বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)

২৫ জানুয়ারি— একদলীয় শাসন তথা বাকশাল প্রতিষ্ঠার সেই কালো দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রচিত হয় এক কালো অধ্যায়। এদিন সংসদে শেখ মুজিবুর রহমান পেশকৃত চতুর্থ সংশোধনী বিল পাস করে দেশের সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্তির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে এবং একদলীয় শাসন তথা বাকশাল গঠনের পথ উন্মুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে এ সংশোধনীর বলে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হন। আর এ পদক্ষেপকে তিনি তার দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা হিসেবে উল্লেখ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি মানুষের সব মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে দেশের সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্তির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এক আদেশ বলে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল) নামে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন করেন। একই সঙ্গে নিজেকে এই দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেন। পাশাপাশি দল পরিচালনার ক্ষেত্রেও যাবতীয় ক্ষমতার অধিকারী হন তিনি। এক নজিরবিহীন ন্যূনতম সময়ের মধ্যে (মাত্র ১১ মিনিট) চতুর্থ সংশোধনী বিলটি সংসদে গৃহীত এবং তা আইনে পরিণত হয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিলটি নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা বা বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়নি।
প্রশাসন ব্যবস্থায় এক হঠকারী পরিবর্তন সাধন করে এই বিলের মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান দেশের নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধিকারী হন। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার আত্মীয়স্বজনরা দল ও রাষ্ট্রের সবরকম ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। অন্য কয়েকটি দলের মাধ্যমে বাকশাল গঠিত হলেও দল এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না।

একটি সাংবিধানিক বিলের মধ্য দিয়ে মোহাম্মদ উল্লাহর পরিবর্তে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতার উচ্চতম আসনে আরোহণ করেন। বিল পাস হওয়ার অব্যবহিত পরেই পদত্যাগ করার সুযোগ পর্যন্ত না দিয়ে মোহাম্মদ উল্লাহকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণ করা হয় এবং শেখ মুজিব তত্ক্ষণাত্ স্পিকারের কাছে নয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্টের এক আদেশ বলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল স্বাভাবিকভাবে বিলুপ্ত হয় এবং দেশে বিরাজ করে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল—বাকশাল। এই বাকশালের দর্শন বাস্তবায়নের জন্য ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন এক আদেশ বলে দেশের সবক’টি সংবাদপত্র বিলুপ্ত করে বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়। শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনায় দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ অবজারভার এবং বাংলাদেশ টাইমস—এ চারটি পত্রিকা সাময়িকভাবে প্রকাশনার সুযোগ দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে আবার বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু হয়।

তবে ওই সময় এসব ঘটনা বিষয়ে বিশ্বনেতারা কিংবা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কোনো মন্তব্য পত্রপত্রিকায় পাওয়া যায়নি। এসব ঘটনায় তখন দিল্লিতে গণতন্ত্রমনারা ভীষণ মর্মাহত হন এবং জয়প্রকাশ নারায়ণ এক বিবৃতিতে বলেন, মুজিবকে আমরা গণতন্ত্রের বরপুত্র হিসেবে জানতাম। আমাদের ধারণা, ভারতের পরামর্শে তিনি এটা করেছেন। তার এ বক্তব্যের সত্যতা মেলে চতুর্থ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার দিনই ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অভিনন্দন বার্তার মাধ্যমে। এ বিষয়ে ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুর প্রতি ইন্দিরা গান্ধীর অভিনন্দন’ শিরেনামের প্রতিবেদনটি নিম্নরূপ : ‘নয়াদিল্লি, ২৫ জানুয়ারি (বাসস)— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাঁহাকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করিয়াছেন। বঙ্গবন্ধুর নিকট আজ প্রেরিত এক বাণীতে মিসেস গান্ধী বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য ও সাফল্য কামনা করিয়াছেন।’

এদিকে এ বছর এমন একটি সময় দিনটি আমাদের কাছে ফিরে এসেছে, যখন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং তারা অনেকটা বাকশালী কায়দায় রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর চালানো হচ্ছে নানা ধরনের অমানবিক নির্যাতন ও নিপীড়ন। ফ্যাসিস্ট কায়দায় আঘাত হানা হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায়। আর বর্বর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সাংবাদিকরা। এ প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘বাকশালের চিন্তা-চেতনাকে আমরা এখনও ধারণ করি। সব দলকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্লাটফর্মের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে বাকশালের চিন্তা-চেতনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করতে চাই।’ গত বছর বাকশাল বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা হানিফের এমন বক্তব্য দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে নানা শঙ্কার জন্ম দেয়। তারা হানিফের ওই বক্তব্যকে দেশের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে উল্লেখ করেন। তারা বলেন, আওয়ামী লীগের এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, দেশে আবার বাকশাল বা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলতে পারে। জনগণ বাকশাল মেনে নেবে না। কারণ বাকশালের চিন্তা-চেতনা ধারণ করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। বাকশালের শেষ পরিণতি কী হতে পারে তা অতীতে আমরা দেখেছি।

এ ব্যাপারে ওই সময় প্রবীণ সাংবাদিক, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও ছড়াকার ফয়েজ আহ্মদ বলেন, বাকশাল বিষয়ে হানিফের বক্তব্য সাধারণভাবে আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। কারণ এর শেষ পরিণতি কী হতে পারে তা অতীতে আমরা দেখেছি।

অন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেছেন, এ বক্তব্য দেশের জন্য অশনি সংকেত। দেশে আবার বাকশাল বা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলতে পারে। জনগণ বাকশাল মেনে নেবে না। তরুণ প্রজন্ম গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী। যদিও তারা বাকশালের শাসন প্রত্যক্ষভাবে দেখেননি। তবু গণতন্ত্রকামী এ প্রজন্ম বাকশাল মানবে না। এতে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হবে, যা দেশ ও জনগণের জন্য শুভ হবে না। এমনকি আওয়ামী লীগের জন্যও শুভ হবে না।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, মাহবুব-উল আলম হানিফের বক্তব্যের মূল কথা হলো, আওয়ামী লীগ একদলীয় চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায় তারা বিশ্বাস করে না।

এদিকে চতুর্থ সংশোধনী বিল পাস এবং বাকশাল গঠনের ঘটনা ওই সময় দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলাসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। ওই বছর ২৬ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্টে বলা হয়, ‘গতকাল শনিবার জাতীয় সংসদ ভবনে আয়োজিত এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে স্পিকার আবদুল মালেক উকিল বঙ্গবন্ধুকে শপথ গ্রহণ করান। অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্যবৃন্দ, সাবেক মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ও কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। বিলের ওপর বক্তব্য রাখার সুযোগ না দেয়ায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ৩ জন সদস্য আবদুল্লাহ সরকার, আবদুস সাত্তার ও মইনুদ্দিন আহমেদ মানিক এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মি. মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ‘ওয়াকআউট’ করেন।’

ব্যারিস্টার মওদুদ তার বইতে উল্লেখ করেন, ‘শনিবার দিন এই বিল পেশ করার জন্য মুজিবকে পরামর্শ দেয়া হয়। কারণ সেদিন সুপ্রিম কোর্টের কোনো অধিবেশন বসে না। বিনা বিতর্কে এই বিল পাস করার পদক্ষেপ থেকে বোঝা যায় যে, শেখ মুজিব চাননি এতে কেউ বিরোধী বক্তব্য রাখার সুযোগ পান। প্রধান বিচারপতি হয়তো শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা নাও করতে পারেন বলে তারা আশঙ্কা করেছিলেন। তা না হলে এই বিধি সংশোধনের কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না। বিল পাস হবার সঙ্গে সঙ্গে স্পিকার আবদুল মালেক উকিল, যিনি একজন দলীয় নেতা, সংসদ ভবনে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।’

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি (শনিবার) চতুর্থ সংশোধনী বিলটি পাস হওয়ার পরদিন ২৬ জানুয়ারি (রোববার) দৈনিক ইত্তেফাক এ সংশোধনী বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করে। ওইদিনের ইত্তেফাকে প্রকাশিত চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘জাতীয় দল গঠন’ এবং রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ হুবহু তুলে ধরা হলো :

১১৭-ক। জাতীয় দল :
(১) রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে এই সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনায় মূলনীতি সমূহের কোনো একটা পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করিবার উদ্দেশ্যে অনুরূপ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি, আদেশ দ্বারা, নির্দেশ দিতে পারিবেন যে রাষ্ট্রে শুধু একটা রাজনৈতিক দল (অতঃপর জাতীয় দল নামে অভিহিত) থাকিবে।
(২) যখন (১) দফার অধীনে কোনো আদেশ প্রণীত হয়, তখন রাষ্ট্রের সকল রাজনৈতিক দল ভাঙ্গিয়া যাইবে এবং রাষ্ট্রপতি জাতীয় দল গঠন করিবার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করিবেন।
(৩) জাতীয় দলের নামকরণ, কার্যসূচি, সদস্যভুক্তি, সংগঠন, শৃঙ্খলা, অর্থসংস্থান এবং কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কিত সকল বিষয় রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা পরিচালিত হইবে।
(৪) (৩) দফার অধীন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত আদেশ সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি জাতীয় দলের সদস্য হইবার যোগ্য হইবেন।
(৫) এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে তাহা সত্ত্বেও যখন জাতীয় দল গঠিত হয় তখন কোনো ব্যক্তি—
(ক) যদি তিনি যে তারিখে জাতীয় দল গঠিত হয় সেই তারিখে সংসদ সদস্য থাকেন, তাহা হইলে তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জাতীয় দলের সদস্য না হইলে সংসদ সদস্য থাকিবেন না এবং সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে।
(খ) যদি তিনি জাতীয় দলের দ্বারা রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত না হন, তাহা হইলে অনুরূপ নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হইবেন না।
(গ) জাতীয় দল ছাড়া অন্য কোন দল গঠন করিবার বা অনুরূপ দলের সদস্য হইবার কিংবা অন্য কোনো অনুরূপ দলের কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করিবার অধিকার প্রাপ্ত হইবেন না।
(১) এই অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত কোনো আদেশ পরবর্তী কোনো আদেশ দ্বারা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত বলবত্ থাকিবে।
৩৪ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিশেষ বিধানে বলা হয় : সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও এই আইন প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, (ক) এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকিবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবে।
(খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন, যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত বিধানের অধীনে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন। (দৈনিক ইত্তেফাক : ২৬ জানুয়ারি, রবিবার ১৯৭৫)
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিশেষ বিধানে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে ‘জাতির পিতা’ শব্দটি বসানো হয়। যে আইন বলে শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি হন, সে আইনটি ছিল একটি অস্থায়ী ক্রান্তিকালীন আইন। সে কারণে জাতির জনক উপাধিটি সংবিধানের অংশ নয়।
এদিকে ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাকশাল গঠন সংক্রান্ত আদেশটি পরদিন অর্থাত্ ২৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে হুবহু প্রকাশ করা হয়। ইত্তেফাকে প্রকাশিত বাকশাল গঠন সংক্রান্ত আদেশটি তুলে ধরা হলো :
১ নং আদেশ
প্রেসিডেন্ট গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বর্ণিত জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র—এই মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতিসমূহের পূর্ণতাদানের উদ্দেশ্যে দেশে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের নির্দেশ দানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়াছেন। অতএব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৭-ক অনুচ্ছেদের (১) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রেসিডেন্ট দেশে এখন হইতে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকিবে বলিয়া নির্দেশ দান করিতেছেন।
২ নং আদেশ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৭-ক অনুচ্ছেদের (২) ও (৩) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রেসিডেন্ট নিজেকে চেয়ারম্যান করিয়া বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে একটি জাতীয় দল গঠন করিয়াছেন। ইহা সংঘটনের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় ব্যবস্থা তিনিই গ্রহণ করিবেন এবং ইহার পরিচালনার যাবতীয় ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে।
৩ নং আদেশ
রাষ্ট্রপতি অন্য কোনো নির্দেশ দান না করিলে জাতীয় সংসদের অবলুপ্ত আওয়ামী লীগ দলীয় সকল সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রীগণ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্য বলিয়া গণ্য হইবেন। প্রেসিডেন্ট দলীয় সংগঠন নির্ধারণ না করা পর্যন্ত— অবলুপ্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ব্যতীত অন্যান্য সকল কমিটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কমিটি রূপে কাজ চালাইয়া যাইবে। (দৈনিক ইত্তেফাক : ২৫ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ১৯৭৫)
চতুর্থ সংশোধনী সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়, বাকশাল গঠনের আদেশ এবং সংসদে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ওই সময় দৈনিক ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। চতুর্থ সংশোধনী বিল পাসের পরদিন দৈনিক ইত্তেফাক ‘রাষ্ট্রপতি হিসাবে বঙ্গবন্ধুর শপথ গ্রহণ : প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার কায়েম’ শিরোনামে প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে ৮ কলামে প্রকাশ করে।

ওই প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো :
রাষ্ট্রপতি হিসাবে বঙ্গবন্ধুর শপথ গ্রহণ : প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার কায়েম
(ইত্তেফাক রিপোর্ট)
সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের পরিবর্তে দেশে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার কায়েম করা হইয়াছে। গতকাল (শনিবার) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করিয়াছেন। দেশের সর্বময় ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর হাতে ন্যস্ত থাকিবে। অতঃপর দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকিবে। জাতীয় সংসদের কোনো সদস্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রস্তাবিত রাজনৈতিক দলের সদস্য তালিকাভুক্ত না হইলে তাঁহার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হইয়া যাইবে। দেশের নির্বাহী কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সংবিধান অনুযায়ী তিনি তাহা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে তাঁহার অধীনস্থ কর্মচারীদের মাধ্যমে পালন করিবেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শদানের জন্য একটি মন্ত্রিপরিষদ থাকিবে। রাষ্ট্রপতি একজন উপ-রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করিবেন। আজ নয়া মন্ত্রী পরিষদ শপথ গ্রহণ করিবে। চতুর্থ সংবিধান সংশোধনী বিল ২৯৪ ভোটে গৃহীত হয়।
এই বিলের বিরোধিতা করে ৩ জন বিরোধী, ১ জন স্বতন্ত্র সদস্য ‘ওয়াক আউট’ করেন। জনাব আতাউর রহমান খান পূর্বাহ্নে সংসদ কক্ষ ত্যাগ করেন।

প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পাঁচ বত্সরের জন্য প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হইবেন। সংবিধান লঙ্ঘন ও গুরুতর অসদাচরণের দায়ে রাষ্ট্রপতিকে অভিযুক্ত করার ব্যবস্থা রাখা হইয়াছে। সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের স্বাক্ষরিত প্রস্তাবে এই অভিযোগ আনা যাইবে। রাষ্ট্রপতি পূর্বাহ্নে ভাঙিয়া না দিলে বর্তমান সংসদের আয়ুকাল হইবে পাঁচ বছর। রাষ্ট্রপতি পরবর্তীকালে এক আদেশবলে দেশের সকল রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘোষণা করিতে পারিবেন। জাতীয় দলের নামকরণ, কার্যসূচি, সদস্যভুক্তি, সংগঠন, শৃঙ্খলা, অর্থসংস্থান এবং কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা নির্ধারিত হইবে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল পাসের অব্যবহিত পরেই জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হন।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম