আমাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্য
মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে তমদ্দুন বা সংস্কৃতির জন্ম হয়। তমুদ্দনের অগ্রগততিতে সাধনা ও অভিজ্ঞতা-এ দুটো জিনিস সমানভাবে পাশাপাশি কাজ করে চলে। সভ্যতা সংস্কৃতি সাধনাসাপেক্ষা। কষ্ট করে, প্রচেষ্টা চালিয়ে যা অর্জন করা গেল, তা বিস্মৃতি হলে পর যে সার বস্তুটুকু বেঁচে থাকে, তাই হলো মানব-সব্যতার অন্তনির্হিত নির্যাস-আর তাকেই বলতে হবে তমদ্দুন। সংস্কৃতি কথাটা সেই কারণে অনেক রিফাইনমেন্ট অর্থে ব্যবহার করতে প্রয়াসী : আবার কেউ বা মানবকল্যাণমুখীনতাকে তমদ্দুনের আসল জিনিস বলে তুলে ধরেন। কারো কারো মতে, বুদ্ধিমত্তার কায়েমী আসন পাতা তমুদ্দনের মাঝে কোন বিশেষ যুগের ও দেশের জনসাধারণের বুদ্ধির সেই যুগের ও দেশের সাংস্কৃতিক মূল্য মোটামুটি তমদ্দুনকে আমরা দুভাগে ভাগ করে দেখতে পারি: ১। আদর্শিক বা সার্বজনীন আদর্শভিত্তিক তমদ্দুনও ২। আদর্শহীন বা আকস্মিক তমদ্দুন। আদর্শগত তমুদ্দনকে আবার দুপর্যায়ে ভাগ করা চলে: ক. বস্তু ও আত্মার সমন্বয়গত তমদ্দুন ও খ. বস্তুগত তমদ্দুন। ইসলাম ও অন্যান্য সার্বজনীন ধর্মের উপরে ভিত্তি করে যে তমদ্দুন গড়ে ওঠে, তাকে প্রথম বা ক পর্যায়ে এবং ফ্যাসিজম, নাৎসীজম ও মার্কসীয় সাম্যবাদ বা কমিউনিজমকে দ্বিতীয় বা খ পর্যায়ভূক্ত করা যায়। আবার আদর্শহীন তমদ্দুনকে ক, জাতিভিত্তিক ও খ. স্থান ভিত্তিক এই দুভাগে ভাগ করা চলে জার্মান সাংস্কৃতি মূলত জাতিভিত্তিক ও আধুনিক ভারতীয়, বৃটিশ ও মার্কিন সংস্কৃতি স্থানভিত্তিক। আমরা তাই চার রকমের তমদ্দুন, জাতিভিত্তিক তমদ্দুন ও স্থান ভিত্তিক তমদ্দুন।
আদর্শমূলক তমদ্দুন ও আদর্শহীন তমদ্দুনে যথেষ্ট তফাত রয়েছে। আগর্শগত সংস্কৃতিতে আদর্শকে সচেতনভাবে সমাজ জীবনে রূপায়িত করা, অপরদিকে আদর্শহীন তমদ্দুনে জাতি ও স্থানকেই সংস্তৃতির প্রধান ভিত্তিরূপে গণ্য করা চলে। জাতি ও স্থানকেই এখানে সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কোন সার্বজনীন আদর্শের উপর ভিত্তি করে সমাজ সংগঠন করা এই তমদ্দুন গুলোতে খুব বেশী বড় ব্যাপার নয়। এদিক দিয়ে বিচার করলে সব রকমের আদর্শহীন সংস্কৃতিকে সুবিধাবাধী সংস্কৃতিও বলা যেতে পারে। আবার একান্ত ভাবে বস্তুভিত্তিক সংস্কৃতিআদর্শবাদী হলেও আত্মজ্ঞানের অভাবে ও মানবচেতনাকে পরিপূর্ণকে বস্তুগত বলে মনে করার দরুন শেষ পর্যন্ত সুবিধাবাদী সংস্কৃতিতে পর্যবসিত হতে পারে। মার্কসবাদ এরূপ একটি বস্তুভিত্তিক তমদ্দুন। এই জীবন প্রচেষ্টার নাম হলো সংস্কৃতি। জীবন সংগ্রামের প্রকৃতির উপর অধিকার বলতে বুঝায় উৎপাদন শক্তি ও তার বিভিন্ন আকার-প্রকারের হেরফের। এ মতবাদের অনুযায়ী উৎপাদন শক্তির পরিবর্তনের মাঝে সংস্কৃতির বিবর্তনের রূপ দেখতে পাওয়া যায়। উৎপাদন পদ্ধিতকে সংস্কৃতির মাল-মসলা হিসেবে ধরে না নিয়ে এ শক্তিকে মার্কসবাদে এক একচ্ছত্রনীতি বা প্রিনন্সিপাল হিসাবে ধরে নেয়া হয় ও তথাকথিত বৈজ্ঞানিকতার মারফত এই পদ্ধতি মানবতা ও মানবাধিকারকে ছাপিয়ে নৈতিক বা মরার মান নির্ণয়ে তৎপর হয়ে থাকে।
ইসলামী জীবনদর্শনে যে তমদ্দুনের জন্ম দিয়েছে, তা হলো একটি আদর্শ-ভিত্তিক তমদ্দুন। তবে আদর্শগত তমদ্দুন বলেই কোনমতে একে সংকীর্ণ বা কুপমুন্ডুক সংস্কৃতি বলা যায় না। কারণ ইসলামী জীবনদর্শন সর্ব দেশ, কাল, দর্শন ও তমদ্দুন থেকে বিনয়ের সাথে যা কিছু সুন্দর মহান চিরন্তন, কল্যাণকর, তাকে সাদরে বরণ করে নিতে উদাত্ত আহবানে জানিয়েছে বারে বারে। তবে যেসব ভাল জিনিস গ্রহণ করা হলো, তাকে ইসলামে ভাবধারায় সমৃদ্ধ ও তৌহীদবাদ দ্বারা সঞ্জীবিত করে তুলতে হবে। ইসলামী সংস্কৃতি সব মানুষের, সব জাতির, দেশের ও কালের সংস্কৃতি। সেইজন্য এই সাংস্কৃতি বিভিন্ন ভাষা, জাতি ও দেশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। বিভিন্ন জাতি, দেশ ও ভাষা হলো তমদ্দুনের অপরিহার্য মাল মসলা। কিন্তু এই সংস্কৃতির মূলনীতি ইসলামী জীবনদর্শন ও মানবতার উপায়ে নির্ভর করে। জাতি ও দেশ, বর্ণ ও ভাষঅ এই সংস্কৃতির মূল ভিত্তি, যার উপরে নির্ভর করে তার বিরাট সৌধ ও শাখা-প্রশাখা। যে তমদ্দুন আদর্শহীন, তাতে মূল্যবোধের কোন বিশেষ স্বীকৃতি আমরা দেখতে পাইনা। আর তার পেছনে কোন সচেতন ও সংবেদনশীল বিকাশ ও বিবর্তন দেখতে পাওয়া যায় না। কাজেই বুঝা গেল যে, আদর্শিক সংস্কৃতির মাপকাঠিতে এবং আকস্মিক সংস্কৃতি ও সাধারণ সমাজবৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির মাপকাঠিতে পার্থক্য বিস্তর। ইসলামী সংস্কৃতি মূলত আদর্শিত, কার্যত সমাজতাত্ত্বিক আর আদর্শহীন তমদ্দুন মূলত আকস্মিক, কার্যত সমাজতাত্ত্বিক। সাধারণত সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে দুটো আকস্মিক, কার্যত সমাজত্ত্বিক। সাধারণত সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে দুটো সংস্কৃতির বাহ্যিক সাদৃশ্যই তাদের পারস্পরিক সমতা সপ্রমাণ করে। যেমন যুক্ত প্রদেশের এবং কাশ্মীরের হিন্দু ও মুসলমান আর আরবদেশের খৃষ্টান ও মুসলমান। কিন্তু আদর্শিক সংস্কৃতির বিচারে সংস্কৃতির বিচারের এই মানদন্ড ও পদ্ধতি একেবারে কৃত্রিম। কোন এক দেশের আদর্শগত সংস্কৃতির অপর এক দেশের আর্দশগত সংস্কৃতির বাহ্যিক দিক থেকে পৃথক হতে পারে। (আর এর ফলে সাধারণ সমাজতাত্ত্বিক বিচারে তারা দুই সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য হবে। যেমন সিরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ইসলামী সংস্কৃতির জাতিভূক্ত আর বর্তমান চীন ও রাশিয়া কমিউনিস্ট সংস্কৃতির গোষ্ঠীভূক্ত। অবশ্য একথা সত্য যে, মূল্যবোধ এক হলে, কালচার ও তমুদ্দনের বাইরের দিকটা কোন কোন ক্ষেত্রে এক রকম হতে পারে। আবার দেশ, কাল, বণৃ ও ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে সেই ......................................................
সংস্কৃতির মাপকাঠিতে একই সংস্কৃতিভূক্ত বলে গণ্য হতে পারেন না। আল-কুরআন একথা খুব স্পষ্ট করেই বলেন: মহান আল্লাহ মানুষকে কথা বলার ক্ষমতা দিয়েছেন; (সূরা আর রহমান : ৫৫ : ১-৪)। সেই হিসাবে দুনিয়ায় সব ভাষাই সংস্কৃতির ভাষা।
প্রতিটি ভাষা আল্লাহর দোয়া শক্তি থেকে উদ্ভূত। তৌহীদজাত সমাজ ব্যবস্থা গঠনের আহবান নিয়ে সমগ্র মানবাতির জন্যই প্রেরিত হয়েছি। তবে প্রাথমিক দিকে আরববাসীকে তিনি অজ্ঞানতা থেকে নিয়ে এলেন আলোর পথে। তাই বলা হল : কুরআকে আমরা তোমাদের নিজের ভাষায় তৈরী করেছি, যাতে তোমরা সাবধান বাণী শুনতে পাও। (আল লোকমান :৪৪-৫৮) কুরআনের মতানুসারে মাতৃভাষাই শিক্ষার শ্রেষ্ঠ বাহন। আল্লাহ প্রেরিত পয়গম্বরগণ তাঁদের নিজ নিজ ভাষার ভেতর দিয়েই ধর্মের বাণী প্রচার করেছেন। আমরা একজন রাসূল (সা) পকে পাঠাইনি, যিনি তাঁর গোষ্ঠীর নিজের ভাষার মারফতে প্রচার করেননি, যাতে করে তারা আল্লাহর কালাম স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। (ইবরাহীম ১৪ : ৪)। ভাষা ও বর্ণের পার্থক্য সৃষ্টির বৈচিত্র ও মহিমা ঘোষণা করে। তাঁর (আর) নির্দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে; আসমান যমীনের সৃষ্টি আর বর্ণ ও ভাষার বৈচিত্র; এর মধ্যে সব মানুষের জন্য রয়েছে অগণিত নিদর্শন; (৩০ : ২৭-২৮)। সব ভাষাই ইসলামী ভাষা ও ইসলামের জীবনদর্শন কোন একটা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা হবে ইসলামের তমদ্দুনী ভাষা। কাজেই বাস্তব ক্ষেত্রে ইসলামী মূল্যবোধের আওতায় বিচিত্র সংস্কৃতির সমন্বয়ে মানবতার উদ্বোধন ও সুষ্ঠু সমাজ গঠনের নামই হল ইসলামী সংস্কৃতি। আল্লাহ বলেন :বিভিন্ন জাতিকে পারস্পরিক আদান-প্রদান, পরিচিত ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার জন্যই পয়দা করা হয়েছে। তবে কেবল মাত্র সে জাতিই শ্রষ্ঠত্ব দাবী করতে পারে, যারা সৎ ও মহৎ। কোন একটি ভাষায় কথা বলাই ভালো, আর অপর একটি ভাষায় কথা বলা খারাপ-এই মতবাদ ইসলাম-বিরোধী। উগ্র গোষ্ঠীবাদ ও জাতীয় অন্ধতার ফলে উগ্র জাতিগত অন্ধতাকে অনেকদিন ধরে ইসলামের সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে। কিন্তু ইসলামী মূল্যবোধের দৃষ্টকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, এই মানসিকতার সঙ্গে ইসলামী জীবনর্শনের কোন রফা হতে পারে না। কারণ ইসলামে কোন একটি ভাষা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড নয়, নীতিজ্ঞান ও তার বাস্তব রূপায়নই শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র নিরিখ।
ইসলাম তমদ্দুন জাতিগত অন্ধতা মানে না। অরিজিন্যাল ও কনভার্টেড মুসলমানে এই সমাজ ব্যবস্থার আওতায় কোন পার্থক্যই স্বীকার করা হয় না। রক্ত, বর্ণ ও ভাষার ভিত্তিতে মুসলমানের ঐক্য নয়, আদর্শের দিক থেকেই মুসলমান একসূত্রে বাঁধা।
সংস্কৃতির বিকাশে সাহিত্যের অবদান অনস্বীকার্য। সাহিত্যের মধ্যে দিয়েই এক একটি জাতি তার অন্তর্নিহিত ভাবধারা প্রকাশ করবার সুযোগ পায়। প্রাচীনকালে ব্যাকরণের সঙ্গে মিলিয়ে যা পড়া হতো, তাকে বলা হতো সাহিত্য। সাহিত্যের এই ধাতুগত ব্যাখ্যা এর অন্তনির্হিত ভাবটার প্রকাশ করতে পারে না। কথার মধ্যে যে শিল্পজ্ঞান আছে, যে রসবোধ আছে, তা হলো সাহিত্যের অর্ধভাগ। সাহিত্যের প্রকাশধর্ম হলো কাল্পনিক, সৃষ্টির আবেগে যে মানব সংগীত কথার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে, তাই সাহিত্যে যদি কোন উপদেশ থেকে যায়, তা ইংগিতে-ইশারায়, আকারে-প্রকারে প্রকাশ পাবে, তার মধ্যে ফুটে উঠবে এমন একটি সাবলীলতা ও অপরূপতা, যার নাম এক কথায় দেয়া চলে কান্তা-সস্মিত। যে জাতির জীবন লক্ষ্যহীন, যার কিছু পাবার নেই, তার বলবারই বা কি থাকে? যে জাতির কোন জীবনবোধ নেই, যার জীবন আদর্শহীন, তার সাহিত্যিক স্ফুরণ হবার নয়। কারণ সাহিত্য মানুষের জীবন সাধনা ও জীবন প্রবাহের নব নব রূপায়ণ।
ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণাকে অযথা জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছে : সেটি হচ্ছে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে ধর্ম বিশেষভবে পরিপন্থী। কারণ ধর্ম মানলে নাকি সাহিত্যিকের রসকল্পনা বিশিষ্ট শ্রণী-প্রত্যয়ের উপরে উঠতে পারে না, বুদ্ধিদীপ্তির অভাব ঘটে ও সমাজজীবনে সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে মানবিক নীতি, পুরোহিততন্ত্র ও ধর্ম এক জিনিস নয়। সেই সমাজকেই ধর্মীয় সমাজ বলা হয়, যেকানে এই নীতিগুলো সামাজিক চাহিদা ও পরিবেশের ওপরে নির্ভর করে বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে। ধর্ম একথা প্রমাণ করতে চায় না যে, সমাজে শোষণ নেই। মানব সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব থাকা আর শোষক শ্রেণী থাকা এক কথা নয়। শোষণ ও শ্রেণী-সংগ্রামকে অস্বীকার করলে যেমন সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা যায় না, তেমনি সমাজনীতি ও সামাজিক কার্যপদ্ধতিকে নিছক শ্রেণী-সংগ্রাম ও হিংসাভিত্তিক করে গড়ে তুললে, কি উঁচুদরের সাহিত্য, কি উঁচুদরের সমাজ কোনটাই জন্মলাভ করতে পারে না। তবে সমাজের ও সাহিত্যের যেটুকু উচ্চাংগের ও যেটুকু মংগলময়, সেটুকু অর্জন করা সম্ভব হয় রসবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিভালবদ্ধ জ্ঞানকে শ্রেণীপ্রত্যেয়ের ওপর তুলে ধরেই। তাই সাহিত্য সৃষ্টি করতে গেলে যেমন বাস্তবগ্রাহ্য মন চাই, তেমনি সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টির প্রয়োজনও স্বীকার করতে হবে। সাহিত্য এই দৃষ্টিকোণের স্বীকৃতির মাঝে কেবলমাত্র শ্রেণী-বিচার যথেষ্ট নয়। কেবল রস সৃষ্টির ব্যাপারে কেন, সামাজিক উৎকর্ষের জন্যও এই উপলব্ধিও মানবচেতনা অপরিহার্য। আর সার্বজনীন ধর্মের মূল্যবোধ এই মানসিকতাকে কোন মতেই খর্ব করে না। কারণ এই মূল্যবোধের মাঝে রয়েছে মানবতার জয়জয়কার।
হরহামেশা একথা বলা হয় যে, ধর্মের আওতায় সাহিত্যের বিকাশ ও প্রতিভার স্ফুরণ নয়। কারণ প্রতিভার বড় গুণ হলো বৈচিত্র ও অস্বীকার করার নেতিবাচক বৈপ্লবিক মনোবৃত্তি। আসলে সার্বজনীন ধর্মের মূল্যবোধ বাস্তবে কাজে লাগানো হলে এই বৈচিত্র মৃতকল্প হয়ে যাবার কোন কারণ নেই। সার্বজনীন ধর্মের মূলনীতিগুলো এত ব্যাপক ও সার্বজনীন যে, এর আওতায় মানুষের প্রতিভা নব নব রূপে, রসে, আকারে, প্রকারে আত্মপ্রকাশ করার ভরসা রাখে। বাস্তবে কাজে লাগনো হলে এই বৈচিত্র মৃতকল্প হয়ে যাবার কোন কারণ নেই। সার্বজচনীন ধর্মের মূলনীতিগুলো এত ব্যপক ও সার্বজনীন যে, এর আওতায় মানুষের প্রতিভা নব নব রূপে, রসে, আকারে, প্রকারে আত্মপ্রকাশ করার ভরসা রাখে। মানুষের জীবনবোধ সার্বজনীন না হবার ফলে ও বাস্তব জীবনে রূপায়িত না হবার ফলেই বরং সাহিত্য ও সংস্কৃতি পঙ্গু, শ্লথগতি, সংকীর্ণ ও মৃতবত হয়ে পড়ে। সার্বজনীন ধর্মের দৃষ্টিতে সব জীবনদর্শনকেই এক-একটি ধর্ম ভলে অভিহিত করা হয় ও সর্বজনীন ধর্ম হলো এক প্রকারের সার্বজনীন জীবনাদর্শ। তাই ধর্মকে এখানে কেবল নীচুদরের লোকদের কালচার মনে করার প্রবৃত্তি নেই বা কালচারকে উঁচু স্তুরের ধর্ম মনে করে চিন্তার কুয়াশা সৃষ্টিরও প্রয়াস নেই। ইসলামে পুরোহিততন্ত্র স্বীকৃতি পায়নি। ধর্মকে আমরা যদি পুরোহিততন্ত্র হিসেবে মনে না করি, তবে উঁচু স্তর ও নীচু স্তর সব স্তরের লোকেরই ধর্ম বা জীবনবোধ একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। তবে সে জীবনদর্শন সর্বজনীন ধর্ম জীবনরোধের অনুসারী কিনা, সে প্রশ্ন বিচারসাপেক্ষ।
ধর্ম কথাটিতে নীতি বা মূল্যবোধ অর্থে গ্রহণ করলে ও সেই মূল্যবোধ ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে পালনে করলে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কৌণিকতার কোন সম্ভবনা নেই। বহুভঙ্গিম সাহিত্যের সৃষ্টি ও প্রসার আর অসীম কৌতুহল ও বিস্ময়ে দৃষ্টির উৎকর্ষে একান্তরূপেই সম্ভব। ধর্মকে শুধু মানলে হয় না, জীবনকে জীবনবোধের মাধ্যমে জানতে ও জয় করতে হয়, সেটাই আল-কুরআনের সাংস্কৃতিক চিন্তার বড় কথা।
তারপর প্রকৃত ধর্মাদর্শের প্রবণতা মানুষকে বিচ্ছেদের দিকে কিছুতেই টানতে পারে না। কারণ ধর্মের আদর্শ উদার, মানবিক ও সার্বজনীন। এই আদর্শ সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণার ফলেই বিচ্ছেদ, কলহ ও সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি হয়। অজ্ঞনতার ফলে ধর্মীয় মূল্যবোধ, সাম্প্রদায়িকতা ও নায্য সাম্প্রদায়িক অধিকারের মধ্যে পরপস্পর পার্থক্য নির্ণয় করাও কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষের আদর্শিক পার্থক্য নির্ণয় করে দিলে সার্বজনীন ধর্মাদর্শ মানুষকে এক করে ভাগ করে না। যদি বলা হয় যে ধর্ম মানুষের-মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, সুতরাং ধর্ম চাই না; সুতরাং প্রশ্ন ওঠে মানুষ সম্পূর্ণরূপেভাব ও চিন্তানিরপেক্ষ হতে পারে কিনা। সব মানুষ কমবেশী চিন্তাশীল। তাই মানুষের পক্ষে এটা একেবারেই অসম্ভব। বুদ্ধিমত্তা মানুষের একটা অপরিহার্য গুণ। আর বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্বের ফলে মানুষের মধ্যে চিন্তার বিভিন্নতা দেখা দেয়। তথাকথিত ধর্ম না চাইলেও জীবনবোধ বা ধর্ম মানুষকে মানুতেই হয়। তবে সে জীবনবোধকে হয়ত দর্শক নামে অভিহিত করা হয়। ধর্ম হয়ত সে মানতে চাইল না, কারণ ধর্মকে সে পুরোহিততন্ত্র বলে ধরে নিল। কিন্তু ধর্মের স্থানে নতুন নতুন দর্শন এসে শিকড় গেড়ে বসে। গণতন্ত্র এলো, তার রকমের অন্ত নেই; সমাজতন্ত্রে, তার আবার হরেক কিসিম, তাই বলে কি জোর করে কোন একটা দর্শন বা ধর্ম মানুষের উপর চাপিয়ে দেবো? আসল কথা হলো, সব ধর্ম ও দর্শককে বেঁচে থাকার অধিকার দান করতে হবে, তাদের বিকৃতি দূর করতে হবে, আর তাদের স্বকীয়তা অক্ষুন্ন রেখে নিজ নিজ সার্বজনীন ধর্মে এই মানবিক দিকগুলো বড় করে তুলতে হবে, সার্বজনীন ধর্মে এই মানবিক দিকগুলো বড় করে তুলে ধরতে হবে, সার্বজনীন ধর্মে এই মানবিকতার অভাব নেই, কারণ জ্ঞানের সাধনা ও অন্যান্য ধর্ম ও দর্শনের প্রতি উদারতা এর একটা মূল্যবান নীতি। এ মানবিকতার (উদ্র গোষ্ঠীবদ্ধতার নয়) ওপরে ভিত্তি করে মানব অধিকারের স্বীকৃতি ধর্মীয় সমাজ ব্যবস্থার মূল নিরিখ। চলিষ্ণু জগত ও সমাজের মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করা এই জীবনবোধের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ জীবনব্যবস্থায় ধর্মের ব্যাখ্যায় ধর্ম ব্যবসায়ীদের নীতি মারফত মানুষের বুদ্ধি ও আত্মার মুক্তি ষোষণা করেছে ও বুদ্ধিকে সদাজাগ্রত রাখতে দিয়েছে অপুরন্ত প্রেরণা। তবে যে পরিমাণে বুদ্ধির লম্ফন-কুর্দন মানবতা ও সাধারণ মানুষের অধিকারগুলোকে লংঘন করে যায়, সেই পরিমাণে ইসলামী দর্শনের মূল্যবোধ-অনুগ ও মানবিক হওয়া বাস্তব মুক্তি ও মানসিক স্ফূর্তি চেয়েছে, কিন্তু এর কুর্দন-কোলাহল বরদাশত করেনি। অবশ্য এ কথা সত্য যে, আমাদের দেশের অজ্ঞ জনসাধারণ ও ধর্ম ব্যবসায়িগণ ইসলামের বহু বিঘোষিত বুদ্ধিদীপ্তিকেও অনেকে সময়ে ইসলাম-বিরোধী বলে ফতোয়া দিতে ছাড়েনি। হৃদয়ের মূকুক্ষা ও চিন্তার বিপ্লব মূলত ইসলামের অনিভিপ্রেত হতে পারে না। ইসলামী সাহিত্যের সহজ স্বীকৃতির মাঝে রয়েছে বর্তমান অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সুষ্ঠতা নিয়ে আসার তাগিদে। রাশিয়ার পীটার দি-গ্রট এর বা তুরষ্কের সুলতানের মত তামদ্দুনিক শুদ্ধিকরণ নয়।
এই কারণে আমাদের জাতীয় সাহিত্য কেউ যদি ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রত্যাশা করেন, তা হবে নিতান্ত স্বাভাবিক। তাকে শরীয়তের হুবুহু প্রবর্তন বললে ভয়ানক ভুল করা হবে। কারণ ধর্মের সর্বকালীন মূল্যবোধের পেছনে রয়েছে মানবচিত্তের চিরন্তন স্পন্দন। যে সদাজাগ্রত চিন্তা ইসলামী সাংস্কৃতির নব নব সম্ভবনার ইঙ্গিত, তাকে পুনরায় সঞ্জীবিত করে তুলতে হবে। ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বা জাতিতে গোল বাধতেই পারে না। যিনি প্রকৃতপক্ষে ধর্ম পালন করেন, তিনি ধর্মের আপাত বিরোধিতার মাঝেও ঐক্য খুঁজে বার করেন ও সবার ও সবার সঙ্গে মিলতে পারেন। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মূল কারণ হলো ধর্মের আসল রূপ, মানবতা, সর্বজনীনতা ত্যাগ সম্পর্কে ভ্রান্ত কারণ হলো ধর্মের আসল রূপ, মানবতা, সর্বজনীনতা ও ত্যাগ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা। নিজের ধর্মে দৃঢ় বিশ্বাস ও অপরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা একসঙ্গে বিদ্যমান থাকা মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়।
তাই জাতীয় অগ্রগতির যুগে আমাদের শুধু তথাকথিত ধর্মপ্রাণ হলে চলবে না। (ধর্ম অবশ্যই মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীন রূপ, যা সর্বযুগেইবহুমূল্য) আমাদেরকে আজ প্রাণধর্মী ও ধর্মপ্রাণ দুই-ই হতে হবে একসঙ্গে। বিচারবুদ্ধকে জাগ্রত করে আমাদের সমাজের জীবনবোধের উপর ভিত্তি করে এক প্রাণসঞ্চারী নতুন সাহিত্য ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য গোরস্তান-মানসিকতা ও মোল্লাতন্ত্র বর্জন আমাদের প্রধান কর্তব্য।
0 comments: