, অন্যদিকে আধুনিক মুসলিমের শ্লোগানপ্রিয়তা। মুসলিম জনগণ মুসলিম রাষ্ট্র, মুসলিম শাসক ও মুসলিম সাহিত্য চেয়ে এসেছেন যুগ যুগ ধরে। কিন্তু তারা দেখেননি তাঁদের রাষ্ট্রে সংস্কৃতিতে ও সাহিত্য ইসলামের অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ সম্যকভাবে রূপায়িত হয়েছে কিনা। আবার আধুনিকেরা মুসলিম জনগণের এই মনোভাবকে ইসলামের নামে চালিয়ে দিয়ে ইসলামকে বুঝতে, চিনতে ও রূপায়িত করতে অপরাগ হয়ে পড়েছেন। সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করতে গেলে নিজস্ব জীবনবোধের ওপর শ্রদ্ধাশীল থেকে প্রচীন ও আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি, পাশ্চাত্য সাহিত্য ও সস্কৃতি, ইসলামী সাহিত্য ও সস্কৃতিকে মন্থন করতে হবে। তারপর এই সাধনাকে নিজের জবানীতে স্বতন্ত্রতা ও স্বকীয়তার মধ্যে প্রকাশ করতে হবে। সত্য চিরদিনের; কিন্তু সে সত্যকে অক্ষুন্ন রেখে নিজের জীবনবোধ ও আঙ্গীকের মারফত প্রকাশ করা চাই। দেশের মাটির আকর্ষন, ইতিহাসের ধারা ও বিশ্ব-সংযোগ অক্ষুন্ন রেখে সংযম ও স্থৈর্যের মারফত জাতির অসীম বাসনা, অযুত বেদনা ও অতন্দ্র সাধনা বিকাশ লাভ করবে।

মানুষের কাছে যা মূল্যবান, কিন্তু বাইরে থেকে চোখে পড়ে না, তাকে উদঘাটন করতে হবে। নিজস্ব প্রাণ-মনকে অবলম্বন করেই হবে আমাদের সৌন্দর্যের ও অমরত্বের সাধনা। এজন্য ইতিহাস শিক্ষা প্রণালীর রদবদল করতে হবে। অত্যাচার হিন্দু বা মুসলমানের একচেটিয়া নয়। অজ্ঞনতা ও স্বেচ্ছাচারিতাকে সমাজ-জীবন থেকে দূর করতে হবে। জীবনের সাধনায় জীবন গঠনের উপাদান শরীফ হওয়া আমাদের চিরন্তন অধিকার। জগতের জন্য আমাদের ভূমিকা শেষ হয়ে যায়নি। মানুষে মানুষে মিলনের আসল বস্তুটি মুখের নয়, বুকেরও । যারাই সত্য-সুন্দরের অভিসারে যাত্রা করেছেন, তারা যে দেশের বা যে জাতিরই হোন, তাদের সবাইকে আমরা যেন সশ্রদ্ধ সালাম জানাতে শিখি। আমাদের সাহিত্যও সংঘাত চলছে। তার ফলে আমাদের সাহিত্য এখনো শৃঙ্খলা ও আত্মশক্তি খুঁজে পায়নি, নতুন সংস্কৃতি সম্পর্কে সুষ্ঠু মানসচেতনা জাগেনি। সাহিত্য অতীত নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না; কিন্তু অতীতকে সঙ্গে নিয়েই চলবে। কারণ মানুষের রসবোধ ও জীবনবোধ অতীতের সঙ্গে যুক্ত। অতীতকে শুধু সংগ্রহ করলে হবে না, তাকে উপলদ্ধি করে সাধারণ জীবনে কার্যকরী করতে হবে। তবু সত্য ও কল্যাণের সন্ধান করতে হবে। নিছক অতীতমুখী গোরস্তান মানসিকতা ও পশ্চাদমুখিতা ত্যাগ করে পরমতম সহিষ্ণুতা ও নিজস্ব জীবনবোধের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে সাহিত্য নতুন মোড় নিতে হবে।

নিজেদের প্রচেষ্টার সামান্যের দেশে যেন আমরা ক্ষুন্ন না হই। একটি জীবন্ত জাতির জীবন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিও গতিশীল ও বলিষ্ঠ হতে বাধ্য। কিন্তু এ সহজলভ্য নয়, সাধনা ও অনুশীলনসাপেক্ষ। চিত্তের স্বাভাবিক স্ফুর্তি ও সংযম চাই। ইসামের সমগ্রতা পৌছে দিতে হবে মানুষের সামনে। সত্যিকার মুসলিম অন্য জাতিকে ঘৃণা করে না। (পাগলা কানাই, লালন ফকির) আমর সার্থক সাহিত্য সৃষ্টির যে পথের কথা বলেছি, সেই পথে চললে বাঙালী মুসলিমের মধ্যে মনীষার ও শক্তিশালী সাহিত্যিকের আবির্ভাব অসম্ভব কল্পনা নয়। আমাদের জীবনবোধ অন্ধ গোষ্ঠীবাদ বা একটি ভাষার সীমায় আবদ্ধ নয়। জীবনবোধই মুসলিমদেরকে এক করেছে ও জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সমগ্র মানুষকে ভালবাসতে শিখিয়েছে। আমাদের জীবনবোধের মাধ্যমে জাতীয় জীবনের সমস্যার সমাধান ও সাহিত্য তার প্রাণধর্মী প্রকাশ অপরিহার্য। দুনিয়ার সব ভাষার মারফতেই এই জীবনবোধ বিকাশ লাভ করতে পারে। অহেতুক আরবী হরফ ও আরবী-ফারসী আমাদের জীবনবোধের একমাত্র বাহন মনে করার হীন সঙ্কীর্ণতার ফলে আমাদেরকে চিন্তাশীল লোকদের বিদ্বেষ কুড়াতে হয়েছে।

জীবনের পারিপার্শ্বিকতার দিকে জাগ্রত দৃষ্টি দিয়ে স্বকীয় আদর্শ অক্ষুন্ন রেখে ঢেলে সাজাতে হবে। এ জীবন্ত জীবনবোধই হবে আমাদের সাহিত্যের জীবনকাঠি। মুসলিম মানসের সেই ঔদার্য, ব্যাপকতা ও সর্বজনীনতা আবার আনতে হবে। স্বীয় দু:খ-কালিমাকে লুকিয়ে না রেখে সেগুলো সাধারণো প্রকাশ করে, অনুশীলন করে, আত্মস্থ করে, দুঢ় প্রত্যয় নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তবেই আমাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্য নবজীবন লাভ করে স্বগৌরবে প্রদীপ্ত হবে ও আমরা নতুন পথে অগ্রসর হতে পারব।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম