গতকাল রাতে একটা ‘বন্দুক যুদ্ধ’ দেখলাম!
পুলিশের হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে গত দুই মাস ধরে বিভিন্ন বাসায় ঘুমাচ্ছি। ঘুমানোর স্থান হিসেবে মোটামোটি নিরাপদ লোকেশান খুঁজি। এরকম একটা নিরাপদ স্থান হিসেবে ক্যান্টনমেন্ট ও মিরপুরের মাঝখানে ভাষানটেক এলাকাকে বেছে নিলাম। এইসব ক্ষেত্রে এলাকা নিরাপদ তিন দিনের বেশি থাকে না। অর্থাত এক এলাকায় দুই তিন দিনের বেশি থাকি না।
ভাষানটেক এলাকায় আমার ছেলে বেলা কেটেছিল। এখানে আমাদের পৈত্রিক জমি ছিল যা এখন আওয়ামীলীগ নেতা কামাল মজুমদার দখল করে নিয়েছে (এটা নিয়ে একটা পোষ্ট দিয়েছিলাম)। এই এলাকায় অনেক বন্ধু বান্ধব থাকার কারনে গত রাতে ভাষানটেক বস্তির এক বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম।
রাত দুইটায় হঠাত প্রচন্ড শব্দ শুনি। এই শব্দ আমার সুপরিচিত- গুলির শব্দ। প্রথমে ভেবেছিলাম আমার লোকেশান হয়তো ট্রেস করে ফেলেছে। ধরতে পারলে নিশ্চিত ক্রসফায়ার। আমার হাতে র্যাব পুলিশ মোকাবেলা করার মত সরঞ্জামাদিও নেই। তবুও প্রতিজ্ঞা করলাম যদি আমাকে ধরতেই আসে তবে দুই চারটা পুলিশকে জাহান্নামে পাঠিয়ে নিজে মরে যাব। বস্তির দরজা জানালাগুলো তেমন মজবুত থাকে না। জানালা লাগালেও ফাঁক ফোঁকর থাকে।
নিরাপত্তার স্বার্থে আগে থেকেই জানালা লাগানো ছিল। জানালা না খুলেই জানালার ফাঁক দিয়ে বাহিরে তাকালাম। আমি যে লোকেশনে ছিলাম সেই লোকেশান থেকে আশে পাশের এক কিলোমিটার দেখা যায়। এই এক কিলো যায়গাটা পুরোই ফাঁকা মাঠ। এখানে বালু ফেলা হচ্ছে। রাতের বেলায় ভয়ে এখানে কেউ আসে না। হিরোইঞ্চি গাঁজাখোরের আড্ডা থাকে। আজ তারাও নেই। দূরে সাত আট জন মানুষকে দেখলাম। পরিষ্কার চাঁদের আলোতে সব দেখা যাচ্ছে। সাত আট জনের দলটি এদিকেই এগিয়ে আসছে। আমি পালাব কি না বুঝতে পারছি না। কারন র্যাব পুলিশের মুভমেন্ট আমি জানি। ওদের মুভমেন্ট দেখে মনে হচ্ছে ‘অপারেশন’ কমপ্লিট করে ফিরছে। দেখতে দেখতে ওরা আমার বাসার কাছাকাছি চলে এলো। সংখ্যায় ওরা আট জন। প্রত্যেকের গায়ে বুলেট প্রুফ পোষাক। এরা পুলিশের লোক। একজনের হাতে একটা গামছা দেখলাম। আমাদের বাসার কাছে এক গাছের নিচে এসে তারা গামছাটিতে আগুন লাগিয়ে দিল। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গামছা পোড়া দেখল। গামছা পোড়া শেষ হলে লোকগুলো কাকে যেন ফোন করল। পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি ওরা কাকে যেন হত্যার কথা বলেছে। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তার মানে এখানে তারা কাউকে খুন করেছে। এই খুন আমাকেও করতে পারত। এই আট জন পুলিশ আমি যে এখানে আছি তা জানে না। জানলে নিশ্চিত এই বাসা লক্ষ্য করে গুলি করত। কিছুক্ষন পরে একটা মাইক্রো আসল। এই আট জন তাতে চড়ে বসল, মাইক্রো ছেড়ে দিল।
ওরা যেহেতু কোন প্যাকেট নিয়ে যায় নি এবং কারো লাশও নিয়ে যায় নি তাহলে যাকে খুন করেছে তিনি কোথায়? তাকে নিশ্চয়ই এখানে ফেলে রেখেছে? সেই লোক যদি বেঁচে থাকে? সে নিশ্চয়ই বিএনপি অথবা জামাতের কেউ না কেউ হবে। আমি কী করব ভাবতে ভাবতেই বেরিয়ে পড়লাম। যা থাকে কপালে! পুলিশ গুলো যে গাছের নিচে গামছা পুড়িয়েছে সেই গাছের নিচে গিয়ে মোবাইল টর্চের আলোতে দেখলাম একটা পোড়া গামছা। আশে পাশে রক্তের দাগ। তার মানে এই গামছা থেকে রক্ত ঝরেছে। অর্থাত যাকে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ মেরেছে তাকে এই গামছা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। গুলি করার পর তার শরীর থেকে রক্ত ঝরে এই গামছা ভিজে গেছে। গামছার সামান্য কিছু অংশ পুড়ে নি।
আমি পুলিশ গুলো যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে দৌড় দিলাম। যদি লোকটি কোন ভাবে বেঁচে থাকে! এই মাঠ অনেক বড়। কোন লাশ পড়ে থাকলে এই রাতে চাঁদের আলোয় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। হঠাত দূরে গাড়ীর আলো দেখতে পেলাম। নিশ্চিত এটা পুলিশের গাড়ী। তার পিছনে আরেকটা গাড়ী, তার পিছনে আরেকটা। পর পর তিনটা গাড়ী এদিকেই আসছে। তার মানে এরা লাশ নিতে আসছে। আগে ছিল কিলার বাহিনী আর এরা লজিস্টিক বাহিনী।
এখন আমাকে যে কাজ করতে হবে সেটা হল দ্রুত পালাতে হবে। কিন্তু এই মাঠে দৌড়াতে গেলে গুলি নিশ্চিত। মাঠের এক পাশে একটা খাদ ছিল। সেই খাদে নেমে পড়লাম। ভাল করে দেখে নিলাম এই খাদে লাশ আছে কি না। লাশ থাকলে পুলিশ এখানে আসবে আর আমাকে ধরে ফেলবে। পুলিশের গাড়ীর শব্দ শুনলাম। আমার কাছাকাছি অবস্থানে এসে গাড়ী গুলো থামল। আমার তখন নিশ্বাস নিতেও ভয় লাগছে। যদি নিশ্বাসের শব্দ তারা শুনে ফেলে! বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে। এই শীতের রাতেও প্রচন্ড ভাবে ঘমাছি। গলা শুকিয়ে কাঠ। পুলিশ যদি আমাকে ধরেই ফেলে তাহলে পুলিশকে অনুরোধ করতাম “ভাই ক্রস ফায়ারে দেন ভাল কথা তার আগে আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়ান”
পুলিশ এক স্থানে গিয়ে তাদের জিনিস নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। আমি পরে ঐ স্থানে গিয়ে দেখি ঐ স্থানে রক্ত আর রক্ত। বেচারা কার মায়ের বুক খালি হয়েছে। কে এই অপ রাজনীতির শিকার? আমি দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম।
কোপা শামসু
‘বুবু আমারে বাঁচাও। পাঁচ লাখ টাকা না দিলে আমারে মাইরা ফালাইব। বুবু আমারে বাঁচাও।’-এই আর্তনাদ ২৩ বছরের যুবক নাহিদের। রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা নাহিদ প্রাণে বাঁচতে পুলিশি বেষ্টনীর ভিতর থেকে আকুতি জানিয়েছিল তার বোন শিলার কাছে। কিন্তু নাহিদকে বাঁচাতে সেই পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করতে পারেনি শিলা। ৫০ হাজার টাকা নিয়ে হাজির হয়েছিল পুলিশের কাছে। কিন্তু সেই টাকা মুখের ওপর ছুড়ে মেরে পুলিশ বলে, হবে না। এক দাম পাঁচ লাখ! এক টাকা কম হলেও চলবে না। চার দিন পর নাহিদকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু জীবিত নয়। গুলিবিদ্ধ লাশ হয়ে পড়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে।
খোদ রাজধানীর পল্লবী থানার বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের নামে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, তালিকা ধরে ধরে গ্রেফতার করা হচ্ছে। টাকা পাওয়া গেলে তাদের মুক্তি মিলে, অন্যথায় ক্রসফায়ার। পল্লবী থানা পুলিশের বিরুদ্ধে এমনই ভয়ঙ্কর অভিযোগ পাওয়া গেছে। টাকা না দেওয়ায় নিরীহ নাহিদকে গুলি করে ভাসানটেক এলাকায় ফেলে রাখে। নাহিদ কি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন, নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে, এমন প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট মহলে।
নাহিদের বোন শিলা আক্তার জানান, ‘আমার ভাইরে পল্লবী থানা পুলিশ গাড়িতে তুইলা চোখের সামনে দিয়া ঘুরলো। পরে মিললো ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ লাশ।’ এখন তারা বলে, নাহিদকে তারা চেনেন না। নাহিদের বৃদ্ধ বাবার প্রশ্ন, কী অপরাধ ছিল আমার নিরীহ ছেলের? কেন এভাবে গুলি করে হত্যা করা হলো? নাহিদের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও ছিল না। পুলিশের কাছে ধরনা দিতে দিতে শেষমেশ পেলাম ছেলের লাশ। আমি পুলিশকে বলেছিলাম, বাড়ি বিক্রি করে হলেও পাঁচ লাখ টাকা দিব। তবুও আমার ছেলেকে ফেরত দেন। কিন্তু ওরা ছেলেরে দিল না।
গতকাল বিকালে রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের পল্লবীর ৬ নম্বর লাইনের ৪ নম্বর বাসায় বসে কথা হয় নাহিদের পরিবারের সঙ্গে। নাহিদের বড় বোন শিলা আক্তার কথা বলছিলেন আর কাঁদছিলেন। পাশেই বসা ছিলেন তার অসুস্থ বাবা গাজী মো. সাঈদ। অনবরত চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল তার। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। জ্ঞান ফেরার একপর্যায়ে তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, টাকা না দেওয়ায় পুলিশ আমার ছেলেরে মাইরা ফালাইছে। এখন পুলিশ বলছে আমার ছেলে নাকি সন্ত্রাসী ছিল। তার আর্তচিৎকারে আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
তবে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে নাহিদকে গ্রেফতার করা হয়নি। অন্য কোনোভাবে তার মৃত্যু হয়েছে। গত ২ ফেব্র“য়ারি রাজধানীর মিরপুরে প্রশিকা ভবনের সামনে থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন মো. নাহিদ (২৩)। ৫ ফেব্র“য়ারি ভোরে ভাসানটেক এলাকা থেকে নাহিদের গুলিবিদ্ধ লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। সর্বশেষ গত রবিবার নাহিদের স্বজনেরা মর্গে গিয়ে তার লাশ শনাক্ত করেন। নিহতের শরীরে পাঁচটি গুলির চিহ্ন ছিল। এর আগে কয়েক দফায় পুলিশ ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২ ফেব্র“য়ারি নিখোঁজ হওয়ার পর সম্ভাব্য কোথাও নাহিদের সন্ধান না পেয়ে পল্লবী থানায় গিয়েছিলেন নাহিদের পরিবারের সদস্যরা। সেখানে থানার সোর্স তারেকের মাধ্যমেই নাহিদের অবস্থান জানতে পারেন তারা।
পরবর্তীতে বিভিন্ন মুঠোফোন নম্বর থেকে নাহিদের সঙ্গে কয়েক দফা কথাও হয়েছিল তাদের। একই সঙ্গে পল্লবী থানার এসআই তৌহিদুল ইসলাম আরেফিন এবং এএসআই শুব্রতের সঙ্গেও তারা কয়েক দফা কথা বলেছিলেন। তবে তাদের সবার দাবি ছিল ৫ লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন নিহত নাহিদের বড় বোন শিলা। তিনি বলেন, পুলিশের সোর্স তারেকের মোবাইলে আমার ভাই নাহিদের লগে ৪ তারিখ বিকাল থাইক্যা তিনবার কথা হইছিল। পরের দিনও থানার দুজন পুলিশের লগে কথা হইছে আমার। রাইত ১০টা থাইক্যা রাইত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত পুলিশ গাড়িতে কইরা আমাগো সামনে আমার ভাইরে ঘুরাইছিল।’ শিলা বলেন, গত ২ ফেব্র“য়ারি ০১৭০৩৪৯৮৮২২ মুঠোফোন নম্বর থেকে আমার মুঠোফোন নম্বরে ফোন করে জানায়, আপনার বাবাকে পল্লবী থানার সামনে পাঠান। আবার বাবা থানার সামনে গেলে তারেক ওই নম্বর থেকে কল করে থানার পিছনে ৯ নম্বর রোডে নিয়ে যায়। সেখানে সিভিল টিম ঢাকা মেট্রো চ-১৩-৪৭৬৮ নম্বর গাড়িতে নিয়ে বসায়। আমার বাবা ওই গাড়িতে নাহিদকে দেখতে পান। তারা দাবি করেছিল ৫ লাখ টাকা দিলে নাহিদকে ছেড়ে দেওয়া হবে। রাত ১০টার দিকে থানার সামনে ২০ হাজার টাকা জোগাড় করে এসআই তৌহিদের কাছে গেলে ওই টাকায় হবে না বলে আমার বাবাকে তাড়িয়ে দেয়। তবে ০১৫৩৪২২৭৮০৯, ০১৯৪৭৮২০৬৬৮, ০১৭৬৪৩৫১৪০৬ নম্বরগুলোর মাধ্যমে কয়েক দফা যোগাযোগ হয় তাদের সঙ্গে। শিলা আরও জানান, পরদিন ৩ ফেব্র“য়ারি বিকাল ৪টার দিকে সোর্স তারেক ০১৭৩০.... নম্বর থেকে কল করে এক লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। ওইদিনই সন্ধ্যা ৬টার দিকে ০১৯৪৭... নম্বর থেকে কল করে টাকা নিয়ে থানার সামনে যেতে বলে। ৫০ হাজার টাকা নিয়ে থানার সামনে গিয়ে নাহিদকে ওই গাড়িতেই বসা দেখতে পাই। এসআই তৌহিদুলের সঙ্গে কথা বলে তারেক আমাদের জানিয়ে দেয় এক লাখ টাকা না দিলে তাকে ছাড়া হবে না। এ ঘটনায় শিলা গত ৫ ফেব্র“য়ারি মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার নেসারুল আরিফের দফতরে একটি আবেদন করেছিলেন শিলা। ওই আবেদনটি রিসিভও করা হয়। আবেদনপত্রে ঘটনার শুরু থেকে সোর্সের সঙ্গে এবং থানার দুই পুলিশ সদস্যের ব্যাপারে সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলেন শিলা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার নেসারুল আরেফিন বলেন, পুরো ঘটনাটি তদন্তের জন্য পল্লবী জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে যে নম্বর থেকে ভুক্তভোগী পরিবারকে ফোন করা হয়েছিল সেগুলো আমার কোনো পুলিশ সদস্যের নয় বলে আমি জেনেছি। পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউজ্জামান বলেন, নাহিদের নামে থানায় কয়েকটি মামলা রয়েছে। তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। তার পরিবারের সব অভিযোগ ভিত্তিহীন।
0 comments: