ঈদের দিন সকাল ৭টা। সবাই যখন গোসল করে নতুন জামা কাপড় পরে ঈদগাহে যেতে ব্যস্ত ঠিক তখই আনোয়ারা বেগম ছেলের রক্তমাখা শার্ট আর পায়ের জুতা জড়িয়ে ধরে বলছে মোস্তফা মোস্তফা ওঠ। দেখ বাবা সবাই ঈদে যাচ্ছে তুমি যাবা না। সিমাই খাবা না। বাবা ওঠ। চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে আমার মোস্তফা কই। আমার কাছে আসে না কেন। ছেলেকে ডাকতে ডাকতে মায়ের বুক যেন ক্ষত হয়ে গেছে। তাই মুখ দিয়ে অঝরে রক্ত ঝরছে। ডাক্তার বলছে অনেক টাকার প্রয়োজন। বিদেশে দেখাতে হবে। আর্থিক দৈন্যতার কারণে শহীদের মায়ের চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর সাতক্ষীরার সার্কিটহাউজ মোড়ে সরকারি পেটুয়াবাহিনীর হাতে নিহত হন ছাত্রশিবিরের সাথী দেবহাটা উপজেলার কুলিয়া শষাডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল মজিদের পুত্র শহীদ আলী মোস্তফা। স্বজন হারানো এ পরিবারটির ঈদ কেটেছে চোখের পানিতে। ঈদের দিনের প্রতিটি আহার ছিল পরিবারটির এক বেদনা। এমন ঈদ আর কোনদিন দেখেনি পরিবারটির সদস্যরা।
কেমন কাটল সদরের পায়রা ডাঙ্গা গ্রামের শাহিন আলমের পরিবারের ঈদ। জানতে চাইলে শাহিনের একমাত্র ছোট বোন ১০ম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী দিতিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে, ভাইয়া আমাদের আর ঈদ। যে ভাই প্রতিবছর আমাকে নিয়ে শহরে যেয়ে আমার পছন্দের জামা-কাপড় কিনে দিতেন সে ভাই আজ রক্তে রঞ্জিত লাল জামা পড়ে কবরে শুয়ে আছেন। সেই ভাইকে ছাড়া কি ঈদের আনন্দ করা যায়। ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে তিনি শহীদ হন। শহীদের আম্মা বলেন, বাবা ২১ বছরের মধ্যে আমার আদরের ছেলে শাহিন কোনোদিন পান্তা ভাত খায়নি। তাকে কোনোদিন একটি চড়ও মারিনি। সেই ছেলেকে ছাড়া আমরা ঈদ করব কিভাবে। একই অবস্থায় ঈদ কেটেছে শহীদের প্রতিবেশিদেরও। পরিবারটিকে সাহায্য করতে স্বয়ং ১ লাখ টাকা দিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। এছাড়া বিভিন্ন মহল থেকে আরো কয়েক লাখ টাকার অনুদান পরিবারটিকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু একটি টাকাও গ্রহণ করেনি পরিবারটি। শহীদের মায়ের কথা আমার ছেলেকে আমার কাছে ধরে রাখতে পারলাম না টাকা নিয়ে কি হবে। সমস্ত টাকা এলাকার বিভিন্ন মসজিদে দান করে দেয় তারা।
৪ মার্চ কলারোয়ার ওফাপুরে বিজিবির গুলীতে নিহত দু’সহদর ভাই আরিফ বিল্লাহ ও রুহুল আমিনের পরিবারে ঈদ কেটেছে অজানা আতঙ্কে। পরিবারের একমাত্র উপার্জন ক্ষমতাকে হারিয়ে পরিবার দুটির অন্যান্য সদস্যরা ঈদ কাটিয়েছে একটু ভিন্নভাবে। নতুন জামা-কাপড় যেন শহীদের স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাই ঈদের নামায পড়েই পরিবারের সকলকে নিয়ে কবরের পাশে গিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে শহীদের সন্তানেরা। শহীদ রুহুল আমিন ও শহীদ আরিফ বিল্লাহর বড় ভাই মিজানুর রহমান জানান, আমার মায়ের ইচ্ছা ছিল শহীদের মা হওয়ার জন্য। হয়তবা আল্লাহ আমার মায়ের সেই আশা পুরণ করেছে।
একই দিনে বিজিবির গুলীতে নিহত কলারোয়ার ওফাপুর গ্রামের শামসুর রহমানের স্ত্রীর ঈদ কেটেছে বাড়ির পাশে দেয়া স্বামী কবরের পাশে। ঈদের প্রতি মুহূর্তের আনন্দ ছিল যেন স্বামীর স্মৃতি বক্ষে নিয়ে। রক্তমাখা জামাটি আজ যেন সেই দিনে স্মৃতিকে তাড়া করে বেড়ায়। নতুন শাড়ি পরা যেন তার কাছে অভিশাপ। তার একটাই দাবি এ সরকারের পতন কবে হবে। কবে পাবে তার স্বামী হত্যার বিচার। তার স্বামীর খুনি স্থানীয় আ’লীগ নেতা আজও তাদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। হত্যার ঘটনায় থানাও মামলা নেয়নি বরং উল্টা তাদের হত্যা মামলার আসামী করা হয়েছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলী ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের হাতে যে ক’জন শহীদ হন তার মধ্যে আশাশুনি উপজেলার খাজুরা ইউনিয়নের তুয়ারডাঙ্গা গ্রামের মৃত মাহাবুদ্দিন মোল্লার ছেলে আব্দুস সালাম অন্যতম। শাহাদাতই ছিল তার জীবনের একমাত্র কাম্য। ১৩ ভাইবোনের মধ্যে সে ছিল সবার বড়। শহীদের আগে তিনি পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে চিরবিদায় নেন। ঘটনার দিন সকালে তিনি শেষ গোসল করেন। নিজের হজ্বকৃত পোশাক পরিধান করেন। নেমে পড়েন মাওলানা সাঈদীর রায়ের প্রতিবাদে জামায়াতের ডাকা হরতালের পিকেটিংয়ে। পিকেটিংয়ের একপর্যায়ে ঘোষণা আসল যে কোনো মুহূর্তে সাঈদীর রায় ঘোষণা হবে। ছুটে আসে বাড়িতে। কিন্তু বাসায় বিদ্যুৎ না থাকায় বিভিন্ন জায়গায় মোবাইল করতে থাকে। একপর্যায়ে আল্লামা সাঈদীর ফাঁসির রায় শুনে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। এ যেন আপনজন হারানোর কান্না। আর বলতে থাকেন আল্লাহ মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে আল্লাহ যেন আমাকে তুলে নেন। নিজ চোখে সাঈদীর ফাঁসি দেখার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল। এ কথা বলতে থাকে পরিবারে সকলের সাথে। এ সময় তিনি আরো বলেন, আমি যদি আজ শহীদ হতে পারি তাহলে তোমরা আমার গোসল দিবে না। আব্দুস সালাম শহীদ হলেন। তার লাশকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে দুশমনেরা। সেই পরিবারটিকে ঈদের কথা বলা মাত্রই একটি সুর ভেসে আসে তার মোবাইল থেকে শুধু কান্নার আওয়াজ। বেশি কিছু না জিজ্ঞাসা করেই বুঝে নিতে হল ঈদ আনন্দ। খুনি এই সরকারের বিচার হবে এমনটাই আশা করছেন পরিবারটি।
সদর উপজেলার ঘোনা ইউনিয়নের ছুনকা গাজীপুর গ্রামের আনারুল মোড়লের ছেলে শহীদ রবিউল ইসলামের পরিবারে ঈদের আনন্দ বলে কিছুই নেই। ৩ বছরের অবুজ ছেলের ভাগ্যে জুটেনি ঈদে পিতার মমতা। জুটবে বা কি করে। বর্তমান সরকারের পেটোয়া বাহিনী ২৮ ফেব্রুয়ারি নির্মমভাবে তার জীবন কেড়ে নিয়েছে। পুত্রের হত্যার দায়ে পিতাকে হত্যা মামলার আসামী হতে হয়েছে। কেমন নিষ্ঠুর নির্মম সরকারের পুলিশবাহিনী।
আগরদাড়ি এলাকার হরিশপুর গ্রামের আব্দুল বারীর ছেলে শিবির কর্মী ইকবল হাসান তুহিনকে হারিয়ে এই প্রথম ঈদ করল তার পরিবার। সারাদিন যেন তার মায়ের চোখে তুহিনের স্মৃতি ভেসে উঠে। প্রতি ঈদে তুহিন তার মায়ের জন্য খাবার কিনে আনতো। আর বলত মা মা দেখ আমি তোমার জন্য কি এনেছি। এবার আর কেউ এমনভাবে বলেনি বলে জানালেন তার মা।
বালিয়া ডাঙ্গাগ্রামের আবুল হাসান। সারা জীবনই ছিল যার শহীদি বাসনা। তাই মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির রায় শুনে ৯ মাসের কন্যা, স্ত্রীর বাধা আর মায়ের দোয়া নিয়ে জনতার প্রতিবাদ মিছিলে সামিল হন হাসান। কিছুক্ষণের মধ্যে তার বুক ঝাঝরা করে দিল সরকারের পেটোয়া বাহিনী। সেই দিনের সেই স্মৃতি আজও তাড়া করে চলেছে পরিবারটিকে। তাই ঈদের দিন রান্না-বান্না ফেলে রেখে বেশিরভাগ সময় ধরেই কবরের পাশে গিয়ে কেঁদেছেন শহীদ আবুল হাসানের মা।
খানপুরের শহীদ সাইফুল্লাহ, রইসপুরের মাহবুবুর রহমানের পরিবারের ঈদের আনন্দ বলে কিছুই ছিল না। তারা সারাক্ষণই হারানো বেদনার ক্ষত নিয়ে এবারের ঈদ কাটিয়েছে।
১৬ জুলাই কালিগঞ্জে পুলিশের গুলীতে নিহত আরিফ বিল্লাহর পরিবারে ঈদ কেটেছে কান্নার মধ্যে। মাত্র কয়েকদিন আগেই পরিবারটি তাদের বড় ছেলেকে হারিয়েছে। সেই পরিবারের অন্য সদস্যদের ঈদের আনন্দ বৃথা।
শহীদ আরিফ বিল্লাহর গর্বিত পিতা মাস্টার আফসার উদ্দীন জানালেন, আমার কোল থেকে এ জালিম সরকারের পেটোয়া বাহিনী আমার আদরের ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে। আমি এর বিচার দেখে যেতে চাই। শহীদের মা রাফিজা বেগম বলেন, আমার ছেলের বুক যারা ঝাঝরা করে দিল আল্লাহ যেন তাদের বিচার করেন।
একই দিনে কালিগঞ্জে পুলিশের গুলীতে নিহত রুহুল আমিনের ইয়াতিম ৩ ছেলে ও বিধবা স্ত্রীর ঈদ কেটেছে একটু ভিন্ন ধারায়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষমকে হারালেও দেশ বিদেশের অগণিত মানুষের ভালবাসা পেয়েছে পরিবারটি। দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় পরিবারটির ওপর একটি প্রতিবেন প্রকাশিত হয়। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ইসলামপ্রিয় জনগণ। অনেকে নিজেদের ঈদের কেনাকাটা বাদ দিয়ে পরিবারটিকে সাহায্য করেছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ টাকার আর্থিক সাহায্য পেয়েছে পরিবারটি। পরিবারটি দৈনিক সংগ্রামকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ধন্যবাদ জানান।
জেলাতে ১৩ শহীদ পরিবারের ক্ষত বয়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষের এবারের ঈদ মলীন করে দিয়েছে সরকারের রাজনৈতিক সহিংসতা।
সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি নুরুল হুদা জানিয়েছে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পাশা পাশি অগণিত মানুষ শহীদ পরিবারগুলোকে সাহায্য করেছে। অনেকে শহীদ পরিবারের ঘরবাড়ি তৈরি করে দেয়া, শহীদ সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালানোসহ শহীদের স্ত্রীদের মাসিক আর্থিক সাহায্য করে যাচ্ছে। সরকারের দমন-নিপীড়নে এদেশের ইসলামপ্রিয় মানুষ কোনোদিন পিছু হটবে না। শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এ দেশে একদিন শান্তির বাতাস বইবে এমনটাই আশা করছে হাজারো সাঈদীভক্ত প্রেমিকরা।
সাতক্ষীরার ১৩ শহীদের ক্ষত (২০১৩)
☼→
শাহাদাৎ
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: