অধ্যায় ০৪ : বাঙালী মুসলিম সংস্কৃতি ও সাহিত্যে মুসলিমদের অবস্থান

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎপত্তি এবং মুসলমান

মুসলিম আমলের পূর্বে বংলা ভাষা ও সাহিত্যের কোন নযীর পাওয়া যায় না। অবশ্য বৌদ্ধ যাজকরা বাংলার মৌলিক ও কথ্য ভাষায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করতেন ও ধর্ম গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। খ্রীষ্টীয় সপ্তম ও দশম শতাব্দীতে ব্রাক্ষ্ণন্যবাদের সঙ্গে সংঘর্ষে সেই বৌদ্ধ-সাহিত্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। সাধারণ লোকের মুখের ভাষাকে ব্রাক্ষ্ণণেরা ইতর বা নীচুদের ভাষা বলতেন। মুসলিম সম্পর্কের ফলেও ইসলামের তৌহিদ ও সাম্যনীতির সংস্পর্শে বৌদ্ধ দোঁহার এই বাংলা ভাষা ও তুর্কী মুসলিমের সংযোগে এক নতুন ভাষার উৎপত্তি হলো, যা বাংলা ভাষার প্রথম স্পষ্ট ও ঐতিহাসিক সাহিত্যিক রূপ। এই ভাষা হিন্দু-মুসলমানের ভেতর সমানে প্রচলিত ছিল। দলিল-পত্রাদিতে এর স্পষ্ট নযীর রয়েছে। গৌড়ের সিংহাসন নিয়ে মুজাফফর শাহ ও শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই সুযোগে হাবশী দাসগণ বিদ্রোহ করে। তখন বাংলার হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে বিচক্ষণ ও মানব প্রেমের চরিত্রবান হোসেন শাহকে (১৪৯৩-১৫১৯) গৌড়ের আধিপতি নির্বাচিত করলো। তিনি মগদেরকে পরাস্ত করেন ও তাঁর আমলেই কামরূপ গৌড়ের অন্তর্ভূক্ত হয়। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা তাঁর করতলগত ছিল।

হোসেন শাহের হৃদয় ছিল উদার, সরল ও একাত্মবোধদীপ্ত। তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নব যুগের প্রবর্তন করলেন। তাঁর পূর্বে সংস্কৃতি শাস্ত্রগ্রন্থ বাংলায় তরজমা হয়নি। তাঁর সভাতেই বাংলা কাব্যের গোড়াপত্তন হলো। তিনি প্রথম বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের প্রবর্তন করলেন। ফারসী ভাষার পারদর্শী হিন্দু-মুসলমান মিলিতভাবে সাহিত্য সৃষ্টি করে চললেন। এইভাবে এক মহানুভব মুসলমান শাসনকর্তার মহানুভবতায় ও ইসলামের তৌহীদে, সামাজিক সাম্য ও মানবিক ঐক্যের প্রত্যক্ষ প্রভাবে ঐতিহাসিক বাংলা ভাষার জন্ম হলো। হোসেন শাহের প্রেরণায় বেদ, গীতা, রামায়ণ ও মহাভারত বাংলা ভাষায় অনুদিত হলো। এই সময়ের অনুবাদক ও সাইহিকদের মধ্যে মালাধর বসু (গুণরাজ খাঁভাগবতের অনুবাদ), গোপীনাথ বসু (পুরন্দর খাঁ), বিজয়গুপ্ত (পদ্মাপূরাণ), কবীন্দ্র পরমেশ্বর (পরাগলী মহাভারত) ও শীকর নন্দীর (মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব) নাম উল্লেখযোগ্য। শ্রীকৃষ্ণবিজয়, মনসা মঙ্গল, ভারত পঞ্চালী, এই সব গ্রন্থও এই আমলে রচিত হয়। উত্তর ভারতের মুসলমানের শ্রেষ্ঠ দান যেমন উর্দু ভাষা, তেমনি বাংলাদেশে মুসলমানের শ্রেষ্ঠ দান হলো বাংলা ভাষা। এইভাবে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা ও পূর্ণবিকাশে মুসলমানগণ প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করলেন। শাহ মুহম্মাদ সগীর ও আলাওল বাঙালী সাহিত্যের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। হোসেন শাহের জীবন বাংলা সাহিত্যের স্ফুরণ অমর হয়ে রয়েছে। অবশ্য এই আমলের পূর্বেও মুসলমানদের লেখা বাংলা পুস্তক পাওয়া যায়। চতুর্দশ শতাব্দীতে মুসলমানের হাতে যে বিরাট পুঁথিসাহিত্য গড়ে উঠলো, তা বহুলাংশে আত্মরক্ষামূলক। বৈষ্ণবাবাদের প্রভাবে ইসলামী সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা তার মধ্যে স্বতস্ফূর্ত।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিবর্তন এবং পলাশীর যুদ্ধ কেবল বাঙালী মুসলমানের রাজনৈতিক পতন আনেনি, তাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরাজয়ও এরই সঙ্গে এসে পড়লো। মুসলামনের এ পরাজয় হিন্দুরা সাদরে বরণ করে নিয়েছে ও সন্তুষ্ঠচিত্তে বৃটিশের শাসন মেনে নিয়েছে। নিজেদের সুযোগ-সুবিধা তারা খুঁজে পেলো বৃটিশের শাসনে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অনুসৃত নীতির ফলে চাকরীর ক্ষেত্রে তাদের একচ্ছত্র অধিকার কায়েম হয়ে গেল। এইভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানের অস্তিত্ব মুছে গেল। ফরাসী ভাষা ও মুসলিম আইনের স্থানে ইংরেজী ভাষা ও আইন রাষ্ট্রীয় ভাষা ও আইন হওয়ায় মুসলমানগণ লজ্জায়, ক্ষোভে, দু:খে সরে দাঁড়ালেন। অবশ্য শাসনকার্যে সুবিধার জন্য কলকাতায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করে কিছুদিন তথাকথিত মৌলভী তৈরীর মহড়া চললো। তবে ইসলামের প্রাণধমৃ জীবনর্শনের কোন শিক্ষা সেখানে ছিল না। আয়ম-লাখেরাজ বাজেয়াফত করে (১৭৯৭-১৮২৮) সেখানে তথাকথিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গোড়াপত্তন করা হলো। পলাশী পরবর্তী যুগের মুসলিম অসহযোগের সুযোগ হিন্দুরা খুব ভালভাবেই গ্রহণ করলো, আর মুসলিমেরা ডুবে গেল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নৈরাশ্যের অন্ধকারে।

অতপর বাংলা ভাষার বিকাশও মুসলামনের হাত থেকে সরে গেল। এর স্থান দখল করলো হিন্দুঘেষা খ্রীষ্টান মিশনারী ও হিন্দু সাহিত্যিকগণ। ১৮০০ সালে শ্রীরামপুরে মিশনারী ও হিন্দু সাহিত্যিকগণ। ১৮০০ সালে শ্রীরামপুরে মিশনারী কেরী মার্শম্যান ওয়ার্ড খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচারের তাগিদে যে বাংলা ভাষা প্রবর্তন করলেন, তাতে হিন্দদের প্রভাব সুস্পস্ট। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একচ্ছত্র হিন্দুযুগ শুরু হলো। এলো হেমচন্দ্র, মধুসূদন, নবীনচন্দ্র ও বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ। হিন্দুত্ব ও বাঙালিত্ব এক জিনিস হয়ে দাঁড়ালো। হিন্দু বাংলা সাহিত্যকে বাংলা সাহিত্য বলে চালানো হলো বহুদিন। ফলে আদি থেকে বাংলা সাহিত্যের যে একটা মুসলিম ধারা ছিল, তা বিস্মৃতির তলে তলিয়ে গেল। বাঙঅলীর জীবন বলতে হিন্দু বাঙালীর জীবনই বোঝাতে হতো। বাংলাদেশের মুসলমানও যে বাঙালী, একথা সবাই এক রকম ভুলেই গেল। মুসলমান কথাটি বাঙালী হিন্দুর কাছে অবাঙালী বলে ঠেকাতো। আমাকে কলকাতায় এক হিন্দু ভ্রদলোক জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি মুসলমান না বাঙালী? আমি জওয়াবে বলেছিলাম, আমি বাঙালী মুসলমান।

বাংলা ভাষা হিন্দু ও মুসলমানের কাছে ভিন্নরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। রাষ্ট্রীয় জীবন এক হলেও যে সাংস্কৃতিক জীবন আলাদা হতে পারে, বাংলার হিন্দু-মুসলমানই তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। পুঁথি-সাহিত্য থেকে মুসলিম জনগণ অফুরন্ত প্রেরণা পেয়েছে কিন্তু ইতিহাসের বিবর্তনে বাংলা ভাষার জনক মুসলমানের নিকট থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য দূরে সরে গেছে। এই বিবর্তন হিন্দু-বৃটিশ আঁতাতের অনিবার্য ফল। ভারতচন্দ্র ও কবি কঙ্কনের মধ্যে যে ভাষা দেখতে পাই, তাতে মুসলিম প্রাধান্য ছিল সুস্পষ্ট। বর্তমানকালে জনসাদারণের কাছে অপ্রচলিত কৃত্রিম ভাষাই হয়েছে সাহিত্যের বাহন। আর সে যুগে প্রচলিত ভাষাই সাহিত্যের ভাষা।

বাঙালী মুসলিম সংস্কৃতি

মুসলমানের কাছে আর্দশ ইসলাম ও মানবতা, দেশজ আদর্শ ও নীতির চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইসলাম আদর্শ মানবতার আওতায় দেশকে ভালবাসাতেই শিখিয়েছে। নিজের দেশকে ঘৃণা বা দেশের জনসাধারণকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতে কোনদিনই বলেনি। খাঁটি মুসলমানের কাছে (এবং সব ধার্মিকের কাছে) তাঁর আদর্শগত সংহতি তাঁদের দেশের সীমানার চাইতে বড়। কারণ সেই আদর্শ জাতিগত অন্ধতা দূর করে সব মানুষকে ভালবাসতে শেখায়। ইসলামী জীবনদর্শন সম্বন্ধে গভীর পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এই আদর্শ মুসলমানকে তার নিজের দেশের সমস্যাকে অবহেলা করে অলীক কল্পনা করতে বলেনি। কিন্তু ইসলামের মহত্ব, মানবতা ও সুবিচারের আদর্শ দেশজ, পার্থক্য, সংকীর্ণতা চরমবাদের উর্দ্ধে। দেশকে বা দেশত্মবোধকে ইসলাম কোনদিন অস্বীকার করেনি বা নষ্ট করে দিতেও চায়নি। বিভিন্ন দেশ,জাতি বর্ণ ও ভাষা ইসলাম স্বীকার করেছে। কিন্তু দেশ বা জাতির মাধ্যমে উগ্র বা চরম নীতিবোধ (দেশের কুকুর বিদেশের ঠাকুরের চেয়ে শ্রেয়) আমাদের দেশ যা করে সব ভাল) কখনো স্বীকার করেনি। মুসলিম বাদশাহদের সঙ্গে জড়িত না থেকে ইসলাম যদি কেবলমাত্র মুসলিম দরবেশসুফীদের শান্তিপূর্ণ প্রচারের মারফত রূপায়িত হতো, তবে ইসলামের মানবিক দিকটা বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশের গভীরতর সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করতে পারতো।
মুসলমানের মন যে অনেকখানি আরব-অভিমুখী, তা খুবই স্বাভাবিক। কারণ মুসলামানের আর্দশ ইসলাম-অভিমূখী। গভীর নৈরাশ্যের যুগে আরবমূখিনতা মুসলিম চিন্তাধারায় বিশেষ প্রকট হয়ে উঠেছে ও এর থেকে মুসলমানেরা পেয়েছেন গভীর প্রেরণা। তবে আত্মস্থ হয়ে মুসলমানেরা যদি ইসলামের মৌলিক জীবনবোধ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন, তবে দেখবেন যে, ইসলাম দেশের সমস্যাকে অবহেলা করতে কোনদিনই বলেনি, তাই নৈরাশ্যজনক ও দু:খবাদী নেতিবাচক ভাবধারা পরিহার করা নিতান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশে বাস করে একদিকে এখানকার প্রকৃতি, মাঠ, নদী, বন, নারকেল, সুপারী,কোকিল, শালিক, ডাহুক, দেশের সুখ-দু:খ ও অন্যদিকে উট, খেজুর, মরুদ্যান, লু-হাওয়া, আখরোট, বাদাম খুবানী আমাদের মনে সমান ভাবে দোলা দেবে বাস্তব জীবনকে অবহেলা করা হবে ও ইসলামকে সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠা করা হবে না। আবার মরুর লু-হাওয়া থেকে আমাদের মনকে একেবারে সরিয়ে রাখলে মুসলমানদের মানসিক ঐতিহ্যকে মারাত্মকভাবে অস্বীকার করা হবে। ইসলামের ও মানবতার আওতায় চিরজাগ্রত মন দিয়ে আজ আনন্দ, প্রেম ও কল্যাণের উপলবদ্ধি চাই-ইসলামের ভিত্তিতে গতিশীল সংগঠন চাই। নিছক কৃত্রিম পুনুরজ্জীবনে (রিভাইভালিজম) বিশেষ কোন পয়দা হবে না। মোল্লাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা তথা কথিত ধর্মীয় লেবেলের প্রচারের মারফতেই আমাদের সমাজ প্রতিষ্ঠা নয়। ইসলামের সমাজনীতির সঙ্গেই বাস্তব সমাজ ব্যবস্থার অচ্ছেদ্য ও অবিচ্ছিন্ন সংযোগ স্থাপন করতে হবে। আমরা যখন ইসলামী সমাজের কথা বলি, তখন আমরা অতীতে ফিরে যাই না, ইসলামের মূল আদর্শ ও বিচিত্র সম্ভবনার কথা বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে আমাদের যাত্রা শুরু। রাসূলুল্লাহ (সা) ও খেলাফায়ে রাশেদা থেকে আমরা অফুরন্ত প্রেরণা পাই; পেছন দিকে আমরা তাকিয়ে দেখি, কিন্তু পিছু হটি না। সামনের দিকেই কেবল আমাদের পথ চলা। আকাশচারী দিব্যদৃষ্টি ও বস্তুনিষ্ঠ অনুভূতি-এ দুটোকে এক করে আজ অগ্রসর হতে হবে। জীবনের বৈচিত্র্য ও গভীরতার মধ্যে প্রাচুর্য খুঁজে বের করতে হবে। জীবনকে পরিপূর্ণ করার জন্য বাসনা সৃষ্টির প্রয়োজন, আর এই পরিপূর্ণতা আছে জীবনবোধের সঙ্গে বিশ্ব-বৈচিত্র্যের তুলনায় ও সামঞ্জস্য বিধানে। বাংলাদেশে মুসলিম সংস্কৃতি দেশকে কোনদিনই বাদ দেয়নি। বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে দেখতে পাই, ইসলামের প্রভাবেই বাংলার প্রাণ-মনকে জনগণের জীবনের দিকে ও লৌকিকতার দিকে গভীরভাবে আকর্ষণ করেছে। মুসলমানেরাই বাংলা ভাষার জনক। অবশ্য নানা কারণে এ ভাষা মুসলমানের হাত থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। এই কারণে সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাদে বিশ্বাসী (ইসলামী জীবনদর্শনে নয়) মুসলমানেরা বলে যে, বাঙালী মুসলমান এখনো খাঁটি মুসলমান হতে পারিনি।
কোন একটি দেশে বাস করে সে দেশের রাজনৈতিক জাতীয়তা গ্রহণ করতে ইসলাম কোনদিনই বাধা দেয়নি। ইসলাম জাতীয়তা ও দেশাত্নবোধ তখনই বাদ দিতে চেয়েছে, যখন তার জাতীয়তা ও গোষ্ঠীপ্রেম মানবতা, ন্যায়, ইনসাফ ও ইসলামকে উল্লঙ্ঘন করে গেছে। নিজের ভাষার মাধ্যমে ধর্মজ্ঞান লাভ করতে ও কুরআন শরীফ পড়তে কোন বাধাই নেই (অবশ্য মুসলিমের ঐক্য-সাধনে আরবী ভাষার অবদান স্বীকার করতেই হবে)। বহুবিবাহ বা পোশাকের শালীনতাকে অবরোধে পর্যবেসিত করার জন্য ইসলাম দায়ী নয়; মোল্লাতন্ত্র ইসলাম স্বীকার করেনি বা ফেজ মাথায় দিলে কেবল মুসলমান হয়, এটাও ইসলামের নীতি নয়। তবে ইসলামী আদর্শের উপর জোর দেবার অর্থ হলো ; ইসলামের চোখে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের চাইতে সততা ও সামাজিক সুবিচারের শ্রেষ্ঠত্বই অধিক মূল্যবান। প্রকৃত ধর্মীয় রাষ্ট্র (খ্রীষ্টান, ইহুদী, হিন্দ বা ইসলামী যাই হোক না কেন) আর সম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। সেজন্য বাংলাদেশে রাজনৈতিক জাতিয়তাকে একেবারে বাদ দেবে না। কিন্তু এ দেশের মানুষ মানবতা ও ইসলামী আদর্শের উপর দিয়ে দেশজ কুসংস্কার, গোষ্ঠীবাদ, অন্ধতা ও চরমবাদে বিশ্বাসী নয়। ইসলাম রাজনৈতিক জাতিত্ব ও আদর্শগত জাতিত্ব-উভয়ই স্বীকার করে। রাজনৈতিক জাতিত্ব স্বীকার না করলে দেশের সমস্যাগুলোর যথাযথ সমাধান করা যায় না। আবার আদর্শগত জাতিত্ব স্বীকার না করলে দেশজ সংকীর্ণতার উর্দ্ধে মানবতার ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। মাটির বাঁধন ইসলাম অস্বীকার করে না। প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্র রাজনৈতিক সংগঠনে দেশজ, আর জাতীয় ও আদর্শিক ব্যাপারে মানবতামূর্খী সর্বজনীন। আর সব দেশের মুসলমানের মধ্যে যে সংহতি ও একত্মবোধ রয়েছে, তা এই মানবতাসঞ্জাত আদর্শিক ঐক্যের ফলেই জন্মলাভ করে। মানবিক পরিসীমার মধ্যে জাতীয়তার স্বীকৃতি ইসলামী জীবনাদর্শের বিরোধী নয়। দেশকে, দেশের লোককে ভালবাসতে ইসলামে কোন বাধাই নেই। কিন্তু তথাকথিত দেশতন্ত্রের যাঁতাকলে মানবতার অপমান, দেশে নামে বিধর্মী বা বিজাতীয়ের অপমান ইসলামে বরদাশত করা হয়নি। আর এই হিসাবে দেশকে বড় করার বিরুদ্ধে ইসলামের অভিযান, তাতে সংকীর্ণতার লেশমাত্র নেই। তবে এ কথা সত্য যে, মুসলিম পরাজয়ের যুগে মুসলিম মানসে বায়বীয় আরবমূখিনতা ভিড় করেছে, আদর্শগত জাতিত্ব ও মানবতার স্থানে অন্ধ গোষ্ঠীবাদ অধিক প্রাধান্য লাভ করেছে। ইসলামী সংস্কৃতিতে রিসালাত এর নীতি থাকায় প্রত্যেক সত্যিকার মুসলিম বিশ্বাস করে যে, দুনিয়ার সব জাতের ভিতরেই আল্লাহর নবী এসেছেন ও তৌহীদ, মানব ঐক্য ও ন্যায়বিচারমূলক সমাজব্যবস্থার ইঙ্গিতও প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এই নবীদের অনুসারী জাতিগুলো মূলত ইসলামের অনুসারী হওয়ায় আদতে সবারই সংস্কৃতি সর্বজননীতার উপরে স্থাপিত ছিল। তাই ইসলামী জীবনবোধ ও সংস্কৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্র উগ্র দেশাত্মবোধ ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মানবতা ও মাখলুকাতের কল্যাণের নিশ্চিত গ্যারান্টি।
বাঙালী মুসলিমের সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে রাজনীতিমুক্ত ও তৌহীদসঞ্জাত। এর কতকগুলো ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। হযরত (সা) এর জীবদ্দশায় তাঁর কয়েকজন শিষ্য ভারতের মালাবার উপকূলে চেরুমলজেরুমল নামে হিন্দু রাজার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এই রাজা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ও শারাফ বিন মালিক নামক একজন আরবীয় মুসলিমকে ভূমি প্রদান করেন ও ইসলাম প্রচারের অনুমতি দেন। সিংহলের রাজাও ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন ও ইসলামের ও দাক্ষিণাত্যে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন।
৭১১ সনে মুহম্মাদ বিন কাসিম সিন্ধু জয় করেন। বাংলাদেশে বখতিয়ার খিলজীর আগমনের অনেক আগেই আরব বণীকদের দ্বারা ইসলাম চট্টগ্রামে ও নিকটবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। Richard Symonds এর The Making of Pakistan এ অধ্যাপক আহমদ আলীর প্রবন্ধে (১৯৭পৃষ্ঠা) রয়েছে : The culture that developed in Bengal was entirely different from that of the Hindus. The ports of the country especially Chittagong had come under the influence of the Arabs as early as the 7th century A.D. and many of the Arab voyages and traders had left a permanent impress upon the area. Islam therefore took out very early in this soil.
বাঙালী মুসলমানেরা ইরানী ও তুর্কী সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি গড়তে চেয়েছিল। সাম্যধর্মী আরব বণীকেরা পাল রাজাদের আমলে বাংলার কূলে ব্যবসা করতেন। বিখ্যাত আরব সওদাগর আল হোসায়নি জাহাজ দিয়ে নসরত শাহকে মগদের বিরুদ্ধে সাহায্য করেন। উদারমনা মুসলিমদের আগমনকে বৌদ্ধরা মুবারকবাদ জানান। বৌদ্ধ দোঁহার মধ্যে মুসলিম তমদ্দুনের অনেক মাল-মসলা পাওয়া যায়। এর থেকে নিশ্চিত প্রমাণ মেলে যে, বাঙালী ও রাজসিকতা ও গোষ্ঠীগত অন্ধতামূক্ত। এই সংস্কৃতি মানবতা ও ভ্রাতৃত্ব প্রকাশী, শক্তিধর্মী ও বাস্তব প্রাণশীল।
হযরত উমর (রা) এর খিলাফতকালে (খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে) কয়েকজন প্রচারক (মুমিন) বাংলাদেশে আসেন। এদের নেতা ছিলেন হযরত মামুদ ও হযরত মুহামিন। দ্বিতীয়বার প্রচার করতে আসেন হযরত হামেদউদ্দীন, হযরত হুসেন উদ্দীন হযরত মুর্তাজা,হযরত আবদুল্লাহ ও হযরত আবূ তালীব। এইরূপ পাঁচটি দল পরপর বাংলাদেশে আসেন। তাঁদের সঙ্গে কোন অস্ত্র-শস্ত্র বই-কাতাবও থাকতো না। তাঁরা রাজক্ষমতার সাহায্যও নিতেন না। তাঁদের প্রচার-পদ্ধতির একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই যে, তাঁরা এ দেশের চলতি ভাষার মাধ্যমেই প্রচার করতেন। অল্প সংখ্যক সত্যিকার মুসলিম তৈরী করা তাঁদের লক্ষ্য ছিল। এরপর আরও পাঁচটি দল মিশর ও পারস্য থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এদের বলা হত আবিদ। এরা বিভিন্ন স্থানে খানকা বা প্রচারকেন্দ্র স্থাপন করে ধর্ম হয়ে ওঠে।
খ্রীষ্ঠীয় নবম শতাব্দীতে রণভাই-এর উপকূলে এক জাহাজডুবী হয়। এই ডুবির পর যাঁদের প্রাণ রক্ষা পায়, তাঁদেরকে আরাকান রাজ্যের নিকট উপস্থিত করা হয়। রাজা এদের নিকট ইসলাম ধর্মের বিবরণ শুনে মুদ্ধ হন ও কয়েকটি পল্লীতে তাঁদের বসবাসের অনুমতি দেন। সপ্তম, নবম ও চতুর্দশ শতাব্দীতে অনেক মুসলিম ওলী বাংলায় আসেন। বাবা আদম শহীদ শাহ সুলতান, মহীসওয়ার ও বায়েজীদ বোস্তামীর নাম এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া শেখ জালালুদ্দিন তাবিজী, শেখ বদর আলম ও জালালুদ্দিনের নাম করা যেতে পারে। চতুর্দশ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বহু দরবেশে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আখি সিরাজউদ্দীন, আলাওল হক ও হযরত নূর কুতুবুল আলমের নাম বিশেষ প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। খানজাহান (বাগেরহাট), খান গাজী (ত্রিবেণী) ও শাহ ইসমাইল গাজী একাধারে দরবেশ ও সেনানায়ক ছিলেন।
বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারের এই সব ঐতিহাসিক কারণ বিদ্যমান থাকার ফলে বাংলার মুসলিম সংস্কৃতিও সংকীর্ণতা দোষমুক্ত। এদিক দিয়ে দেখলে আলীগড়ে ও লক্ষ্ণৌর তমদ্দুন থেকে এর পার্থক্য বিস্তর। এই সংস্কৃতি মূলত গ্রামীণ ও খুলাফায়ে রাশেদা ও তুর্কী বীরদের গাঁথা এর মর্মবানী। রাষ্ট্রে তুর্কী ও মুগল প্রভাব থাকায় যদিও বাংলার সমাজব্যবস্থা ইসলামী রূপে গড়ে ওঠেনি, তবু সমগ্র বাংলাদেশে ও বিশেষ করে পূর্ববংগে তৌহীদবাদ আগুণের মত ছড়িয়ে পড়েছে। বাঙালী মুসলিম তাই একান্তভাবে গণনির্ভর।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম