ইসলামী সংগঠনে নেতৃত্বের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আসনে আসীন হতে পারে সেদিকে নির্বচকমণ্ডলীকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়।
নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির তাকওয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হয় সর্বাগ্রে। তাকওয়া যদিও ব্যক্তির ভেতরের ব্যাপার তা ব্যক্তির কথাবার্তা,পোশাক পরিচ্ছেদ, চাল চলন,লেন দেন এবং যাবতীয় কার্যকলাপের ওপর সুস্পষ্ট ছাপ রাখে। দীর্ঘকাল পর্যন্ত এগুলোর দিকে নজর রাখলেই ব্যক্তির তাকওয়া সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। একদিন আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দেখতে পেলেন এক ব্যক্তি সালাত আদায় করছে আর তার দাড়ি নিয়ে খেলছে । তখন তিনি বললেন, “এই ব্যক্তির অন্তরে খুশু থাকলে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপরও খুশু পরিলক্ষিত হতো।”
প্রকৃতপক্ষে তাকওয়ার ব্যাপারটি এমনই।
ইসলামী সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচন কোন সাধারণ ব্যাপার নয়। এই নির্বাচনে কেউ প্রার্থী থাকে না। বরং পদপ্রার্থী হওয়া এই সংগঠনের দৃষ্টিতে মারাত্মক অন্যয়। তাই নির্বাচক মণ্ডলীকে সংগঠনের সর্বত্র যোগ্যতম ব্যক্তি খুঁজে বেড়াতে হয়।
ইসলামী সংগঠনের সদস্যদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে এই নেতৃত্ব নির্বাচন। কারো পক্ষে বা বিপক্ষে কোন ক্যানভাস চলে না এখানে। নিজের বিচার বুদ্ধি ও উপলব্ধিকে সম্বল করেই নির্বাচকগণ এখানে ভূমিকা পালন করে। তাই তাদেরকে গভীরভাবে ভাবতে হয়। বিভিন্ন ব্যক্তির যোগ্যতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হয়। নিজের বিচার বুদ্ধর সবটুকু প্রয়োগ করে বেছে নিতে হয় যোগ্যতম ব্যক্তিকে।
সকলের মত ব্যক্তি হওয়ার পর সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থা অর্জনকারী ব্যক্তিকে নেতা ঘোষণা করা হয়। তখন সকলেই তাকে নেতা রূপে গ্রহণ করে তার নির্দেশে জামায়াতী জিন্দেগী যাপন করতে থাকে।
ইসলামী নেতৃত্বের গুনাবলী ইসলামী সংগঠনে নেতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। নেতৃত্বকে কেন্দ্র করেই গোটা কর্মী বাহিনী আবর্তিত হয়। নেতৃত্বর গুনাবলীই কর্মীবাহিনীর ওপর প্রতিবিম্বিত হয়। এখানে নেতৃত্বের কয়েকটি বুনিয়াদী গুনের কথা আলোচিত হচ্ছে অতি সংক্ষেপে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব ইসলামী নেতৃত্বকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হতে হয়। ইসলামী জীবন দর্শন ও জীবন বিধান সম্পর্কে তার ব্যাপক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে ইবলীসী চিন্তা প্রসুত যেসব মতবাদ দুনিয়ার মানুষকে বিভ্রান্ত করে রেখেছে জীবন ও জগত,মানব জীবনের উদ্দেশ্য ও প্রতিষ্ঠিত থাকর করণে মানবগোষ্ঠী কোন কোন সমস্যার সম্মুখীন- এসব কিছু সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট ধারনা থাকা প্রয়োজন। সাধারণ জ্ঞানের দৈন্যও তর থাকা উচিত নয়। তদুপরি নেতাকে যেহেতু মানুষ চালাতে হয় সেই জন্য মানব মনকে বুঝার যোগ্যতাও তার থাকা চাই। তাই মনোবিজ্ঞানও তার ভালভাবে পড়া প্রয়োজন। জ্ঞানই শক্তি কথাটা নি:সন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। জ্ঞানরে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারলে কেবল কর্মীবাহিনী ওপরই নয়, এর বাইরে যেই বিশাল মানবগোষ্ঠী রয়েছে সেখানেও প্রভাব বিস্তার করা সহজ হয়।
উন্নত আমল
নেতাকে হতে হবে ইসলামের মূর্ত প্রতীক। তার চিন্তা-ভাবনা, কথাবার্তা,আচার-আচরণ এবং যাবতীয় কাজকর্মে ইসলামের সঠিক রূপ প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর মূল নেতা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)চরিত্র সকলের জন্য সর্বোত্তম উদাহারণ। তিনি ছিলেন বিমূর্ত আল কুরআন। মুসলিম জীবনের যেই রূপটি আল কুরআন অংকন করেছে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিলেন তারই জীবন্ত রূপ। তার জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলোতে ইসলামের যেই সৌন্দর্য ফুটে উঠেছিলো প্রধানত: আকৃষ্ট হয়েই অমুসলিমগণ ইসলাম গ্রহণ করতো।
নম্র ব্যবহার
রুক্ষ ভাষা এবং রূঢ় আচরণ মানুষকে আহত করে। রূঢ় আচরণে অভ্যস্ত ব্যক্তি কখনো মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারে না। ইসলামী নেতার পক্ষে রূঢ় আচরণ বড়ো রকমের অযোগ্যতা। কর্মীগণ সাংগঠনিক শৃঙ্খলার খাতিরে এই ধরনের নেতার আনুগত্য করলেও তাদের অন্তরে তীব্র বেদনা থাকে। বেদনাহত কর্মীরা স্বতঃ:স্ফুর্তভাবে গতিশীল হয়ে কাজ করতে পারে না। তাই নেতাকে অবশ্যই নম্র ব্যবহারের অধিকারী হত হবে। তার আচরণের সৌন্দর্য কর্মীদেরকে তার দিকে চুম্বকের মতোই আকর্ষণ করে নিয়ে আসবে। এতে করে সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সংহতি অত্যন্ত মজবুত হবে, এটাই স্বাভাবিক।
সাহসিকতা
ইসলামী সংগঠনের নেতা আল্লাহর ছাড়া আর কাউকে ভয় করবেন না। প্রকৃতপক্ষে তাকওয়ার দাবীও এটাই। যেই হৃদয়ে আল্লাহর ভয় থাকবে সেই হৃদয়ে অন্য কাউকে ভয় করবে, তার অবকাশ কোথায়! আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “ যেই ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে দুনিয়ার সবকিছু তাকে ভয় করে।কিন্তু যেই ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ভয় পোষণ করে না দুনিয়ার সবকিছু তাকে ভয় দেখায়।” সংগঠনের নেতা নির্ভীক হলে তার প্রভাব পড়ে সংগঠনের কর্মীবাহিনীর ওপর। এই ধরনের নেতার কর্মী বাহিনী বিপদ- মুসিবত দেখে মনভাঙ্গা হয় না। হিম্মতহারা হয় না।
সময়ানুবর্তীতা
নেতাকে প্রতিদিন অনেক কাজ করতে হয়। অনেক লোকের সাথে সাক্ষাৎ করতে হয়। অনেক স্থানে যেতে হয়। দিনের শুরুতেই করণীয় কাজের তালিকা তৈরি করে নেতা যদি সঠিক কাজ করে চলেন,তিনি একদিনেই বহু কাজ করতে পারেন। এক জায়গায় সময় প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে তারা সারা দিনের কাজগুলো একের পর এক ডিস্টার্ব হতে থাকবে। দিনান্তে হয়তো দেখা যাবে বেশ কেয়কটি কাজের জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করলেই দেখা যাবে সারাদিনের করণীয় সবগুলো কাজই সম্পন্ন করা গেছে।
সাংগঠনিক প্রজ্ঞা
সংগঠনের নেতাকে অবশ্যই সবচেয়ে বেশি সাংগঠনিক প্রজ্ঞার অধিকারী হতে হবে। সংগঠন গড়ে তোলার যোগ্যতা,কর্মী পরিচালনার যোগ্যতা,সংগঠনের সংহতি সংরক্ষণের যোগ্যতা, ময়দান বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা,সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার যোগ্যতা, জনশক্তিকে কর্মমুখর রাখার যোগ্যতা, কর্মীদের মানোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কর্মপন্থা উদ্ভাবনের যোগ্যতা এবং সংগঠনের কর্মীদেরকে গ্যাপ অব ইনফরমেশন থেকে বাঁচিয়ে রাখার যোগ্যতা নেতার অবশ্যই থাকতে হবে।
প্রেরণা সৃষ্টির যোগ্যতা
নেতা হবেন কর্মীদের জন্য প্রেরণার উৎস ও সান্ত্বনার স্থল। নেতার কথাবার্তা কর্মীদের মাঝে হতাশা বা নিরাশার বিষবাষ্প ছড়াবে না। তার কথা শুনে কর্মীরা প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।
নেতা হবেন কর্মীদের জন্য বটগাছ যার ছায়াতে এসে কর্মীগণ আন্তরকে শীতল করতে পারবে। প্রতিকূলতার আঘাত খেয়ে খেয়ে কর্মীরা যখন অস্থির হয়ে ওঠে তখন মনের বেদনা প্রকাশ করার জন্য তারা নেতার নিকট ছুটে আসে। নেতার হাসি মাখা মিষ্ট সান্ত্বনা-বাণী তাদের মনের জ্বালা দুর করে দেয়।নেতার হৃদয়ে কর্মীদের জন্য যে মুহাব্বাতের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হতে থাকে তাতে সিক্ত হয়ে তারা প্রশান্ত হয়। যেই নেতা কর্মীদের ওপর বটগাছের মতো শীতল ছায়া বিস্তার করতে পারেন না তিনি নাৎসী পার্টির নেতা হতে পারেন, কিন্তু ইসলামী সংগঠনের নেতা হওয়া তার সাজে না।
সুভাষণ
নেতা সুবক্তা হওয়া প্রয়োজন। কম কথায় বেশি ভাব প্রকাশ উত্তম ভাষণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বক্তৃত্বা পয়েন্ট ভিত্তিক হলে শ্রোতার পক্ষে বুঝা সহজ হয়। বক্তৃতার ভাষা সহজ হওয়া দরকার। বক্তৃতার প্রারম্ভ, মধ্যভাগ ও সমাপ্তি থাকা চাই। বক্তৃতার ভাবগুলো ধারাবাহিকভাবে সাজানো রূপে আসা দরকার যাতে বক্তৃতার বিষয় বুঝতে শ্রোতাদের কষ্ট না হয়। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “বুয়িসতু বিজাওয়ামিইল কালিম” অর্থাৎ “আমাকে ব্যাপক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত ভাষণের যোগ্যতাসহ প্রেরণ করা হয়েছে।” আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ছিলেন শ্রেষ্ঠ বক্তা। তাঁর বক্তব্য ছিল প্রাঞ্জল ও চিত্তাকর্ষক। ইসলামী সংগঠনের নেতার তাঁরাই অনুকরণে সুবক্তা হওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
নথিপত্র সংরক্ষণের পারদর্শিতা
নেতাকে হতে হবে নথিপত্র সংরক্ষণে পারদর্শী। নথিপত্রের সঠিক নামকরণ,যথাযথভাবে নাম্বারিং করণ এবং ভেতরে সঠিকভাবে কাগজপত্র সন্নিবেশ করনের যোগ্যতা তার অন্য সকলের চেয়ে বেশি দরকার। নিজে পারদর্শী না হলে অন্যদের দারা এগুলো ভালভাবে করিয়ে নেয়া সম্ভব হয় না। নথিপত্র সঠিকভাবে সংরক্ষণ না হলে অনেক সময়ই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হদিস পাওয়া যায় না,অথবা সেগুলো খুঁজে বের করতে বেশ খানিকটা সময় অপচয় হয়।
হিসাব সংরক্ষণের পারদর্শীতা
নেতা হবেন দক্ষ হিসাব রক্ষক। সংগঠনের যাবতীয় আয় ব্যয়ের রেকর্ড ও হিসাব সঠিকভাবে রক্ষণের দায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত। এই ক্ষেত্রে ব্যর্থতা নেতার অতি বড়ো অযোগ্যতা।
অধ্যায়-০২ : ইসলামী সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচন
☼→
ইসলামী সংগঠন
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: