এবার গাড়ী ছাড়ার পালা। গাড়ী ছেড়ে দিল। মাইক থেকে উচ্চারণ করে সবাইকে ট্যুরের দোয়া “সুবহানাল্লাযী সাখখারা লানা হাজা ওয়ামা কুন্না লাহু মুকরীনীন ওয়া ইন্না ইলা রাব্বিনা লা মুনক্বালিবূন” পড়ানো হল। গাড়ী তার নিজস্ব গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরক্ষনেই আমাদের মধ্যকার একজন ভাই পবিত্র কুরআন শরিফ থেকে তেলাওয়াত করলেন। পরে কয়েকজন ছাত্র দ্বারা পরিবেশিত হল ইসলামী ও দেশের গান।
দেখতে দেখতে আমাদের বহনকারী বাসটি আফ্রিকা মহাদেশের সর্ববৃহৎ শহর ও মিশরের রাজধানী কায়রোর সীমানা অতিক্রম করে মরুভূমিতে প্রবেশ করল। কায়রোর সীমানা শেষ হওয়ার পর থেকে তুরে সীনার রাস্তায় আর কোন উল্লেখযোগ্য ঘর বাড়ি চোখে পড়ে না। তবে, মাঝে মাঝে সম্ভবতঃ দু’একটি বেদুঈনের ঘর-বাড়ী রয়েছে। শা শা গতিতে বাসটি এগিয়ে চলেছে মরুভূমির মধ্যে পীচঢালা পথ বেয়ে। রাস্তায় কোন জ্যাম নেই তাই বাসের পথচলা ছিল আপনগতিতে। বাসের মধ্যকার আমাদের অনুষ্ঠান কিন্তু থেমে নেই। এবার চলন্ত বাসের মধ্যে শুরু হল সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা। সাধারণজ্ঞান প্রতিযোগিতার একেকটি প্রশ্নে যে প্রথম হচ্ছে সে সাথে সাথে পুরস্কার নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আঞ্চলিক ভাষায় ছোট্ট গল্প বা নাটক উপস্থাপিত হচ্ছে। একজন সিলেটি ভাই সিলেটি ভাষায় ছোট্ট একটা গল্প বলে তার অনুবাদ করে দিলেন। এরপর আমাদের এক ভাই সংক্ষেপে উদ্দিষ্ট স্থানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও যৎসামান্য ইতিহাস তুলে ধরলেন। ইতিমধ্যে, মরুভুমির মধ্যে একটা রেস্টুরেন্টে গাড়ি পৌছে গেল। সেখানে সব গাড়ি কিছুক্ষন অপেক্ষা করে। আমাদের গাড়িও কিছুক্ষণ ওয়েট করল এখানে। সবাই বাস থেকে নেমে আশেপাশে ১৫ মিনিটের মত পায়চারী করলেন।
পায়চারী শেষে আবার যাত্রার পালা। সবাই নিজ নিজ আসন গ্রহন করলে পূণরায় বাস তার যাত্রা শুরু করল। মাইকে ঘোষণা দেয়া হল- আমাদের সামনেই রয়েছে ঐতিহাসিক সুয়েজ খাল। একটু পরেই গাড়ী সুয়েজ খালের নিচের টানেলে প্রবেশ করে ওপারে যাবে। যারা সুয়েজের টানেল দেখতে চান তারা প্রস্তুতি নেন তা দেখার জন্য। গাড়ী টানেলের গেটের কাছে চলে আসল। টানেলের গেটের অনেক আগে থেকেই দুইদিকে উচু করে মাটি দিয়ে টানেলে ঢুকার রাস্তা তৈরী করা হয়েছে। ফলে, গাড়ী থেকে সুয়েজ খাল দেখা যায় না। সবার দৃষ্টি এখন সামনের দিকে। সুয়েজের নিচের সেই ঐতিহ্যবাহী টানেলটা কেমন? কেমন করে সুয়েজ খালের নিচে দিয়ে এ রাস্তা তৈরী হয়েছে? এটা সবার কাছে আশ্চর্যের ব্যাপার মনে হচ্ছে যে, এর উপর দিয়ে যাচ্ছে বড় বড় জাহাজ আর আমরা তার নিচের টানেলে?!!
টানেলের প্রবেশপথ
এখানে টানেলের ভিতরে কোন মানুষের হেটে যাওয়া বা চলাফেরা করা নিষেধ। শুধুমাত্র গাড়ীতে করেই তারা যেতে পারবে। গাড়ী ঢুকে গেল টানেলের মধ্যে আমরা সবাই তখন পানির নিচে। আমাদের উপরে বড় বড় জাহাজ। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে টানেলের বৈশিষ্ট্য। কেমন করে তা তৈরী করা হয়েছে? ইত্যাদি। যাদের কাছে ক্যামেরা আর ভিডিও ছিল তাদের কাউকে আর নিজের সিটে পাওয়া যায় নি। সবাই বাসের ড্রাইভারের পাশে ক্যামেরা তাক করে আছে সামনের দিকে। তিন-চার মিনিট লাগল টানেল পার হতে।
টানেলের ভিতরের দৃশ্য
টানেলের ভিতরে
টানেলে ঢুকার আগে বা পরে বাস থেকে সুয়েজ খাল দেখা সম্ভব না হলেও আমি সুয়েজ খালের ছবি এখানে দিয়ে দিলাম।
সুয়েজ খাল
সুয়েজ খাল
নিচে সুয়েজ খালের নিচের টানেলের ভিডিও দেখুন
টানেল দেখলাম। এরপর আমাদের ঘুমানোর পালা। তাড়াতাড়ি না ঘুমালে রাত্র তিনটার দিকে পাহাড়ে উঠতে পারব না। সে সুযোগ কস্মিনকালেও মিস করা যাবে না।
সর্বশেষে, হালকা নাস্তা দিয়ে সবাইকে ঘুমানোর জন্য ছেড়ে দেয়া হল। কারণ, পুরা রাত্রটা জার্নি করতে হবে। আমাদের টার্গেট ছিল রাত্র ৩ টার মধ্যে তুরে সিনাই এলাকায় পৌছাতে হবে। তারপর পাথুরে পাহাড়ের আকাবাকা পথ বেয়ে উপরে উঠে পাহাড়ের চুড়ায় যেখানে হযরত মুসা (আঃ) চল্লিশদিন রাত্রিযাপন করেছিলেন সেখানে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে সুর্যোদয় দেখব। সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। কোন ঝামেলা নেই। জনমানবহীন রাস্তা দিয়ে বাস এগিয়ে চলছে। মাঝে মাঝে শুধুমাত্র চেকপোষ্টে গাড়ী থামছে। কিছুদুর পরপর চেকপোষ্ট আছে। আর মাঝে মাঝে টহল পুলিশও আছে। এদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই উন্নত। তাই, রাতদিনের যে কোন সময় যেকোন স্থানে আপনি নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতে পারবেন। জনমানবহীন প্রান্তরেও তারা চেকপোষ্ট বসিয়ে রেখেছে। তাদের চোখ ফাকি দিয়ে কারো সামনে যাওয়ার সুযোগ নেই। সুয়েজ খাল পার হওয়ার কিছুক্ষন পর থেকে শতশত মাইল রাস্তার দুপাশে বয়ে গেছে উচু উচু পাহাড়। এ পাহাড়গুলো মাটির না বরং সব পাথরের পাহাড়। রাত্র তিনটার দিকে আমরা পৌছে গেলাম ঐতিহাসিক তুরে সিনাই পাহাড়ের কাছে। এর কিছুক্ষন আগেই সবাইকে জাগানো হল পাহাড়ে উঠার জন্য প্রস্তুতি নিতে। সাথে সাথে আমাদের জন্য সকালের নাস্তা ও পানি বিতরণ করা হল। এগুলো যার যখন ইচ্ছা খেয়ে নেবে। কারণ, পাহাড়ে সবাই উঠতে পারবে না। আর তখন সবাই এক স্থানে একত্রিত হতে পারবে না। তাই, নাস্তা এখন সবাইকে দিয়ে দেয়াই যুক্তিযুক্ত হবে মনে করে যার যার নাস্তা তার তার হাতে দিয়ে দেয়া হল। পাহাড়ের পাদদেশের যে স্থান পর্যন্ত বাস যেতে পারে সে স্থানটির নাম “সেন্ট কাট্রিন”। এখান থেকে নাস্তা নিয়ে দলে দলে উঠতে হবে পাহাড়ের চুড়ার সেই স্থানে যেখানে মুসা (আঃ) চল্লিশদিন যাবত ধ্যানে রত ছিলেন।
আরেকটি কথা বলা হয়নি- সেটা হল এই এলাকায় রাত্রে খুব ঠান্ডা থাকে। যখন কায়রোতে থাকে প্রচন্ড গরম তখন এখানে থাকে অত্যন্ত ঠান্ডা। গত ২০০৮ সালে আমি যখন এখানে প্রথমবার গিয়েছিলাম তখন ছিলে জুলাই মাস। প্রচন্ড গরমের সময়। শীতের কাপড় নিই নাই। আশ্চর্যের ব্যাপার তুরে সিনার আশেপাশে যাওয়ার পর বাসের ভিতরেও প্রচন্ড শীত অনুভব করছিলাম। কে জানত যে শীত লাগবে? কিন্তু, এখন কি আর করা যাবে? ধৈর্য না ধরে উপায় নেই। শীতে কাপছিলাম। আমার মনে হয় আশে পাশের পাহাড়গুলো পাথরের হওয়ার কারণে এত ঠান্ডা হয়ে যায় রাত্রিবেলায়। এবং দিনের বেলায় তা আরও গরম হয়ে যায়।
নাস্তা ও পানির বোতল হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। অপেক্ষা করতে থাকলাম পাহাড়ের চুড়ায় উঠার জন্য সরকারী বাহিনীর সবুজ সংকেতের অপেক্ষায়। সেখানে সর্বদা সরকারী বাহিনীর লোকেরা পাহারায় থাকে। তুর পাহাড়সহ বিশাল এরিয়াকে ১৯৬৭ সালে ইসরাইল মিশরের কাছ থেকে দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু, আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে ১৯৭৩ সালের ৬ই অক্টোবর আরবী ১০ই রমজান এ এলাকাকে পুনরায় মিশরীয় বাহিনী ইসরাইলকে উচিত শিক্ষা দিয়ে মুক্ত করেছে। প্রতি বছর ১০ই রমজানের সেই দিনকে শুকরিয়া হিসেবে মিশর সরকার উদযাপন করে থাকে।
সরকারী বাহিনীর সবুজ সংকেত পেয়ে আমরা উপরে উঠতে শুরু করলাম।
সেন্ট ক্যাট্রিনে নিরাপত্তা বাহিনীর সবুজ সংকেত পেয়ে সামনে এগোতে শুরু করলাম।
সেন্ট ক্যাট্রিন
দূর থেকে সেন্ট ক্যাট্রিন বাস স্ট্যান্ড
রীতিমত বন্ধুদের সাথে এগিয়ে চলছি। সামনের দিকে দেখলাম ডানদিকে খৃষ্টানদের একটা গীর্জা। গীর্জাতে পরে প্রবেশ করব।
নিচে গীর্জার ছবি
চলুন আগে পাহাড়ের চুড়া থেকে ঘুরে আসি। এর একটু বামেই পাহাড়ের গায়ে দেখলাম একটা বিল্ডিং রয়েছে। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম বিল্ডিং সম্বন্ধে। সে বলল: ওটা নাকি বিদেশী কোন এক লোকের বাড়ী। সম্ভবতঃ বিনোদনের জন্যই ওটা তৈরী করা হয়েছে। এর পরে রাস্তার পাশেই রয়েছে বেশ কিছু উটের সারি। উট চালকরা তাদের উটকে টুরিস্টদের কাছে ভাড়া দেয়ার জন্য লাইন ধরে বসে আছে। কেউ ভাড়া নিলে চালক নিজে পায়ে হেটে তাকে পাহাড়ের উপরের দিকে নিয়ে যাবে।
যাই হোক, সবার টার্গেট হচ্ছে আমরা একসাথে এবং যত দ্রুত সম্ভব পাহাড়ের চুড়ায় উঠে ফজরের নামাজ আদায় ও সুর্যোদয় দেখতে হবে। কিন্তু, পাথুরে পাহাড়ের আকা বাকা পথ চলে সর্বোচ্চ চুড়ায় উঠতে সময় লেগে যাবে প্রায় ৩ ঘন্টা।
সামনে উচু পাহাড় দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি শেষপ্রান্তে চলে এসেছি। কিন্তু, ওখানে পৌছে দেখছি যে, না আরও অনেক পথ বাকী আছে। এভাবে পাহাড়ের মধ্যকার পায়ে চলার মত সামান্য পথ বেয়ে এগিয়ে চলছি। উপরে উঠার জন্য উটেরও ব্যবস্থা আছে। যেটা উপরে উল্লেখ করেছি। উটের চালকরা তাদের উট নিয়ে বসে আছে ভাড়া দেয়ার জন্য। উটে আরোহন করে পাহাড়ের চুড়া থেকে কিছুটা দূরে (যতদুর উটে চড়ে যাওয়া সম্ভব ততটুকু পর্যন্ত) যে কেউ যেতে পারবে। এই পথটুকুর ভাড়া লোকভেদে (যার কাছে যা নিতে পারে) ৬০ থেকে ৯০ পাউন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে। (১ পাউন্ড= ১৩ টাকা প্রায়)।
এগিয়ে যাচ্ছি টার্গেটের দিকে। কখন সেখানে পৌছাব? যত কম সময়ে সেখানে পৌছাতে পারব সেটা আমাদের ক্রেডিটের ব্যাপার। আমরা একসাথে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ৮-১০ জন বন্ধু। হাটছি স্বাভাবিক গতিতেই। কিন্তু, তারপরেও কয়েকজন বন্ধু আমাদের থেকে বারবার পিছে পড়ে যাচ্ছিল। আমরা বার বার কিছুদুর সামনে গিয়ে আবার অপেক্ষা করছিলাম তাদের জন্য। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত মনে করলাম এত দেরী করলে তো আমরা টার্গেটে পৌছাতে পারব না। তাই, আমাদের মত করে হাটতে শুরু করলাম দুই বন্ধু। পিছনে যারা আছে তারা যখন খুশি আসুক। তাদের সাথে পাহাড়ের চুড়ায় সাক্ষাৎ হবে। মাঝে মাঝে আকা বাকা পথ বাদ দিয়ে পাথরের মধ্যে দিয়ে সোজা পথে সতর্ক পায়ে সামনে যাচ্ছিলাম আমরা দু বন্ধু। তবে, সেটাতেও সামান্য ঝুকি ছিল; তাই, সতর্কভাবেই যাচ্ছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল পথ যেন কিছুটা হলেও কম হয়। অনেক উচুতে উঠে গেছি। রাত্রিবেলা তো! ঘোর অন্ধকারের কারনে পিছনের কিছুই দেখার উপায় নেই। দূরে দেখা যাচ্ছে লোকেরা টর্চলাইট মেরে সামনে এগোচ্ছে।
আমরাও মোবাইলের টর্চলাইটের আলোতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আশে পাশে কয়েকটি বেদুইনের ছোট ছোট ঘর দেখা যাচ্ছে। আর মোড়ে মোড়ে সরকারী নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা দায়িত্ব পালন করছে। এখানে কিন্তু, শুধু মুসলমানরাই যাচ্ছে তাই নয়; বরং, ইউরোপিয়ান টুরিস্টের সংখ্যাই বেশী। মুসলমান, ইহুদী ও খৃষ্টান সবাই এখানে যায় সমানে সমান। সে জন্য নিরাপত্তার খুব প্রয়োজন আছে। উচু-নিচু ও আকা বাকা পায়ে হাটা পথ দিয়ে হাটতে হাটতে অনেক দূর চলে এসেছি। কিছুটা ফর্সা হয়ে গেছে আশপাশ। উপর থেকে নিচের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে- নিচের যে রাস্তা বেয়ে আমরা এসেছি, সেখানে লাইন ধরে মানুষ আসছে। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট প্রাণী দল বেধে চলে আসছে।
উপর থেকে নিচের রাস্তার ছবি
নিচ থেকে উপরের পথচারীদের ছবি
এখান থেকে চিৎকার দিলেও লাভ নেই। তারা শুনতে পারবে না। পিছনের ফ্রেন্ডরা কোথায় আছে তা জানার উপায় নেই। এ ছাড়া তাদের মোবাইলে কল করাও সম্ভব নয়, কারণ, নিরাপত্তার খাতিরেই এ এলাকাকে মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে রাখা হয়েছে। এভাবে উঠে গেলাম অনেক উপরে। সেখান থেকে নিচের রাস্তা খুবই চিকন মনে হচ্ছে। প্রায় দেড় ঘন্টা উপরের দিকেই উঠতে থাকলাম। তবে, সেটার জন্য যে পথ ছিল তা ছিল কিছুটা সমতল। একটা জায়গায় দেখালাম উচু পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরী করা হয়েছে।
দেখুন উক্ত স্থান
এবার সামনে আর কোন সমতল পথ নেই। সামনে উঠতে হবে পাথরের অনেকটা খাড়া সিড়ি বেয়ে উপরের দিকে।
যে কেউ এখানে আসলেই হতাশ হয়ে যেতে পারে এই ভেবে যে, এতদুর আসলাম কত কষ্ট স্বীকার করে। সামনে পাথরের খাড়া সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গেলে তো আর বাচব না। আমাদেরও অনেকটা সে রকমই অবস্থা হয়েছিল। তবে, মনোবল দৃঢ় থাকলে কোন কাজে বাধা আসতে পারে না। খাড়া সিড়িতে উঠলাম। কিন্তু, সামনের দিকে তাকিয়ে বলার উপায় নেই যে, রাস্তা আর কতটুকু বাকী। উঠতে উঠতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। প্রায়ই বসছি রাস্তার পাশে। ইউরোপীয়রাও বসে নেই। তারাও পুরুষ-মহিলা দল বেধে উপরে সিড়ি বেয়ে উঠছে। বেশ কয়েকবার সিড়ির পাশে বিশ্রাম নিলাম। বিশ্রাম না নিলে তো কাজের কাজ কিছুই হবে না। অনেক কষ্ট হবে।
বেশ কয়েকবার বিশ্রাম ও পথ চলার পর প্রায় ২ ঘন্টা পর পাহাড়ের চুড়ায় উঠে গেলাম। এটা তো সেই ঐতিহাসিক পাহাড়ের চুড়া, যেখানে মুসা (আঃ) আল্লাহ তায়ালার সাথে কথাবার্তা বলেছিলেন। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তিনি চল্লিশদিন এখানেই ধ্যানে রত ছিলেন। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এই চুড়ার উচ্চতা ২৪৩৯ মিটার। কিলোমিটারের হিসেবে ২.৪৩ কিলোমিটার।
পাহাড়ে কয়েকটি ছবি
পাথরের পাহাড়
উটের চলার পথের শেষসীমা। এখান থেকে প্রায় চল্লিশ মিনিট হেটে চুড়ায় পৌছাতে হবে।
সিড়ি বেয়ে নামছে
পাথরের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে
আমরা এখন ঐতিহাসিক তুর পর্বতের চুড়ায়। এতো সেই পর্বত চুড়া, যেখানে মুসা (আঃ) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে চল্লিশদিন ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। এখানেই তিনি রোজাবস্থায় চল্লিশদিন অতিবাহিত করে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আসমানী কিতাব তাওরাত লাভ করেছিলেন। এখানেই তিনি মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে সরাসরি কথোপকথন করেছিলেন। এস্থানের সাথে জড়িয়ে আছে সম্মানিত নবী মুসা (আঃ) এর স্মৃতি। সেজন্যই তো শুধু মুসলমান নয়; ইহুদী খৃষ্টানরাও এখানে ভ্রমণ করতে আসে। কারণ, মুসা (আঃ) ই ছিলেন ইহুদী ধর্মের প্রবর্তক।
এখানে উঠেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম। দেখলাম আমাদের আগেই বহু ইউরোপীয় উপরে উঠে গেছে। তাহলে, নিশ্চয় তারা আমাদের অনেক আগেই রওয়ানা করেছে। সবাই সুর্যের দিকে মুখ করে নিজ নিজ সুবিধাজনক স্থানে বসে সুর্যোদয়ের অপেক্ষা করছে। সবার দৃষ্টি তখন পুর্বাকাশের দিকে সুর্যোদয়ের অপেক্ষায়। অনেকে তাদের ভিডিও ক্যামেরা সেট করে রেখেছে তুরে সীনার চুড়া থেকে সুর্যোদয়ের দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দী করার জন্য। মনে হল ঐতিহাসিক পাহাড় চুড়ার চেয়ে যেন সুর্যোদয়ের দিকেই মানুষের ঝোক বেশী।
সবাই সুর্যোদয়ের অপেক্ষায়
সুর্যোদয়ের সময়
সুর্যোদয়ের সময় কোন এক ব্যক্তি পাহাড় চুড়ায়
টুরিস্টরা চুড়া থেকে লাইন ধরে নেমে আসছে
পাহাড় চুড়ায় টুরিস্টরা
যা হোক, সুর্যোদয়ের আরও অনেক বাকী কিন্তু, আমাদের ফজর নামাজ তো পড়া হয়নি। তাড়াতাড়ি ফজরের নামাজ পড়তে হবে। ওজু করার জন্য আশে পাশে কোন পানি নেই। সাথে যা পানি আছে সবকিছু পান করার জন্য নেয়া হয়েছে। সেটা দিয়ে অজু করতে গেলে পান করার পানি পাওয়া যাবে না। সে জন্য তায়াম্মুম (পানি না পাওয়া গেলে ওজুর বিকল্প হিসেবে নিয়ত তথা সংকল্প করে চেহারা ও দুই হাতের কনুই পর্যন্ত মাসেহ করা) করে নিলাম। তায়াম্মুম করে চুড়াতে নির্মিত মসজিদে প্রবেশ করলাম।
দূর থেকে মসজিদের দৃশ্য
মসজিদের সামনে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে
ভিতর থেকে মসজিদ
জামায়াতের সাথে উক্ত মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করে নিলাম। নামাজ শেষে মসজিদের ভিতরে কয়েকজন তুর্কীর সাথে সাক্ষাৎ হল।
এক ফ্রেন্ডের সাথে মসজিদের ভিতরে
তাদের মধ্যকার আরবী জানা একলোকের সাথে কিছুটা কথোপকথন করে বাইরে বের হলাম। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম আমাদের বাকী বেশ কিছু ফ্রেন্ড ইতিমধ্যে চুড়ায় পৌছে গেছে। একটু পরেই সুর্যোদয় হল। অনেকে সুর্যোদয়ের ছবি ক্যামেরাবন্ধী করে নিল।
সুর্যোদয়ের ভিডিও
সুর্যোদয় দেখুন
চুড়ায় কি কি আছে তা একটু বলা দরকার। চুড়া থেকে কিবলাহ বা কা’বা শরীফ থাকে দক্ষিণ দিকে। পাহাড়ের চুড়াতে একদিকে আছে একটি মসজিদ। মসজিদের একটু পাশেই আছে খৃষ্টানদের একটি গীর্জা। খৃষ্টানরা মনে করে এ গীর্জার স্থানেই মুসা (আঃ) তাওরাত লাভ করেছিলেন।
পাহাড় চুড়ায় নির্মিত গীর্জা
ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমান তথা সমস্ত ধর্মাবলম্বী যে একসাথে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে সহাবস্থান করে সমাজে শান্তি এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে সেটা এখান থেকে প্রমাণিত হয়। মসজিদটা সর্বদা খোলা থাকে। গীর্জাটাকে প্রায়ই বন্ধ থাকতে দেখা যায়। সেটা হয়ত বিশেষ বিশেষ সময় খোলা হয়। বিভিন্ন ধর্মের লোক আসার কারণেই হয়ত এখানে মুসলমানদের জন্য মসজিদ ও খৃষ্টানদের জন্য গীর্জা তৈরী করা হয়েছে। যেন তারা সেখানে প্রয়োজনীয় উপাসনা করতে পারে।
আমি প্রথমবার প্রচন্ড গরমের সময় (জুলাই মাস ২০০৭) ওখানে একবার টুরে গিয়েছিলাম। তখন সেখানে ছিল প্রচন্ড শীত। আর শীতকালে তো আরও বেশী হওয়ার কথা। একবার আমাদের এক বড় ভাই (আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র) ওখানে শীতের পোশাক না নিয়েই ভ্রমনে গিয়েছিলেন বলে শুনেছি। তার পরিণতি সম্বন্ধে অন্যদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি যে, তিনি শীতে যেন মৃত্যু দুয়ারে পৌছে গিয়েছিলেন। যদি তাড়াতাড়ি সুর্য না উঠত তাহলে, নাকি তাকে বাচানো যেত না। এদিক ওদিকের বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম। প্রাণ ভরে দেখে নিলাম আশ পাশের অবস্থা। সব দিকে পাহাড় আর পাহাড়। মনে হয় যেন দুনিয়ায় পাহাড় ছাড়া আর কিছুই নেই। যে পাহাড়ের চুড়ায় উঠেছি এর মত চতুর্দিকে আরও অনেক পাহাড় রয়েছে।
চুড়ায় একদল টুরিস্টকে দেখলাম মাথা নিচু করে নির্দিষ্ট ভংগিতে কান্নাকাটি করছে। বুঝতে বাকী রইলনা যে, তারা তাদের ধর্মানুযায়ী স্রষ্ঠার কাছে উপাসনা করছে। তাদের উপাসনার আসল ধরণটা এখন সঠিকভাবে মনে করতে পারছি না। তাদের উপাসনার ধরণ দেখে এটাও বুঝতে পারলাম যে, তারা নিশ্চয় কোন না কোন ধর্মের অনুসারী। তারা নাস্তিক বা সেকুলার নয়। আমাদেরই পাশে তাদের ধর্মানুযায়ী স্বাধীনভাবে উপাসনা করছে। তাদের প্রতি যেন কিছুটা শ্রদ্ধাবোধ জাগল আমার মনে। কারন, আমাদের তথা মুসলমানদেরই তো দায়িত্ব রয়েছে আমাদের দেশসমুহে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্য ১০০% স্বাধীনতা দেয়া। শত্রুর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধের সময়ও শত্রুপক্ষের কেউ নিরাপত্তা চাইলে তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَإِنْ أَحَدٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْلَمُونَ (6)
অর্থাৎ, আর যদি মুশরিকদের কোন ব্যক্তি আশ্রয় প্রার্থনা করে তোমার কাছে আসতে চায় তাহলে তাকে আল্লাহর কালাম শোনা পর্যন্ত আশ্রয় দাও,তারপর তাকে তার নিরাপদ জায়গায় পৌছিয়ে দাও। এরা অজ্ঞ বলেই তাদের সাথে এটা করা উচিত। (সুরা তাওবা: ৬)
আর এসব টুরিস্টরাও যখন ভিসার আবেদন করে তখন পরোক্ষভাবে তারা নিরাপত্তারও আবেদন করে থাকে। অতএব, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব।
এছাড়াও, আল্লাহ তায়ালা কারও ধর্ম পালনে বাধা দিতে কিংবা, তার নিজস্ব ধর্ম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করতে পারবে না বলে ফরমান জারি করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ (256)
অর্থাৎ, দ্বীন বা ধর্মের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। ভ্রান্ত মত ও পথ থেকে সঠিক মত ও পথকে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। এখন যে তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর ওপর ঈমান আনল ,সে যেন এমন একটি মজবুত অবলম্বন আঁকড়ে ধরল ,যা কখনো ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ তায়ালা সবকিছু শোনেন ও জানেন। (সুরা বাকারাঃ ২৫৬)
মুসলমান, ইহুদী ও খৃষ্টান যে যার মত ইচ্ছা ঘুরছে ছবি তুলছে। আমরাও আশেপাশে ঘুরছি; দেখছি সবকিছু। তখন শুধু এ কথাটাই ঘুরেফিরে মনের মধ্যে উকি দিচ্ছে যে, এই সেই ঐতিহাসিক পাহাড় যেখানে আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুসা (আঃ) অবস্থান করেছিলেন। এখানে আবার পুণরায় আসতে পারব কিনা আল্লাহ তায়ালাই জানেন। আরও মনে হচ্ছে আমার পরিবারের সদস্যদের কথা। তারা যদি সাথে থাকতেন কতই না ভাল হত ইত্যাদি।
বন্ধুদের সাথে আমি
বন্ধুদের সাথে আমি পাহাড় চুড়ায়
আমি কোথাও গেলে সেখানকার ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্বন্ধে কিছুটা হলেও আমার জানতে মনে চায়। সেজন্য আশেপাশের লোকদেরকে সে সকল ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। এখানেও তার বিপরীত হয়নি। এখানে অবস্থানরত একজন মিশরীকে জিজ্ঞাসা করলাম- চুড়ার যে মসজিদে নামাজ পড়লাম এই মসজিদটা কখন তৈরী হয়েছে? তিনি জবাব দিলেন- এই মসজিদের স্থানেই হযরত মুসা (আঃ) নামাজ আদায় করতেন। আর সেস্থানেই এ মসজিদটি ফাতেমী খেলাফতের আমলে তৈরী করা হয়। মসজিদের পাশের গুহায় মুসা (আঃ) ধ্যানে মগ্ন থাকতেন।
মসজিদের পার্শ্ববর্তী গুহা
এটুকু বলার পরে নিজের কথাকে সত্য প্রমাণ করার জন্য বললেন: “ওয়াল্লাহু আ’লাম”। (অর্থাৎ, এভাবেই জানা যায় তবে, আল্লাহ তায়ালা এ সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশী জানেন।)
এরপরও আমি থামলাম না। আমি তাকে বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে থাকলাম। তিনিও আমার প্রশ্নের জবাব দিতে থাকলেন। কারণ, এভাবে প্রাক্টিক্যালি কারও কাছ থেকে জেনে না নিলে জীবনেও সঠিকভাবে ইতিহাস হয়ত জানতে পারব না। এখানকার এই ট্যুরও সফলতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হবে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মুসা আলাইহিস সালাম যখন আল্লাহ তায়ালাকে দেখতে চেয়ে আবেদন করেছিলেন তখন আল্লাহ তায়ালার নুরের তাজাল্লিতে একটি পাহাড় পুড়ে ভস্ম হয়ে গিয়েছিল। সেই পাহাড়টি কোথায়? তখন তিনি আংগুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিলেন।
আরও কয়েকটি দৃশ্য দেখুন
বৃহৎ পাথরের পাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে
উক্ত পাহাড়ের ছবিসহ বাকী বর্ণনা আগামী কিস্তিতে আসবে ইনশাল্লাহ। আশা করি সে পর্যন্ত সাথেই থাকবেন।
লোকটি আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন ঐযে সেই পাহাড় যে পাহাড়ের দিকে মুসা (আঃ) কে আল্লাহ তায়ালা দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে বলেছিলেন।
ঘটনাটা আগে খোলাসা করা দরকার। একবার হযরত মুসা (আঃ) আল্লাহ তায়ালার কাছে আবেদন করে বললেন: হে আল্লাহ! আমি তোমাকে দেখতে চাই। আল্লাহ তায়ালা বললেন: তুমি কখনো আমাকে দেখতে পাবে না। এছাড়াও বললেন: তুমি ঐ পাহাড়ের দিকে তাকাও। যদি সে নিজ স্থানে স্থির থাকে তাহলে, অচিরেই তুমি আমাকে দেখতে পারবে। আল্লাহ তায়ালা যখন পাহাড়ের উপর তার নুরের একটা ঝলক দিলেন তখন তা পাহাড়কে চুর্ণ-বিচুর্ণ করে দিল। মুসা (আঃ) এটা দেখে বেহুশ হয়ে গেলেন।
অপলক নেত্রে দেখে নিলাম পাহাড়টাকে। এটা আমরা যে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছি তার থেকে উত্তর পুর্বকোণে অবস্থিত। পাহাড়টাকে দেখে মনে হচ্ছে আসলেই এটা আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরবর্তী ছাইয়ের স্তুপ। কোন সময় হয়ত এটা আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। কুরআন শরীফের বর্ণনাটা দেখলে এখানকার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। আসুন! কুরআনের বর্ণনাভংগীটা দেখে নিই।
এ সম্বন্ধে কুরআন শরীফে বলা হয়েছে-
“আর আমি মূসাকে (আঃ) ত্রিশ রাত-দিনের জন্য (সিনাই পর্বতের ওপর) ডাকলাম এবং পরে দশ দিন আরো বাড়িয়ে দিলাম। এভাবে তার রবের নির্ধারিত সময় পূর্ণ চল্লিশ দিন হয়ে গেলো। যাওয়ার সময় মূসা (আঃ) তার ভাই হারুনকে (আঃ) বললেন: আমার অনুপস্থিতিতে তুমি আমার জাতির মধ্যে আমার প্রতিনিধিত্ব করবে,সঠিক কাজ করতে থাকবে এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পথে চলবে না। অতপর মূসা (আঃ) যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলেন এবং তার রব তার সাথে কথা বললেন তখন তিনি আকূল আবেদন জানিয়ে বললেন, হে প্রভু! আমাকে দর্শনের শক্তি দাও,আমি তোমাকে দেখব। তিনি বললেনঃ তুমি আমাকে দেখতে পারবে না। হাঁ, সামনের পাহাড়ের দিকে তাকাও। সেটি যদি নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে তাহলে অবশ্য তুমি আমাকে দেখতে পাবে। কাজেই তার রব যখন পাহাড়ে জ্যোতি প্রকাশ করলেন তখন তা তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল এবং মূসা (আঃ) সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলেন। সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে মূসা (আঃ) বললেন: পাক-পবিত্র তোমার সত্ত্বা। আমি তোমার কাছে তাওবা করছি এবং আমিই সর্বপ্রথম মুমিন। আল্লাহ তায়ালা বললেন হে মূসা (আঃ)! আমি সমস্ত লোকদের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে তোমাকে নির্বাচিত করেছি; যেন আমার নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করতে পার এবং আমার সাথে কথা বলতে পার। কাজেই আমি তোমাকে যা কিছু দেই তা নিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। এরপর আমি মূসাকে (আঃ) কতকগুলো ফলকে জীবনের সকল বিভাগ সম্পর্কে উপদেশ এবং প্রত্যেকটি দিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ লিখে দিলাম এবং তাকে বললামঃ “এগুলো শক্ত হাতে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং তোমার জাতিকে এর উত্তম তাৎপর্যের অনুসরণ করার হুকুম দাও। শীঘ্রই আমি তোমাদের দেখাবো ফাসেকদের গৃহ।” (সুরা আ’রাফ: ১৪২-১৪৫)
পাহাড়টাকে কালো ছাইয়ের স্তুপের মতই দেখাচ্ছে। সেদিকে মানুষ একেবারেই যায় না। সবার শুধু আগ্রহ আমরা যে পাহাড়ে গিয়েছি সেটার দিকে। কেন সেদিকে কারও দৃষ্টি নেই তা আল্লাহ তায়ালাই ভাল জানেন। হয়ত ওই পাহাড়ের উপর দেখার কিছুই নেই সেজন্যই সেদিকে মানুষের কোন আকর্ষণ নেই।
পুড়ে যাওয়া সেই ঐতিহাসিক পাহাড়
আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, তুর পাহাড়ের পুড়ে যাওয়া অংশের ছাই থেকেই সুরমা তৈরী হয়। আর সেই সুরমা আমরা আমাদের চোখে দিয়ে থাকি। আমারও সে রকম ধারণা ছিল মানুষের মুখে মুখে শুনে। কিন্তু, মিশরে এসে এ কথার কোন সত্যতা খুজে পেলাম না। এ কথার সত্যতা না পেয়ে আমার কাছে সুরমা তৈরীর আসল কাহিনী জানতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু, অনেক খুজেও সেটা বের করতে পারলাম না। সুরমা কি থেকে তৈরী হয় কারও জানা থাকলে আশা করি আমাদেরকে জানিয়ে বাধিত করবেন।
চুড়া থেকে মাঝে মাঝে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখছি মানুষ চলাচলের রাস্তা কেমন দেখায় সেটা লক্ষ্য করার জন্য। দেখলাম ছোটছোট পিপড়া যেমন লাইন ধরে রাস্তা চলাচল করে মানুষগুলোকে অনেকটা সে রকমই দেখাচ্ছে ।
উপরে ছিলাম বেশ কিছুক্ষন। একটু পরেই আস্তে আস্তে সবাই নামতে শুরু করল। তাড়াতাড়ি না নামলে পাথরের পাহাড় গরম হয়ে যাবে তখন গরমে নামতে কষ্ট হবে। আমার মনে বলছিল আর কিছুক্ষন থেকে যাই। কারণ, জীবনে আর কখনো আসা হবে কিনা আল্লাহ তায়ালাই ভাল জানেন। হয়তবা এটাই তুরে সীনা অভিমুখে আমার জীবনের শেষ ট্যুর হতে পারে।
আশে পাশের বেশ কিছু ছবি দেখে নিন।
ফ্রেন্ডরা নিচে নামছে
আস্তে আস্তে সবাই নেমে গেল। আমি ঘুরে ফিরে দেখছি। আর এক ফ্রেন্ড আছে মসজিদের ভিতরে। তার অপেক্ষা করছি উদ্দেশ্য হচ্ছে একসাথে নামব। নামছিলাম এমন সময় দেখলাম মিশরস্থ বাংলাদেশ দুতাবাসের যে লোক স্বপরিবারে আমাদের সাথে ট্যুরে গিয়েছিলেন তার ওয়াইফ, তার ছেলে, মেয়ে ও দুতাবাসের রাষ্ট্রদুতের গাড়ীচালকের ওয়াইফ (সম্ভবত আসতেছে আমাদের আরেক ফ্রেন্ডের সাথে। তারা মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তাদের টার্গেট ছিল তারা যে কোন মুল্যে পাহাড় চুড়ায় উঠবে। দুইজন মহিলা ওই ফ্রেন্ডের সাথে সবে মাত্র চুড়ায় পৌছল। ওদেরকে সাথে নেয়ার কারণে ফ্রেন্ডেরও আসতে দেরী হয়েছে নইলে অনেক আগেই পৌছত। ফ্রেন্ড আমাকে বলল: আনোয়ার ভাইয়ের ওয়াইফ (দুতাবাসের কর্মকর্তা) আর তার ছেলে কিছুদুরে নিচে অপেক্ষা করছে। তারা এখনই আসবে। ওখান থেকে চুড়ায় আসতে সর্বোচ্চ ৫/১০ মিনিট লাগবে। আর যে দুইজন উপরে উঠেছে তারা সামান্য পথ বাকী থাকতেই হতাশ হয়ে গিয়েছিল। তারা বলেছিল চলেন ফিরে যাই। আর যেতে পারছি না। আমার ওই ফ্রেন্ড তাদেরকে অনুরোধ করে বলেছে আপনারা এতক্ষন নিজ উদ্দোগে এসেছেন। এবার আমার অনুরোধে আর মাত্র কয়েক মিনিট আসেন। এই ৫/১০ মিনিট আমার।
সবশেষে তারা চুড়ায় পৌছায়। অনেক ফ্রেন্ডের মতে: ওইদিন হয়ত সর্বপ্রথম কোন বাংলাদেশী নারীর তুর পাহাড়ের চুড়ায় আরোহন। পরে, আনোয়ার ভাইয়ের ওয়াইফ ওয়েট করার পর আর উপরে উঠার সাহস করেনি। ওখান থেকেই আবার নিচে নেমে এসেছে।
এদিকে দুতাবাসের উক্ত কর্মকর্তা ও বেশ কিছু লোক নিচেই ছিল। তারা কষ্ট হবে বলে উঠতে চায়নি।
এবার ফ্রেন্ডের সাথে নিচে নামতে শুরু করলাম। ফ্রেন্ডদের আসতে দেরী হচ্ছে। কারণ, মেয়েরা রাস্তা চলাচল করে ধীর গতিতে। সেটা সবারই জানা আমি সেটা বিস্তারিত নাইবা বললাম। ব্লগে এ কথা বলার কারণে মহিলারা আবার আমার উপর হয়ত রেগে যেতে পারেন। নাহ, রাগ করার কিছুই নেই। সব মহিলা এক রকম না। অনেক মহিলা আছে যাদের কাছে পুরুষেরা যে কোন কাজে হার মানতে বাধ্য। ফ্রেন্ডকে বললাম- আপনার আসতে তো অনেক দেরী হবে পরবর্তী স্পটে (আগেই বলেছিলাম প্রবেশপথের গীর্জাতে পরে ঢুকব) আগে ভাগেই পৌছানো দরকার। অনুমতি দিলে আমি আগেই নেমে যাই। ফ্রেন্ড বলল: ঠিক আছে। আপনি নেমে যান। আমি এদের সাথে আসছি। নামতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে অনেক আঁকাবাঁকা রাস্তা বাদ দিয়ে সরাসরি পাথরের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এখানেও ইচ্ছা সময় নষ্ট যেন না হয়। মাঝে মাঝে উট চলাচল করছে আরোহী ট্যুরিস্টদেরকে নিয়ে। যাওয়ার সময় যতটা সময় লেগেছে তার চেয়ে অনেক কম সময়েই নিচে নেমে আসলাম।
গত ১৮ই মার্চ ২০১০ সুয়েজ খাল অভিমুখে টুরে গিয়েছিলাম। বিভিন্ন দেশের প্রায় পঞ্চাশজন ছাত্র একসাথে গিয়েছিলাম "ফরেন স্টুডেন্ট সিটি" থেকে সুয়েজ খাল তীরবর্তী ঈসমাঈলীয়া সিটিতে। টুরের ব্যবস্থা করেছিল "আল-আযহার ইউনিভার্সিটি" কর্তৃপক্ষ।
যা হোক, সেখানে আমরা একেবারে সুয়েজখালের পাশেই একটি পার্কে প্রায় ৫ ঘন্টার মত সময় কাটিয়েছিলাম। নিচে কয়েকটি ছবি আপনাদের সাথে শেয়ার করা হল।
সুয়েজ খালের উপর থেকে
সুয়েজ খাল
দূর থেকে সুয়েজখালের উপরস্থ ঐতিহাসিক সালাম ব্রিজ
ঐতিহাসিক সালাম ব্রিজ সামনে থেকে
--------------------------------------
নীলনদের ছবি
ইসমাইল একেবি এর ব্লগ থেকে কপি করা হয়েছে
0 comments: