বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ রূপে পরিচিত হলেও, দেশটিতে যে চেতনা বা মতবাদটি বিজয়ী সেটি ইসলাম নয়। আইন রূপে যে বিধিমালা আদালতে প্রতিষ্ঠিত সেটিও আল্লাহর আইন নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা ও সাধারণ মানুষের প্রাত্যাহীক জীবনে যে আচার, রীতিনীতি বা সংস্কৃতিটি বিজয়ী সেটিও ইসলামী নয়। বাংলাদেশে বিজয়ী জীবনদর্শনটি হল সেকুলারিজম। তবে দেশটিতে সেকুলারিজম যেভাবে ধর্ম-নিরপেক্ষতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে শব্দটির প্রকৃত অর্থ তা নয়। সেকুলারিজমের এটি এক ভূল, বিভ্রান্তকর এবং সে সাথে প্রতারণামূলক ব্যাখা। ধর্ম নিয়ে সেকুলারিজম যেমন নীরব নয়, তেমনি নিরপেক্ষও নয়। সেকুলারিজমের আভিধানিক অর্থ হল ইহজাগতিকতা। এটি হল এমন এক বিশ্বাস বা চেতনা যা শিক্ষা, সাহিত্য, সংগঠন ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মের কোন ভূমিকা ও প্রভাবকে স্বীকার করে না। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এ ক্ষেত্রগুলোকে তারা ধর্মশূণ্য দেখতে চায়, তাই রাজী নয় ধর্মের প্রবেশাধিকার দিতে। ব্যক্তি ও সমষ্ঠির জীবনে ধর্মের প্রভাবকে বলে সাম্প্রদায়িকতা।
সেকুলারিষ্টগণ তাদের বিশ্বাস ও রাজনীতিতে শুধু আপোষহীনই নয়, যুদ্ধাংদেহীও। বাংলাদেশে এ মতবাদটির অনুসারিরা কাজ করছে ইসলামী চেতনার নির্মূলে। নির্মূল করতে চায় ইসলামের প্রতিষ্ঠায় যারাই সচেষ্ট তাদেরকেও। ইসলামের প্রতিষ্ঠাকামী চেতনাকে তারা বলে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ চেতনা, বলে রাজাকারের চেতনা। কথা হল, ধর্মের বিরুদ্ধে –বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধে এমন একটি সুস্পষ্ট এজেন্ডা থাকার পরও কি সেকুলারিজমকে ধর্ম নিরেপক্ষ বলা যায়? বাংলাদেশের রাজনীতি, সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সেকুলারিজমের নামে এটি হল সবচেয়ে বড় ভন্ডামী বা প্রতারণা। দেশের রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সেকুলারিজমের এ বিজয় নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে বিস্ময়ের বিষয় হলো, দেশের সেকুলার নেতৃবর্গই শুধু নয়, সংখ্যাগরিষ্ট রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ এবং সাধারণ মানুষও সেকুলারিজমের এ বিজয় নিয়ে গর্বিত। অথচ সেকুলারিজমের এ বিজয়ে এবং আল্লাহর শরিয়তী বিধানের পরাজিত দশায় কোন মুসলমান কি খুশি হতে পারে? খুশি হতে পারেন কি মহান আল্লাহ? একটি আদর্শরূপে ইসলামের এ পরাজয় শুধু রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আ্ইন-আদালত ও সাধারণ মানুষের কর্ম ও আচরণের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। অপরদিকে সেকুলারিজম যে শুধু বাংলাদেশের ধর্মে অঙ্গিকারশূণ্যদের গ্রাস করেছে তা নয়। গ্রাস করেছে তাদেরকেও যারা নিজেদেরকে ইসলামের পক্ষ্যের শক্তি রূপ পরিচয় দেয়। প্রশ্ন হল, ব্যক্তি বা সমষ্টির জীবনে সেকুলারিজমের মূল মিশনটি কি? সেটি হল, ইহলৌকিক স্বার্থ হাছিলের ফন্দি-ফিকির ও প্রয়াস-প্রচেষ্টা। এবং সে লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ ও নিজ সামর্থের পূর্ণ বিণিয়োগ। সে পার্থিব লাভের চিন্তাভাবনা থেকেই নির্নীত হয় সেকুলারিষ্টদের রাজনীতি, ব্যাবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, এমনকি পোষাক-পরিচ্ছদও। এটি দেয় জীবন ও জগত নিয়ে দেয় একটি পরিপূর্ণ প্যাকেজ। তাই যে ব্যক্তি সেকুলার সে শুধু রাজনীতিতেই সেকুলার নয়; সেকুলার অর্থনীতি, পোষাক-পরিচ্ছদ, সংস্কৃতিতেও সে সেকুলার। এমন কি ধর্ম পালনেও সে সেকুলার। ধর্মপালনের মধ্যেও সে পার্থিব স্বার্থ খুঁজে। তাই ইসলামের যে বিধানগুলো এমন সেকুলার ব্যক্তিটির পার্থিব স্বার্থের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তখন আল্লাহপ্রদত্ত সে বিধানগুলোকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তখন সূদী ব্যাংক থেকে চাকুরি ছেড়ে দেওয়া বা সূদ-মূক্ত অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পণ তার কাছে অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেকুলার চেতনায় যেটি প্রবল ভাবে বাড়ে সেটি হল পার্থিব স্বার্থ শিকারের চিন্তা। স্বার্থশিকারী এমন ব্যক্তির পক্ষ্যে সৎ থাকাটাই তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই বাংলাদেশে যতই বাড়ছে সেকুলারিজমের প্লাবন ততই ভেসে যাচ্ছে ন্যায়-নীতি ও ইসলামী চেতনাবোধ। দেশটি বিশ্বরেকর্ড গড়ছে তাই সূনীতিতে নয়, দূর্নীতিতে। এমন এক দুনিয়াদারি চেতনার কারণেই রাজনীতিতেও প্রাধান্য পাচ্ছে মার্কিন বা পাশ্চাত্য শক্তির চলমান ইসলাম-বিরোধী যুদ্ধে শরিকদার হওয়ার আকাঙ্খা। আগ্রাসী শক্তিবর্গের কাছে বিশ্বস্থ্য হওয়া যাবে, এবং সেখানে থেকে আর্থিক সাহায্য আসবে -সে আশায় বাংলাদেশের সেকুলার চরিত্রটিকে তাদের কাছে ফলাও করে প্রচার করা হয়। গুরুত্ব পায়, শরিয়তের প্রতিষ্ঠা, সূদ-বিহীন অর্থনীতি ও অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জ্বিহাদ –ইসলামের এরূপ মৌল বিশ্বাসগুলো থেকে দূরত্ব বজায় রাখার নীতি।
সেকুলারিজমের ইহকালমুখি চেতনার বিপরীতে ইসলামী চেতনাটি হল পুরাপুরি পরকালমুখি। এখানে প্রবল ভাবে কাজ করে আল্লাহকে খুশী করার চেতনা। কাজ করে, আল্লাহকে খুশি করার মধ্য দিয়ে মৃত্যু-পরবর্তী অনন্ত-অসীম সুখময় জীবন লাভের চেতনা। তখন প্রবল ভাবে বেড়ে উঠে, ক্ষুদ্র পার্থিব স্বার্থ ছেড়ে অসীম পরকালীন স্বার্থের প্রতি নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার চেতনা। এটি এমনই এক শক্তিশালী চেতনা যে প্রবল বিপ্লব আনে ব্যক্তির সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে। তখন পাল্টে যায় ব্যক্তির বাঁচার মূল উদ্দেশ্য, আচার-আচরন, কর্ম ও চরিত্র। তখন সে সমুদয় শারিরীক, আর্থিক, মানসিক সামর্থ নিয়োগ করে নিছক আল্লাহকে খুশি করতে, কোন বান্দাহ, কোন সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠানকে নয়। এমন আখেরাতমুখি চেতনার কারণে অসম্ভব হল, এমন চেতনাধারি ব্যক্তিকে দূর্নীতিপরায়ন করা। যে ব্যক্তি বহু হাজার কোটি টাকায় নিজেকে পূর্বেই বিক্রি করে দিয়েছে, সে কি কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ বা কয়েক কোটি টাকার বিণিময়ে নিজেকে দ্বিতীয়বার বিক্রি করতে পারে? এমন বেচাকেনার চুক্তিতো মোমেনের জীবনে মহান আল্লাহর কাছে ঈমান আনার সাথে সাথেই চুড়ান্ত হয়ে যায়। ফলে পুনরায় বিক্রি করার মত তার হাতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। মহান আল্লাহতায়ালা তো তাঁর জান-মাল কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিণিময়ে। পবিত্র কোরআনে সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ঈমানদারের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিণিময়ে। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায়। এ পথে তারা যেমন (ইসলামের শত্রুকে)হত্যা করে তেমনি নিজেরাো নিহত হয়।” –(সুরা তাওবা, আয়াত ১১১)। ঈমানদার তাই আল্লাহর কাছে তার বিক্রয়কৃত জান-মালকে বিণিয়োগ করে মহান আল্লাহর দ্বীনের বিজয় আনার জ্বিহাদে। আল্লাহর সাথে ঈমানদারের চুক্তিটি এতটাই বাধ্যতামূলক যে, চুক্তি পালনে ব্যর্থ হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি অনিবার্য। নিষিদ্ধ হয় হেদায়েত লাভও। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর ঘোষণাটি এসেছে এভাবেঃ “বল, তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান –যাকে তোমরা পছন্দ কর-যদি তোমাদের নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ও তার রাস্তায় জ্বিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর হুকুম আসা পর্যণ্ত। এবং আল্লাহ ফাসেকদের তথা পাপাচারী দুর্বৃত্তদের হেদায়াত দেন না।” –(সুরা তাওবাহ, আয়াত ২৪)।
উপরের দুটি আয়াতের মূল শিক্ষা কি দাঁড়ালো? আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট ঘোষণা হল, এ জীবনে সত্যপথের হেদায়াত তথা সিরাতুল মোস্তাকিম পেতে হলে সে জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার কাজে শুধু প্রস্তুত নয়, নিয়োজিতও থাকতে হয়। নিছক নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাতে সেটি হয় না, আরো উর্ধ্বে উঠতে হয়। এজন্যই যেখানে প্রকৃত ঈমানদারের সংখ্যা সেখানে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে লড়াইও শুরু হয়। সেকুলারিজমে এমন লড়াই মৌলবাদী চরমপন্থা। সেকুলারিজমের সাথে এখানেই ঈমানদারের বিবাদ। সে সাথে বৈপরীত্যও। যারা সেকুলার তাদের জীবনে মহান আল্লাহর সাথে উঁচ্চ মূল্যে জীবন বিক্রির চুক্তি নেই। তাই সামান্য বেতন পেলেই নিজ জীবনকে দুনিয়াদারীর লোভে বিলিয়ে দিতে রাজী। সেকুলারদের মধ্য থেকে যেভাবে ডাকাত দলের সদস্য, দুর্বৃত্ত সন্ত্রাসী দলের ক্যাডার, ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলের কর্মী বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভাড়াটে সৈনিক পাওয়া যায় সেটি ঈমানদারদের মাঝে খুঁজে পাওয়া দূরুহ। ঈমানদারগণ তো এমন দুর্বৃত্ত শক্তির নির্মূল চায়। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সামান্য বেতনের চাকুরি দিয়ে ইরাক দখলে এবং সেখানে মুসলিম হত্যার মিশনে ভারতের সেকুলার মুসলমানদের মধ্য থেকে সৈনিক পেতে ব্রিটিশদের কোন অসুবিধায় হয়নি। এমন কি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সে বাহিনীতে নাম লিখেয়েছিলেন। অপর দিকে জেনারেল আতাউল গনি ওসমানি ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে বার্মায় গিয়েছিলেন যুদ্ধ করতে। আজও যারা ইরাকে ও আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধে লাগিয়ে মুসলিম হত্যা করছে তারাও সে অভিন্ন সেকুলার চেতনার লোক। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকেরা উপমহাদেশে তাদের সমগ্র শাসনকাল ধরে এমন এক সেকুলার চেতনারই পরিচর্যা দিয়েছিল। পাকিস্তান ও বাংলাদেশী আমলে শুধু মানচিত্রে পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু সেকুলার চেতনা নির্মানের সে প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন আসেনি। বরং অব্যাহত রয়েছে সে অভিন্ন ধারা। এমন সেকুলার চেতনার কারণেই পাকিস্তান আর্মি নিজ দেশে আজ ইসলামপন্থিদের হত্যা করছে। এককালে সেটি করেছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের খুশি করতে, আর এখন সেটি করছে মার্কিনীদের খুশি করতে। শুধু পাকিস্তান নয়, আলজেরিয়া, তুরস্ক, আফগানিস্তানসহ সেকুলার আর্মি দেশে দেশে আজও সেটিই করছে। ইসলামের বিজয়ে তারা কি আদৌ কোন ভূমিকা রেখেছে? আছে কি ইসলামের প্রতি অঙ্গিকার?
যে তুলনাহীন অসীম মূল্যে একজন মুসলমান আল্লাহতায়ালার কাছে তাঁর জানমাল বিক্রি করে, তার সাথে কি তুলনা চলে সে ব্যক্তির যে মাত্র কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ টাকা মাসিক বেতনের চাকুরি করে? আল্লাহপাক তাঁকে যে বিশাল জান্নাত দিবেন তার এক হাত জমিনও কি সে তার সারা জীবনের বেতনের টাকা দিয়ে কিনতে পারবে? হাজার কোটি টাকা দিয়েও কি কেনা যাবে? জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আছে কি? এমন তুলনাহীন প্রাপ্তিতেই তো ঈমানাদারের আগ্রহ বাড়ে আল্লাহর কেনা সে প্রাণখানি আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে বিলিয়ে দেওয়ায়। এমন ব্যক্তি তখন ফাঁসীর মঞ্চেও হাঁসতে পারে। পার্থিব স্বার্থের গোলামদের কাছে সেটি অচিন্তনীয়। তারা তো মৃত্যু অবধি স্বার্থ খুজে। বহু হাজার বা বহু লাখ টাকার বেতনেও তাদের লালসা মেটে না। তাই তারা ঘুষ খায়, সূদ খায় ও নানারূপ দূর্নীতিও করে। সেকুলার আর্মীর সদস্যদের উচ্চ বেতন, উচ্চ ভাতা এবং অতি মূল্যের বাড়ী-গাড়ি ও প্লট জুগিয়েও নিজদেশ রক্ষায় মনযোগী করা যায় না। দেশের সুরক্ষা ছেড়ে তারা বরং নিজ দেশ দখলে নামে। অথচ প্রকৃত ইসলামি ব্যক্তিতো নিজের উপার্জিত অর্থ, সে উপার্জিত অর্থে কেনা অস্ত্র নিয়ে জ্বিহাদে যায়। প্রাণও দেয়। বেতনের তারতম্যের সাথে বাড়ে কর্মে নিষ্ঠার তারতম্য। কোটি টাকা বেতনের চাকুরিজীবীর নিষ্ঠা এজন্যই হাজার টাকা বেতনের কর্মী থেকে বহুগুণ বেশী হয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে কাফের মানুষদের থেকে মুসলমানদের পার্থকটি এজন্যই এতটা বিশাল ছিল। তাঁরা ছিলেন চলমান কোরআন। তাদের চরিত্র দেখে বিধর্মীরা কোরআনের শিক্ষা বুঝতো। দলে দলে তারা মুসলমানও হত। অথচ আজ কে মুসলমান আর কে মুসলমান সেটি পোষাক-পরিচ্ছদ, চরিত্র, আচরণ ও কর্ম দেখে বুঝে উঠাই সম্ভব নয়। সৈয়দ জামাল উদ্দীনের ভাষায় মেঘ যেমন সূর্যকে আড়াল করে এরাও তেমনি ইসলামকে আড়াল করে রেখেছে। ইসলামের গৌরব বাড়ানোর সামর্থ কি এদের আছে? দূর্নীতিতে বাংলাদেশীরা তো কাফেরদেরও হারিয়ে দিয়েছে। একবার নয়, পাঁচবার। অথচ ১৫ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। ৫৫টি মুসলিম দেশের মাঝে জনসংখ্যা বিচারে বাংলাদেশ তৃতীয়। মুসলমানদের মুখ উজ্বল করার কাজে দায়িত্ব পালনেও তাদের তৃতীয় হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে দায়িত্ব-পালন হয়নি।
ঈমানদার ব্যক্তির জন্য এটি অসমম্ভব যে, পরিবারিক, গোত্রীয় বা দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের রাজনীতিতে আল্লাহর কাছে বিক্রয়কৃত তার জানমালকে সে ব্যয় করবে। প্রাথমিক যুগের কোন মুসলমান রোমান, পারসিক বা অন্য কোন শত্রুবাহিনীতে ভাড়াটিয়া হিসাবে কাজ করেছেন সে নজির নেই। কারন সে একমাত্র আল্লাহর এবং একমাত্র আল্লাহর কাছেই ফিরে যায়। “ইন্না লিল্লাহি ও ইন্না ইলাহি রাযীয়ুন।” –(সুরা বাকারা আয়াত ১৫৬)। অর্থঃ ..নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য, এবং নিশ্চয়ই তাঁর কাছে আমরা ফিরে যাবো। ফলে মোমেনের জীবনের মূল গতিময়তা একমাত্র আল্লাহর দিকে। চলার এ পথটিই সিরাতুল মোস্তাকিম। সে বাঁচে শুধু আল্লাহকে খুশি করার জন্য। এ জন্যই সে লড়াই করে, এজন্যই প্রাণ দেয়। এমন একটি উচ্চতর মিশনের কারণেই ঈমানদাদেরর পক্ষ্যে দূনীর্তি-পরায়ন হওয়া অসম্ভব। সে তো আত্ম-নিয়োগ করে দূর্নীতির বিরুদ্ধে জ্বিহাদে। পবিত্র কোরআনে মোমেনের জীবনের সে মিশনটি আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন এভাবেঃ “তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকতে হবে যারা মানুষকে কল্যানের দিকে ডাকবে এবং ন্যায়ের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায়ের পথ থেকে রুখবে। এবং তারাই হল সফলকাম।”-(সুরা আল-ইমরান আয়াত-১১৪)। লক্ষ্যণীয় হল, পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক যে কাজকে আখেরাতে সফলকাম হওয়ার পথ রূপে ঘোষণা দিয়েছেন সে কাজটিই সেকুলারিজমে মৌলবাদ। সেকুলারিষ্টগণ চায় সে রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করতে।
ব্যক্তির গায়ের রঙের চেয়েও বেশী দৃশ্যময় হল তার চরিত্র ও চেতনা। কারণ, গায়ের রঙ কসমেটিক লাগিয়ে লুকানো যায়, কিন্তু চরিত্র লুকানো যায় না। সেটি তার কথা-বার্তা, আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ, কর্ম বা লেখনীর মাধ্যমে অতি প্রকট ভাবে প্রকাশ পায়। যে ব্যক্তি সূদী ব্যাংকে চাকুরি করে বা যে মহিলা বেপর্দা ভাবে চলাফেরা করে বা যে ব্যক্তি আল্লাহর আইনের প্রতিষ্ঠা রুখতে রাস্তায় লাঠি নিয়ে নামে বা ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্য ব্যক্তিকে ভোট দেয় তার চেতনার পরিচয়টি জানবার জন্য কি আর গবেষণার প্রয়োজন আছে? নামায-রোযা পড়া বা হজ্ব পালন করা ততটা কঠিন নয়, যতটা কঠিন হল পার্থিব স্বার্থের বিরুদ্ধে উঠে কাজ করা। পার্থিব-স্বার্থ-চেতনা তথা সেকুলার চেতনা শুধু নিজের আর্থিক-স্বার্থ, মান-সম্মান বা পদবী লাভের স্বার্থ নয়, সেটির প্রকাশ ঘটতে পারে নিজের গোত্র, পরিবার, দল, ভাষা, ভূগোল বা জাতীয় স্বার্থের চেতনার মধ্য দিয়েও। কারণ এগুলীও পার্থিব স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়। তাই সেকুলারিষ্ট শুধু ধর্মে অঙ্গিকারশূণ্য রাজনৈতিক নেতারা নয়, বরং ট্রাইবালিজম, জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজবাদসহ দলীয় রাজনীতির পতাকাধারিরাও।
তবে পার্থিব স্বার্থ উদ্ধারে ধর্মও ব্যবহার হতে পারে। এবং বাংলাদেশে সেটি হচ্ছে অতি প্রকট ভাবে। দেশটিতে ধর্মের ব্যাপক অপব্যবহার হচ্ছে সেকুলার রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এসব দলের নেতারা তসবিহ হাতে নেয়, দরগায় হাজিরা দেয়, বিশ্ব-ইজতেমাতেও যোগ দেয়। ধর্মীয় চেতনাকে পুঁজি করে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি নেমেছে ময়দানে। শুধু রাজনীতিতে নয়, সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। লক্ষ্য, নিজেদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তা বাড়ানো। “মানুষকে কল্যানের দিকে ডাকা, ন্যায়ের নির্দেশ এবং অন্যায়ের পথ থেকে রুখার -আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত এ মিশন তাদের কাছে কোন গুরুত্বই পায়নি। তারা মগ্ন নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের মিশন নিয়ে। ফলে মসজিদ, মাদ্রাসা ও মাদ্রাসার ছাত্রদের সংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম হলে কি হবে, ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠায় দেশটি সবার তলায়। নিজ যোগ্যতায় এদের অনেকের স্বচ্ছল ভাবে চলার সামর্থ নেই, কিন্তু ধর্মীয় চেতনাকে পুজি করে তাদের অনেকে বিশাল মাদ্রাসার প্রধান। ন্যায়-নীতির প্রতিষ্ঠা নিয়ে তাদের কোন আগ্রহও নেই। সেকুলার চেতনা ঢুকেছে এখানেও। কারণ ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সমাজের দুর্বৃত্তদের সাথে সংঘর্ষ অনিবার্য|।সে সংঘাতে ক্ষতির সম্ভাবনা এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের। তাই সমাজ দূর্নীতিতে ভেসে গেলে কি হবে, তা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই। দেশটির ব্যর্থতা নিয়ে মনকষ্টে একটি মহুর্তের জন্যও তাদের আহাজারি হয়না, ঘুমেও ব্যাঘাত ঘটেনা। দেশে শরিয়তী আইন পরাজিত, অথচ তা নিয়েও এসব আলেমদের মাঝে কোন মাতম নেই। বরং দুঃশ্চিন্তামূক্ত আলস্যতায় বাড়ছে তাদের শারিরীক মেদ।
সেকুলার চেতনার প্রভাবে ব্যক্তির চরিত্রে যেটি ঘটে সেটি হল, যে কর্মে বা যে নীতিতে পার্থিব ক্ষতি বা লোকসানের সম্ভাবনা দেখা দেয় সেটিই তাদের কাছে পরিতার্য বিবেচিত হয়। আর্থিক লাভ ও নামধাম বা ক্ষ্যাতির নিশ্চিয়তা পেলে এসব সেকুলার চেতনাধারিরা অতিশয় অন্যায় বা গর্হিত কাজও হালাল করে নেয়। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশে সূদ-ভিত্তিক ব্যাংকের সংখ্যা বহু কাফের দেশ থেকে এজন্যই কম নয়। বরং বহু মুসল্লী এসব ব্যাংক থেকে লোন নিচ্ছে, সেখানে চাকুরীও করছে। এদেশে কম নয় এমনকি ব্যাভিচারী পুরুষ ও পতিতা নারীদের সংখ্যাও।
ইসলামপন্থিদের মাঝে যারা নির্বাচন নিযে ব্যস্ত তাদের মাঝে সেকুলারিজমের প্রভাব আরো প্রকট। তারা বার বার নির্বাচন করলে কি হবে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার কথা মুখে আনতে রাজী নয়। রাজী নয় সূদের বিরুদ্ধে জ্বিহাদ ঘোষনায়। বার বার সংসদে বসলে কি হবে শরিয়তের পক্ষে কোন বিলও উত্থাপণ করেনি। তাদের ভয়, না জানি তাদের পার্থিব কায়েমী স্বার্থে আঘাত না আসে। কোন কথা বা কোন কাজে আল্লাহ খুশি হবেন তারা সেটি দেখে না, বরং দেখে কোন কথায় ভোটার খুশি হবে সেটিতে। সে চেতনায় তারা নগ্ন পায়ে জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভেও গিয়ে উঠে। নির্বাচনী বিজয়কে নিশ্চিত করতে তারা তখন জোট বাঁধে চিহ্নিত ইসলাম-বিরোধীদের সাথেও। সেরূপ লাভ-লোকসানের কথা মাথায় রেখেই তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যত কূকর্মই করুক না কেন তার বিরুদ্ধে কথা বলতে রাজি নয়। সৌদি-আরবের মত দেশগুলো যত অন্যায় করুক না কেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখ খুলতেও রাজি নয়। ১৯৮৬ সালে সৌদি পুলিশ যখন চার শতের বেশী হাজিকে নির্মম ভাবে হত্যা করে তখনও তার প্রতিবাদে কোন কথা বলেনি।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ১৭৫৭ সালে বাংলা দখল করেছিল কোন ধর্ম প্রচারের কারণে নয়। বরং সেটি ছিল দেশটির সম্পদ লুটের মাধ্যমে নিজেদের ইহলৌকিক আনন্দ বৃদ্ধি। তারা ছিল নিরেট সেকুলার। পার্থিব সুখ বাড়াতে সূদী আয় যেমন জায়েজ করেছিল, তেমনি জায়েজ করেছিল পতিতাবৃত্তিকে। ইংরেজগণ চলে গেছে, কিন্তু রয়ে গেছে তাদের মানসিক গোলামেরা। আর এ মানসিক গোলামদের কারণেই বিজয়ীর বেশে আজ সেকুলারিজম। আর সেকুলারিজম প্রবলতর হলে সে ভূখন্ডে আল্রাহর গোলামী যথার্থ ভাবে হয় না। কারণ ইবাদতের বলিষ্ঠ প্রেরণা তো আসে আল্লাহর ভয় ও পরকালীন স্বার্থচেতনা থেকে। এমন চেতনার কারণেই ঈমানদারের দেশে ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে জ্বিহাদ শুরু হয়। একটি দেশে ইসলামি চেতনা কতটা গভীর সেটির মাপকাঠি হল এ জ্বিহাদ এবং সে সাথে সে জ্বিহাদে প্রাণদানকারি শহিদের সংখ্যা। মসজিদ বা মাদ্রাসার সংখ্যা নয়। লক্ষ লক্ষ মসজিদ মাদ্রাসা নিয়ে একটি দেশ দূর্নীতিতে কাফেরদের চেয়েও এগিয়ে থাকতে পারে। বাংলাদেশে ইসলাম পরাজিত হলে কি হবে, সে জ্বিহাদ নেই, সে শহিদও নেই। দেশটির আইন-আদালত, রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতির ময়দানে ইসলাম পরাজিত হয়েছে এবং সেকুলারিজম বিজয়ী হয়েছে কোনরূপ লড়াই ছাড়াই। বিজয়ী সেকুলারিজমের বিরুদ্ধে ইসলামী মহল থেকে জ্বিহাদ দূরে থাক প্রতিবাদও নেই। ইসলামী চেতনার এ এক বিপন্নদশা। এতে সাহস বেড়েছে সেকুলারদের। তারা এখন ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে নির্মূলের হুমকী দেয়। কোরআনের মৌলশিক্ষাকে রুখতে চায়। তাদের দ্বারা প্রচন্ড অবাধ্যতা ও বিদ্রোহ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর প্রেরীত বিধানের সাথে। আল্লাহর দ্বীনের এরূপ অবমাননাকর অবস্থাতেও সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান পরিণত হয়েছে নীরব দর্শকে। প্রশ্ন হল, এমন দেশকে কি বলা যাবে? সেকুলার বলা যাবে ঠিকই। কিন্তু মুসলিম বা ইসলামীও কি বলা যাবে?
লেখা: ফিরোজ মাহবুব কামাল
0 comments: