আল-গুরাবাঃ যাদের হাতে ইসলামের বিজয় আসবে।

দুনিয়াতে এখন ইসলামের খুবই দূরবস্থা। মুসলমানদেরকে বিভিন্নভাবে কষ্ট ও মুসীবতের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। হকের অনুসারীদের সংখ্যা যেন প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও অধিকাংশের কাছে প্রকৃত ইসলাম অপরিচিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামকে নিছক কিছু আচার অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে বেশীরভাগ মুসলমান। এ আচার অনুষ্ঠানগুলোর অধিকাংশের সাথেই আবার আল্লাহর কিতাব ও রসূলের (সঃ) সুন্নতের খুব বেশী সম্পর্ক নেই। এভাবেই ইসলাম তার অনুসারীদের কাছে অপরিচিত একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য যা করা দরকার তা হল এ অপরিচিত অবস্থা থেকে ইসলামকে মানুষের কাছে পরিচিত করানো। আর যারা এ পরিচিত করানোর কাজ করবে তারা মানুষের কাছে আশ্চর্যজনক প্রজাতি বলে মনে হবে। রসূলুল্লাহ্ (সঃ) এদেরকে বলেছেন গুরাবা। আর আল্লাহ এদের হাতেই ইসলামের বিজয় দান করবেন।


রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “ইসলামের শুরু হয়েছে এক গারীব [অপরিচিত/আজব/আত্মীয়-বান্ধবহীন] বিষয় হিসেবে। এটা আবার ফিরে যাবে সে গারীব অবস্থায় যেভাবে এ শুরূ হয়েছিল। আর সে সময়ের গুরাবাদের জন্য সুসংবাদ।” বলা হলো, “হে আল্লাহ্‌র রসূল (সঃ), কারা গুরাবা?” তিনি (সঃ) বললেন, “যারা অপরিচিত/বান্ধবহীন অবস্থায় যখন লোকেরা ইসলামের মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে সে সময় এর সংশোধন করবে।” [মুসনাদ আহমদ, মুসলিম, ইবন মাজাহ্‌]

এ হাদীসের অন্য বর্ণনায় নীচের কথাগুলো আছেঃ [লোকেরা] বলল, "হে আল্লাহর রসূল, গুরাবা কারা? তিনি বললেন, "মানুষ বিপর্যয় সৃষ্টি করার পর যারা এর সংশোধন করবে", অন্য বর্ণনায়, "মানূষ যা নষ্ট করে ফেলেছে তারা তার সংশোধন করবে।" অন্য বর্ণনায়, "তারা হবে অল্পসংখ্যক সৎকর্মশীল মানুষ যখন পাপীদের সংখ্যা হবে অনেক।" অন্য বর্ণনায়,"এরা হচ্ছে তারা যারা আমার সুন্নতের মধ্যে লোকেরা যখন বিপর্যয় সৃষ্টি করবে তখন এর সংশোধন করবে।"

গরীব অবস্থায় ইসলামের শুরু হওয়ার রয়েছে দু’টো দিকঃ

১. দায়ীদের একাকী ও সহায় সম্বলহীন অবস্থা / অল্প সখ্যক লোকের ইসলাম গ্রহন করা/ ইসলামের আস্তে আস্তে বিস্তার লাভ করা। নবীরা যখনই দা'ওয়াত দিয়েছেন তখনই তাঁরা একাকী দা'ওয়াতের কাজ করেছেন। রসূলুল্লাহ্‌ (সঃ) যখন দাওয়াতের কাজ শুরু করেন তিনি একা এ দীনের দাও'আতের কাজ শুরু করেন। দুনিয়াতে হকপন্থীদের সংখ্যা ছিল তখন খুবই অল্প কিছু মানুষ। ইয়াদ ইবন হিমারের (রাঃ) বর্ণনা করা এক হাদীসে রসূলুল্লাহ্‌ (সঃ) বলেছেন, “আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের দিকে তাকালেন। আর তারা ছিল সবাই পথভ্রষ্ট – আরব ও আজমের সবাই; শুধুমাত্র আহলুল কিতাবের অল্প কিছু লোক ব্যতীত।” [ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহতে হাদীসটি সংকলন করেছেন]

২. দাওয়াতের বাণী অপরিচিত হওয়া। রসূলুল্লাহ (সঃ) ও অন্যান্য নবীরা (আঃ) যখন ইসলামের দা‘ওয়াত দিতে শুরু করলেন তখন তাঁদের (সঃ) কথা লোকদের কাছে আশ্চর্য মনে হয়েছে; মনে হয়েছে নতুন কথা, অপরিচিত কথা। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুর’আনে আমাদের নিন্মোক্ত আয়াতগুলোতে তা জানিয়েছেন।
• "তোমরা কি আশ্চর্যবোধ করছ যে, তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের মধ্য থেকেই একজনের বাচনিক উপদেশ এসেছে যাতে সে তোমাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করে, যেন তোমরা সংযত হও এবং যেন তোমরা অনুগৃহীত হও?" [৭/৬৩]
• "বরং তারা তাদের মধ্য থেকেই একজন ভয় প্রদর্শনকারী আগমন করেছে দেখে বিস্ময় বোধ করে। অতঃপর কাফেররা বলেঃ এটা আশ্চর্যের ব্যাপার।" [৫০/২]
• "তারা বলল, তুমি কি আমাদেরকে সে পথ থেকে ফিরিয়ে দিতে এসেছ যাতে আমরা পেয়েছি আমাদের বাপ-দাদাদেরকে?" [১০/৭৮]
• "তাদেরকে যখন বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, বরং আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে বিষয়ের উপর পেয়েছি, তারই অনুসরণ করব।" [৩১/২১]
• "বরং তারা বলে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি এক পথের পথিক এবং আমরা তাদেরই পদাংক অনুসরণ করে পথপ্রাপ্ত। এমনিভাবে আপনার পূর্বে আমি যখন কোন জনপদে কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই তাদের বিত্তশালীরা বলেছে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি এক পথের পথিক এবং আমরা তাদেরই পদাংক অনুসরণ করে চলছি।" [৪৩/২২-২৩]

ইসলামের প্রসার ও বিকৃতিঃ
এ প্রাথমিক অস্বীকৃতির পরও ইসলামের প্রসার ঘটেছে। আবূ-বকর, খাদীজা, আলী, জায়দ, বিলাল, [রাদি আল্লাহু আনহুম] প্রমুখ ইসলাম গ্রহন করেছেন। তাঁদের পথ ধরে আরো অনেক গুরাবা ইসলাম গ্রহন করেছেন। কিন্তু তাদের ইসলাম তাদের জন্য নিরাপত্তার কারণ হয়নি। কষ্ট, নির্যাতন, বয়কট, এবং শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে মু'মিনদের। নিজ জন্মভূমি ছাড়তে হয়েছে। হিজরত করেছেন তাঁরা হাবশায়। এরপর আল্লাহ্‌ তাদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন মদীনায়। মদীনায় থেকে গুরাবাদেরকে আত্মরক্ষার জিহাদ করতে হয়েছে। এরপর আল্লাহ মক্কাকে ইসলামের পদানত করে দিয়েছেন। তারপর রসূলুল্লাহ (সঃ) শক্তি প্রয়োগে মুশরিকদের জব্দ করেছেন। তারপর মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করেছে। ইসলাম বিজয়ী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে আরব উপদ্বীপে। এরপর খুলাফায়ে রাশেদার প্রথম পর্যায়ে মুসলমানরা অনারব ভুমিতেও ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছেন। দিকে দিকে উড়েছে ইসলামের বিজয় কেতন। ইসলাম এক সুপরিচিত বিধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল পৃথিবীর দিকে দিকে।

এরপর ইসলাম আবার গরীব হতে থাকল। এ গরীবীর কিছু দিক হচ্ছেঃ

• দলাদলি এবং পারস্পরিক বিদ্বেষ ও বিভেদ।
• আল্লাহ্‌র কিতাব ও রসূলের সুন্নাত বাদ দিয়ে ইচ্ছা-বাসনা [শাহাওয়াত] ও সন্দেহযুক্ত [শুবুহাত] বিষয়ের অনুসরণ করা।
• দীনের মূল শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়া।
• এসময়ে অল্প কিছু সংখ্যক মানূষ মাত্র প্রকৃত দীনের উপর অটল থাকবেন।
• কখনো কখনো কোন কোন এলাকায় আল্লাহ্‌র একজন বান্দা ছাড়া আর কোন মানুষ দিন সম্পর্কে জানতনা।
• বিকৃতি এত বেশী প্রবল হবে যে মানুষ তাকেই মনে করবে সুন্নত, যে সম্পর্কে সুনান আদ-দারিমীতে নীচের বর্ণনাটি এসেছেঃ আব্দুল্লাহ্‌ ইবন মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন, “তোমাদের কি হবে যখন ফিতনা (বিপর্যয়) তোমাদের ঘিরে ধরবে – এমনকি ফিতনার মাঝেই তোমাদের বড়রা বৃদ্ধ হবে, ছোটরা বড় হবে এবং লোকেরা এই ফিতনাগুলোকে মনে করবে সুন্নাহ্‌? আর যখন ফিতনাগুলোকে পরিবর্তন করা হবে তখন লোকেরা বলবে সুন্নাতকে পরিবর্তন করা হলো।” বলা হল, “হে আবূ আব্দুর রহমান! সে সময়টা কখন আসবে?” তিনি বললেন, “যখন তোমাদের নির্বোধ আবেদদের সংখ্যা বেড়ে যাবে, কিন্তু জ্ঞানী আলিমদের সংখ্যা কমে যাবে; যখন [খিয়ানতকারী] নেতাদের সংখ্যা বেড়ে যাবে কিন্তু আমানতদারদের সংখ্যা কমে যাবে; এবং মানুষ দুনিয়া পাওয়ার জন্য আখিরাতের আমল করবে।”

গুরাবাদের জন্য সুসংবাদ ও তাঁদের গুনাবলীঃ
শুরুতে যে হাদীস আমরা উল্লেখ করেছি তাতে রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন গুরাবাদের জন্য “তুবা”। তুবার অনেক মানে রয়েছে। এর একটা হচ্ছে বিজয়। এজন্য শেখ রশীদ রিদার মতে প্রাথমিক গুরাবাদের হাতে যেভাবে ইসলামের বিজয় হয়েছে তেমনি পরবর্তী গুরাবাদের হাতেও ইসলামের বিজয় সাধিত হবে। ইমাম মাহদী (আঃ) ও 'ঈসার (আঃ) আগমন বার্তা সে সুসংবাদই বহন করে। এঁরা হবেন মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম। ঈমান ও আমলের সৌন্দর্যের কারণে আল্লাহ তাদের জন্য তুবার ওয়াদা করছেন। যেমন আল্লাহ্‌ তা'আলা বলেছেন (তর্জমা): যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের জন্যে রয়েছে তুবা [সুসংবাদ, বিজয়, পুরষ্কার, ইত্যাদি] এবং মনোরম প্রত্যাবর্তনস্থল। [১৩/৬৯]

গুরাবাদের কিছু বৈশিষ্ট নিম্নে আলোচিত হলঃ

১. তাঁরা আল্লাহ্‌ বিশ্বাসের উপর ইস্তিকামত করবেন এবং ঈমান ও আকীদা পরিশুদ্ধ রাখবেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে বলেছেনঃ “নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের রব্ব হচ্ছেন আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না এবং তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ শোন। ইহকালে ও পরকালে আমরা তোমাদের বন্ধু। সেখানে তোমাদের জন্য আছে যা তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্যে আছে তোমরা দাবী কর। এটা ক্ষমাশীল করুনাময়ের পক্ষ থেকে সাদর আপ্যায়ন।” [৪১/৩০-৩২]

২. তাঁরা তাঁদের আমলও বিশুদ্ধ রাখবেন। রসূলুল্লাহকে (সঃ) যখন জিজ্ঞেস করা হল “কারা গুরাবা”, তখন তিনি বলেছেন, "মানুষ বিপর্যয় সৃষ্টি করার পর যারা এর সংশোধন করবে", অন্য বর্ণনায়, "মানূষ যা নষ্ট করে ফেলেছে তারা তার সংশোধন করবে।" অন্য বর্ণনায়, "তারা হবে অল্পসংখ্যক সৎকর্মশীল মানুষ যখন পাপীদের সংখ্যা হবে অনেক।" অন্য বর্ণনায়,"এরা হচ্ছে তারা যারা আমার সুন্নতের মধ্যে লোকেরা যখন বিপর্যয় সৃষ্টি করবে তখন এর সংশোধন করবে।"

৩. তাঁরা আল্লাহ্‌, রসূল ও মু'মিনদের ছাড়া আর কাউকে ওয়ালী হিসেবে গ্রহন করবেন না এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহ্‌র উপর সন্তুষ্ট থাকবেন। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে আমাদের জানিয়েছেনঃ

• “আমার সহায় তো হলেন আল্লাহ, যিনি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। বস্তুত; তিনিই সাহায্য করেন সৎকর্মশীল বান্দাদের।” [৭/১৯৬]
• "হে নবী, আপনার জন্য এবং যেসব মুসলমান আপনার সাথে রয়েছে তাদের সবার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট।" [৮/৬৪]
• "যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন।" [৬৫/৩]
• "তোমরা কি মনে কর যে, তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে এমনি, যতক্ষণ না আল্লাহ জেনে নেবেন তোমাদের কে যুদ্ধ করেছে এবং কে আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মুসলমানদের ব্যতীত অন্য কাউকে ওয়ালী হিসেবে গ্রহণ করা থেকে বিরত রয়েছে। আর তোমরা যা কর সে বিষয়ে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত।" [৯/১৬]
৪. আল্লাহ্‌র পথে কোন নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া তাঁরা করেন না। তাঁরা মু'মিনদের প্রতি দয়ার্দ্র ও কাফিরদের প্রতি কঠোর হবেন। আল্লাহ বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের মধ্যে যে নিজ দীন থেকে ফিরে যাবে, [তার জানা উচিৎ] অচিরেই আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও তাঁকে ভালবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি হবে দয়ার্দ্র এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করবেনা। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ-তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী, মহাজ্ঞানী।” [৫/৫৪]

৫. তাঁরা হবেন মিল্লাতে ইবরাহীমের পরিপূর্ণ অনুসারী, কারণ মিল্লাতে ইবরাহীমের পূর্ণ অনুসরণ ব্যতীত কল্যাণ লাভ সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ “আর কে আছে যে ইব্রাহীমের মিল্লাত থেকে মুখ ফেরায়, শুধু সে ছাড়া যে নিজেকে বোকা প্রতিপন্ন করে? নিশ্চয়ই আমি তাকে পৃথিবীতে মনোনীত করেছি এবং সে পরকালে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।” [২/১৩০]

৬. তারা আল্লাহ্‌ ও রসূলকে সব কিছুর উপর বেশী ভালবাসবেন। রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “তিনটি গুন এমন যা কারো মধ্যে থাকলে সেই ঈমানের সুমিষ্ট স্বাদ লাভ করেছে। এগুলো হলঃ (১) তার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রসূল সব কিছুর চেয়ে বেশী প্রিয়; (২) কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তিকে আল্লাহর ওয়াস্তে ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে ভালবাসেনা; (৩) ঈমান আনার পর কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে সেভাবে ঘৃণা করে যেভাবে সে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে ঘৃণা করে।” [বুখারী ও মুসলিম] মুসলিমের অন্য বর্ণনায় এসেছে, “সেই ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছে যে আল্লাহকে রব্ব, ইসলামকে দীন এবং মুহাম্মদকে (সঃ) নবী হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছে।” [[বুখারী, মুসলিম ও সুনানের অন্যান্য কিতাব]

৭. এঁরা সর্বাবস্থায় বিভেদ-বিচ্ছেদ এড়িয়ে রসূলের সুন্নতের পূর্ণ অনুসরণ করেন। ইরবাদ ইবন সারিয়্যা (রাঃ) বর্ণনা করেছেনঃ রসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের সাথে ফজরের নামাজ আদায় করলেন এবং তারপর আমাদেরকে মর্মস্পর্শী ভাষায় ওয়াজ করলেন, যার ফলে চোখগুলো অশ্রুসিক্ত হল এবং হৃদয় আন্দোলিত হল। তখন এক ব্যক্তি বলল, “ হে আল্লাহর রসূল! এটাতো বিদায়কালীন উপদেশের মত। সুতরাং আপনি আমাদের আরো উপদেশ দিন।” তিনি বললেন, “আমি তোমাদের আল্লাহর ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বনের উপদেশ দিচ্ছি এবং তোমাদের নেতাদের কথা শোনা ও মানার নির্দেশ দিচ্ছি এমনকি তারা যদি হাবশী গোলামও হয়। আর তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে তারা অনেক মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমাদের উপর অবশ্য কর্তব্য হল আমার সুন্নাত ও খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নতকে আঁকড়ে ধরা। তোমরা তা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। আর আমি তোমাদেরকে দীনের ব্যাপারে প্রত্যেক নতুন বিষয়ের ব্যাপারে সাবধান করছি, কারণ প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদ’আত।” [তিরমিজ়ী, ইবন মাজাহ, আহমাদ ও আদ-দারিমী]

৮. নবী ও বিশ্বাসীদের [সাহাবীদের] পথই তাঁরা অনুসরণ করেন। নিজেদের মন মত তাঁরা চলেন না। কারণ নবী ও বিশ্বাসীদের পথ বাদ দিয়ে অন্য পথ ধ্বংসের কারণ। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, “হিদায়াতের পথ সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও যে কেউ রসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, এবং মু’মিনদের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান। [৪/১১৫]

৯. শুবুহাত [সন্দেহযুক্ত বিষয়] ও শাহাওয়াত [কামনা-বাসনা]সর্বাবস্থায় পরিত্যাগ করেন, কারণ যারা আল্লাহ ও রসূলের দেয়া সুস্পষ্ট হিদায়াত বাদ দিয়ে শুবুহাত ও শাহাওয়াতের অনুসরণ করে তারা হিদায়াতের পথ থেকে বিচ্যুত। “আল্লাহ তোমাদের তোমাদের তওবা কবুল করতে চান, আর যারা শাহাওয়াতের [কামনা-বাসনার] অনুসারী, তারা চায় যে তোমরা পথ থেকে অনেক দূরে বিচ্যুত হয়ে পড়।” [৪/২৭] আল্লাহ আরো বলেছেন, “অতঃপর তাদের পরে এল অপদার্থ পরবর্তীরা। তারা নামায নষ্ট করল এবং শাহাওয়াতের অনুবর্তী হল। সুতরাং তারা অচিরেই পথভ্রষ্টতা প্রত্যক্ষ করবে। কিন্তু তারা ব্যতীত, যারা তওবা করেছে এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছে। সুতরাং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের উপর কোন জুলুম করা হবে না।” [১৯/৫৯]

১০. এঁদেরকে কেউ পরাভুত করতে পারবেনা, বরং তাঁরা বিজয়ী থাকবে। আল্লাহ তা’আলা এটার ওয়াদা করেছেন। "আমার রাসূল ও বান্দাগণের ব্যাপারে আমার এই বাক্য সত্য হয়েছে যে, অবশ্যই তারা সাহায্য প্রাপ্ত হয়। আর নিশ্চয় আমার বাহিনীই হয় বিজয়ী।” [৩৭/১৭১-১৭৩] “আমি সাহায্য করব রসূলগণকে ও মুমিনগণকে পার্থিব জীবনে ও সাক্ষীদের দন্ডায়মান হওয়ার দিবসে।” [৪০/৫১] রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের একটা দল কখনো পরাজিত হবেনা। তারা সত্যের পথে থেকে লড়াই করতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত।” হাদীসটি বিভিন্ন রিওয়ায়েতে বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সুনানের কিতাবে এসেছে। হতে পারে তাদেরকে শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হবে, কিন্তু তাদেরকে কখনো বাতিলের আনুগত্য করানো যাবেনা।

কিছু গুরাবাঃ

আবুবকর (রাঃ) - সন্দেহ-সংশয় ছাড়াই ইসলাম গ্রহন করেছেন। আল-ওয়ালা ওয়া আল-বারার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মানদণ্ড স্থাপন করে ইসলামের জন্য সবকিছু উৎসর্গ করে আম্বিয়াদের (আলায়হিমুস-সালাম) পরেই নিজের স্থান করে নিয়েছেন।

উমর (রাঃ) - ক্ষমতার মসনদে আরোহন করার পরও ফকিরী জীবন যাপন করেছেন। হক ও বাতিলের মূর্তিমান মানদণ্ডে পরিণত হয়েছেন তিনি। ইসলাম ও ফিতনার মাঝে শক্ত দরজা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আদল ও ইনসাফ দিয়ে ভরে দিয়েছেন তাঁর খিলাফতকে।

উসমান (রাঃ) - ধন সম্পদের প্রাচুর্য থাকা স্বত্ত্বেও রসূলের সুন্নতের অনুসরণ করেছেন।

আলী (রাঃ) - যখন কালের গতি-প্রবাহ দিক পরিবর্তন করেছিল তখন তিনি দাঁড়িয়েছিলেন এর গতিরোধ করার জন্য। শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়েছেন।

উমার ইবন আব্দুল আজ়ীজ় (রঃ) - ক্ষমতা এবং প্রাচুর্য তাকে বিকৃতির দিকে না টেনে বরং ইসলাহের পথে ধাবিত করেছে। ইসলামের সৌন্দর্যকে আবার পূর্ণরূপে ফোটানোর কোশেশ করেছেন সর্বশক্তি দিয়ে। দুনিয়া আরেকবার প্রত্যক্ষ করেছে ইসলামের শান্তি, প্রাচুর্য, ন্যায়বিচার ও সাম্য।

আইম্মাহ আল-মুজতাহিদিন (রঃ) - ক্ষমতার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দীন-ই-মুহাম্মদীর বিশুদ্ধ রূপকে ধারণ করেছেন এবং এর সম্প্রসারণের ও উন্নয়নের কাজ করেছেন।

ইমাম ইবন তাইমিয়্যা (রঃ) - যুগের সমস্ত ফিতনা, বিদ’আত ও শিরকের সয়লাবের বিরুদ্ধে একা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তৌহীদের বাণী ও রসূলের সুন্নতকে জ়িন্দা করতে। অন্ধ-অনুকরণের পথ পরিহার করে কিতাব ও সুন্নাহ্‌কে সব কিছুর উপর প্রাধান্য দেয়ার আহবান জানিয়েছেন। পরিণামে জেল-জ়ুলুম ও অন্যান্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা ইবন তাইমিয়্যার পথকে আদর্শ হিসেবে গ্রহন করেছে। তাঁর শত্রুরা যখন তাঁকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছিলো তখন তিনি বলেছিলেনঃ "আমার শত্রুরা আমার কী করতে পারে? আমি আমার জান্নাতকে আমার বুকে ধারণ করে চলি। আমি যখন পথ চলি তখন তা আমার সাথেই থাকে, কখনো আমাকে ত্যাগ করেনা। তারা যদি আমাকে হত্যা করে তবে তা হবে আমার জন্য শাহাদাত; ওরা যদি আমাকে বহিষ্কার করে তবে তা হবে আমার হিজরত; তারা যদি আমাকে জেলে দেয় তাহলে তা হবে আমার ইবাদতের নিভৃত গৃহ।”

আল-ইমাম সাইয়্যিদ আবুল আলা আল-মওদূদী (রঃ) গুরাবাদের বর্ণনা দিয়েছেন অত্যন্ত সুন্দর করে। তিনি বলেছেনঃ “এ বিধান [ইসলাম] ভীরু কাপুরূষের জন্য অবতীর্ণ হয়নি; নফসের দাস ও দুনিয়ার গোলামদের জন্য নাজ়িল হয়নি; বাতাসের বেগে উড়ে চলা খড়-কুটো, পানির স্রোতে ভেসে চলা কীট-পতঙ্গ এবং প্রতি রঙ্গে রঙ্গীন হওয়া রঙ্গীনদের জন্য একে অবতীর্ণ করা হয়নি। এ এমন দুঃসাহসী নর-শার্দুলদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে যারা বাতাসের গতি বদলে দেবার দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করে; যারা নদীর তরঙ্গের সাথে লড়তে এবং তার স্রোতধারা ঘুরিয়ে দেবার মতো সৎসাহস রাখে। যারা খোদার রঙকে দুনিয়ার সব রঙের চাইতে বেশী ভালবাসে এবং সে রঙেই যারা গোটা দুনিয়াকে রাঙিয়ে তুলবার দৃঢ় আগ্রহ পোষণ করে। যে ব্যক্তি মুসলমান তাকে নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়ার জন্য পয়দা করা হয়নি। তার সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হলো জীবন নদীকে তার ঈমান ও প্রত্যয় নির্দেশিত সোজা ও সরল পথে চালিত করা। যদি সেই সোজা পথ থেকে নদী তার স্রোত ফিরিয়ে নেয়, আর সেই পরিবর্তিত স্রোতধারায়ই কেউ ভেসে চলতে সম্মত হয়, তো এমন ব্যক্তির ইসলামের দাবী একেবারেই মিথ্যা। বস্তুত যে ব্যক্তি সাচ্চা মুসলমান, সে এই ভ্রান্তমূখী স্রোতের সাথে লড়াই করবে, তার গতি ঘুরিয়ে দেবার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করবে – সাফল্য ও ব্যর্থতার কোন পরোয়াই সে করবেনা। এ লড়াইয়ের যে কোন সম্ভাব্য ক্ষতিই সে বরণ করে নেবে। এমনকি নদীর স্রোতের সাথে লড়াই করতে করতে তার বাহু যদি ভেঙ্গেও যায়, কিংবা শক্তি শিথিল হয়ে পড়ে এবং পানির তরঙ্গাঘাত তাকে আধমরা করে কোন তীরের দিকে ছুঁড়ে ফেলেও দেয়, তবুও তার আত্মা কখনো পরাজয় বরণ করবেনা। তার হৃদয়ে এই বাহ্যিক ব্যর্থতার জন্য এক মুহুর্তের তরেও কোন অনুতাপ জাগবেনা, কিংবা নদীর স্রোতে ভেসে চলা কাফির ও মুনাফিকদের সাফল্যের জন্য ঈর্ষার ভাবধারা প্রশ্রয় পাবেনা।” [সাইয়েদ আবুল ‘আলা আল-মওদূদী, ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব (৫ম সংস্করণ, ১৯৯৩), পৃঃ ২০৩-২০৪, শতদল প্রকাশনী, ঢাকা।]

মানবেতিহাসের সর্বপর্যায়ে এ গুরাবারা সক্রিয় ছিলেন। অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সাহসী সংগ্রামে কখনো পিছপা হননি এরা, যদিও বাহ্যিকভাবে এদের অনেককেই অসত্যের সৈনিকরা দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে; কিন্তু তাঁদের আত্মা কখনো পরাজয় বরণ করেনি। আল্লাহ্‌ তা‘আলা তার কিতাবে এদের সম্পর্কে বলেছেন, “এমন কত নবী ছিলেন যাদের সাথী হয়ে অসংখ্য আল্লাহগত প্রাণ [অসত্যের বিরুদ্ধে] লড়াই করেছেন। আল্লাহ্‌র পথে যে মুসীবতের মুখোমুখি তাঁরা হয়েছিলেন তা তাঁদের ভগ্নহৃদয় করতে পারেনি, তাঁদেরকে দমিয়ে দেয়া যায়নি, আর তাঁরা তাঁদের সংগ্রাম ছেড়েও দেননি। আর আল্লাহ্‌তো তাদেরকে ভালবাসেন যারা তার পথে দৃঢ় ও অবিচল থাকেন। তাঁরাতো শুধু বলেছেনঃ আমাদের প্রভূ আমাদের গুনাহগুলো মাফ করো আর আমাদের আচরণের বাড়াবাড়িগুলোও; আমাদের কদমগুলোকে মজ়বুত করে দাও, আর সত্য অস্বীকারকারীদের মুকাবিলায় আমাদের তুমি সাহায্য করো।” [৩/১৪৬-১৪৭] ইমাম আহমদ ও আততবারানী আবূ উমামা আল-বাহিলী [রাঃ] আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে রসূলুল্লাহ [সঃ] বলেছেনঃ আমার উম্মতের একটা দল সব সময় হক্বের উপর থাকবে এবং তারা সব সময় তাদের শত্রুদের উপর বিজয়ী থাকবে। শত্রুদের কোন দলই তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবেনা; শুধুমাত্র শারিরীকভাবে তাদের নিশ্চিহ্ন করা ছাড়া। এভাবে তারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী থাকবে।

পুরো আলোচনার শিক্ষাঃ
১. ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরাই হল গুরাবা। তাদের হাতেই আল্লাহ্‌ তা'আলা ইসলামের বিজয় দান করবেন।
২. কিন্তু তাদের গুরাবার গুন অর্জন করতে হবে। তারা সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন করেন; সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলার আন্দোলন নয়।
৩. গুরাবা হতে হলে লোক নিন্দার পরোয়া না করে ইসলামের তাজদীদের কাজ করতে হবে। সমাজে প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে সত্যিকার ইসলামের শিক্ষা জানতে হবে এবং তার বাস্তবায়ন করতে হবে।
৪. ইসলামের মৌলিক কাজগুলোর সাথে সাথে সুন্নতে রসূলের পূর্ণ আনুগত্য করতে হবে এবং বিদ‘আত বিসর্জন দিতে হবে।
৫. নিজের ব্যক্তিগত পসন্দ-অপসন্দ এবং ভাল লাগা-নালাগা নয়, বরং আল্লাহ্‌র কিতাব ও রসূলের সুন্নতই হতে হবে আমলের মাপকাঠি।
৬. এসব নাহলে যতই ইসলামী আন্দোলনের কাজ করার দাবী করা হোক না কেন তা দিয়ে ইসলামের বিজয় কখনো অর্জিত হবেনা।


লিখেছেন আবূসামীহা 

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম