কুরআন শরীফে যেখানে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে হজ্জের জন্যে সাধারণ দাওয়াত দেয়ার হুকুমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে এর প্রথম কারণ হিসেবে বলা হয়েছেঃ
-মানুষ এসে দেখুক যে ,এ হজ্জব্রত উদযাপনে তাদের জন্যে কি কি কল্যাণ নিহিত রয়েছে অর্থাৎ হজ্জের সময় আগমন করে কা’বা শরীফে একত্রিত হয়ে তারা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করবে যে , তা তাদের জন্যে বস্তুতই কল্যাণ কর । কেননা এতে যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে , তা মানুষ নিজ চোখে দেখেই অনুধাবন করতে পারে।একটি বর্ণনা হতে জানা যায় যে হযরত ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহ আলাইহি হজ্জ করার পূর্ব পর্যন্ত ঠিক বুঝতে পারেননি যে, ইসলামি ইবাদত সমুহের মধ্যে কোনটি সর্বোত্তম; কিন্তু যখনই তিনি হজ্জ করে তার অন্তর নিহিত কল্যাণ প্রত্যক্ষ করলেন, তখন স্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘হজ্জ-ই সর্বোত্তম ইবাদত’।
এখানে হজ্জের বৈশিষ্ট্য ও কল্যাণকারিতা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হচেছ। দুনিয়ার মানুষ সাধারনত দু’প্রকারের ভ্রমণ করে থাকে। এক প্রকারের ভ্রমণ করা হয় রুযি-রোযগারের জন্যে আর এক প্রকারের ভ্রমণ হয় আনন্দ-র্ষ্ফুতি ও অবসর বিনোদনের উদ্দেশ্যে। এ উভয় প্রকারের ভ্রমনেই মানুষের নিজের স্বার্থ ও প্রবৃত্তিই তাকে ভ্রমণে বের হতে উদ্বুদ্ধ করে । নিজের গরজেই ঘর-বাড়ী ত্যাগ করে , নিজের কোনো পার্থিব উদ্দেশ্যেই সন্তান সন্ততি ও আত্মীয় -স্বজন হতে দূরে চলে যায় । আর এ ধরনের সফরে সে টাকা- পয়সা যা কিছুই খরচ করে নিজের উদ্দেশ্য লাভের জন্যেই করে থাকে । কাজেই এসব সফরে মানুষকে আসলে কিছুই কুরবানী বা আত্মত্যাগ করতে হয়নি । কিন্তু হজ্জ উপলক্ষ্যে যে সফর করা হয় তা উল্লেখিত সফর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এটা নিজের কোনো গরযে কিংবা নিজের প্রবৃত্তির লালসা পূরণ করার জন্যে করা হয়না ; বস্তুত এটা করা হয় খালেছভাবে আল্লাহ তায়ালার জন্যে এবং আল্লাহর র্নিদিষ্ট উদ্দেশ্য পূর্ণ করার মানসে । এজন্যেই মানুষের মনে যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর প্রেম ভালোবাসা ও আল্লাহর ভয় জাগ্রত না হবে এবং আল্লাহর নির্ধারিত ফরযকে ফরয বলে মনে না করা হবে , ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ এ সফরে যাওয়ার জন্যে কিছুতেই উদ্যোগী হতে পারে না। কাজেই যে ব্যক্তি একটি দীর্ঘকালের জন্যে নিজের ঘর-বাড়ী, আত্বীয় -স্বজনের সাথে সর্ম্পক ত্যাগ করে এবং নিজের কারবার এর ক্ষতি, অর্থ ব্যয় ও সফরের কষ্ট স্বীকার করে হজ্জের জন্যে বের হবে ,তার এভাবে বের হওয়াই প্রমাণ করে যে তার মনে আল্লাহর ভয় ও ভালবাসা আছে । আল্লাহর ফরযকে সে ফরয বলে মনে করে এবং মানসিকভাবে সে এত দূর প্রস্তুত যে , বাস্তবিকই যদি কখনো আল্লাহর পথে বের হওয়ার প্রয়োজন হয় তখন সে অনায়াসেই গৃহ ত্যাগ করতে পারবে । কষ্ট স্বীকার করতে পারবে , নিজের ধন-সম্পদ এবং আরাম-আয়েশ সবকিছু আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে কুরবান করতে পারবে ।
এ পবিত্র ইচছা নিয়ে যখন সে হজ্জের সফরে যাবার জন্যে তৈরী হয় তখন স্বভাব -প্রকৃতি সম্পূর্ন আলাদা ধরনের হয়ে যায় । তার অন্তরে বাস্তবিকই আল্লাহর প্রেমের উদ্দিপনা স্বতঃষ্ফূর্ত হয়ে ওঠে। বস্তুত সে সেই দিকের জন্যে পাগল হয়ে ওঠে ,তার মনে তখন নেক ও পবিত্র ভাবধারা ছাড়া অন্য কিছুই জাগ্রত হতে পারেনা ।
সে পূর্বকৃত যাবতীয় গুনাহ থেকে তাওবা করে ,সকলের কাছে ভুল -ত্রুটির জন্যে মাপ চায় , পরের হক যা এ যাবত আদায় করেনি তা আদায় করে , কারণ ঋণের বোঝা নিয়ে আল্লাহর সামনে হাজির হওয়া সে মোটেই পসন্দ করেনা । সকল প্রকার পাপ ও অন্যায় চিন্তা থেকে তার মন পবিত্র হয়ে যায় ।স্বভাবতই তার মনের গতি মংগলের দিকেই নিবদ্ধ হয়, সফরে বের হওয়ার পর সে যতই অগ্রসর হতে থাকে ততই তার হৃদয় -মনে পৃণ্য ও পূত ভাবধারার তরংগ খেলে ওঠে । তার কোনো কাজ যেন কারো মনে কোনোরূপ আঘাত না দেয়, আর যারই যতটুকু উপকার করা যায় সেই সমস্ত চিন্তা এবং চেষ্টাই সে করতে থাকে। অশ্লীল ও বাজে কথা-বার্তা, নির্লজ্জতা, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা এবং ঝগড়া-ফাসাদ ইত্যাদি কাজ থেকে তার প্রকৃতি স্বভাবতই বিরত থাকে। কারণ সে আল্লাহর ‘হারাম শরীফের’ যাত্রী তাই অন্যায় কাজ করে এ পথে অগ্রসর হতে সে লজ্জিত না হয়ে পারে না । তার সফরটাই যে ইবাদত, এ ইবাদতের কাজে যুলুম, আর পাপ কাজের কি অবকাশ থাকতে পারে? অতএব দেখা যাচ্ছে যে, অন্যান্য সকল প্রকার সফর থেকে এ সফর সম্পূর্ণ আলাদা। মানুষের মনকে এ সফর প্রতিনিয়ত পূত-পবিত্র করতে থাকে । সত্য বলতে গেলে এটা একটি বিরাট সংশোধনকারী কোর্স বিশেষ, প্রত্যেক হজ্জ যাত্রী মুসলমানকেই এ অধ্যায় অতিক্রম করতে হয়।
সফরের একটি অংশ সমাপ্ত করার পর এমন একটি স্থান সামনে আসে যেখানে পৌছে প্রত্যেক মক্কাযাত্রী মুসলমান ‘এহরাম’ বাঁধতে বাধ্য হয় । এটা না করে কেউ সামনে অগ্রসর হতে পারে না। এই ‘এহরাম’ কি ? একটি সিলাই না করা লুংগী, একখানি চাদর এবং সিলাইবিহীন জুতা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এর অর্থ এই যে, এতকাল তুমি যাই থাক না কেন , কিন্তু এখন তোমাকে ফকিরের বেশেই আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে। কেবল বাহ্যিক ফকীরই নয়, প্রকৃতপে অন্তরেও ফকীর হতে চেষ্টা কর। রঙীন কিংবা জাকজমকপূর্ণ সকল পোশাক খুলে রাখ, সাদাসিধে ও দরবেশ জনোচিত পোশাক পরিধান কর। মোজা পরবে না, পা উন্মুক্ত রাখ, কোনো প্রকার সুগন্ধি ব্যবহার করবে না, চুল কেট না, সকল প্রকার অলংকার ও জাকজমক পরিহার করা। স্বামী -স্ত্রী সংগম হতে দূরে থাক, যৌন উত্তেজক কোন কাজ করো না, শিকার করো না। আর কোনো শিকারীকে শিকারের কাজে সাহায্য করো না। বাহ্যিক জীবনে যখন এরূপ বেশ ধারণ করবে তখন মনের ওপরও তার গভীর ছাপ মুদ্রিত হবে ভিতর হতেও তোমার মন সত্যিকারভাবে ‘ফকির’ হবে। অহংকার ও গৌরব দূরীভুত হবে, গরীবানা ও শান্তি -প্রিয়তার ভাব ফুটে ওঠবে। পার্থিব সুখ- সম্ভোগে লিপ্ত হওয়ার ফলে তোমার আত্মা যতখানি কলংকিত হয়েছিল তা দূর হয়ে যাবে এবং আল্লাহর বন্দেগী করার পবিত্র ভাবধারা তোমরা জীবনের ভিতর ও বাইর উভয় দিককেই মহীয়ান করে তুলবে।
‘এহরাম’ বাঁধার সাথে সাথে হাজীকে একটি বিশেষ দোয়া বার বার পড়তে হয়। প্রত্যেক নামাযের পর, পথের প্রত্যেক চড়াই- উৎরাইয়ের সময়, কাফেলার সাথে মিলিত হবার সময় এবং প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার সময়। দোআটি এইঃ
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ
বস্তুত হযরত ইবারাহীম আলাইহিস সালাম সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে আল্লাহর আদেশে (হজ্জ করার জন্য) যে সার্বজনীন আহবান জানিয়েছিলেন, তার জবাবেই এ দোয়া পাঠ করার নিয়ম হয়েছে। পঁয়তাল্লিশ শত বছর আগে, আল্লাহর এ আহ্ববানকারী ডেকে বলেছিলেনঃ “আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহর ঘরের দিকে আস, পৃথিবীর প্রতি কোণ থেকে ছুটে আস। পায়ে হেটে আস, কিংবা যানবাহনে চড়ে আস।” এর জবাব স্বরূপ আজ পর্যন্ত ‘হারাম শরীফের’ প্রতিটি মুসাফির উচ্চৈস্বরে বলে ওঠেছেঃ “আমি এসেছি, হে আল্লাহ, আমি হাজির হয়েছি। কেউ তোমার শরীক নেই, আমি কেবল তোমারই আহবানক্রমে এসেছি, সব তারীফ প্রশংসা তোমারই দান, কোন কিছুতেই তোমার কেউ শরীক নেই।”
এভাবে ‘লাব্বায়েকের’ প্রত্যেকটি ধ্বনির মারফত হযরত ইবারাহীম আলাইহিস সালাম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালামের আমল থেকে প্রচলিত ইসলামী আন্দোলনের সাথে ‘হাজী’র নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সাড়ে চার হাজার বছরের দূরত্ব মাঝখান হতে সরে গিয়ে একাকার হয়ে যায়। মনে হয় যেন এদিক থেকে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর তরফ থেকে ডাকছেন, আর ওদিক থেকে প্রত্যেক হাজীই তার জবাব দিচ্ছে- জবাব দিতে দিতে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে । যতই সামনে অগ্রসর হয় ততই তার মনে প্রাণে উৎসাহ উদ্দীপনা এবং আধ্যাত্মিক ভাবের ঝর্ণাধারা অধিকতর বেগে প্রবাহিত হতে থাকে। পথের প্রত্যেক চড়াই - উৎরাইয়ের সময় তার কানে আল্লাহর আহবান ধ্বনিত হয়, আর সে তার জবাব দিতে দিতে অগ্রসর হয়। কাফেলার পর কাফেলা আসে, আর প্রত্যেকেই প্রেমিক পাগলের ন্যায় এই পয়গাম শুনে বলে উঠেঃ “আমি এসেছি, আমি হাজির হয়েছি।” প্রতিটি নূতন প্রভাত তার কাছে বন্ধুর পয়গাম বহন করে আনে,আর উষার ঝলকে চোখ খোলার সাথে সাথেই আমি এসেছি,’হে আল্লাহ! আমি হাজির হয়েছি’, বলে আওয়াজ দিতে থাকে । মোটকথা বারবার দেয়া এ আওয়াজ এহরামের গরীবানা পোশাক, সফরের অবস্থা এবং প্রত্যেকটি মঞ্জিলে কা’বা ঘরের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য নৈকট্যের ভাব উম্মাদনায় এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয় যে হাজী আল্লাহর অতল স্পর্শ গভীর প্রেমে আত্মমগ্ন হয়ে যায় এবং সেই এক বন্ধুর স্মরণ ভিন্ন তার জীবনের কোথাও অন্য কিছুর অস্তিত্ব থাকে না।
এ অবস্থার ভিতর দিয়ে হাজী মক্কায় উপনীত হয় এবং সেখানে পৌছেই সোজা আসল লক্ষ্যস্থলের দিকে ছুটে যায়। বন্ধুর আস্তানাকে চুম্বন করে।তারপর নিজের আকীদা-বিশ্বাস, ঈমান, মতবাদ, দ্বীন ও ধর্মের কেন্দ্রস্থলের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে ততবারই আস্তানাকে চুম্বন করে।(১)প্রত্যেক বারের তাওয়াফ কা’বা ঘরের কালো পাথর চুমু দিয়ে শুরু ও শেষ করা হয়। এখানে থেকে বের হয়ে ‘সাফা’ পর্বতে আরোহণ এবং এখান থেকে যখন কা’বা ঘরের দিকে তার দৃষ্টি পড়ে, তখন সে উচ্চস্বরে বলে ওঠেঃ
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَلَا نَعْبُدُ إِلَّا إِيَّاهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
"আল্লাহ ছাড়া আর কেউ মা’বুদ নেই, আমরা অন্য কারো বন্দেগী করি না ; আমরা কেবল একনিষ্টভাবে আল্লাহরই আনুগত্য স্বীকার করি - কাফেরদের কাছে এটা যতই অসহনীয় হোক না কেন।”
অতপর ‘সাফা’ ও মারাওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যস্থলে দৌঁড়াতে হয়। এর দ্বারা হাজী একথা প্রমান করে যে, সে আল্লাহর নৈকট্য এবং তার সন্তোষ হাসিল করার উদ্দেশ্যে সবসময় এমন করে দৌড়াতে প্রস্তুত থাকবে। এ দৌড়ের সময়ও তার মুখ থেকে উচ্চারিত হতে থাকেঃ
أَللَّهُمَّ اسْتَعْمَلْنِيْ بِسُنَّةِ نَبِيِّكَ وَتَوَفَّنِيْ عَلَى مِلَّتِهِ وَأَعِذْنِيْ مُّضِلاَّتِ الْفِتَنِ
“হে আল্লাহ ! আমাকে তোমার নবীর আদর্শ ও রীতিনীতি অনুসারে কাজ করার তাওফীক দাও। তোমার নবীর পথেই যেন আমার মৃত্যু হয় এবং সত্য পথভ্রষ্টকারী ফেতনা থেকে আমাকে রক্ষা কর।”
কখনো কখনো এই দোয়া পড়া হয়ঃ
اغْفِرْ وَأَرْحَمْ وَتَجَا وَزَعَمَّا تَعْلَمُ إِنَّكَ أَنْتَ الْأَعَزُّ الْأَكْرَمُ
“হে রব! ক্ষমা কর, দয়া কর, আমার যেসব অপরাধ সম্পর্কে তুমি অবহিত তা মাফ করে দাও। তোমার শক্তি সবচেয়ে বেশী, দয়াও অতুলনীয়।”
এরপর হাজী যেন আল্লাহর সৈনিকে পরিণত হয়। তাই পাচঁ ছয় দিন পর্যন্ত তাকে ক্যাম্পে জীবন কাটাতে হয়। একদিন ‘মিনা’র ছাউনীতে অতিবাহিত করতে হয়, পরের দিন আরাফাতে অবস্থান করতে হয় এবং সেনাপতির ‘খুতবার’ নির্দেশ শুনতে হয়। রাতে মুজাদালিফায় গিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করতে হয়। দিন শেষে আবার ‘মিনায়’ ফিরে যেতে হয় এবং এখানে পাথর টুকরা নিক্ষেপ করে ‘চাঁদমারী’ করতে হয়। আবরাহা বাদশার সৈন্য- সামন্ত কা’বা ঘর ধ্বংস করার জন্য এ পর্যন্ত এসে পৌছেছিল । প্রত্যেকটি পাথর নিক্ষেপ করার সাথে সাথে আল্লাহর সিপাহী বলে উঠেঃ
اَللهُ أَكْبَرْ رَغَماً لِلشَّيْطَانِ وَحِزْبِهِ
“আল্লাহ মহান। শয়তান ও তাঁর অনুসারীদের মুখ ধূলায় মলিন হোক।” এবং- أَللَّهُمَّ تَصْدِيْقاً بِكِتَابِكَ وَإِِتِّبَاعاً لِسُنَّةِ نَبِيِّكَ “হে আল্লাহ ! তোমার গ্রন্থের সত্যতা ঘোষণার ও তোমার নবীর আদেশ অনুসরণের তাওফীক দাও।”
পাথর টুকরা দিয়ে চাঁদমারী করার অর্থ এ কথা প্রকাশ করা যে, হে আল্লাহ ! তোমার দ্বীন ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য কিংবা তোমার আওয়াজকে স্তব্ধ করার জন্য যে -ই চেষ্টা করবে, আমি তোমার বাণীকে উন্নত ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার বিরুদ্ধে এমনি করে লাড়াই করবো। তারপর এ স্থানেই কুরবানী করা হয়। এটা দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জীবন বিসর্জন দেয়ার ইচ্ছা ও বাসনার বাস্তব এবং সক্রিয় প্রমান উপস্থিত করা হয়। এরপর সেখান থেকে কা’বার দিকে যাত্রা করা হয়- যেন ইসলামের মুজাহিদগন কর্তব্য সমাধা করে বিজয়ীর বেশে ‘হেড কোয়ার্টারের’ দিকে ফিরে যাচ্ছে। তাওয়াফ এবং দু’ রাকআত নামায পড়ার পর এহরাম খোলা হয়। এহরাম বাঁধার কারণে যেসব কাজ হারাম হয়েছিল এখন তা হালাল হয়ে যায়, হাজীর জীবন এখন স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকে। এ জীবন শুরু হওয়ার পর আবার তাকে ‘মিনায়’ গিয়ে ক্যাম্প গাড়তে হয় এবং পরের দিন পাথরের সেই তিনটি স্তম্ভের ওপর আবার কংকর দ্বারা চাঁদমারী করতে হয়। এটাকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ‘জুমরাত’। এটা আবরাহা বাদশার মক্কা আক্রমণকারী ফৌজের পশ্চাদপসরণ ও তাকে পরাভুত করার প্রতীক মাত্র। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের বছর হজ্জের সময়ই আল্লাহর ঘর ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে আবরাহা এসেছিল। আল্লাহর তরফ থেকে আসমানী পাখী কংকর নিক্ষেপ করেই তাদেরকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। তৃতীয় দিবসে পুনরায় সেই স্তম্ভগুলোর ওপর পাথর নিক্ষেপ করার পর হাজী মক্কা প্রত্যাবর্তন করে এবং সাতবার তার দ্বীনের কেন্দ্র কা’বা ঘরের তাওয়াফ করে। এ তাওয়াফকে বিদায়ী তাওয়াফ বলা হয়। এটা সম্পন্ন হলেই হজ্জের কাজ সমাপ্ত হয়।
হজ্জের নিয়ত এবং সে জন্য প্রস্তুতি ও যোগাড় যন্ত্র থেকে শুরু করে পুনরায় নিজ বাড়িতে ফিরে আসা পর্যন্ত কমবেশী তিন মাস কাল ধরে হাজীর মন- মগযে কত বিরাট ও গভীর খোদায়ী ভাবধারা পুঞ্জীভূত হয়ে থাকে ওপরের এই বিস্তারিত আলোচনা থেকে তা অনুমান করা খুবই সহজ। এ কাজে শুরু থেকেই সময়ের কুরবানী করতে হয়, অর্থের কুরবানী করতে হয, সুখ-শান্তি ত্যাগ করতে হয়, অসংখ্য পার্থিব সম্পর্ক - সম্বন্ধ ছিন্ন করতে হয়। হাজীর নিজের মনের অনেক ইচ্ছা - বাসনা স্বাদ - আস্বাদনকে উৎসর্গ করতে হয়। আর এ সবকিছুই তাকে করতে হয় কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য - নিজস্ব কোনো স্বার্থ তাতে স্থান পেতে পারে না। তারপর এ সফরে তাকওয়া-পরহেযগারীর সাথে সাথে আল্লাহর স্মরণ এবং আল্লাহর দিকে মনের ঔৎসুক্য ও আগ্রহ যত বৃদ্ধি পায়, তাও মানুষের মনের ওপর স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে, বহুদিন পর্যন্ত সেই প্রভাব স্থায়ী হয়ে থাকে।হারাম শীরফে’ কদম রেখে হাজী প্রত্যেক পদে পদে সেসব মহামানবদের অতীত কর্মধারার স্পষ্ট নিদর্শন দেখতে পায়। যারা আল্লাহর বন্দেগী ও আনুগত্য করে এবং আল্লাহর দীন ইসলামকে কায়েম করতে গিয়ে নিজেদের যথাসর্বস্ব কুরবানী করেছেন, যারা সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে লাড়াই করেছেন, নানা প্রকার দুঃখ - লাঞ্জনা অকাতরে সহ্য করেছেন, নির্বাসন দন্ড ভোগ করেছেন, অসংখ্য যুলম বরদাশত করেছেন, কিন্তু আল্লাহর দীনকে কায়েম না করা পর্যন্ত তারা এতটুকু ক্লান্তিবোধ করেননি। যেসব ‘বাতিল’ শক্তি মানুষকে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করতে বাধ্য করছিল, তাঁরা তাদের সকলেরই মস্তক চূর্ণ করে দীন ইসলামের পতাকা উন্নত করে ধরেছেন।
এসব সুস্পষ্ট নিশানা ও বরকত মন্ডিত নিদর্শনসমূহ প্রত্যক্ষ করে একজন আল্লাহ বিশ্বাসী ব্যক্তি প্রবল ইচ্ছা-বাসনা, সাহস ও আল্লাহর পথে জিহাদ করার যে প্রাণস্পর্শী শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। তা অন্য কোন জিনিস থেকে গ্রহণ করতে পারে না। কা’বা ঘরের তাওয়াফ করায় দ্বীন ইসলামের কেন্দ্র বিন্দুর সাথে হাজীর নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। হজ্জ সম্পর্কীয় অন্যান্য কার্যাবলী দ্বারা হাজীর জীবনকে সৈনিকের ট্রেনিং দিয়ে গঠন করা হয় । নামাজ, রোজা এবং যাকাতের সাথে এসবকে মিলিয়ে যাচাই করলে পরিস্কার মনে হবে যে, ইসলাম এসব কিছুর সাহায্যে কোন এক বিরাট উদ্দেশ্যে মানুষকে ট্রেনিং দান করে। এর জন্যই মক্কা পর্যন্ত যাতায়াতের সামর্থ্য সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলমানের প্রতি হজ্জ ফরজ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য এই যে, প্রতি বছরই অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যক মুসলমান ইসলামের এ প্রাণ কেন্দ্রে আসবে এবং ট্রেনিং লাভ করে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের দিকে ফিরে যাবে।
অতপর আরো একটি দিক লক্ষ্য না করলে হজ্জের কল্যাণ ও স্বার্থকতা পরিপূর্ণরূপে হৃদয়ংগম করা যাবে না। এক একজন মুসলমান কখনো একাকী হজ্জ করে না। দুনিয়ার সমগ্র মুসলমানের জন্যই হজ্জ করার একটি তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মুসলমান একত্রিত হয়ে একই সময়ে হজ্জ করে। ওপরের কথা দ্বারা আপনি শুধু এতটুকু বুঝতে পারেন যে, আলাদাভাবে একজন মুসলমান হজ্জ করলে তার ওপর তার কতখানি প্রভাব পড়া সম্ভব। পরবর্তী প্রবন্ধের মারফতে আপনি বিস্তারিতরূপে জানতে পারেবেন যে, দুনিয়ার মুসলমানদের জন্য হজ্জের একটি সময় নির্দিষ্ট করে দিয়ে হজ্জের কল্যাণ কত লক্ষগুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হয়েছে একটি কাজে দু’টি ফল নয়, কয়েক হাজার ফল লাভের সুযোগ করে দেয়া একমাত্র ইসলামেরই এক অতুলনীয় কীর্তি। নামায আলাদাভাবে পড়ারও ফায়দা কম নয়। কিন্তু তার সাথে জামায়াতে শামিল হয়ে ইমামের পিছনে নামায পড়ার শর্ত করে দিয়ে এবং জুময়া ও দু’ ঈদের নামায জামায়াতের সাথে পড়ার নিয়ম করে তার ফায়দা অসংখ্য গুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে রোযা রাখায় রোযাদারদের মন ও চরিত্র গঠন কাজ কম সাধিত হতো না। কিন্তু সকল মুসলমানের জন্য একটি মাসকে রোযার জন্য নির্দিষ্ট করে তার ফায়দা এত পরিমান বৃদ্ধি করে দেয়া হয়েছে, যা গুণে শেষ করা যায় না। এক একজন লোকের ব্যক্তিগতভাবে যাকাত আদায় করার উপকারিতাও কম নয়; কিন্তু বায়তুলমালের মারফত যাকাত দেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে তার উপকারিতা এতদূর বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে, ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম না হওয়া পর্যন্ত সঠিকভাবে এর ধারণাও করা যায় না। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনেই সকল মুসলমানের যাকাত ‘বায়তুলমালে’ জমা করা হয় এবং সুসংবদ্ধভাবে প্রাপকের মধ্যে বন্টন করা হয়। ফলে তাতে সমাজের অভাবগ্রস্ত লোকদের অপূর্ব কল্যাণ সাধিত হয়। হজ্জের ব্যাপারেও তাই। একাকী হজ্জ করলেও হাজার হাজার মানুষের জীবনে বিরাট বিপ্লব সুচিত হতে পারে। কিন্তু দুনিয়ার মুসলমানকে একত্রিত হয়ে হজ্জ করার রীতি করে দিয়ে সীমাহীন কল্যাণ লাভের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
অধ্যায়-০৩ : হজ্জের বৈশিষ্ট্য
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: