রক্ষীবাহিনী বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় হুমায়ূন আহমেদদের

 

নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এর পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান ১৯৭১ সালে পিরোজপুর মহকুমার পুলিশ প্রধান ছিলেন (সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসার, এসডিপিও)। ১৯৭১ সালের ৫ মে তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বলেশ্বর নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করে।

হুমায়ূন আহমেদের মায়ের নাম আয়েশা ফয়েজ। স্বাধীনতার পর আয়েশা ফয়েজ শহীদ পরিবার হিসেবে বাবর রোডে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছিলেন। সে বাড়ি বরাদ্দ পেতে তাকে অশেষ লজ্জা, অপমান, হেনস্থা এবং হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়েছিল সরকারি অফিসে। দিনের পর দিন ঘুরতে হয়েছে এক অফিস থেকে আরেক অফিসে। এক অফিসার থেকে আরেক অফিসারের টেবিলে ।
কিন্তু বহু কষ্টে বরাদ্দ পাওয়া সেই বাড়ি থেকে মাত্র দিন দিনের মাথায় তাদেরকে রক্ষী বাহিনী অস্ত্রের মুখে তাড়িয়ে দেয়। তাড়িয়ে দেয়ার আগে আয়েশা ফয়েজ রুখে দাড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে শত শত রক্ষীবাহিনী তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে বাড়ি অবরোধ করে। কিন্তু সে অবস্থায়ও তারা বাড়ি ছেড়ে চলে না যাওয়ায় তাদেরকে গুলি করতে উদ্যত হয় রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা। শেষ পর্যন্ত ছেলে মেয়ের জীবন বাঁচাতে শূণ্য হাতে ছেলে মেয়েদের হাত ধরে রাতের অন্ধকারে বের হয়ে আসেন রাস্তায়।

আয়েশা ফয়েজের লেখা বই ‘জীবন যে রকম’ অবলম্বনে এ পর্যন্ত হয়ত অনেকে জেনেছেন। কিন্তু রাস্তায় বের হয়ে আসার পরে কি হয়েছিল? আসুন সে বিষয়ে জেনে নেয়া যাক।

প্রথমে হুমায়ূন আহমেদের লেখা থেকেই জানা যাক।

“সদ্য দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার দয়াপরবশ হয়ে আমার মাকে বাবর রোডে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ দিয়েছে। আমরা সেই বাড়িতে বাস করি। আসবাবপত্র খাট পালঙ্ক কিছু নেই। কম্বলের ওপর শোয়া, কম্বলের ওপর বসা। বাড়িতে পানি নেই। তাতে কী? মাথার ওপর একটা ছাদ তো আছে! আমরা ভাগ্যবান, রাস্তায় বসে নেই। আমাদের সৌভাগ্য স্থায়ী হলনা। এক মধ্যরাতে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিল।

কম্বল এবং হাড়িপাতিলসহ আমি, ভাইবোল, মা, একটা আট বছর বয়সী কাজের ছেলেকে নিয়ে রাস্তায় বসে রইলাম। তিন বোনের মধ্যে দুজন ফিচ ফিচ করে কাঁদছে। মা কাঁদছেন। আমাদের কাজের চেলে জিতু মিয়া কাঁদছে চিৎকার করে। আমি অধিক শোকে পাথর। এক সময় রাত কাটবে। সকাল হবে।

এদেরকে নিয়ে কোথায় যাব? জলে ভেসে যাওয়া একটি শহীদ পরিবারকে কে আশ্রয় দেবে?
আমরা সারা রাত পথে বসে রইলাম। সকাল হল। হঠাৎ দেখি রিক্সা করে ছফা ভাই এসে উপস্থিত। তার সঙ্গে একটি কেরোসিনের টিন। মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। আমাকে বললেন, হুমায়ূন রিক্সায় উঠুন।

আমি বললাম, কোথায় যাব?

ছফা ভাই বললেন, গণভবনে যাব। নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেব। একটি শহীদ পরিবারের প্রতি যে অপমান করা হয়েছে তার প্রতিবাদ স্বরূপ এ কাজটা করব। আত্মহুতি।

কি বলছেন ছফা ভাই?

কথা বলে সময় নষ্ট করবেননা। উঠে আসুন। সঙ্গে ভারী চাদর নিয়ে এসেছি। আপনি আমার গায়ে ভালমতো চাদরটা জড়িয়ে দেবেন। যেন আগুনটা ঠিকমত লাগে।

ছফা ভাই গায়ে কেরোসিন ঢেলে জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছেন। এ খবর চারদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল।

কবি সিকান্দার আবু জাফর ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসলেন ছফা ভাইয়ের কাছে। তাকে ধমক দিয়ে বললেন, আমি ব্যবস্থা করছি। কথা দিচ্ছি এই শহীদ পরিবারের জন্য থাকার একটা ব্যবস্থা করব। তুমি কেরোসিন টিন আমার বাসায় দিয়ে এসো। আমি ভাইবোন নিয়ে আগের বাড়িতেই ওঠার সুযোগ পেলাম।”

(পুরো বাড়ি আয়েশা ফয়েজকে ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। একটি তলা দেয়া হল আয়েশা ফয়েজকে এবং নিচের তলা দেয়া হল দখলদার রক্ষীবাহিনীর মেজর হাফিজকে। এভাবে এর সমাধান করা হল এবং আয়েশা ফয়েজ তা মেনে নিলেন)।


বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পরের দৃশ্য বিষয়ে আয়েশা ফয়েজ যা লিখেছেন: হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ তার জীবন যে রকম বইয়ে লিখেছেন,

“রক্ষী বাহিনীর এই গোলমালের মাঝে যারা সাহায্যের জন্য ছুটে এলেন তার মাঝে একজন হলেন আহমদ ছফা। এই খেয়ালী মানুষটি রক্ষীবাহিনীর এমন আচরনে একেবারে ক্ষেপে গেল। চেনাজানা সমস্ত মানুষকে সে টেনে নিয়ে এল বাবর রোডে। প্রাণ নিয়ে আমরা বাসা থেকে বের হয়ে আসার পর রক্ষীবাহিনীর বীর জওয়ানেরা আমাদের বাসার সমস্ত জিনিসপত্র টেনে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। তার মাঝে চেয়ার টেবিলও আছে। রাত্রিবেলা সেখানেই সবাই বসেছে। খোলা আকাশের নিচে রাত্রিবেলায় এক রাউন্ড চাও খেয়ে নিল সবাই। সরকারি যে দলিলটির জন্য আমার আজ এতবড় লজ্জা সেটি ছফা যাবার সময় হাতে করে নিয়ে গেল। পরদিন গণকণ্ঠ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ পরিবারের ওপর নির্যাতনের এই খবরটি ছবিসহ ছাপা হল। সাথে সরকারি এলটমেন্ট বরাদ্দের ডকুমেন্টের একটি ছবি (যেটি ছফা নিয়ে গিয়েছিল হাতে করে)। আওয়ামী লীগ সরকার তখন প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছে। তাদের কিংবা রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলে সেরকম সাহস কারোর নেই। গণকণ্ঠ একমাত্র কাগজ যারা সাহস করে কিছু বলত। ”

আগের কাহিনী, রক্ষীবাহিনী তাড়িয়ে দেয় হুমায়ূন আহমেদদের:

রক্ষী বাহিনী কিভাবে হুমায়ূন আহমেদদের বাসা থেকে তাড়য়ে দিয়েছিল লেখাটি যারা মিস করেছেন তাদের জন্য এখানে আবার তা তুলে ধরা হল।

আয়েশা ফয়েজ তার জীবন যে রকম বইয়ে লিখেছেন

“বাবর রোডের বাসায় ওঠার তিনদিন পর হঠাৎ একদিন রক্ষীবাহিনী এসে হাজির হল। একজন সুবেদার মেজর জিজ্ঞাসা করল, এ বাড়ি আপনি কোথা থেকে পেলেন?
 
আমি বললাম সরকার আমাকে দিয়েছে। আমার স্বামী যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাই।

সুবেদার মেজর কিছু না বলে চলে গেল। আমার মনের ভেতর হঠাৎ করে একটা খটকা লেগে গেল।

হঠাৎ করে রক্ষীবাহিনী আসছে কেন? ক্ষানিকক্ষন পর আরেকজন সুবেদার মেজর এসে হাজির। সে একা নয়। তার সাথে বোঝাই এক ট্রাক রক্ষী বাহিনী। সবার হাতে অস্ত্র। সুবেদার মেজরের নাম হাফিজ।

ভেতরে ঢুকে বলল, এই বাড়ি আমার। শেখ সাহেব আমাকে দিয়েছেন।

আমি বললাম, সে কি করে হয়? আমার সাথে বাসার এলটমেন্ট রয়েছে।

সে কোন কথা না বলে টান দিয়ে ঘরের একটা পর্দা ছিড়ে ফেলল। সাথে আসা রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বলল ছেলে মেয়েদের ঘাড় ধরে বের কর ।

আমি এতদিনে পোড় খাওয়া পাথর হয়ে গেছি। রুখে দাড়িয়ে বলেছি, দেখি তোমার কত সাহস।
সুবেদার মেজর একটু থমকে গিয়ে কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

দেখতে দেখতে পুরো এলাকা রক্ষী বাহিনী দিয়ে বোঝাই হয়ে গেল। বাসা চারদিকে ঘেরাও হয়ে আছে। কাউকে বাসায় ঢুকতেও দেয়না, বের হতেও দেয়না। কাজল (সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ) মহসিন হলে ছিল। খবর পেয়ে এসেছে। তাকেও ঢুকতে দিলনা। সারা রাত এভাবে কেটেছে।

ভোর হতেই আমি বের হলাম। পুলিশের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলাম। পুলিশ বলল আমরা গোলামীর পোশাক পরে বসে আছি। রক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা কি করব?

বঙ্গভবন, গণভবন এমন কোন জায়গা আমি বাকি রাখলামনা সাহায্যের জন্য। কিন্তু লাভ হলনা। আমি তুচ্ছ মানুষ। আমার জন্য কার মাথাব্যথা?

রাতে ফিরে এসেছি। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবেনা। অনেক বলে ভেতরে ঢুকেছি। রাত আটটার দিকে রক্ষীবাহিনীর দল লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে গেল। ইকবাল .. আমাকে আড়াল করে দাড়াল। একজন বেয়োনেট উচিয়ে লাফিয়ে এল। রাইফেল তুলে ট্রিগারে হাত দিয়েছে। চিৎকার করে কিছু একটা বলছে। গুলি করে মেরে ফেলবে আমাদের?

আমি ছেলে মেয়েদের হাত ধরে বের হয়ে এলাম।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাকে প্রথমবার গৃহহারা করেছিল।

বাংলাদেশ সরকারের রক্ষীবাহিনী আমাকে দ্বিতীয়বার গৃহহারা করল।

মনীষী আহমদ ছফা গণকণ্ঠ পত্রিকায় পরের দিন শহীদ পরিবারের ওপর এ নির্যাতনের একটি খবর ছাপার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া তিনি শহীদ পরিবারের ওপর এই নির্যাতনের প্রতিবাদে গণভবনের সামনে গিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহুতির আয়োজন করায় পরবর্তীতে রক্ষী বাহিনী কর্র্র্র্তৃপক্ষ এর একটা সুরাহা করতে এগিয়ে আসে। রক্ষীবাহিনী প্রধান নুরুজ্জামান ওপরের তলা দিলেন আয়েশা ফয়েজকে এবং নিচের তলা দিলেন রক্ষী বাহিনীর মেজর সুবেদার হাফিজকে।

কাজল (হুমায়ূন আহমেদ) ঝামেলা মোটে সহ্য করেনা। এসব ঝামেলা দেখে সে মহসিন হলে পাকাপাকিভাবে আশ্রয় নিল। প্রতিদিন সকালে উঠে সে কাগজে খঁজত রক্ষীবাহিনী কাউকে বাসা থেকে উচ্ছেদ করেছে এরকম কোন খবর আছে কি-না। যদি না থাকে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে।

সরকারি বাড়িটি বরাদ্দ পেতে আয়েশা ফয়েজকে তখন যেভাবে হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়েছিল:

আয়েশা ফয়েজ তার বইয়ে লিখেছেন, “পেনশনের টাকা তোলার জন্য কাগজপত্র নিয়ে আবার গেলাম।

কাজলের আব্বার পরিচিত একজন এআইজি তার অধস্তন অফিসারকে ডেকে আমার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। অফিসার বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, কোন চিন্তা করবেননা স্যার। সব ঠিক করে দেব।

তার সাথে অফিসে গিয়েছি। সে রাগে ফেটে পড়ল। মুখ খিচিয়ে বলল, আপনার বেশি ক্ষমতা হয়েছে না? ভাবেন ওপরওয়াল বললেই সব হয়ে যাবে? মনে রাখবেন টাকা অত সহজে পাওয়া যায়না। টাকা যদি চান এখানে এসে খরচপাতি করবেন।

ভদ্র লোক গজগজ করতে করতে তার এক সহকর্মীকে বললেন, এই একটা নতুন দল বের হয়েছে। শহীদ পরিবার। যেখানেই যাই সেখানেই শহীদ পরিবার। জ্বালিয়ে খাচ্ছে এরা।

এইভাবে শহীদ পরিবার হিসেবে আমার এক নতুন জীবন শুরু হল। শহীদ পরিবারের প্রথম কাজ হচ্ছে ঘোরাঘুরি করা। আমার ঘোরা ঘুরি শুরু হল। এক অফিস থেকে আরেক অফিস। এক অফিসার থেকে আরেক অফিসার। সাথে থাকে ইকবাল না হয় রুহুল (আহসান হাবীব)। কাজলকে (হুমায়ূন আহমেদ) এসব কাজে নেয়া যায়না। এসব নোংরা দায়িত্ব থেকে কেমন করে যেন পিছলে বের হয়ে যায়। এভাবে আস্তে আস্তে ঘোরাঘুরিতে অভিজ্ঞ হয়ে গেলাম।

ঢাকায় থাকার জায়গার খুব সমস্যা। শহীদ পরিবারকে বাড়ি দেয়া হয়েছে শুনে তার জন্য ঘোরাঘুরি শুরু করেছি। একদিন খোঁজ খবর নিয়ে বাড়ি সংক্রান্ত একজন মন্ত্রী, নাম মতিউর রহমান, তার সাথে দেখা করতে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার মত আরো অনেকে আছেন। দীর্ঘ সময় পর মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে দেখা হল। আমাদের দেখে একেবারে ক্ষেপে গেলেন মহোদয়। পেয়েছেন কি আপনারা? প্রত্যেক দিন সকালে এসে বসে থাকেন? সকালে ঘুম থেকে উঠেই আর কত বিধবার মুখ দেখব?

আমি লজ্জায় মরে গেলাম। খোদা তুমি আমাকে আর কত অপমান সহ্য করাবে?

অবশেষে এভাবে ঘেরাঘুরি করতে করতে অশেষ লজ্জা অপমান হজম করে আয়েশা ফয়েজ শহীদ পরিবার হিসেবে একটি বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছিলেন। তার স্বামীর বন্ধু কাজী জাহেদুল ইসলাম বাড়িটি তাকে পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। জনৈক অবাঙ্গালীর পরিত্যাক্ত বাসা। ১৯/৭ বাবর রোড।

এই বাড়ি থেকেই তিনদিনের মাথায় তাদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের রক্ষীবাহিনী অস্ত্রের মুখে তাড়িয়ে দেয়। ডাক্তার মনোয়ার হোসেন নামে এক প্রতিবেশী তাদের আশ্রয় দেন ।

মনীষী আহমদ ছফা গণকণ্ঠ পত্রিকায় পরের দিন শহীদ পরিবারের ওপর এ নির্যাতনের একটি খবর ছাপার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া তিনি শহীদ পরিবারের ওপর এই নির্যাতনের প্রতিবাদে গণভবনের সামনে গিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহুতির আয়োজন করায় পরবর্তীতে রক্ষী বাহিনী কর্র্র্র্তৃপক্ষ এর একটা সুরাহা করতে এগিয়ে আসে। রক্ষীবাহিনী প্রধান নুরুজ্জামান ওপরের তলা দিলেন আয়েশা ফয়েজকে এবং নিচের তলা দিলেন রক্ষী বাহিনীর মেজর সুবেদার হাফিজকে।



হুমায়ূন আহমেদের পিতা ফয়জুর রহমান ১৯৭১ সালের ৫ মে শহীদ হওয়ার পর পিরোজপুরে তাদের সরকারি বাসা লুট হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ পিরোজপুর থানায় লুটের মামলা করেন। সে মামলার আসামির তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। বাসা লুটের মামলায় আয়েশা ফয়েজ পাকিস্তানি দু’জন সেনাকর্মকর্তাকে আসামি করেন। তারা হলেন ক্যাপ্টেন এজাজ ও লে. শহিদ।


মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে বর্তমানে যেসব অভিযোগে বিচার চলছে তাতে একটি অভিযোগ হলো সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের পিতা শহীদ ফয়জুর রহমানসহ পিরোজপুরে তিনজন সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যায় সহায়তা করা। কিন্তু আয়েশা ফয়েজ তার জীবন যে রকম বইয়ে স্বামীর হত্যা বিষয়ে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তো দূরের কথা বইয়ে তিনি মাওলানা সাঈদীর নামও উল্লেখ করেননি কোনো ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত করে। বাড়ি লুট ছাড়াও স্বামী হত্যা বিষয়ে স্বাধীনতার পর পিরোজপুরে তিনি একটি হত্যা মামলা করেন। সেখানেও তিনি দু’জন প্রধান আসামির নাম উল্লেখ করেছেন যথা ব্রিগেডিয়ার আতিক রশিদ ও মেজর এজাজ।


বাসা লুট : মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এসডিপিও ফয়জুর রহমান তার স্ত্রী আয়েশা ফয়েজ ও ছেলেমেয়েদের পিরোজপুরের সরকারি বাসা ছেড়ে নাজিরপুর থানার নিভৃত পল্লী বাবলা গ্রামে গোপন আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেন। সেখানে একদিন গোপনে পরিবারের সাথে দেখা করতে আসেন ফয়জুর রহমান। এ অবস্থায় পিরোজপুর থানার ওসি তফাজ্জাল হোসেন তাকে অভয় দিয়ে পিরোজপুর আসার জন্য চিঠি লেখেন।।


চিঠিমোতাবেক পিরোজপুর হাজির হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ৫ মে ফয়জুর রহমানকে বলেশ্বর নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করা হয়।


স্বামী হত্যার খবর পাওয়ার সাথে সাথে আয়েশা ফয়েজ সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে একা ছুটে যান পিরোজপুর। ওসি তফাজ্জালসহ স্বামীর অফিসের অধস্তন কর্মকর্তা, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান খান বাহাদুর সৈয়দ মো: আফজাল, সবার সাথে দেখা করে স্বামীর বিষয়ে সঠিক খবর জানতে চান। কিন্তু সবাই তার কাছে স্বামী ফয়জুর রহমান হত্যার কথা গোপন রাখে। স্বামীর ব্যাপারে কোনো সন্ধান না পেয়ে আয়েশা ফয়েজ ফিরে আসেন পিরোজপুর তাদের সরকারি বাসায়। সে বাসা লুট হওয়া বিষয়ে তিনি তার বইয়ে যা লিখেছেন তা এখানে তুলে ধরা হলো।


‘আমি একা বাসায় বসে আছি। রাতে ঘরদোর গুছিয়ে বাসায় বসে থাকলাম। ...কিন্তু সে (স্বামী ফয়জুর রহমান) আর আসে না। ভোর হতেই সবাই আমাকে চাপ দেয় চলে যাবার জন্য। .... আমি তখন বাসা ছেড়ে বাচ্চাদের কাছে যাবো বলে ঠিক করলাম। আমি আবার ঘর পরিষ্কার করে দিলাম। কাজলের (হুমায়ূন আহমেদ) বাবা যদি ফিরে আসে তার জন্য পরিষ্কার কাপড় আলনায় ঝুলিয়ে দিলাম। বিছানায় নতুন চাদর দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিলাম। রিকশা নৌকাঘাটে পৌঁছানোর আগেই মিলিটারিরা সদলবলে এসে আমার বাসা লুট করে নিল। আমার এত দিনের সংসার, কাজলের আব্বার শত শত বই, তার লেখা অপ্রকাশিত বইয়ের পাণ্ডুলিপি, বাচ্চাদের ছেলেবেলার স্মৃতি সব কিছু তছনছ হয়ে গেল। রাস্তার মানুষ ডেকে মিলিটারি আদেশ দিলো সব কিছু লুট করে নিয়ে যেতে।’
তাদের আশ্রয় দেন।

আয়েশা ফয়েজের ‘জীবন যে রকম’ বই (হুমায়ুন আহমেদের মা এর আত্মজীবনী)


একান্ত সাক্ষাৎকারে হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ
আয়েশা ফয়েজের জীবনসংগ্রামের কথা, তিন ছেলের লেখক হয়ে ওঠার খণ্ডস্মৃতি এবং আত্মজীবনী লেখার পটভূমি উঠে এসেছে একান্ত সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তায়েব মিল্লাত হোসেন

[২০০৮ সালের কথা। আয়েশা ফয়েজের ঢাকার স্মৃতিও রেখেছিলাম এই সূচিতে। এ রত্নগর্ভার স্মৃতি সংগ্রহের দায়িত্ব বর্তায় আমার কাঁধে। আমার ব্যক্তিগত আগ্রহও কম ছিল না। কারণ ওই বছর একুশে বইমেলায় আয়েশা ফয়েজের আত্মজীবনী 'জীবন যে রকম' বের হয়। যার জন্য একটি পত্রিকার হয়ে এ আত্মজীবনী রচনার পটভূমি জানতে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারও নিতে হয় আমাকে। ]

তায়েব মিল্লাত হোসেন : ১৯৭১ সালে আপনার স্বামী ফয়জুর রহমান আহমেদ পিরোজপুর মহকুমার সাব-ডিভিশনাল অফিসার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি হিসেবে পুলিশের অস্ত্রভাণ্ডার থেকে ২০০ রাইফেল স্থানীয় জনগণকে তিনি দিয়ে দেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে হত্যা করে ৫ মে। এমন একটা সময়ে ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে আপনার অবস্থা কী?

আয়েশা ফয়েজ : যুদ্ধের সময় জীবনের ওপর দিয়া ঝড়-তুফান গেছে। পিরোজপুরে মিলিটারির হাত থেকে বাঁচতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে পালিয়ে থেকেছি। শেষে আব্বা আমাদের মোহনগঞ্জে নিয়া এলেন। স্বাধীনতার পরে প্রথমে পিরোজপুরে গেলাম কাজলের (হুমায়ূন আহমেদ) বাবার কবর দেখতে। কবরটা ছিল রাধানগর নদীর পারে। ইকবাল (মুহম্মদ জাফর ইকবাল) তার বাবার কবর খুঁড়ে ডেডবডি বের করে। ডেডবডি পিরোজপুরে আনা হয়। সেখানে জানাজার পর মাটি দেওয়া হয়।
তায়েব মিল্লাত হোসেন : আপনি নাকি মামলা করেছিলেন...।

আয়েশা ফয়েজ :
তখন পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে প্রমাণসহ ১২টা কেস হইছিল। একটা ছিল আমার। কাজলের বাবার হত্যাকারী কর্নেল আতিক রশীদ ও মেজর এজাজের বিরুদ্ধে কেস করছিলাম। তারা দাঁড়াইয়া থাইকা আমাদের বাড়িঘর লুট করাইছে। তারাই কাজলের বাবারে গুলি কইরা মারছে। কিন্তু কিছুই হয়নি। সরকার সবারে ছেড়ে দিল। সব সরকারের কাছে আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে যাব।
তায়েব মিল্লাত হোসেন : সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় আসেন কবে? কোথায় উঠেছিলেন?

আয়েশা ফয়েজ : ১৯৭২ সালে প্রথম ঢাকায় আসি। সে সময় সন্তানদের নিয়ে অনেকটা উদ্বাস্তু-জীবন গেছে। পিরোজপুরের ঘরবাড়ি আগেই লুট করছিল। আমার টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি কিছু ছিল না, ছিল বই। বইগুলো আলমারি খুলে নিয়ে গেছে, যার যা খুশি। স্বাধীনতার পরে শহীদ পরিবার হিসেবে মোহাম্মদপুরে বাড়ি দিল সরকার। তিন দিন পর সেই বাড়িতে রক্ষীবাহিনী এসে হাজির। আমার মতো মানুষরে উচ্ছেদ করতে ট্রাকভর্তি অস্ত্রশস্ত্র আনছে! সুবেদার মেজর হাফিজ আমাদের বাসার পর্দাটর্দা ছিঁড়া ফেলল। অশালীনভাবে আমাদের উচ্ছেদ করল। এ সময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়াইল আহমদ ছফা। রক্ষীবাহিনীর অন্যায়ের প্রতিবাদে কেরোসিন ঢাইলা নিজের গায়ে আগুন ধরাইয়া দেওয়ার হুমকি দিল সে। পাশের বাসাতেই থাকতেন ডা. মনোয়ার হোসেন। রাতে তাঁর বাড়িতে রইলাম। পরের দিন একটা বাসা খুঁজে সেই ভাড়া বাসায় উঠে গেলাম। আহমদ ছফা সরকারি বাড়ি পাওয়ার জন্য তখনো চেষ্টা করছিল। তার উদ্যোগেই কাজ হলো। কয়েক দিন পর মনোয়ার হোসেন আমার বাসায় এলেন। বললেন, 'আমি আপনাকে নিতে এসেছি। রক্ষীবাহিনীর হেড নুরুজ্জামান আপনাকে সালাম দিছেন।' আমি যেতে চাইলাম না। ডাক্তার সাহেব আমাকে বোঝালেন, 'এখন মান-অভিমানের সময় নয়। আমারও বাবা মারা গেছে অল্প বয়সে। কত ঝামেলা গেছে আমার ওপর দিয়া। বাচ্চাকাচ্চাদের দিকে চাইয়া আপনি মাথা ঠাণ্ডা রাখেন।' রক্ষীবাহিনীর প্রধান ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি ভদ্রভাবে বলাতে ওই বাসারই ওপরতলায় কিছুদিন রইলাম। এরপর আবার ওপরতলা নিয়া লাগল। এ আসে, সে আসে বাড়ির দাবি নিয়ানানাভাবে বেইজ্জত করছে দেখে সরকারি বাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাবর রোডেই বাসা ভাড়া নিলাম। এর পরও অনেকে সরকারি বাড়ির চেষ্টা করতে লাগল। সরকারি বাড়ির শখ তত দিনে আমার মিটে গেছে। তাই আমি তাদের মানা করি। তারা বিরক্ত হয়ে বলে, 'সরকার শহীদ পরিবারের সম্মানে বাড়ি দিছে। আপনি নেবেন না কেন?' তারা আমার সই-টই জোর করে নিয়ে যায়। ওই সময়কার আইজি বলেছিলেন, 'আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন, সরকার থেকে আপনাকে বাড়ি দেওয়া হবে।' সরকারি কোনো বাড়ি আমাদের জন্য রেডি হইলেই অন্য কোনো শহীদ পরিবার আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করত, আমি তাদের দিয়ে দিতাম। আমার ছেলেরাও বলত, অনেকেই তো সরকারি বাড়ি পায়নি। সেসব শহীদ পরিবার সরকারি বাড়ি ছাড়া টিকে থাকতে পারলে আমরা পারব না কেন! ১৯৮৮ সালে সরকার পল্লবীর এই দোতলা বাড়িটা দিছে। অ্যালটমেন্ট আছে, কিন্তু পুরোপুরি বুঝাইয়া দেয়নি। আমার ছেলেরা কারও কাছে সমস্যার কথা কোনো দিন বলবে না। এইডা নিয়া আমিই ঝুইলা আছি ।


তায়েব মিল্লাত হোসেন : ঢাকায় যখন এলেন, তখন আপনার পরিবারে রোজগারের কেউ নেউ, তখন সংসার চলত কী করে?

আয়েশা ফয়েজ : ঢাকায় আমার সব ভয়ংকর ভয়ংকর স্মৃতি। এখনো বসে বসে ভাবি, কিভাবে তখন সময় গেছে। আমার বাবা এবং তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী আমার ছোট ভাই নজরুল ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের একটি দলের হাতে মারা যান। পাকিস্তানি মিলিটারিরা বাবাকে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হতে বাধ্য করেছিল। সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল, তারা গা-ঢাকা দিল। বাবা গা-ঢাকা দিলেন না। তিনি তাদের কোনো সহযোগিতা করেননি, বরং অসংখ্য মানুষকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন, অনেককে মুক্তিযুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেছেন; তাঁদের কেউ কেউ মুক্তিবাহিনীতে যোগও দিয়েছেন। তিনি কেন গা-ঢাকা দেবেন? আমি বাবাকে কাছ থেকে দেখেছি। তাই জানি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য তাঁর মনে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল নাআমার বাবা, ভাই মারা গেছেন, সব অন্ধকার। ঢাকায় এসে প্রথমে দেখা করেছিলাম পুলিশের আইজি খালেক সাহেবের সঙ্গে। তিনি বললেন, 'আপনার স্বামী ভালো মানুষ ছিলেন। জানি, উনি ১০ টাকাও আপনাদের জন্য রেখে যাননি। আপনি চিন্তা করবেন না; পেনশন, গ্রুপ ইনস্যুরেন্সের টাকা যেন তাড়াতাড়ি পেয়ে যান তার ব্যবস্থা করব।' তখনই দুই হাজার টাকার একটা চেক দেওয়া হলো। পেনশনের টাকা তোলার জন্য কাগজপত্র নিয়ে আবার গেলাম। এবার কাজলের আব্বার পরিচিত একজন এআইজি তাঁর অধস্তন অফিসারকে ডেকে আমার সব বুঝিয়ে দিলেন। পরে সেই অধস্তন অফিসারের কাছে গিয়েছি, তিনি কাগজপত্রে চোখ বুলানোর আগেই রাগে ফেটে পড়লেন। বললেন, 'আপনার বেশি ক্ষমতা হয়েছে? ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবেন? ভাবেন ওপরওয়ালারা বললেই কাজ হবে? মনে রাখবেন, টাকা এত সহজে পাওয়া যায় না।' একটা ফাইল হাতে তুলে বললেন, 'এই দেখেন, পাঁচ বছর আগে মারা গেছে, এখনো টাকাপয়সা পায় নাই। টাকাপয়সা পাওয়া এত সোজা না। টাকা যদি চান তাহলে এখানে এসে কান্নাকাটি করবেন, খরচাপাতি করবেন। বড় সাহেবদের কাছে গিয়ে কোনো লাভ নেই।' পেনশনের টাকা তোলার জন্য ঘোরাঘুরি শুরু হলো। আমার সঙ্গে থাকে ইকবাল, না হয় ছোট ভাই রুহুল। কাজলকে নেওয়া যায় না, এসব বৈষয়িক দায়িত্ব থেকে কেমন করে যেন পিছলে বের হয়ে যায়। এক অফিস থেকে আরেক অফিস, এক অফিসার থেকে আরেক অফিসার। এভাবে ঘুরে ঘুরে কত রকমের মানুষ যে দেখলাম। হুমায়ূনের নাম নিয়াও ঝামেলা হইল। ওর বাবা প্রথমে নাম রাখছিলেন শামসুর রহমান। সেই নামটাই ছিল ওর বাবার অফিসের কাগজপত্রে। কিন্তু পরে আবার নাম রাখে হুমায়ূন আহমেদ। এসব ঝামেলা শেষে একসময় পেনশন পাইলাম। মাসে ১৪২ টাকা। ২০০ টাকা দিত আরেকটা কী যেন, এই ছিল আয়। ঢাকায় মানুষের অনেক খারাপ ব্যবহার পেয়েছি। টাকাপয়সার জন্য যার কাছে গেছি, সে-ই খারাপ ব্যবহার করছে। কাজলের বাবার পেনশনের দুই হাজার টাকা তুলতে গেলে ৫০০ টাকা ঘুষ দিতে হতো। তবে প্রতিবেশী ডা. মনোয়ার হোসেন ওই সময়ে আমার অনেক উপকার করছেন।

তায়েব মিল্লাত হোসেন : পেনশনের বাইরে আর কোনো আয় ছিল না? আপনি নিজে কোনো কাজ করতেন?

আয়েশা ফয়েজ : আমি সেলাই করতাম। প্রচুর সেলাই করতাম। একটা সমিতি থেকে ১০০ থেকে ১২০টি কম্বল দিত। সেগুলো কেটে বাচ্চাদের শীতের পোশাক বানাইতাম। দিনে নানা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতাম, রাতে সেলাই করতাম। সেলাইকাজ করে যখন যা পেতাম সংসারে খরচ করতাম। ইকবাল টিউশনি করত, টিভিতে প্রোগ্রাম করত, কিভাবে টাকাপয়সা ম্যানেজ করা যায় সেই চেষ্টা করত। ইকবাল যখন পাস করে আমেরিকা গেল, তখন আমাদের একটু দাঁড়ানোর জায়গা হয়েছে। পরের বছর হুমায়ূন গেল। তারা টাকা দিতে আরম্ভ করল। ইকবাল তো ১৮ বছর দেশের বাইরে ছিল। হুমায়ূন ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করেছে। তখন টাকাপয়সার কষ্ট কমে গেছে। মনের কষ্ট ছাড়া আর কোনো কষ্ট ছিল না। ওই সময় হুমায়ূনের বিয়ে বহুদিন পরে আমাদের আনন্দ এনে দিয়েছিল। দুঃখ-কষ্ট ভুলে একটা নতুন জীবন শুরু করেছিলাম। আমার ছেলেমেয়েরা নিজেদের চেষ্টায় নিজেরা দাঁড়াইছে। ওরা কোনো দিন প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়েনি। ওরা স্বার্থপর না। হুমায়ূন তো ভাইবোনের জন্য যতটুকু ওর সামর্থ্য ছিল করছে। বাবা না থাকার কষ্টটা ভোলানোর জন্য ভাইবোনকে ঘোরানো-বেড়ানো সবই করছে।

তায়েব মিল্লাত হোসেন : একাত্তর-পরবর্তী সময়ে আপনার সন্তানদের জীবনচিত্র কেমন ছিল? এ নিয়ে একটু বলুন।

আয়েশা ফয়েজ : তখন দেশের মধ্যে খুব অরাজকতা। পাড়ার বেশির ভাগ ছেলেপেলেই উচ্ছৃঙ্খল। যখন-তখন বাসায় ঢুকে পড়ে। আমার চিন্তা, দলবলের সঙ্গে মিশে ছেলেরা না জানি কী হয়! তবে ওরা পড়াশোনা করত। আমি বলতাম, তোমরা সংসারের চিন্তা কোরো না, পড়াশোনা করো। সংসার আমি দেখব। আমি ধর্মভীরু মানুষ। ওদের জন্য খতম-টতম পড়তাম, দোয়াটোয়া করতাম। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। কাজলের আব্বা বেঁচে থাকলেও ওরা এর বেশি আর কী করত। তাঁরও শখ ছিল ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে। আমাদের যুগে তো পড়াশোনার গুরুত্ব অত ছিল না, আমি খুব বেশি পড়াশোনা করিনি। তিনি আমাকেও পড়াশোনা করতে বলতেন। তিনি বলতেন, 'বাচ্চারা যখন ইংরেজিতে কথা বলবে, তখন তো তোমাকে চুপ করে থাকতে হবে।' এসব বিষয় নিয়ে মজা করতেন। তিনি পুলিশ অফিসার হলেও খুব রসিক ছিলেন। উনি জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করতেন। আমরা, বিশেষ করে আমি বিশ্বাস করতাম না। পরে দেখলাম, যা যা বলছেন তার অনেক কিছু হইছে। হুমায়ূন সম্পর্কে বলতেন, 'অনেক বিখ্যাত হবে তোমার ছেলে! জান, রানি এলিজাবেথের ছেলে আর তোমার ছেলের জন্ম একই দিনে, একই লগ্নে।' আমি বলতাম, কই রানি এলিজাবেথ আর কই আমি। তিনি বলতেন, 'রানির ছেলে বিখ্যাত হবে তার বাবা-মায়ের নামে। আমার ছেলে হবে নিজের যোগ্যতায়।' হুমায়ূনের যেকোনো দুষ্টুমির মধ্যেও বিশেষ কারণ খুঁজে পেতেন ওর বাবা। হুমায়ূন সারা দিন কই কই ঘুরত। আমি কিছু বললে ওর বাবা বলতেন, 'প্রমথনাথ বিশি এরকম ছিলেন, কাজলের ভেতরে অন্যরকম কিছু আছে।' 'নন্দিত নরকে'র পাণ্ডুলিপি ওর আব্বাও পড়েছিলেন। দেখে বলেছেন, 'তোর হবে।' তখন হুমায়ূন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইছে। আজকে ওরা আমার মতো সাধারণ মানুষের কাছে না আইসা ওর আব্বার কাছে আসলে কত কিছু বলতেন! কত খুশি হইতেন!
ভাইবোনের সাথে হুমায়ুন আহমেদ
তায়েব মিল্লাত হোসেন : আপনাদের বাসায় পড়াশোনা ও সাহিত্যচর্চার পরিবেশ কী আগে থেকেই ছিল?
আয়েশা ফয়েজ : মুক্তিযুদ্ধের সময় শাহীন (আহসান হাবীব) তো বাচ্চা ছিল। যুদ্ধের পরে কয়েক বছরের মধ্যে সরকারি বা ভাড়া বাড়ি কয়েকবার চেঞ্জ করতে হইছে। মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, বেইলি রোড, দিলু রোড_কত জায়গায় থাকছি! সাতটা স্কুল চেঞ্জ করে শাহীন ম্যাট্রিক পাস করছে। নিজে খুঁজে খুঁজে স্কুল বের করে ভর্তি হইত। শাহীন অনেক কষ্ট করছে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে রেশন তুলেছে, বাজার করেছে_এর মধ্যে আবার পড়াশোনা করে মানুষ হইছে! আমার সব ছেলেমেয়েই ছবি আঁকতে পারত। সবাই বই পড়ত। ইকবালের প্রিয় লেখক ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। একদিন বাসায় এসে জানাল, মানিকসমগ্র বের হইছে, পুরো সেট ৩০০ টাকা। ৩০০ টাকা তখন অনেক টাকা। কিনতে পারবে না বলে সে হাতাইয়া আসছে। আমি ইকবালকে টাকা দিলাম। বাসায় মানিকসমগ্র আসার পর অন্যরকম এক পরিবেশ। আমি, আমার ছেলেমেয়েরা যে যেখানে যে অবস্থায় আছে, সবাই মানিকের বই পড়ছি। আমার ছেলেদের লেখক হওয়ার জন্য আলাদা কোনো পরিবেশ লাগেনি। বাচ্চারা আশপাশে খেলাধুলা করলেও তাদের লেখালেখিতে কোনো সমস্যা হয় না।

তায়েব মিল্লাত হোসেন : এখনকার ঢাকার মানুষের জীবন আর আগের ঢাকার জীবনের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান?

আয়েশা ফয়েজ : এখন দেখি মায়েরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়া ব্যস্ত। আমাদের সময় এ রকম ছিল না। আমার ছেলেমেয়েদের কোনো প্রাইভেট টিউটর ছিল না। তারা প্রাইভেট টিউটর ছাড়া এমনেই ভালো রেজাল্ট করছে। মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়, আমি ঘুমাইছি আর ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার ছেলেমেয়েরা সব মানুষ হইয়া গেছে। এখনকার মায়েদের মধ্যে দেখি প্রাইভেট টিউটর নেওয়ার প্রতিযোগিতা। সকালবেলা বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে দৌড়াচ্ছে। নিজেরা স্কুলে বসে থাকে। এখনকার মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে পেরেশান।
তায়েব মিল্লাত হোসেন : ছেলেমেয়েরা যখন ছোট, তখন ঢাকার কোথাও বেড়াতে যেতেন না?

আয়েশা ফয়েজ : তখন ঢাকায় আমাদের তেমন কোনো বেড়ানোর জায়গা ছিল না। কোনোদিন কোনো পার্কে, জাদুঘরে বেড়াতে যাইনি। যাত্রাবাড়ীতে ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে যেতাম। আমার এক মামা ছিলেন, উনি জীবন বীমায় চাকরি করতেন। তাঁর বাসায়ও বেড়াতে যেতাম। এখন তো একই বিল্ডিংয়ের কেউ কাউকে চিনে না। আমার সঙ্গে অনেক প্রতিবেশীর পরিচয় ছিল। আমার সঙ্গে কারও বিরোধ ছিল না। জীবনে অনেক ভালো মানুষের সঙ্গে পরিচয় হইছে।

তায়েব মিল্লাত হোসেন : আপনার বই 'জীবন যে রকম' নিয়ে কিছু বলুন। আত্মজীবনী হঠাৎ করেই লিখেছেন, নাকি আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল?

আয়েশা ফয়েজ
: ১৯৯১ সালে আমেরিকায় ইকবালের ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সারা দিন করার কিছু থাকত না। ইকবালের মুক্তিযুদ্ধের একটা বই কম্পোজ করে কম্পিউটারে লেখা শিখে ফেললাম। তখন ইকবাল বলল, আপনার জীবনে তো অনেক ঘটনা, সেগুলো লিখে ফেলেন। হুমায়ূনের আব্বা থাকতেই গল্প লেখতাম। সেসব বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও পুলিশের পত্রিকা 'ডিটেকটিভ'-এ ছাপাইত। পটুয়াখালীতে ঘরবাড়ি লুট হওয়ার সময় সব হারিয়ে গেছে। হুমায়ূনের আব্বার বিভিন্ন লেখার পাণ্ডুলিপিও জ্বালাইয়া দিছে। আমেরিকায় থাইকাই বইটা লিখছিলাম। পাণ্ডুলিপি বহুদিন আমার কাছেই ছিল। হঠাৎ ইকবালের মাথায় এলো, বই ছাপি। কোনো দিন ভাবি নাই বই হবে। ছেলেরা লেখে, আমারও বই বের হলো। আমার শরম লাগে! সবাই চাপ দিচ্ছে বাকি জীবনের ঘটনা লেখার জন্য। নতুন করে লিখতে পারব বলে মনে হয় না। তখন কম্পিউটার শিখে শখে শখে লিখছি। এখন কোনো কাজ নাই, বইটই পড়ে সময় কাটে। আগে নাতি-নাতনিদের আমিই মানুষ করছি। আমার বইটা পড়ে শাহীনের মেয়ে এষা বলতেছে, তুমি আমাদের কথা লেখ নাই। লিখব কী, তখন তো তাদের জন্মই হয় নাই। বড় মেয়ে শেফুর মেয়ে (অপলা হায়দার) ফোন করে কাঁদছে, নানার মৃত্যুর ঘটনা পড়ে তার খুব কষ্ট হইছে।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম