আল্লাহ তাআলা ইসলামী শরীয়াতের এ নিয়ম করেছেন যে, প্রথমে তিনি ভালো এবং পূণ্য কাজের একটা সাধারণ হুকুম জারী করেন, যেন মানুষ নিজের জীবনে সাধারণভাবে ভালো ও কল্যাণকর পন্থা অবলম্বন করতে পারে। তারপর সেই ভালো কাজসুসম্পন্ন করার জন্য একটি বিশেষ পন্থা নির্দেশ করা হয়। সেই বিশেষ পন্থাটি সকলেরই যথাযথ রূপে পালন করা কর্তব্য। উদারহণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, আল্লাহকে স্মরণ করা একটি অত্যন্ত ভালো কাজ এবং সর্বাপেক্ষা অধিক ভালো কাজ। শুধু তাই নয়- বস্তুত সমস্ত ভালো কাজেরই মূল উৎস এটাই। সেজন্য আল্লাহকে সকল সময় ও সকল অবস্থায়ই স্মরণ করা এবং এক মুহূর্তও তাকে ভুল না যাওয়ার জন্য তাঁর নিদেশ রয়েছে:
فَاذْكُرُوْا اللهَ قِيْمًَا وَّقُعُوْدُا وَّعَلى جُنُوْبِكُمْ ـ النساء : 103
দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে (সকল সময় ও সকল অবস্থায়ই) আল্লাহকে স্মরণ কর। সূরা আন নিসা : ১০৩
وَاَذْكُرُوْا اللهَ كَثِيْرَ لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ ـ الانفال : 45
খুববেশী করে তাঁর স্মরণ করতে থাক, কারণ একাজেই তোমাদের কল্যাণ হবে আশা করা যায়। সূরা আল আনফাল : ৪৫
اِنِّ فِىْ خَلْقِ السَّموتِ وَالاَرْضِ وَاَخْتِلاَفِ الَّيْلِ وَالنَّهَارِ لاَيْتٍ لاَوْلِىْ الاَلْبَابِ ـ الَّذِيْنَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ قِيْمَامًا وَّقُعُوْادًا وَّعَلى جُنُوْبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُوْنَ ـ فِىْ خَلْقِ السَّموتِ وَالاَْرْضِ رَبُّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلاًَ ـ
আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির ব্যাপারে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে (আল্লাহর অস্তিত্বের) বহু নিদর্শন রয়েছে, এবং চিন্তাশীল লোকদের জন্য- যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে, আর আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি ও গঠন রহস্য সম্পর্কে চিন্তা করতে থাকে এবং (গভীরভাবে চিন্তা করার পর প্রত্যেকটি জিনিসের মহাত্ম্য বুঝতে পেরে উদাত্ত কন্ঠে) বলে উঠে- হে আল্লাহ! তুমি এর কোনো একটিও নিরর্থক সৃষ্টি করনি। সূরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১
وَلاَ تَطِعْ مَنْ اَغْفَلْنَا قَلْبَه عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوْيهُ وَكَانَ اَمْرَهُ فُرُطًا ـ الكهاف : 28
যাদের দিলে আল্লাহর স্মরণ নেই, যারা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যারা প্রত্যেকটি কাজের নির্দিষ্ট সীমালংঘন করে থাকে, তোমরা তাদের আনুগত্য বা অনুসরণ করো না। (সূরা আল কাহাফ :২৮)
এ আয়াতসমূহে এবং এ ধরণের আরও অনেক ও অসংখ্য আয়াতে পরিস্কার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, হে মানুষ! তোমরা সকল সময় সকল অবস্থায়ই আল্লাহকে স্মরণ কর। কারণ, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর স্মরণই মানুষের সকল কাজ-কর্ম সুষ্ঠু এবং সুন্দর করে দেয়। মানুষ যখনই এবং যে কাজেই তাঁকে ভুলে যাবে; সেখানেই প্রবৃত্তি (নফসের খাহেস) এবং শয়তানের প্রতারণা তাকে পরাভূত করবে। এর অনিবার্য পরিণামে মানুষ সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজেদের জীবন যাপনের ব্যাপারে সীমালংঘন করতে শুরু করবে।
এটা ছিল আল্লাহকে স্মরণ করার একটি সাধারণ নির্দেশ। অতপর আল্লাহকে স্মরণ করার একটি বিশেষ উপায় নির্ধারণ করা হয়েছে। সে জন্য দিন-রাতের মধ্যে পাঁচবার কয়েক রাকাআত করে নামায পড়া ফরয করা হয়েছে। এ নামাযসমূহে একবার পাঁচ-সাত মিনিটের বেশী সময় অতিবাহিত হয় না। পাঁচ মিনিট এখন, আর পাঁচ মিনিট তখন এভাবে আল্লাহকে স্মরণ করা ফরয করে দেয়ার অর্থ এই যে, অন্ততপক্ষে এতটুকু সময়ের জন্য তো মুসলমানকে আল্লাহর স্মরণের কাজে আত্মনিমগ্ন হতেই হবে। তারপর তারা নিজ নিজ কাজ করে যাবে এবং সেই অবস্থায়ও আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকবে।
ইসলামে যাকাতের ঠিক এ অবস্থা। এখানেও একটি বিশেষ হুকুম এবং একটি সাধারণ হুকুম রয়েছে। একদিকে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে, কৃপণতা ও মনের সংকীর্ণতা থেকে দূরে থাক, কারণ এটাই সকল অনর্থের মূল এবং সকল বিপর্যয়ের উৎস। তোমাদের নৈতিক জীবনে আল্লাহর রং ধারণ কর। কারণ তিনি প্রতিটি মুহূর্তে গোটা সৃষ্টিজগতের ওপর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষণ করে থাকেন, যদিও তাঁর ওপর কারো বিশেষ কোনো অধিকার বা দাবী নেই। আবার বলা হয়েছে, আল্লাহর রাস্তায় যত এবং যাকিছুই খরচ করতে পার, তা করতে থাক, নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করে যা উদ্ধৃত্ত রাখতে পার রাখ এবং আল্লাহর অন্যান্য অভাবগ্রস্ত বান্দাদের প্রয়োজন মিটাবার জন্য যত পার দান কর। দীনের খেদমত এবং আল্লাহর কালেমা প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্য জান-মাল দিয়ে চেষ্টা করতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হইও না। আল্লাহর প্রতি যদি তোমার ভালবাসা থাকে, তবে ধন-সম্পত্তির প্রেমকে সে জন্য উৎসর্গ কর।
আল্লাহর পথে অর্থ দান করার জন্য এটা সাধারণ হুকুম। কিন্তু সেই সাথে বিশেষ নির্দেশ এই যে, এত পরিমাণ অর্থ তোমাদের কাছে সঞ্চিত হলে তা থেকে কমপক্ষে এত পরিমাণ অবশ্যই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবে। তোমাদের ক্ষেতে এত পরিমাণ অবশ্যই আল্লাহর পথে অবশ্যই দান করবে। নির্দিষ্ট কয়েক রাকাআত মাত্র নামায ফরয করার অর্থ যেমন এই নয় যে, ঐ কয় রাকাআত মাত্র আদায় করলেই আল্লাহকে স্মরণ করার কর্তব্য সম্পন্ন হয়ে গেল, অতএব তা ভিন্ন অন্যান্য সময় আল্লাহকে ভুলে যেতে পারবে। অনুরূপভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আল্লাহর রাস্তায় দান করা যে ফরয করা হয়েছে, তার অর্থও এটা নয় যে, যাদের কাছে এত পরিমাণ অর্থ আছে কেবল তারাই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করত বাধ্য। আর যারা তদপেক্ষা কম অর্থের মালিক, তাদের মুঠি বন্ধ করে রাখবে। এমনকি, তার অর্থ এটাও নয় যে, ধনীদের ওপর যে পরিমাণ যাকাত ফরয হয়েছে, তারা কেবল সেই পরিমাণ অর্থ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেই নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে, অতপর কোনো অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি আসলে তাকে বাড়িয়ে দেবে-দীন ইসলামের কোনো বৃহত্তর কাজের তাগীদ আসলে বলবে, একমাত্র যাকাতই আমার প্রতি ফরয হয়েছিল, আমি তা আদায় করেছি। অতএব এখন আর আমার কাছে কিছুই পেতে পারে না। বস্তত যাকাত ফরয করার অর্থ মোটেই এটা নয়। যাকাত ফরয করার প্রকৃত তাৎপর্য এই যে, প্রত্যেক ধনী ব্যক্তি অন্ততপক্ষে এ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ অবশ্যই আল্লাহর পথে খরচ করতে বাধ্য। আর তার অধিক ব্যয় করার সামর্থ থাকলে তাও তাকে অবশ্যই করতে হবে।
আল্লাহর রাস্তায় অর্থ খরচ করার সাধারণ হুকুম এবং তার বিশ্লেষণ এখানে করা যাচ্ছে:
কুরআন মজীদ কোন কাজের নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে তার অন্তনির্হিত যৌক্তিকতাও স্পষ্ট করে বলে দেয়। এটা কুরআন মজীদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। এর সাহায্যে মানুষ আল্লাহর আদেশের মূল লক্ষ্যে ও যৌক্তিকতা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে।
কুরআন মজীদের শুরুতে যে আয়াতটি চোখে পড়ে তা এই:
ذَلِكَ الْكِتبُ لاَرَيْبَ فِيْه هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ ـ الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَمِمَّا رَزَقْنهُمْ يُنْفِقُوْنَ ـ البقرة : 2-3
এ কুরআন আল্লাহর কিতাব, এতে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। এটা সেই সব সত্যনিষ্ঠ মুত্তাকী লোকদেরকে সত্য পথের সন্ধান করে দেয়, যারা অদৃশ্যে বিশ্বাসী, নামায কায়েম করে এবং আমার দেয়া জীবিকা থেকে (আমার পথে) খরচ করে। সূরা আল বাকারা : ২-৩
এ আয়াতে একটি মূলনীতি বলে দেয়া হয়েছে। পার্থিব জীবনে সোজা পথে চলার জন্য তিনটি জিনিস অপরিহার্য। প্রথম, ঈমান বিল গায়েব অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন: দ্বিতীয়, নামায কায়েম করা এবং তৃতীয়, আল্লাহ তাআলা যে রিযক দান করেছেন, তা থেকে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা। অন্যত্র বলা হয়েছে:
لَنْ تَنَالُوْا الْبِرَّ حَتّى تُنْفِقُوْنَ مِمَّا تَحِبُّوْنَ ـ ال عمران : 92
তোমাদের প্রিয় জিনিসগুলো আল্লাহর পথে অকাতরে খরচ না করা পর্যন্ত পুণ্যশীলতার উচ্চ মর্যাদা তোমরা কিছুতেই লাভ করতে পারো না।
আবার বলা হয়েছে:
اَلْشَّيْطنُ يَعِدُكُمْ الْفَقْرَ وَيَامُُرُكُمْ بِالْفَحْشَآَءِ ـ البقرة : 268
টাকা-পয়সা খরচ করলে শয়তান তোমাদেরকে গরীব হয়ে যাওয়ার ভয় দেখায় এবং তোমাদেরকে লজ্জাকর কাজ-কৃপণতার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।
এরপর ইরশাদ করা হয়েছে:
وَاَنْفِقُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَلاَ تُلْقُوْا بِاَيْدِيْكُمْ اِلَى التَّهْلُكَةِ ـ 195
আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর এবং নিজের হাতেই নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না (আল্লাহর রাস্তায় খরচ না করলেই নিজকে নিজকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করা হয়)। সূরা আল বাকারা : ১৯৫
সর্বশেষ বলা হয়েছে:
وَمَنْ يُّّوْقَ شُحَّ نَفْسِه فَاُوْلَئْكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ـ الحشر : 9
মনের সংকীর্ণতা হতে যারা বাঁচতে পারবে তাঁরাই পরম কল্যাণ লাভ করবে। সূরা আল হাশর : ৯
উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে পরিষ্কার জানতে পারা যায় যে, দুনিয়ায় মানুষের জীবন যাপনের দুটি মাত্র পথ বিদ্যমান। একটি আল্লাহর পথ-যার পরিণামে চিরন্তন সুখ শান্তি এবং পরম কল্যাণ রয়েছে। এ পথে মানুষের দিল উদার-উন্মুক্ত হয়ে থাকাই স্বাভাবিক। আল্লাহ তাকে কম কিংবা বেশী যে পরিমাণ রিযকই দান করেছেন, তা থেকে সে নিজের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করবে, অন্যান্য ভাইদেরকেও যথাসম্ভব সাহায্য করবে এবং আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করা বা আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে কায়েম করার কাজেও ব্যয় করবে। অপরটি হচ্ছে শয়তানের পথ। এ পথে বাহ্য দৃষ্টিতে মানুষ খুব আনন্দ এবং সুখ দেখতে পায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ পথে ধ্বংস এবং বিপর্যয় ভিন্ন আর কিছুই নেই। এ পথে স্বাভাবিকভাবেই অর্থ-সম্পদ শোষণ করে সঞ্চয় করতে চেষ্টা করে এবং অর্থের জন্য মন ও প্রাণ দিতেও কুন্ঠিত হয় না। আর তা করতেও প্রস্তত হয় না। একান্তই যদি খরচ করে, তবে তা কেবল নিজের প্রয়োজন এবং নিজের মনের লালসা চরিতার্থ করার জন্য মাত্র।
আল্লাহর পথের যাত্রীদেরকে আল্লাহর রাস্তায় ধন-সম্পদ খরচ করার যে নিয়ম ও পন্থা বলে দেয়া হয়েছে, এখানে ধারাবাহিকভাবে তা উল্লেখ করা হয়েছে:
এক: সর্বপ্রথম কথা এই যে, কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই খরচ করবে, কারো প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করা বা দুনিয়ায় নাম ও খ্যাতি লাভ করার জন্য খরচ করবে না।
وَمَا تُنْفِقُوْنَ اِلاَّ اِبْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ ـ البقرة : 272
তোমরা যা কিছু খরচ কর, তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ছাড়া তোমাদের যেন আর কিছুই লক্ষ্য না থাকে।
يَآ يُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لاَتُبْطِلُوْا صَدَقتِكُمْ بِالْمَنِّ وَاَلاَذى كَالَّذِيْ يُنْفِقُ مَالَهُ وِئَآءَ النَّاسِ وَلاَيُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيُوْمِ الاخِرِ فَمَثَلُه’ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَيْهِ تُرَابٌ فَاصَابَه وَابِلٌ فَتَرَكَاهُ صَلْدًا البقرة : 264
হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের দান-খয়রাতকে অনুগ্রহ প্রকাশ করে এবং মন:কষ্ট দিয়ে সেই ব্যক্তির ন্যায় কষ্ট দিও না-যে ব্যক্তি কেবল পরকে দেখাবার জন্য খরচ করে এবং আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে না। তার দান-খয়রাত ঠিক তেমনি যেমন একটি প্রস্তর খন্ডের ওপরে মাটি পড়ে আছে, এমতাবস্থায় তার ওপর যদি প্রবল বৃষ্টিপাত হয় তবে সমস্ত মাটিই ধুয়ে-মুছে প্রস্তর খন্ডটি একেবারে ছাফ ও মাটিহীন হয়ে যাবে। সূরা আল বাকারা : ২৬৪
দুই : কাউকে কিছু দান করলে তার কাছে অনুগ্রহ প্রকাশ করতে পারবে না এবং এমন কোনো কাজ করতে পারবে না যাতে তার মনে কিছু মাত্র কষ্ট লাগতে পারে:
اَلَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ ثُمَّ لاَيُتْبِعُوْنَ مَآاَنْفَقُوْا مَنَّا وَّلاَ اَذّى لَّهُمْ اَجْرَهُمْ عِنْدَ رَبَّهِمْ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَهُمْ يَحْزَنُوْنَ ـ قَوْلٌ مَعْرُوْفٌ وَّمَغْفِرَةٌ خَيْرٌ مِنْ صَدَقَةَ يَّتْبَعُهَآ اّذّى : البقرة : 162-163
আল্লাহর পথে যারা খরচ করে এবং খরচ করার পর নিজের অনুগ্রহ প্রকাশ করে না এবং কাউকে মন:কষ্ট দেয় না, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে বড়ই সওয়াব আছে এবং কোনো প্রকার ভয় ও ক্ষতির আশাংকা তাদের নেই। কিন্তু যেসব দানের পর কষ্ট দেয়া হয় সেসব দান অপেক্ষা প্রার্থীকে নম্রতর সাথে ফিরিয়ে দেয়া এবং ভাই,ক্ষমা কর বেল বিদায় করাই উত্তম। সূরা আল বাকারা :২৬২-২৬৩
তিন: আল্লাহর পথে সবসময়ই ভালো জিনিস দান করা উচিত। বেছে বেছে কেবল খারপটাই যেন দেয়া না হয়। গরীবকে দেয়ার জন্য যারা ছিন্ন জামা-কাপড় তালাশ করে এবং কোনো দরিদ্রকে খাওয়াবার জন্য নিকিৃষ্টতর খাদ্য প্রদান করে, আল্লাহর কাছ থেকে তারা অনুরূপ নিকৃষ্ট ফলই পাবে:
يَآيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا مِنْ طَيِّبَةُ مِنْ طَيّبِتِ مَاكَسَبَتُمْ وَمِمَّآ اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنْ الاَرْضِ وَلاَ تَيْمَّمُوْا الْخَبِيْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ ـ البقرة : 167
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা উপার্জন করেছ এবং আমরা তোমাদের জন্য মাটির বুক থেকে যা নির্গত ও উৎপন্ন করেছি, তা থেকে ভালো ভালো জিনিস আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর-আল্লাহর পথে খরচ করার জন্য নিকৃষ্ট মাল তালাশ করে ফিরো না। সূরা আল বাকারা : ২৬৭
চার : যতদূর সম্ভব আল্লাহর রাস্তায় গোপনভাবেই খরচ করতে হবে, লোক দেখানোর বিন্দুমাত্র ভাব যেন তাতে স্থান না পায়। প্রকাশ্যভাবে খরচ করায় যদিও দোষের কিছু নেই কিন্তু তবুও গোপনে খরচ করা উত্তম।
اِنْ تُبْدُوْا الصَّدَقتِ فَنْعِمًا هِىَ وَاِنْ تُخْفُوْنَ وَتُؤْتُوْهَا الْفُقَرَاءَ فُهُمْ خَيْرَ لَّكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيَّاتِكُمْ ـ البقرة: 271
প্রকাশ্যভাবে খরচ করলে তা ভালো: কিন্তু লুকিয়ে গরীবদের দান করলে তোমাদের পক্ষে অতি ভালো এবং তাতে তোমাদের গুনাহ দূর হয়ে যাবে: সূরা আল বাকারা : ২৭১
পাঁচ : নির্বোধ ও অজ্ঞ লোকদেরকে তাদের প্রয়োজনতিরিক্ত সম্পদ কখনও দেয়া যাবে না। কারণ অধিক অর্থ পেয়ে তাদের বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়ার এবং তাদের হাতে সম্পদ নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। আল্লাহর ইচ্ছা এটা যে, খাদ্য ও বস্ত্র সকল মানুষকেই দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, সে যত বড় পাপী আর আল্লাহদ্রোহী হোক না কেন। কিন্তু মদপান, গাঁজা, আফিম খাওয়া এবং জুয়া খেলার জন্য কাউকে এক পয়সাও দেয়া যেতে পারে না।
وَلاَ تُؤْتُوْا السُّفَهَآَءَ اَمْوَالَكُمْ الَّتِىْ جَعَلَ اللهُ لَكُمْ قِِيْمًَا وَّارزٌقُوْهُمْ فِيْهَا وَاكْسُوْهُمْ ـ النساء : 5
তোমাদের ধন-সম্পত্তিকে আল্লাহ তাআলা জীবনযাপনের উপায় করে দিয়েছেন, কাজেই তা কখনও অজ্ঞ-মূর্খতার হাতে ছেড়ে দিও না। অবশ্য তা দ্বারা তাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে দিতে হবে।
ছয় : কারো প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য তাকে ধার দেয়া হলে বার বার তাগাদা করে তাকে বিরক্ত করো না। তা আদায় করার জন্য তাকে যথেষ্ট অবকাশ দিতে হবে। আর তা ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তার অক্ষমতা যদি নিসন্দেহে জানা যায় এবং ঋণদাতারও যদি ক্ষমা করার মতো সঙ্গতি থাকে, তবে তাকে মাফ করে দেয়াই বাঞ্ছনীয়।
وَاِنْ كَانَ ذُوْ عَسْرَةً فَنَظِرَةٌ اِلى مَيْسَرَةٍ وَاَنْ تَصَدَّقُوْا خَيْرَ لٌكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ـ البقرة : 280
ঋণী ব্যক্তির আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত তাকে অবশ্যই লংঘন করা যেতে পারে না। নিজেকে এবং নিজের সন্তান-সন্তুতিকে বঞ্চিত করে পরকে দান কারার আদেশ আল্লাহ তাআলা করেননি-তাঁর উদ্দেশ্যও তা নয়। আল্লাহর ইচ্ছা এই যে, সহজ ও সাধারণভাবে জীবনযাপনের জন্য যা কিছুর প্রয়োজন হবে তা তো খরচ করতেই হবে, তারপরে যা উদ্বৃত্ত থাকবে তা হতেই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবে:
وَيَسْئَلُوْنَكَ مَاذَا يُنْفِقُوْنَ قُلِ الْعَفْوَ ـ البقرة : 219
তার জিজ্ঞেস করে: কি খরচ করবো? (হে নবী! আপনি) বলে দিন যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা তাই খরচ করবে। সূরা বাকারা : ২১৯
وَاَلَّذِيْنَ اِذَا اَنْفَقُوْآ لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يُقتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا ـ الفرقان : 67
আল্লাহর নেক বান্দাহ তারাই-যারা খরচ করে; কিন্তু অনর্থক খরচ করে না এবং খুব বেশী কার্পণ্যও করে না। বরং এ দু প্রান্তসীমার মধ্যবর্তী পন্থাই হয় তাদের আদর্শ। সূরা আল ফুরকান : ৬৭
وَلاَ تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُوْلَةً اِلى عُنُقِكَ وَلاَ تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوْمًا مَّحْسُوْرًا ـ بنى اسرايل : 29
তোমাদের (দানের) হাত গুটিয়ে একেবারে গলার সাথে বেঁধে নিও না এবং তা বেশী ছড়িয়েও দিও না, কারণ তার ফলে তোমাকে অনুতপ্ত এবং লোকদের কাছে তিরস্কৃত হতে হবে। সূরা বনী ঈসরাঈল : ২৯
আট : এ দানের উপযুক্ত পাত্র কে? সর্বশেষে একথাও জেনে নেয়া আবশ্যক। তার এক পূর্ণ তালিকাও আল্লাহ তাআলা পাক কালামে পেশ করেছেন। কে কে আপনার সাহায্য পেতে পারে এবং আপনার উপার্জনে আল্লাহর তরফ থেকে কার কার অধিকার নির্ধারিত হয়েছে, এ তালিকা দৃষ্টে তা পরিষ্কাররূপে বুঝতে পারা যায়।
وَاتِ ذَا الْقُرْبى حَقَّهُ وَالْمِسْكِيْنَِ وَابْنَ السَّبِيْلِ ـ بنى اسرائيل : 26
গরীব নিকটাত্মীয়দেরকে তাদের প্রাপ্য দাও এবং মিসকীন ও গরীব প্রবাসীকেও। বনি ঈসরাঈল :২৬
وَاتِ الْماَلَ عَلى جُيَِه ذَوِى الْقُرْبى وَالْيَتَمى وَالْمَسْكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلِ وَالسًَّآئِلِيْنَ وَفِىْ الرِّقَابِ ـ البقرة : 177
তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যারা নিকাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, পথিক ও প্রার্থীকে এবং দাস ও কয়েদীদের মুক্তি বিধানের জন্য অর্থ দান করে, তারা আল্লাহর প্রিয়। সূরা আল বাকারা : ১৭৭
وَّبِالْوَالِدَيْنِ اَحْسَانًا وَّبِذِى القُرْبى وَالْيَتمى وَالْمَسكِيْنَ وَالْجَارِذِى الْقُرْبِى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيْلِ وَمَا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْ ـ النساء : 36
নিজের পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, আত্মীয় প্রতিবেশী ও অনাত্মীয় প্রতিবেশী, চলার সাথী, প্রবাসী এবং নিজের দাস-দাসীদের সাথে ভাল ব্যবহার কর। সূরা আন নিসা : ৩৬
وَيُطْعِمُوْنَ الطّعَامَ عَلى حُبِّه مِسْكِيْنًا وَّيَتِيْمًا اِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْه الله لاَنُرِيْدُ مِنْكُمْ جَزَآءً وَّلاَ شُكُوْرًا ـ اِنَّا نَخَافُ مِنْ رَّبِّنَا يُوْمًا عَبُوْسًا قَمْطَرِيْرًا ـ الدهر : 8-10
আল্লাহর নেক বান্দাহগণ ইয়াতীম, মিসকীন এবং কয়েদীকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রেম লাভ করার উদ্দেশ্যে খাদ্যদান করে। তারা বলে যে,আমরা তোমাদেরকে শুধু আল্লাহর জন খানা খাইয়ে থাকি। আমরা তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় ও কৃতজ্ঞতা চাই না। আমরা কেবল আল্লাহর কাছে সেই দিনেরই ভয় করছি, যে দিনের কঠিন বিপদে মানুষের মুখ শুকিয়ে যাবে এবং কপালে ভাঁজ পড়ে যাবে। সূরা আদ দাহর : ৮-১০
وَفِىْ اَمْوَالِهِمْ حَقٌ لِّلْسَّآئِلِ وَالْمَحْرُوْمِ ـ الذّريت : 19
এবং তার ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিত জনের অধিকার রয়েছে।
لِلْفُقَرَآءِ الَّذِيْنَ اُحْصِرُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ لاَيَسْتَطِيْعُوْنَ ضَرْبًا فِىْ الاَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ اَغْنِيَآءَ مِنَ التَّعَفُّفْ تَعْرِفُهُمْ بِسْيْمهُمْ لاَيَسْئَلُوْنَ النَّاسَ اِلْحَافًأ وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ خِيْرِ فَاِنَّ اللهَ بِه عَلِيْمٌ ـ
যারা সকল সময়ে আল্লাহর কাজে লিপ্ত থাকে বলে নিজেদের জীবিকা উপার্জনের জন্য কোনো কাজ করতে পারে না, দান-খয়রাত তাদেরই প্রাপ্য। তাদের আত্মসম্মান জ্ঞান দেখে অন্তত মূর্খ লোকেরা তাদেরকে ধনী বলে মনে করে। কিন্তু তোমরা তাদের বেশ ও রূপ দেখেই বুঝতে পার, তারা কতো কষ্ট করছে। তোমাদের নিজেদেরই অগ্রসর হয়ে তাদের দান করা উচিত। কারণ, তারা মানুষকে জড়িয়ে ধরে সাহায্য চাওয়ার মত লোক নয়, গোপনভাবে তোমরা তাদেরকে যা কিছু দেবে আল্লাহ তা নিশ্চয় জানাবেন এবং তিনি তার বিনিময় নিশ্চয়ই দেবেন। সূরা আল বাকারা : ২৭৩
অধ্যায়-০৪ : আল্লাহর পথে খরচ করার জন্য সাধারণ নির্দেশ
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: