মাঝে সবুজ গাছ- গাছালী বেষ্টিত এ সিটিতে ১০৫ টি দেশের মধ্যে আমরা বেশ কিছু বাংলাদেশীও থাকি। এ এলাকাটা শুধুমাত্র বৃত্তিপ্রাপ্ত বিদেশী ছাত্রদের জন্যই নির্ধারিত। বাইরের অন্য কাউকে সচরাচর এখানে ঢুকতে দেয়া হয় না। স্টাফ ছাড়া মিশরীয়দেরও এখানে প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এলাকাটার চারিদিক প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এর দুইটি গেটে সার্বক্ষনিক সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকজন পুলিশ পাহারায় থাকে। ছাত্রদের যত মেহমানই আসুক তাকে ভিতরে আনা সাধারণত টাফ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অনুমতি না দিলে কোন কিছু করার নেই। তাকে রিসিপশন থেকেই বিদায় জানাতে হয়। তবে, বাইরে যেখানেই যাক এখানকার ছাত্ররা স্বাধীন। রাত্র-দিন ২৪ ঘন্টাই ছাত্র সিটিতে প্রবেশ কিংবা সিটি থেকে বের হতে পারে। তবে, ভিতরে প্রবেশ করার সময় স্টুডেন্ট সিটির কার্ড দেখানোর নিয়ম রয়েছে।
আমাদের যে সমস্ত ফ্রেন্ড বাইরে থাকে তাদের এখানে আসতে হলে অনুমতি ছাড়া ভিতরে ঢুকার কোন ব্যবস্থা নেই। তারা শুধুমাত্র রিসিপশন রুম পর্যন্ত আসতে পারে। পুলিশকে অনুরোধ করলে পুলিশের যদি দয়া হয় তবে, কিছুক্ষনের জন্য ঢোকার অনুমতি দিতে পারে। এক ফ্রেন্ড দেশে যাওয়ার সময় আমাকে বলেছিলেন: উনি নাকি কায়রোতে ছিলেন চার বছর। অথচ, ইসলামিক স্টুডেন্ট সিটির ভিতরে ঢোকার অনুমতি মিলেছে মাত্র দুই বা তিনবার। পুলিশ ছাড়াও সিটির ভিতরে আছে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার অফিস। তারাও ভিতরে দেখাশোনা করে থাকেন।
এখানে ছাত্রদের থাকার জন্য বিল্ডিং আছে প্রায় ৪৫ টি। দুই বিল্ডিঙয়ের মাঝে বিভিন্ন সুশোভিত গাছ আছে। দুই বিল্ডিঙয়ের মাঝে রাস্তাও আছে। সেখান দিয়ে প্রয়োজনে ছোট ট্রাক চলাচল করতে পারে। এ ছাড়া রাস্তার দুইপাশে একধরণের উদ্ভিদ দিয়ে বেড়া তৈরি করা হয়েছে। যেমন আমাদের দেশে সম্ভবতঃ ডাক বাংলা গাছ (নিশ্চিত নই) দিয়ে বেড়া দেয়া হয়। এক কথায় মনমুগ্ধকর করেই পরিকল্পিতভাবে এ সিটিকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। ভিতরে আছে একটি অডিটরিয়াম, একটি মসজিদ। এছাড়াও ছাত্রদের জন্য একটি বিশাল খেলার মাঠ রয়েছে স্টুডেন্ট সিটির পাশেই। সেখানে ছাত্ররা ফুটবল, ভলিবল ইত্যাদি খেলাধুলা করে থাকে। বর্তমানে খেলার মাঠের পাশে সুইমিং পুলও তৈরি করা হচ্ছে। এখন সেটা নির্মানাধীন।
বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের জন্য তিনটি হাসপাতাল আছে। চিকিৎসায় হাজার হাজার ডলার খরচ হলেও তারা এই হাসপাতালগুলো থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবে। স্টুডেন্ট সিটি থেকে একটা টোকেন নিয়ে গেলেই তারা চিকিৎসা করে এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ দিয়ে দেয়। শুধু এতটুকুই নয়, কোন ছাত্র যদি মিশরে মারা যায় এবং ছাত্রের আত্মীয় স্বজন লাশ দেশে না নিতে চায় তাদের দাফন করার জন্য একটা গোরস্থানও আছে। মরলেও চিন্তা করা লাগবে না। দুইদিন আফ্রিকান দুইজন ছাত্রকে দাফন করার জন্য সেখানে গিয়েছিলাম। ঘুরে এসে যখন ফ্রেন্ডদেরকে সবকিছু বললাম তখন পিরোজপুর জেলার একজন ফ্রেন্ড বলল: আমি যদি মারা যায় দেশে আমার লাশ অবশ্যই পাঠিয়ে দেবেন। সেই ফ্রেন্ড এখন বাংলাদেশে।
আমরা এখানে বিভিন্ন দেশের ছাত্রদের সাথে মেশার কারণে বিভিন্ন দেশের কালচার সম্বন্ধ সহজেই জানতে পারি। বলা যায় যে- আমরা একটা মিনি ওয়ার্ল্ডে অবস্থান করছি। যেখানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের লোককেই পাওয়া যাচ্ছে।
তাহলে, আসুন! আমরা দেখে নিই ইসলামিক স্টুডেন্ট সিটিটা দেখতে কেমন?
উপর থেকে তিন নম্বর সারির ১ম রুমে (পাইপের পাশে) সুদীর্ঘ ৪ টি বছর কাটালাম।
দূরে মেয়েদের ছাত্রাবাস দেখা যাচ্ছে।
স্টুডেন্ট সিটি মসজিদ
স্টুডেন্ট সিটি মসজিদ।
আর মাত্র এক সপ্তাহেরও কম সময়ে আমাকে এত সুন্দর মিনি পৃথিবীকে ছাড়তে হবে। চলে যেতে হবে দেশে। আমাদের বড় ভাইয়েরা বলে থাকেন- সিটি থেকে বের হলেই বুঝা যায় যে, সিটির কদর কত!! সিটিতে থেকে সেটার কদর বুঝা যায় না।
ফাতেমী খলীফাদের আমলে খলীফা মুঈজ লি দ্বীনিল্লাহর নির্দেশে ৩৫৯হিজরীর ১৪ই রমজান ইংরেজী ৯৭১খৃষ্টাব্দে আযহার মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। এর ২ বছর পর ৩৬১ হিজরির ৭ ই রমজান নামাজ পড়ার মাধ্যমে এর শুভ উদ্বোধন করা হয়। রাসুল (সাঃ) র কলিজার টুকরা সন্তানফাতেমার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে "জামেউল আযহার"।
এখানে শিক্ষাদান শুরু হয় ইংরেজী ৯৭৫ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে (আরবী ৩৬৫ হিজরী)। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে।
আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বড় একটা বিশ্ববিদ্যালয়। আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬২ টি ফ্যাকাল্টি ও মিশরের বিভিন্ন শহরে ৫টি শাখা রয়েছে।এর একেকটি ফ্যাকাল্টির আন্ডারে আবার বেশ কয়েকটি করে সাবজেক্ট রয়েছে।এটাতে ছাত্র সংখ্যা সাড়ে চার লক্ষ।(পেপারের ভাষ্য মতে)
একবার শুনেছিলাম থিওলজী ডিপার্টমেন্টে একটা ইয়ারের ছাত্রসংখ্যা ১৭ হাজার। এজন্য বিশাল বিশাল চারটি হল তাদের ক্লাসের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। এছাড়া আমি যে ফ্যাকাল্টিতে ছিলাম (ইসলামী আইন অনুষদ) সেখানে প্রথম বর্ষে লোক ছাত্রসংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার।
এখানে ইসলামী শিক্ষা,বিজ্ঞান,কমার্স,ইঞ্জিনিয়ারিং,মেডিক্যাল সহ প্রায় সমস্ত বিষয়ে অনার্স,মাস্টার্স ও ডক্টরেট করানো হয়।ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা শাখা আছে। হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী এখানে অনার্স,মাস্টার্স ও ডক্টরেট করছে।
মেয়েদেরকে উচ্চ শিক্ষিত (ডক্টরেট ডিগ্রীধারী)মহিলারাই ক্লাস নেন। সেখানে সম্পূর্ণ মহিলা। কোন পুরুষ নেই। মহিলারাই পূর্ণ শাখাকে পরিচালনা করে।
আযহারে শুধু মহিলারাই পড়ে তা নয় বরং,অন্ধ লোকেরাও আযহার থেকে অনার্স মাস্টার্স ও ডক্টরেট করে। বেশ কয়েকজন অন্ধ ডক্টরও আছেন তারা ক্লাস নেন। বিশেষ করে তাদের অধিকাংশই দর্শন ক্লাস নেন।তারা যখন ক্লাস নেন তখন ছাত্রদেরকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা কিংবা দেখে দেখে পড়তে বললে ছাত্র যদি ভুল করে ফেলে তাহলে বলেন:- এই ছেলে এখানে অমুক শব্দ বাদ দিলে কেন? দেখ ওখানে অমুক শব্দের পরে অমুক শব্দটি আছে। আল্লাহ এদের অনেক স্মরণ শক্তি দিয়েছেন। আমাদের ফ্যাকাল্টিতে আমাদের ক্লাসে দুইজন অন্ধ ছিল কিছুই দেখতে পেত না।বাস্তবে দুনিয়ার কোন কিছু না দেখতে পেলেও তারা তাদের মা কিংবা ভাইয়ের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নিয়মিত ক্লাস করে। ক্লাসের পড়া মুখস্ত করে এবং পরীক্ষার সময় হলে নিচু ক্লাসের কোন পিচ্চিকে সাথে করে নিয়ে আসে। পিচ্চি এর কাছ থেকে শুনে শুনে যা লেখার দরকার লিখে দেয়।
এখানকার ছাত্রদেরকে প্রতি বছর সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে কুরআন শরীফ মুখস্ত করতে হয়। বিদেশী ছাত্রদেরকে প্রতি বছর ১ পারা করে আর মিশরী ছাত্রদেরকে পূর্ণ কুরআন শরীফ মুখস্ত করে মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়। মিশরী ছাত্রদেরকে চার বছরে সম্পুর্ণ কুরআন শরীফ মুখস্ত করতে হয়। এ জন্য অমুসলিমরা এখানে পড়ে না বা শিক্ষকতা করে না।
এদেশের ছাত্রীরা ছাত্রদের থেকে কোন অংশেই পিছিয়ে নেই। তারা নিজেরা হিজাব পরে নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। মহিলা আলেমরা বিভিন্ন স্থানে মহিলাদের মাঝে বক্তৃতাও করে থাকেন।
এখানকার খরচ অনেক। তবে, ইসলামিক ফ্যাকাল্টীগুলোতে নামেমাত্র সামান্য খরচ নেয়। অন্যান্য সাবজেক্ট যেমন- ইংরেজী মিডিয়াম,ইঞ্জিনিয়ারিং,মেডিক্যাল,কৃষি শিক্ষা,ট্রান্সিলেশন,পদার্থ বিজ্ঞান,রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি সাবজেক্টে প্রতি বছরের খরচ প্রচুর। তবে,আমরা আলহামদুলিল্লাহ সরকারী স্কলারশীপে এসেছি। তাই,আমাদের পড়াশুনাসহ সমস্ত খরচ সরকার বহন করে থাকে।
এখান থেকে একজন ছাত্র যদি ডাক্তার হয়,সে একাধারে কুরআন শরীফের হাফেজ হয়ে বের হয়। লোকটা যে সাবজেক্টেই পড়ুক না কেন সে কুরআনের হাফেজ হয়ে বেরিয়ে আসে। ফলে আমাদের দেশের মত নিজ ধর্ম ও স্বকীয়তা বিকিয়ে দিয়ে নাস্তিক হয় না। এ দেশের মহিলারা কুরআন হাদীস যেমন বুঝে আমাদের দেশের একজন সাধারণ আলেম তার সামান্যও বুঝে না।
আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে এদেশের লোকজন প্রচুর সম্মান করে।আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের প্রটৌকল হচ্ছে এদেশের প্রধানমন্ত্রীর সমান।একইসাথে তিনিই পদাধিকারবলে মিশরের গ্রান্ড ইমামের পদে সমাসীন হন।আশির দশকে প্রেসিডেন্ট আনওয়ার সাদাত নাকি তার মর্যাদাকে প্রধানমন্ত্রীর সমান স্তরে নিয়ে এসেছেন। সেদিক থেকে তিনি সরকারের কাছে অত্যাধিক সম্মানের পাত্র।
আসুন! আমরা আল আযহারের বিভিন্ন দৃশ্য একনজর দেখে নিই।
প্রশাসন ভবনের সামনে ছাত্ররা প্রতিবাদ সমাবেশে নামাজ আদায় করছে।
কমার্স ফ্যাকাল্টি
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের একাংশ
ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি
ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি
ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি
ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি
ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি
ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি
আরও কয়েকটি বিল্ডিং
কনফারেন্সে মিশরীয় গ্রান্ড মুফতী
ক্লাসের বাইরে এখনও মসজিদে বিশেষভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত দারসের সুযোগ থাকে। যে কেউ এ মজলিসে এসে বসতে পারে। এখানে কেউ বুখারী শরীফ পড়ান, কেউ বা আবার অন্যান্য বিষয় পড়ান। এগুলো বিভিন্ন আলেমদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং বিনামূল্যে। ছবি গ্রান্ড মুফতী মানুষের মাঝে দারস দিচ্ছেন।
মানুষ গ্রান্ড মুফতীকে ঘিরে ধরেছে
মানুষ গ্রান্ড মুফতীকে ঘিরে ধরেছে
পরীক্ষার সময় স্থান সংকুলান না হওয়ায় কিছু কিছু ছাত্রকে এভাবে বারান্দায় পরীক্ষা দিতে হয়।
ক্যাম্পাসের ভিতরের রাস্তা।
মিশরে জালভোটের বিরুদ্ধে মিশরীয় ছাত্রদের বিক্ষোভ
প্রশাসন ভবন
এভাবেই ক্লাস কানায় কানায় ভর্তি থাকে। এটা ৪র্থ বর্ষের একটি ক্লাস।
কমার্স ফ্যাকাল্টি
মেয়েদের শাখা (সংগৃহিত)
বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছেন গ্রান্ড মুফতী। এভাবেই মাইক দিয়ে ক্লাস করান শিক্ষকবৃন্দ
মেইন গেট
মেডিকেল ফ্যাকাল্টি
ভাষা ও অনুবাদ অনুষদ
মেয়েদের শাখার একটা বিল্ডিং
দাওয়াহ ফ্যাকাল্টি
প্রশাসন ভবনের পূর্ব পার্শ্বে
প্রশাসন ভবনের পশ্চিম দিকে সড়ক
আমাদের ফ্যাকাল্টি (আইন অনুষদ)
কনফারেন্স হল
দূর থেকে কনফারেন্স হল।
দাওয়াহ ফ্যাকাল্টি
দাওয়াহ ফ্যাকাল্টির অন্য দিক
ফিলিস্তিনীদের পক্ষে মিশরীয় ছাত্রদের বিক্ষোভ
ফার্মেসী ডিপার্টমেন্ট
ফার্মেসী ডিপার্টমেন্ট
আযহার মসজিদ চত্ত্বর
আযহার মসজিদ চত্ত্বর
আযহার মসজিদের গেট
আযহার মসজিদ চত্ত্বর
আযহার মসজিদ
আযহার মসজিদের ভিতরে।
আযহার মসজিদের গেট
আযহার মসজিদে নামাজ হচ্ছে
আযহার মসজিদে নামাজ হচ্ছে
আযহার মসজিদে নামাজ হচ্ছে
ছাত্ররা নিরিবিলি আল আযহার মসজিদে বসে পড়াশুনা করছে।
ছাত্ররা মসজিদে বসে নিরিবিলি পড়াশুনা করছে।
আল আযহার মসজিদ
মসজিদের ভিতরের দৃশ্য
উপর থেকে আযহার মসজিদের দৃশ্য
মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ
মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ
মহিলা শাখার ক্লাসরুম
ইসমাইল একেবি এর ব্লগ থেকে কপি করা হয়েছে।
0 comments: