২০০৩ সালের কথা। সাংবাদিকতার উপর একটি কর্মশালা চলছিল। বক্তার ডায়াসে সোনার বাংলা সম্পাদক মুহাম্মদ কামারুজ্জামান।
আমরা যারা অডিয়েন্সে বসেছিলাম তারা সবাই তরুন ছাত্র বিধায় গোগ্রাসে গিলছিলাম লেকচারগুলো। অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিকরা সেসময় আমাদের ক্লাস নিয়েছিলেন।
আজ সেই ছাত্রগুলোর অনেককে টিভিতে দেখতে পেলে খুব ভালো লাগে। ক্লাসরুমে বসে তখনো ভাবিনী এই ছেলেগুলো থেকে ভালো ভালো সাংবাদিক তৈরী হবে।
কামারুজ্জামান চাচা খুব শান্ত মেজাজে কথা বলেন। রাজনৈতিক মঞ্চেও তাকে কখনো উত্তেজিত হতে দেখতাম না। সাবলিলভাবে যা বলতেন তা সবার জন্য বুঝতেও সহজ হতো।
সেদিন সাংবাদিকতার নীতি আদর্শ আর চলমান প্রেক্ষাপটে আমাদের কি কি যোগ্যতা অর্জন করতে হবে তাই নিয়ে আলোচনা করলেন সোনার বাংলা সম্পাদক।
তখন মফস্বল থেকে চিঠি খামে নিউজ আসতো, ছবি আসতো। কামারুজ্জামান চাচা তখন বলছিলেন সামনের দিনগুলোতে প্রযুক্তি আমাদের কিভাবে হেল্প করবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে তিনি বলছিলেন, তোমরা কি সব শুরু করলে, বই মেলা, প্রকাশনা মেলা, এখন দরকার তথ্যপ্রযুক্তির মেলা। আমার অফিসে মেইল আসলে আমি না থাকলে কখনো কখনো ফাউল ডাওনলোড দেয়ার লোক থাকে না। তখন ওয়ামিকে বাসা থেকে অফিসে যেতে বলি।
কত সূদূরের কথা ভাবতেন এই নেতা। সময় যেটাকে ভোগ করেছে সেটা নয়, সামনে যা প্রয়োজন তিনি তাই গ্রহণ করতে বলতেন। যুগের গড্ডালিকা প্রবাহে গাভাসিয়ে নয়। সংগঠনকে সময়ের প্রবাহে গতিশীল করার জন্য তিনি ভাবতেন।
ফিরে এলাম সেই কর্মশালা শেষ করে। তার কয়েকদিন পর এলাকার একটি মাঠে জামায়াতের কর্মী সম্মেলন। স্কুল মাঠে প্রায় ৫০০০নেতাকর্মী উপস্থিত। প্রধান অতিথি মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। যেহেতু দুদিন আগে তার লেকচার শুনেছি তাই আবার তার কথা শুনতে ঠিক পিছনে মাঠের এক কোনায় গিয়ে বসলাম।
ইসলামী আন্দোলনে এমন সুন্দর ভাবনার মানুষকে হারিয়ে আজ উপলব্দি করছি কেন তাদের হত্যা করা হয়। হ্যা এটা তাদের যোগ্যতা। আল্লাহর প্রিয় বান্দা হবার যোগ্যতা। শাহাদাতের ইচ্ছা সবাই পোষণ করতে পারে কিন্তু আল্লাহ সবাইকে কবুল করেননা।
এই কামারুজ্জামান চাচারা যখন ছাত্রআন্দোলনের শহীদদের বাড়ি যেতেন শান্তনা দিতে তখন শহীদের বাবা- ভাইদের মাথায় হাত বুলাতেন। কি পরম সান্নিধ্য তাদের। কি সুন্দর মিল খুজে পাই। রূহানিয়াত বটে। এতো প্রশান্তি পৃথিবীর কোন জলসায় নেই।
শহীদ সেতো শহীদের আত্মীয় আত্মার। রক্তমাখা কাপড়ে হাত রেখে যে সন্তানগুলো শপথ করে দ্বীন কায়েমের। আল্লাহতো তাদেরই গ্রহণ করবেন। বাতিলের কাছে এরাই বিজয়ী।
সম্মেলন শেষে চাচার সাথে আব্বার দেখা হল। বাবাকে খুব পছন্দ করতেন। বললেন, আপনার পানের বাটা থেকে একটা পান দেবেন। আব্বার পান নাকি তার খুব পছন্দ।
১১এপ্রিল রাতে যখন চাচার ফাসিঁর প্রস্তুতি চলছিল। তখন বারবার বিদ্যুত চলে যাচ্ছিল। তাই আব্বা টিভির সামনে বসে বিরক্ত প্রকাশ করছিলেন। আম্মা আব্বার অস্থিরতা বুঝতে পেরে নানা কথা বলে তাকে সহজ করতে চাচ্ছিলেন।
প্রতিমুহুর্তেই উৎকন্ঠা।
রাত ১০টা বাজার পর আমি চিৎকার দিয়ে বলছিলাম। সবাই কালেমায়ে শাহাদাত পড়তে থাকেন। আম্মাসহ সবাই তখন তাই করছিলেন। আমাদের প্রার্থণা ছিল হে আল্লাহ আমাদের এ প্রিয় মানুষটিকে তুমি শহীদ হিসেবে কবুল কর। তার মৃত্যুকে সহজ করে দাও। জান্নাতের বাগানে তুমি তাকে স্থান দাও। আন্দোলনের সকল শহীদদের মিছিলে তুমি তাকে সম্মানিত কর।
ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা এ অনুভুতি। ওয়ামীর তোজোদ্দীপ্ত কথায় প্রাণ ফিরে পেলো হাজারো নেতা কর্মী। মৃত্যুর পূর্বে মহান এ নেতার আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা দেখে বিস্ময়ে বিমুঢ় গোটা জাতি। এ মৃত্যু সহজ কোন দূর্ঘটনা নয়। গোটা জাতি যদি তাকে হত্যার উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে তবে তা ভয়ংকর দু:সংবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়।
কেউ বলেন ১৭ কেউ বলেন ১৮/১৯ বছর ছিল তার বয়স। উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছিলেন তিনি। কি অদ্ভুত একটি গল্প লেখা হল। সোহাগপুর নামে এক নরকের ভিলেন বানানো হল তাকে। আর সেই গল্প বলা শেষ হলে ভিলেন চরিত্রে নাটকের পট থেকে বাস্তবতায় নিয়ে আসা হল কামারুজ্জামানকে।
ইয়া আল্লাহ..... তুমি স্বাক্ষী থেকো। তুমি ওদের ক্ষমা করোনা। তুমি মজলুমের ফরিয়াদ শুনো হে প্রভু।
রায়ান মাসরুর
0 comments: