‘ক্রসফায়ার’ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড


আমাদের দেশে যারা কমবেশি রাজনীতির খবরবার্তা রাখেন, আমার ধারণা আপনারা সবাই একটি বিষয় সম্পর্কে অবগত। বিষয়টি হলো, ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি একটি ওয়াদা করেছিল, যদি তারা নির্বাচিত হতে পারে, দেশ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করে ছাড়বে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে সন্ত্রাস নির্মূলের ক্ষেত্রে তাদেরকে একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখেছি। যাকে চারদলীয় জোট সরকার তাদের পাঁচ বছরের শাসনামলে সব থেকে কার্যকর এবং সফল পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করেছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বয়ং অনেক সমাবেশে, অসংখ্যবার সেই ফিরিস্তি দেশবাসীকে জানিয়েছেন। শুনিয়েছেন। অর্থাৎ সন্ত্রাস নির্মূলের প্রশ্নটি ছিল বিএনপির কাছে রাজনৈতিক কর্মসূচি ও নির্বাচনি ওয়াদা।



অন্যদিকে, আমরা প্রত্যেকেই জানি তাদের সন্ত্রাস নির্মূলের গৃহীত পদক্ষেপের সাথে দেশে সংগঠিত চলমান ক্রসফায়ারের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। অর্থাৎ বিএনপির ঘোষিত রাজনীতিক কর্মসূচি, সরকার গঠন ও ক্রসফায়ার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একটি বিষয়। একটি দেশে সরকার পালাবদলের পর নবগঠিত সরকারের সামনে অনেকগুলো লক্ষ্য থাকে। তার মধ্য থেকে যে কোনো একটি লক্ষ্যকে নবগঠিত সরকার প্রাধান্য দেয়। যেমন কোনো সরকার দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ও জনগণের উন্নতির প্রশ্নটাকে প্রাধান্য দিতে পারে। কোনো সরকার খাদ্য উৎপাদনকে প্রাধান্য দিতে পারে। কেউ বা গণশিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে পারে। কেউ বা নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলায় প্রাধান্য দিতে পারে। কোনো সরকার প্রতিরক্ষার নিরাপত্তার প্রশ্নে প্রাধান্য দিতে পারে। কোনো সরকার অপর একটি দেশ দখলের বিষয়টিতে প্রাধান্য দিতে পারে। আবার কোনো সরকারের কাছে দেশের আইন শৃঙ্খলার প্রশ্নটি প্রাধান্য পেতে পারে। এভাবে একটি সরকার যে বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে বা প্রাধান্য দিয়ে থাকে, রাষ্ট্রক্ষমতা সেই প্রশ্নকে ঘিরেই প্রধানভাবে আবর্তিত হয়। ক্ষমতা কাঠামো সেই বিষয় ঘিরেই মূর্ত হয়ে ওঠে। যেমন আমাদের দেশে ২০০১ সালের নির্বাচনের পূর্বে বিএনপির নির্বাচনি ওয়াদা ছিল দেশের আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন এবং সন্ত্রাস নির্মূল করা। এভাবে নির্বাচনি ওয়াদা বা অঙ্গীকার করা বরাবরই বিমূর্ত একটি বিষয়। কিন্তু সেই বিমূর্ত বিষয়টি যখন প্রয়োগে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তাদের রাজনীতি ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ তাদের সন্ত্রাস নির্মূলের ঘোষণা ছিল বিমূর্ত। কিন্তু পদক্ষেপ হিসেবে ক্রসফায়ারের ঘটনা মূর্ত ও নির্দিষ্ট। যা জোট সরকারের দাবি অনুযায়ী তাদের পাঁচ বছরকালের মধ্যে সবচেয়ে সফল একটি কর্মসূচি। ফলে তাদের সরকার, ‘রাষ্ট্রক্ষমতাকে’ সন্ত্রাস নির্মূল বা ক্রসফায়ার সংগঠিত করার ক্ষেত্রে প্রধানভাবে কাজে লাগিয়েছিল - এটাই তাদের দাবি।

জোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পরই সন্ত্রাস দমনে প্রথম দফায় সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে। যা আমাদের সবার কাছে অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে পরিচিত। এতে করে দেশের সেনাবাহিনী একটি বিতর্কের মধ্যে পড়ে। নানা ধরনের প্রশ্ন ওঠে। সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেদিন দুই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়। প্রথমত, সন্ত্রাস দমনের পদক্ষেপ থেকে সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করা। দ্বিতীয়ত, দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি। যার সহজ অর্থ হলো সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য যদি সত্যিকার অর্থে বিনাবিচারে কাউকে হত্যা বা নির্যাতন করেও থাকে, সেই দায় থেকে রাষ্ট্র তাকে অব্যাহতি দিচ্ছে। উক্ত সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা যাবে না। মামলা করা হলেও তা খারিজ হয়ে যাবে, ধোপে টিকবে না। ঘোষণাটি স্বয়ং রাষ্ট্রের। দায়মুক্তি অধ্যাদেশের মূল কথা ছিল এটাই।

এরপর দ্বিতীয় দফায় আমরা জোট সরকারের দলীয় সন্ত্রাসী ও জাগ্রত মুসলিম জনতা নামের একটি রাজনৈতিক দল’র ক্যাডারদেরকে যৌথভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলে সন্ত্রাস নির্মূলে মাঠে নামতে দেখি। এই যৌথবাহিনীর হাতে অনেকেই খুন হন। অনেকেই চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে যান। রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রত্যক্ষ মদদেই সেটা ঘটে। পদ্ধতি হিসেবে সরকারের গৃহীত এ পদক্ষেপ (দলীয় ও সংগঠিত সন্ত্রাসীদের দিয়ে ভিন্নমতালম্বীদের খুন) সেদিন ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়ে। দেশ-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে থাকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি সামনে চলে আসে। ফলে জোট সরকারকে এবারও পিছু হঠতে হয়। কারণ এ পদ্ধতিটি ছিল সম্পূর্ণই আইন বহির্ভূত।

এর পর পরই তারা গ্রহণ করে তৃতীয় পদক্ষেপ, যা ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশে ক্রসফায়ার নামে খ্যাত। এবং সেটা দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময় বা ফখরুদ্দিনের শাসনামলেও ছিল চলমান ছিল। তবে এক্ষেত্রে একটি লক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। জোট সরকারের গৃহীত ক্রসফায়ারের পদক্ষেপ পূর্বে বর্ণিত পদক্ষেপের তুলনায় অনেকটা ব্যতিক্রমধর্মী। যেমন অপারেশন ক্লিনহার্টে অংশগ্রহণকারী সেনা সদস্যদের দায়মুক্তির প্রশ্ন ছিল। যে কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করতে হয়। আর দ্বিতীয় পদক্ষেপ অর্থাৎ সরাসরি রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় দলীয় ও সংগঠিত ক্যাডার বাহিনী দিয়ে ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যা করা - এটা ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে যুক্ত। কিন্তু ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে মানবাধিকার বা আইন লঙ্ঘনের কোনো বিষয় নাকি নেই ! তাহলে, প্রশ্ন দাঁড়ায় ক্রসফায়ার কি রাষ্ট্রের আইনগত ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যেই ‘আইনি হত্যাকাণ্ড’, নাকি নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনা বিচারে খুন। হ্যাঁ, এটা নিয়ে বরাবরই একটা বিতর্ক রয়েছে।

আমরা সবাই জানি বিগত সরকার ক্রসফায়ার সংগঠিত করার জন্য র‌্যাব নামের একটি বিশেষ বাহিনী তৈরি করেছে। তার আরেকটি ভিন্ন নাম আছে - এলিট বাহিনী। অনেকের দৃষ্টিতে আমাদের দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটকারী নব্য এলিট শ্রেণীর প্রয়োজনে এই এলিট বাহিনী। দেশের আর্মস ব্যাটেলিয়ন অধ্যাদেশের অধীনে এই ফোর্স গঠন করে তারা ক্রসফায়ারের নামে। অর্থাৎ ক্রসফায়ার সংঘঠনের সাথে এলিট বাহিনী যেমন যুক্ত, জোটের রাজনীতিও তেমনি যুক্ত ছিল বলে অনেকে মনে করেন।

জোট সরকারের পক্ষ থেকে ২১ শে জুন, ২০০৪ সালে র‌্যাব গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। প্রথম র‌্যাবের হাতে ক্রসফায়ারে একজন মারা পড়ে ২৪শে জুন, ২০০৪ সালে। তারপর থেকে ক্রসফায়ার প্রতিনিয়ত ঘটে চলা একটি বিষয়। দেশের ৬৪ টি জেলায় ১৮ই অক্টোবর, ২০০৪ সালে র‌্যাব একযোগে অপারেশনে নামে। র‌্যাব গঠনের বৈধতা নিয়ে ২৬শে অক্টোবর, ২০০৪ সালে আদালতে একটা মামলা দায়ের হয়। কিন্তু তার ফলাফল শূন্য। কারণ তার পরপর শুধু র‌্যাবই নয়, দেশের পুলিশ বাহিনীও প্রতিযোগিতামূলকভাবে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটাতে থাকে এবং সংখ্যাগতভাবে ক্রসফায়ারের ঘটনা বাড়তে থাকে। অনেকেই একে সমাধান ভেবে আশাবাদ ও স্বস্তি ব্যক্ত করে। কিন্তু অন্যদিকে অনেকে ক্রসফায়ারকে বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দেশের সংবিধানে ঘোষিত মৌলিক অধিকার হানি হিসেবে চিহ্নিত করেন। অনেকেই ভাবেন র‌্যাবের জন্যও দায়মুক্তি অধ্যাদেশের অথবা ইনডেমনিটির প্রয়োজন। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়া অনেকেই র‌্যাব বাহিনীর অস্তিত্ব বিলুপ্তির কথা বলেন। এভাবে র‌্যাব গঠন এবং ক্রসফায়ারের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ২৯শে অক্টোবর, ২০০৪ সালে বাংলাদেশে ক্রাইম রিপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক ইফতার মাহফিলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ঘোষণা দেন - র‌্যাবের জন্য ইনডেমনিটির কোনো প্রয়োজন নেই; কারণ সন্ত্রাসীরা র‌্যাবকে আক্রমণ করলে, তখন আত্মরক্ষার তাগিদে র‌্যাবও পাল্টা গুলি করে, এতে করে সৃষ্ট ক্রসফায়ারে সন্ত্রাসীর মৃত্যু ঘটছে। ফলে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থায় ইনডেমনিটির কোনো প্রসঙ্গ আসে না (৩০ শে অক্টোবর, শনিবার ২০০৪ আমার দেশ)। অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্যে যে বিষয়টি স্পষ্ট ছিল তা হলো, ক্রসফায়ারে ঘটা হত্যাকাণ্ডের একটা আইনগত নায্যতা রয়েছে। তবে এখানে আমাদের আরো একটি কথা স্মরণ রাখা জরুরি যে, জোট সরকার আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছিল সরাসরি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অধীন।

এরপর ১৩ই ডিসেম্বর ২০০৪ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল হক ভুঁইয়া, স্বাস্থ্য ও জীবাণুবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. খায়ের আহমেদ, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. ইসমাইল হোসেন, প্রফেসর সাজেদা আক্তার, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান, কৃষি অর্থায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রইস উদ্দিন মিয়া, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক রেহানা আক্তার, বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রভাষক সাবিনা ইয়াসমিনসহ ২০৬ জন শিক্ষক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব গঠনকে স্বাগত জানায় (১৪ ডিসেম্বর, ২০০৪ আমার দেশ)। অর্থাৎ র‌্যাব গঠনের পক্ষে বিপক্ষে যে বিতর্ক চলছিল, ওই বিতর্কের সূত্র ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০৬ জন শিক্ষক একটি পক্ষ নেন। র‌্যাব গঠনকে তাঁরা ন্যায্য মনে করেন বা ঘুরপথে ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের স্বীকৃতি দেন বা ক্রসফায়ারকে ন্যায্য মনে করেন।

এর কিছু কাল পরে আমরা র‌্যাবের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরেকটি ভিন্ন বিষয় লক্ষ করি। ২৫শে ডিসেম্বর শনিবার, ২০০৪ সালে র‌্যাবের চট্টগ্রাম শাখা তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘ক্রসফায়ার’ শব্দের পরিবর্তে ‘এনকাউন্টার’ শব্দ ব্যবহার করে। প্রসঙ্গটিতে র‌্যাব চট্টগ্রামের তৎকালীন পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী এমদাদুল হক দেশবাসীকে জানান - সন্ত্রাসীরা হামলা চালালে, সেটা প্রতিরোধের অধিকার র‌্যাবেরও রয়েছে। আত্মরক্ষার্থে র‌্যাবকেও অনেক সময় গুলি চালাতে হয় এবং দুইপক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়কালে কোনো সন্ত্রাসীর মৃত্যু হলে তাকে এনকাউন্টার বলে। ক্রসফায়ার থেকে এনকাউন্টার শব্দটি আরো যুক্তিযুক্ত (২৪ ডিসেম্বর, ২০০৪ আমার দেশ)।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, র‌্যাবের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর, তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হুবহু একই ভাষায় কয়েকশো ক্রসফায়ার নামক খুনের গল্প ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এতে করে এক পর্যায়ে তারা তাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কাহিনীটা একই রেখে ‘ক্রসফায়ার’-এর পরিবর্তে ‘লাইন অব ফায়ার’ নামে একটা টার্ম ব্যবহার করে। কিন্তু তাতেও খুব বেশি ফল দেয় না। সমালোচনা চলতেই থাকে। তার পরপরই তাদের এই এনকাউন্টার শব্দের ব্যবহার। প্রশ্ন উঠতে পারে এটা কেন? এ প্রসঙ্গে দেশের অনেক গবেষক মতামত হলো আমাদের উপমহাদেশের ক্ষেত্রে ‘এনকাউন্টার’ শব্দের একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। যেমন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ৭০-এর দশক জুড়ে নকশাল ধারার রাজনৈতিক কর্মীদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনাবিচারে হত্যা করার সময় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে এনকাউন্টার শব্দের প্রচলন হয়েছিল। নেপালেও মাওবাদীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে হত্যা করার সময় একই শব্দের ব্যবহার হয়েছে। আমাদের দেশেও র‌্যাব গঠন এবং ক্রসফায়ার নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা চলছিল, সেটা নিরসনেই হয়ত বা লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী এমদাদুল হক এনকাউন্টার শব্দটি ব্যবহার করে সুস্পষ্টতই একটি বিশেষ ইঙ্গিত দেন। অর্থাৎ কারা প্রকৃত অর্থে এনকাউন্টারের টার্গেট? যাতে করে দেশের অশান্ত বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হতে পারেন।

র‌্যাব পরিচালকের উক্ত ঘোষণার ১২ দিন পর, ৬ই জানুয়ারি ২০০৫ সালে বিএনপি-র আরো একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব, যিনি আবার একইসাথে ছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ নারায়ণগঞ্জে আইনজীবীদের এক সমাবেশে তাদের সরকারের পক্ষ থেকে আরো স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন - আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। সন্ত্রাসীদের সাথে এটি র‌্যাবের যুদ্ধ। ফলে ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনা কোনোভাবেই মানবাধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় (আমার দেশ)। অর্থাৎ শুরুতেই যে প্রশ্নটা তোলা হয়েছে, ২০০১ সালের নির্বাচনি ইস্তেহারে বিএনপি যে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল - সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আইনমন্ত্রী সেটা সেদিন আরো স্পষ্ট করে দেশবাসীকে জানিয়ে দেন। ফলে আমরা ধরে নিতে পারি। বিগত চার দলীয় জোট সরকারের ঘোষিত যুদ্ধের নাম ছিল ক্রসফায়ার এবং সেই যুদ্ধের সৈনিক নবগঠিত র‌্যাব। এবং তাদের ঘোষিত যুদ্ধ যেহেতু তাদের রাজনৈতিক প্রোগ্রাম, সেহেতু তাদের ভাষায় সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে পারে না। সেটা ছিল তৎকালীন আইন মন্ত্রীর ভাষ্যেরও মূল কথা। একইসাথে এটা বর্তমান সরকারেরও অবস্থান। অর্থাৎ এরা মানবাধিকার কমিশন আর পুলিশের সংস্কারের নানান ধুঁয়ো তুলে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে চরম ফ্যাসিবাদী কায়দায় রাজনৈতিক হত্যা ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন কোনো রাখঢাক না করেই বর্তমান আইজি নূর মোহাম্মদ গত ২৭শে আগস্ট ’০৮ রাজশাহীর তাহেরপুর হাইস্কুল মাঠে র‌্যাব আয়োজিত একটি মতবিনিময় সভায় বলেন, ‘জঙ্গি ও চরমপন্থীরা থাকবে না ওদের বাড়িঘরও থাকবে না’(২৮ আগস্ট ’০৮, দৈনিক মানবজমিন)।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম