শুয়াইব (আঃ) এর গ্রাম "ঐতিহাসিক মাদইয়ান" ঘুরে এলাম (ছবি ব্লগ)

 
কয়েকদিন আগে ঐতিহাসিক মু'তা যুদ্ধের ময়দান ও আশেপাশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান দেখে আসলাম। তন্মধ্যে একটি স্থান ছিল মুসা (আঃ) এর শ্বশুর বাড়ী ও আল্লাহর নবী হযরত শুয়াইব (আঃ) এর বাসস্থান এলাকা "মাদইয়ান"।

আগের পোষ্টে আপনাদেরকে জানিয়েছিলাম যে, অচিরেই মাদইয়ানের ফটোব্লগ দেয়া হবে ইনশাল্লাহ। কিন্তু, দেব দেব মনে করে দেরীই করে ফেললাম।

মু'তা যুদ্ধের ময়দান এলাকা সফর করার সময় মুতা যুদ্ধ ময়দানের পাশেই একজন বাংলাদেশীর বাসায় অবস্থান করেছিলাম। সেখান থেকে মাদইয়ান হয়ত ১০ কিলোমিটারের দুরত্বে হবে। যুদ্ধ ময়দানের সন্নিকটে "মাদইয়ান" যাওয়ার জন্য রাস্তার পাশে দাড়ালাম গাড়ীর আশায়। গাড়ীর জন্য আমি ও হামিদ ভাই ওয়েট করছি। কিছুক্ষণ পর মু'তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইন্স ডিপার্টমেন্টের একজন ডক্টর ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাদেরকে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নিজের গাড়ী দাড় করালেন। জিজ্ঞাসা করলেন গন্তব্য কোথায়? আমরা বললাম আমরা মাদইয়ানে যাব। তিনি আমাদেরকে তার গাড়ীতে উঠিয়ে নিলেন। তার পিচ্চি মেয়ে "নুরা" কে পিছনে বসিয়ে নিয়ে নিজে ড্রাইভিং করছেন।


গাড়ীতে উঠার পর পরস্পর পরিচিত হলাম। আমি এখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি জেনে তিনি খুশি হলেন। নিজের পরিচয় দেয়া শুরু করলেন। তিনি হচ্ছেন মু'তাযুদ্ধক্ষেত্রের পার্শ্ববর্তী স্থানে অবস্থিত মু'তা ইউনিভার্সিটির সাইন্স ডিপার্টমেন্টের একজন ডক্টর। ভাবলাম পেয়ে গেছি একজন ভালো লোক। নতুন কোন তথ্য জানতে হলে শিক্ষিত লোকের কাছ থেকেই জানতে হবে। তাকে এখানকার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্পট সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে উনি বললেন: আশেপাশে মুতার যুদ্ধক্ষেত্র আর এখানেই রয়েছে শুয়ায়েব (আঃ) এর মাদইয়ান। এ ছাড়া আর তেমন কিছু নেই। পড়ে উনি নিজের ঠিকানা দিয়ে বললেন মু'তা ইউনিভার্সিটির অমুক ফ্যাকাল্টিতে দাওয়াত থাকল।

পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছি ঠিকই কিন্তু, যখন গিয়েছি সে সময় তিনি ছিলেন ক্লাসে। এরপরে লাইব্রেরীতে ঢুকার কারণে তার সাথে দেখা করার সময় পায়নি।

আমাদেরকে মাদইয়ানের পার্শ্ববর্তী মেইন রাস্তায় নামিয়ে দিলেন। এটাই মাদইয়ান গ্রাম। গ্রামটা অবশ্য অনেক বড়। ওখানে নামার সাথে সাথেই এলাকার এক বাসিন্দা আমাদের দিকে এগিয়ে আসল। তার বয়স হবে ৬৫ থেকে ৭০ বছরের মত। ৬৫-৭০ বছর বয়সী হলেও এরা দেখতে আমাদের দেশের ৪০-৪৫ বছর বয়সী লোকদের মতই মনে হয়। তাদের হাটাচলা করতেও কোন সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় না কোন কাজ করতে। মিশরে একবার দেখেছিলাম ৭৫ বছর বয়স্ক একজন মুরব্বীকে টেক্সি চালাচ্ছে। জর্ডানেও প্রায়ই অনেক বয়স্ক লোককে ড্রাইভিং করতে দেখি। আমার মসজিদের বেশ কিছু মুসল্লী যাদের বয়স ৭০ এর চেয়ে বেশী তারাও গাড়ী ড্রাইভিং করে। কিছুদিন আগে আমার মসজিদের পাশেই রাস্তায় বাসের জন্য দাড়িয়ে ছিলাম ইউনিভার্সিটি যাব বলে; কিছুক্ষণ পর আমার মসজিদের মুসল্লী আবু রাতেব নিজের গাড়ী নিয়ে দাড়িয়ে গেল। লোকটার জন্ম ১৯৩৭ সালে।আমাকে গাড়ীতে উঠিয়ে নিয়ে মেইন বাস টার্মিনালে পৌছে দিল।

যাহোক, আসল কোথায় আসি। মাদইয়ান গ্রামের ওই মুরব্বীর সাথে কথা হল। কোথায় যাব জিজ্ঞাসা করল। বললাম যে, মাদইয়ান এলাকা দেখতে এসেছি। মাদইয়ান সম্বন্ধে টুকিটাকি কিছু কথাবার্তা জিজ্ঞাসা করলাম। এভাবে কথাবার্তা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। সে বলল: আযান হয়ে গেছে চল! মসজিদে নামাজ পড়ে আমাদের বাসায় গিয়ে সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করে নিই। তারপর ওখানে যাইও। শুকরান, বারাকাল্লাহু ফিক বলে ওজর পেশ করলাম। এরপর আমাদেরকে মুসা (আঃ) যেখানে শুয়াইব (আঃ) এর সম্প্রদায়ের দুইজন মেয়ের পশুকে পানি পান করিয়েছিলেন সে কুপের কাছে যাওয়ার জন্য সহজ পথ বাতলে দিয়ে বিদায় নিলেন।

আসলে মাদইয়ান এলাকাটা অনেক বড় এলাকা। পুরোটাই গ্রামাঞ্চল। এখানে শহুরে কিছুই নেই। এখান থেকে মাইক্রোবাস ভাড়া করে সেখানে যেতে হয়। মুরব্বী লোকটা আমাদেরকে বেশ কয়েক মিনিটের পথ হাটার পর একটি মসজিদ দেখিয়ে বললেন: এখানে নামাজ পড়ে রাস্তার পাশেই ওয়েট কর। মাইক্রোবাস আসবে সেই মাইক্রোবাসে আরোহণ করে কুপের কাছে যাইও।

সময়টা ছিল যোহরের নামাজের সময়। মসজিদে প্রবেশ করলাম। ততক্ষনে নামাজ এক রাকাত হয়ে গেছে। ফলে, ইমাম সাহেবের সালাম ফেরানোর পরে আমাদেরকে বাকী রাকাত পুরণ করতে হবে। নামাজ শেষে দেখলাম ইমাম সাহেব তার স্থানেই বসে আছে। পাশের দাঁড়ানো জর্ডানী এক পিচ্চিকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম ইনিই মসজিদের পার্মানেন্ট ইমাম কিনা? কারণ, দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই যাই আমার সাধারণ অভ্যাস হয়ে গেছে জরুরী কাজ না থাকলে তার সাথে পরিচিত হই। এছাড়া যাত্রাপথে পাশের সিটে যিনি বসে থাকেন তার সাথে পরিচিত হতে ইচ্ছা করে।

আমি মসজিদে ইমামতি শুরু করার কিছুদিনপরে পার্শ্ববর্তী এলাকার একজন আলেম আমাদের মসজিদে আসলে তার সাথে পরিচিত হলাম। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই পরিচয় আদান প্রদান করলাম। আমার মোবাইল নাম্বার নিলেন। পরে মসজিদেরই একজন যুবক আমাকে জিজ্ঞাসা করল: তুমি কি একে আগে থেকেই চিনতে? আমি বললাম: না! এটাই আমার তার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। তখন শুনলাম সে আশেপাশের লোকদেরকে বলছে: আমি নাকি খুবই তাড়াতাড়ি মানুষের সাথে মিশে যেতে পারি।

মাদইয়ান গ্রামে নামাজ শেষে ইমাম সাহেব বের হবার সময় তার সাথে পরিচিত হয়ে গেলাম। লোকটা আসলে এখানকার পার্মানেন্ট ইমাম না। উনি সম্ভবত: একজন স্কুল টিচার। ইমাম না থাকলে মসজিদে তিনিই ইমামতি করে থাকেন। মসজিদ থেকে বের হয়ে ওপেন মতবিনিময় করছিলাম। আমাদেরকে অপরিচিত দেখে আরও প্রায় ডজনখানিক লোক একত্রিত হয়ে গেল মসজিদের সামনে। একসাথে মতবিনিময় করছি। বাংলাদেশী জেনে কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করল: বাংলাদেশ মানেই তো পুর্ব পাকিস্তান তাই না? বুঝলাম ইতিহাস সচেতন লোক এগুলো। নিজের পরিচয় দিলাম যে, ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট আর ওয়াজারাতুল আওক্বাফের আন্ডারে একটা মসজিদের দায়িত্বে আছি আলহামদুলিল্লাহ। তারা বাংলাদেশ সম্বন্ধে কিছু জানতে চাইল।

তাদের সাথে এই "মাদইয়ান" এলাকা সম্বন্ধে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত নিয়ে মত বিনিময় করলাম। তারা বললেন: মুসা (আঃ) মিশরে একজন কিবতীকে চড় মারার পর যখন কিবতী নিহত হল তার পরেরদিন যখন জানাজানি হয়ে গেল যে, রাজা মুসা (আঃ) কে শায়েস্তা করার জন্য তার বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করছে তখন তিনি মিশর থেকে পালিয়ে এ এলাকায় এসেছিলেন। এখানে আসার পর ক্ষুধা ও পরিশ্রমের কারণে ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে একটা গাছের ছায়ায় বসে পড়লেন। এরপরে বলল: আল্লাহই ভালো জানেন। এটা জনশ্রুতি আছে যে, এটাই সেই মাদইয়ান। তবে, বাস্তবতা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারও জানা নেই।

এভাবে কথাবার্তার এক পর্যায়ে একজন মুসল্লী জিজ্ঞাসা করল: মুসা (আঃ) এর কুপের কাছে কিভাবে যাব? যানবাহনের ব্যবস্থা কি করেছি? আমরা ঠিক জানতাম না যে স্থানটা এখান থেকে কতদুরে। ওদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম কতদুর হতে পারে? তাদের একজন লোক বলল যে, একটু ওয়েট কর!! তোমাদেরকে গাড়ীতে করে সব এলাকা ঘুরিয়ে নিয়ে আসব ইনশাল্লাহ। নইলে তোমাদের সেখানে যেতে কষ্ট হবে। লোকটি পকেট থেকে মোবাইল বের করে বাড়ীতে ফোন করল। হয়ত ছেলে বাড়ীতে থাকলে তাকে গাড়ীটা বের করে নিয়ে আসতে বলবে। কিন্তু, ছেলে বাড়ীতে না থাকায় উনি নিজেই বাড়ীতে গিয়ে তার গাড়ী বের করে নিয়ে এসে আমাদেরকে ডাকলেন। আমরা এতক্ষণ যিনি নামাজে ইমামতি করলেন তার সাথে কথা বলছিলাম।

গাড়ীতে উঠে বসলাম। এতক্ষণ এই লোকের পেশা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। এবার জিজ্ঞাসা করলাম যে, জনাব! আপনার পেশা সম্বন্ধে জানা হয়নি। তিনি বললেন: আমি জর্ডান ইসলামী ব্যাংকের একজন অফিসার। তার নাম বাসসাম আল উলইয়ানী। শুনে ভালো লাগল যে, উনি ইসলামিক ফাইন্যান্স সেক্টরের সাথে জড়িত আছেন। তখন উনার সাথে পবিত্র কুরআনে ইসলামী অর্থনীতি ও সুদের কুফল ইত্যাদি নিয়ে আলাপ করলাম। আমাদের বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং নিয়েও কথাবার্তা হল যে, আলহামদুলিল্লাহ! বাংলাদেশে লাভের দিক থেকে ইসলামী ব্যাংক শীর্ষে অবস্থান করছে।

কথাবার্তা হল সুদের কুফল নিয়ে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন:
يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ
অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা সুদকে ধ্বংস করেন (তাতে বরকত থাকে না ইত্যাদি) এবং সাদকা (কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে সাদকাহ বলতে যাকাত বুঝানো হয়েছে) তথা যাকাত দেয়া হয়েছে যে সম্পদে তাকে বাড়িয়ে দেন। (সুরা বাকারা:২৭৬)

বিভিন্ন কথাবার্তা বলতে বলতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সামনের দিকে রয়েছে বিভিন্ন পাহাড় ও উপত্যকা তথা দুই পাহাড়ের মধ্যকার সমতল ভুমি। মাঝে মাঝে গাড়ী অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে, আবার অনেকটা খাড়াভাবে উপরের দিকে উঠছে। আমাদের দেশে এত উচু নিচু থাকলে মনে হয় গাড়ীতে করে চলাফেরা করা দায় হয়ে যেত। জর্ডানে প্রচুর পরিমাণে পাহাড় রয়েছে। খোদ রাজধানীতেই যে কত পাহাড় আছে আল্লাহই ভালো জানেন। আম্মানের একটা বাস টার্মিনালের নাম- "রাগাদান"। এই রাগাদানের পাশেই একটা পাহাড় আছে। পাহাড়ের উপরে সব বাড়ীঘর। টার্মিনাল থেকে পাহাড়ের উপরের বাড়ীঘরের উচ্চতা হবে কয়েকশত মিটার। এসব স্থানে মাঝে মাঝে উপরে উঠার জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। এজন্য জর্ডানীরা বলে- জর্ডান সুবহানাল্লাহ আর আল্লাহু আকবারে ভরপুর। এ দ্বারা তার উদ্দেশ্য হচ্ছে- জর্ডানে প্রচুর উচু এবং নিচু জায়গা আছে। উচুতে উঠার সময় বলতে হয় আল্লাহু আকবার আর নিচে নামার সময় সুবহানাল্লাহ। সেই জন্যই বলেছে সুবহানাল্লাহ আর আল্লাহু আকবারে ভর্তি।

যাহোক, চারদিকে তাকাচ্ছিলাম। আমাদের দেশের মত মন জুড়ানো সবুজাভ মনোরম দৃশ্য না থাকলেও পাহাড় পর্বত ও আশেপাশের জনপদ দেখে ভালই লাগছে। মাঝে মাঝে হাতের ক্যামেরা চোখ টিপ দিয়ে ওঠে। কারণ, এ দৃশ্যগুলো সরাসরি ধরে না রাখতে পারলেও কম্পিউটারের স্ক্রিনে ধরে রাখবে।

বেশ কিছু রাস্তা পাড়ি দিয়েই শেষ পর্যন্ত চলে আসলাম সেই স্থানে যেখানে মুসা (আঃ) এসে দেখলেন- শুয়াইব (আঃ) এর সম্প্রদায়ের দুইজন যুবতী মেয়ে তাদের পশুদেরকে পানি পান করানোর জন্য কুপ থেকে একটু দুরে আলাদাভাবে অপেক্ষা করছে। আর কিছু লোক কুপের কাছে নিজেদের পশুদেরকে পান করাচ্ছে।

এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআন মাজীদের বর্ণনাভংগী নিম্নরূপ-

অর্থাৎ, (মিসর থেকে বের হয়ে) যখন হযরত মুসা (আঃ) মাদইয়ানের দিকে রওয়ানা করলেন তখন তিনি বললেন,"আশা করি আমার রব আমাকে সঠিক পথেই চালিত করবেন। আর যখন তিনি মাদইয়ানের কুপের কাছে পৌঁছলেন,তিনি দেখলেন,অনেকগুলো লোক তাদের পশুদেরকে পানি পান করাচ্ছে এবং তাদের থেকে আলাদা হয়ে একদিকে দু'টি যুবতী মেয়ে নিজেদের পশুগুলো আগলে রেখেছে। মুসা (আঃ)মেয়ে দু'টিকে জিজ্ঞেস করলেন:"তোমাদের কি হয়েছে?"তারা বলল:"আমরা আমাদের পশুগুলোকে পানি পান করাতে পারি না যতক্ষণ না এ রাখালেরা তাদের পশুগুলো পানি পান করিয়ে সরিয়ে নিয়ে যায়,আর আমাদের পিতা একজন অতি বৃদ্ধ ব্যক্তি"। একথা শুনে মুসা (আঃ)তাদের পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে দিলেন, তারপর একটি ছায়ায় গিয়ে বসলেন এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে দুয়া করলেন:"হে আমার প্রতিপালক! যে কল্যাণই তুমি আমার প্রতি নাযিল করবে আমি তার মুখাপেক্ষী।" (বেশিক্ষণ অতিবাহিত হয়নি এমন সময়) ঐ দু'টি মেয়ের মধ্য থেকে একজন লজ্জাজড়িত পদক্ষেপে তার কাছে এসে বলল:"আপনি আমাদের পশুগুলোকে যে পানি পান করিয়েছেন এজন্য আপনাকে পারিশ্রমিক দেয়ার জন্য আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন।" মূসা যখন তার কাছে পৌঁছলেন এবং নিজের সমস্ত কাহিনী তাকে শুনালেন তখন তিনি বললেন:"ভয় করো না,এখন তুমি জালেমদের হাত থেকে নিরাপদে।" মেয়ে দু'জনের একজন পিতাকে বলল:"আব্বা! একে চাকরিতে নিয়োগ করুন,কর্মচারী হিসেবে এমন ব্যক্তিই উত্তম হতে পারে যে শক্তিশালী ও আমানতদার।" তার পিতা (মুসা আ: কে) বললেন:"আমি আমার এ দু'মেয়ের মধ্য থেকে একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই।শর্ত হচ্ছে-তোমাকে আট বছর আমার এখানে চাকরি করতে হবে।আর যদি দশ বছর পুর্ণ করে দাও,তাহলে সেটা তোমার ইচ্ছা।আমি তোমার ওপর জবরদস্তি করতে চাই না। তুমি ইনশাল্লাহ আমাকে সৎলোক হিসেবেই পাবে।মুসা (আঃ)জবাব দিলেন যে,"আমার ও আপনার মধ্যে একথা থাকল যে,এ দু'টি মেয়াদের মধ্য থেকে যেটাই আমি পূরণ করে দিই না কেন তারপর আমার ওপর যেন কোন চাপ দেয়া হবে না।আর যা কিছু দাবী ও অঙ্গীকার আমরা করছি আল্লাহ তার তত্বাবধায়ক।" অতঃপর যখন মুসা (আঃ) মেয়াদ পূর্ণ করে দিলেন এবং নিজের পরিবার পরিজন নিয়ে চলতে লাগলেন তখন তূর পাহাড়ের দিক থেকে একটি আগুন দেখতে পেলেন.........। (সুরা কাসাসঃ ২২-২৯)


আমাদেরকে তিনি যে কুপ থেকে মুসা (আঃ) ওই দুইজন যুবতী মেয়ের পশুকে পানি পান করিয়েছিলেন সে কুপের কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে চারপাশে তাকালাম। চারিদিকেই উচু উচু পাহাড়। আশে পাশে অনেকদুর পর্যন্ত কোন ঘরবারী নেই। প্রাচীর দিয়ে এরিয়াটা একসাইড থেকে ঘিরে রেখেছে।

আর অন্যপাশে পাহাড়। পাহাড় থেকে মাত্র ২/৩ গজ দুরেই সেই কুপ। সেটা এখন আর খোলা নেই। শায়েখ বাসসাম বললেন: গন্ডমুর্খরা এটা বুজিয়ে ফেলেছে। এখানে একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম। ভাল করে দেখার আগেই তিনি আমাদেরকে নিয়ে গেলেন পাহাড়ের কিনারার কাছেই একটা গুহার ভিতরে অবস্থিত আরেকটি কুপের কাছে। একটি কূপ থেকে আরেকটির দূরত্ব ৮-১০ গজের মত। একটি পাহাড়ের ভিতরে গুহার ভিতরে আরেকটি পাহাড়ের পাশেই। চারপাশে ধু ধু মরুভূমি। অথচ, তারই পাশে পাহাড়ের গুহার ভিতরে সুমিষ্ট পানি পাহাড়ের ভিতর থেকে টপটপ করে ফোটায় ফোটায় বের হয়ে কুপে পড়ছে। ভিতরটা খুবই গাঢ় অন্ধকার। ভিতরে যাওয়ার সাথে সাথেই চোখটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল। ভিতরের কিছুই দেখি না। আলো যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। মোবাইলের লাইট জালিয়েও তেমন কাজ হল না। বেশ কিছুক্ষণ অপলকনেত্রে তাকিয়ে থাকার পর অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাব কিছুটা কেটে গেলে ভিতরটা দেখে নিলাম। কি আর করার আছে? আশেপাশে তো ভালো করে দেখার মত কোন আলোর ব্যবস্থা নেই। হাতের ক্যামেরা দিয়ে কিছু ছবি তুললাম। তবে, পরে দেখলাম ক্যামেরাতে ফ্ল্যাশ দেয়ার কারণে ছবিটা স্পষ্টই এসেছে।

শায়েখ বাসসাম একটা আরসির বোতল নিয়ে কুপের ভিতরে নেমে পড়লেন। পানি স্তরের একটু উপরে থাকা একটা পাথরের উপরে দাড়িয়ে এক বোতল পানি তুলে নিয়ে আসলেন। সুমিষ্ট পানি। আমাদেরকে পান করার জন্যই তিনি নিয়ে আসলেন। প্রথমে মনে করেছিলাম হয়ত নোংরা পানি হতে পারে। নোংরা হলে তো তা পান করার রুচি আসবে না।

এবার দেশে গিয়ে খানজাহান আলী মাজারে ফকীরদের কর্মকান্ড সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা নিতে বাগেরহাট গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছিলাম মাজারের পার্শ্ববর্তী পুকুরের কর্দমাক্ত নোংরা পানি মানুষ পান করছে। দেখেই আমার গা শিউরে উঠেছিল। ওই মাজারেই থাকে এমন একজন মুরুব্বিকে গল্প করার কথা বলে পাশে বসিয়ে বিভিন্ন আলাপ শুরু করে দিলাম। তাকে এ কথাও বলেছিলাম যে, আংকেল!!! এরকম নোংরা পানি মানুষ পান করে কেমন করে? আমার তো দেখেই ঘৃণা করছে। মাজার ও ফকীরদের নিয়ে আরও বিভিন্ন কথাবার্তা বলার পর মুরব্বী আমাকে বলল: মাজারের এসব কর্মকান্ড বেদাত শেরেক। জানিনা আমাকে বুঝ দেয়ার জন্য মুরব্বী একথা বলল নাকি বাস্তবিকই মন থেকে একথা বলল?

কুপের পানি সম্বন্ধে প্রথমে ধারণা করেছিলাম এখানকার পানি আবার সেরকম নোংরা হয় কিনা? পরে দেখলাম যে, না, পানি পান করার উপযুক্ত ও স্বচ্ছ। পাহাড়ের ভিতর থেকে ফোটায় ফোটায় পানি কুপের মধ্যে পড়ছে। কুপের পানির অনেক কাছে গিয়ে ভিতরটা দেখে নিলাম।

মিশরে যাওয়ার আড়াইমাস পরই ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে এক জায়গায় ট্যুরে গিয়েছিলাম। জায়গাটার নাম- "ওয়াদী আর রাইয়্যান" বা রাইয়্যান উপত্যকা। সেখানে দেখেছিলাম- কায়রো থেকে উক্ত স্থানের দুরত্ব ২০০-২৫০ কিলোমিটার। নীলনদ থেকেও হয়ত ১৫০ কিলোমিটার দুরে। মাঝখানে বিশাল মরুভূমি এলাকা। কোথাও পানির চিহ্নমাত্র নেই। অথচ, মাটির মধ্য দিয়ে গোপন পথ অতিক্রম করে সুমিষ্ট পানির ঝর্ণা সেই উপত্যকার পাশে প্রবাহমান রয়েছে। শুনলাম এটা নাকি একটা আশ্চর্যজনক ও রহস্যময় জিনিস।

এ সবগুলো সেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নেয়ামতের কথাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
কুপের ভিতরে কিছু ছবি তুললাম। পাহাড়ের ভিতরে অবস্থিত এ কুপের পানি থেকেও কয়েক ঢোক পান করলাম। পাহাড়ের গুহার ভিতরস্থ কুপের প্রবেশ মুখে লাল রঙ দিয়ে লেখা রয়েছে পবিত্র কুরআনের সুরা কাসাসের ২৩ নং আয়াতের কিছু অংশ। "যখন মুসা (আঃ) মাদয়ানের পানির নিকট পৌছালেন........."



কুপের প্রবেশ পথ। এর ভিতরেই রয়েছে উভয় কুপ



পাহাড়ের গুহার মধ্যকার কুপে যাওয়ার সুড়ংগ (লাল রঙ দিয়ে আয়াত লেখা)



গুহার প্রবেশ পথের আরও কাছ থেকে



কুপের অনেক নিকটে



সুমিষ্ট পানির কুপ



এই কুপ থেকেই মুসা (আঃ) পানি পান করিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে।



কুপের বর্তমান দৃশ্য


নিচে দেখে নিন কুপের আশেপাশের কয়েকটি দৃশ্য।


















এটা দেখার পর উনি আমাদেরকে নিয়ে গেলেন মাদইয়ানের প্রাচীন পড়োবাড়ী দেখানোর জন্য। এ গ্রামে অনেক অনেক প্রাচীন ঘরবাড়ী পড়ে রয়েছে। সেখানে কেউ বসবাস করে না। এখন সেগুলো হয়ত সাপ বিচ্ছুর নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে একথা বুঝতে দেরী হবে না। একটা বাড়ীর কাছে গিয়ে গাড়ী দাড় করিয়ে আমাদেরকে দেখিয়ে নিয়ে আসলেন বাড়ীটা। বারীটার উপরে ছাদ হিসেবে দেয়া হয়েছে গাছের সরু ডাল আর তার উপরে আখ টাইপের কিছু গাছ দিয়ে ছাউনী। এসব বাড়ী দেখে মনে হচ্ছে- বিগত অন্ততঃ এক দেড়শত বছরে কেউ এখানে বসবাস করেনি।

এ ধরণের একটা বাড়ীতে ঢুকলাম। প্রথমেই তিনি সতর্কতামুলক দেখে নিলেন ভিতরে সাপ বিচ্ছু পোকামাকড় ইত্যাদি আছে কিনা? একটা ঘরের মধ্যে দেখলাম দেয়ালের দিকে রয়েছে সুড়ংগ। এখানে নাকি তারা গম ইত্যাদি রেখে দিত। হয়ত এগুলো দিয়ে তাদের ফ্রিজের কাজ হয়ে যেত। এগুলো ফ্রিজের বিকল্প হিসেবে কাজ করত।

আশেপাশে দেখলাম মাটির নিচের দিকে পাহাড়ের গুহামুখের দরজা। অনেকবার শুনেছি যে, বিভিন্ন দেশে পাহাড়ের গুহায় মানুষ বাস করে। আগে আশ্চর্য হতাম যে, কিভাবে তারা গুহায় বাস করে? কিন্তু, এখানে সেগুলো বাস্তবে দেখে আসলাম। এখানে বেশকিছু গুহার প্রবেশ দ্বার দেখলাম। তিনি আমাদেরকে এর কাছে যেতে নিষেধ করলেন। বললেন, এখানে যেহেতু, মানুষ বাস করে না; তাই সাপ বিচ্ছু পোকামাকড় থাকাটাই স্বাভাবিক। আর তোমরা আমাদের মেহমান। আমরা মেহমানদেরকে বিপদের কাছাকাছি দাড় করাতে চাই না। এসব থেকে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখতে হবে।

চিন্তা করলাম- এই পাহাড়ের গুহার ভিতরে মানুষ কিভাবে বসবাস করত?এখানে বাস করতে হলে তো রাতদিন চব্বিশ ঘন্টার সবসময়ই ভিতরে ল্যাম্প জালিয়ে রাখতে হবে।দুনিয়ার আলো বাতাস থেকে তাদেরকে সার্বক্ষনিকভাবে বঞ্চিত থাকতে হবে।

এভাবে বিশাল গ্রামের অনেকগুলো পড়োবাড়ী নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখেই তিনি ঘুরে ফিরে আমাদেরকে দেখালেন। মাঝে মাঝে আমাদেরকে দেখতে উম্মুক্ত ভাবে ছেড়ে দিয়ে তিনি এক জায়গায় বসে থাকলেন। আমরা প্রাণভরে দেখে পড়োবাড়ীগুলো দেখে নিয়ে তার কাছে ফিরে আসলাম। লোকটার উপর অনেক মায়া লাগল যে, লোকটা শুধুমাত্র দ্বীনি সম্পর্কের খাতিরেই আমাদের জন্য এতটা কষ্ট করছেন, হয়ত নিজের বাড়ীর বিভিন্ন কাজকর্ম ফেলে রেখে আমাদেরকে সময় দিচ্ছেন। আল্লাহ তায়ালা তার উপর রহমত দান করুন। আমীন।

কিছু কিছু ঘরবাড়ী দেখে মনে হল- এগুলো হাজার হাজার বছর আগেকার ঘরবাড়ী। সিডিতে দেখেছিলাম রাসুল (সাঃ) এর দুধ মাতা হালিমা যে ঘরে বসবাস করতেন সেসব ঘরবাড়ী। ঠিক একই স্টাইলের ঘরবাড়ীও এখানে রয়েছে। অতএব, বুঝতে পারলাম গ্রামটার ইতিহাসও নতুন না। হাজার হাজার বছর আগেকার গ্রাম এটা। যদিও, এলাকাবাসীরা বলছে- বলা হয় এটাই শোয়ায়েব (আঃ) এর গ্রাম "মাদইয়ান" তবে, আল্লাহই ভালো জানেন আসলে এটাই সেই মাদইয়ান কিনা। গ্রামটা দেখার পর আমার মনে হল-এটা অসম্ভব হতে পারে না। এই গ্রামের কোন না কোন স্থানেই হয়ত হযরত শোয়ায়েব (আঃ) এর বসতি ছিল।

দেখুন বিভিন্ন পড়োবাড়ীর দৃশ্যঃ---------













































































এবার দেখুন গুহার দৃশ্য যার ভিতরে অনেক মানুষ বসবাস করত।












এগুলোর পাশেই রয়েছে মরুভূমি। এত ছবি যখন দিলাম। মরুভুমির ছবিই বা বাদ দেব কেন? মরুভুমির ছবি না দিলে তো মজাই থাকে না।


আসুন! মরুভুমির দিকে একনজর তাকাই।













শেষ স্পটে এসে চারিদিকে ঘুরাফেরা করতে গিয়ে মনে করলাম-আমরা হয়ত শায়েখ বাসসামের উপর অবিচারই করে ফেলছি। তাকে অপেক্ষায় রেখে আমরা দেরী করছি। এটা ঠিক হচ্ছে না। গাড়ীর কাছে ফিরে আসলাম। তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন: আমাদের গন্তব্য কোথায়? আমরা বললাম: মুতা যুদ্ধ যুদ্ধক্ষেত্রের পাশে। তিনি বললেন: দুঃখিত!! এখন দুপুরবেলা তোমাদেরকে আমার বাড়ীতে নিয়ে যেতাম কিন্তু দুঃখজনক সংবাদ হল- আজকে আমি বাড়ীতে একা। আমার ভাইরা ভাইয়ের ছেলের বিবাহ হচ্ছে। বাড়ীর সবাই সেখানে গেছে। এজন্য বাড়ীতে নিয়ে যেতে পারলাম না।

এরপর তিনি এখান থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দুরে মু'তা যুদ্ধক্ষেত্রের পাশে বাংলাদেশী হামিদ ভাইয়ের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আমাকে তার নিজের মোবাইল নাম্বার দিয়ে নিজের ঠিকানায় চলে গেল ।

বুঝলাম যে, এটাই তো একজন মু'মিনের গুণাবলী হওয়া উচিত। তার সাথে আমার তো কোন পরিচয় ছিল না। ছিল না কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক। আমাদের মাঝে ছিল শুধু একটাই সম্পর্ক আর তাহল দ্বীনি সম্পর্ক। আর সে সম্পর্ক অন্যান্য সকল সম্পর্কের উর্ধ্বে। আমাদের সমস্ত মুসলমানকে এমনই হওয়া উচিত। কিন্তু, আমরা কি সবাই তেমন হতে পেরেছি?

(ইসমাইল একেবি  এর ব্লগ থেকে কপি করা হয়েছে)

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম