সুবর্ণভূমি বিমানবন্দর |
আজকাল থাইল্যান্ড আমাদের অনেকের কাছেই ডাল ভাত হয়ে গেছে। আমরা অনেকেই এখন ছুটি বা চিকিৎসার কাজে থাইল্যান্ড চলে যাই। আমিও তেমন গিয়েছিলাম গত বছর আগস্টে আমার শ্বশুড় শ্বাশুড়ির সাথে আমার শ্বাশুড়ির চিকিৎসার কাজে।দেশটা সম্পর্কে প্রথমেই ইম্প্রেশনটা ভাল হয়ে যায় এয়ারপোর্ট থেকে ব্যাংকক যাওয়ার উড়াল পথটা দেখলে। মনে হয় আহা আমাদের দেশে এমন কবে হবে!!
ফ্লাইওভারটা প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ জুড়ে বিস্তৃত কিছু শাখা প্রশাখা সহ। এখানে ইউ টার্ণগুলো সব উপর দিয়ে উঠিয়ে দেয়া যা কিনা যানজটকে
একদমই পরিহার করতে সাহায্য করেছে। খেলায় করলে দেখবেন, আমাদের ঢাকায় চৌরাস্তা, তিন রাস্তাগুলোই যানজটের অন্যতম কারণ। রাস্তার অপ্রতুলতা, গাড়ি আধিক্য যত বড় করেই দেখেন না কেন, আমি নিশ্চিত আপনি যদি ক্রসিংগুলো পরিহার করতে পারেন, তাহলেই ঢাকার যানযট ৬০% কমে যাবে।
ব্যাংকক স্কাই ট্রেন
যাইহোক, আমরা ব্যাংককে সুকুমভিত সোই (রাস্তা) ৩ এ একটা সার্ভিস এপার্টমেন্টে ছিলাম, যেটা কিনা বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের ঠিক উল্টাদিকে। আমার শ্বাশুড়ীর এপয়েন্টমেন্ট ওখানেই করা ছিল, তাই হাসপাতালের কাছে থাকাতে বেশ সুবিধা হয়েছে।
পরের দিন সকালে হাসপাতালে গেলাম। বড়ই চমৎকার হাসপাতাল। আজকাল হাসপাতালগুলোকে ভাল হতে হলে একটা ফাইভ স্টার লুক নিতে হয়। খালি ভাল চিকিৎসা দিলেই চলে না। আসলে এখন মেডিকেল ট্যুরিজম এর ধারনা চালু হয়েছে। এই হাসপাতাল আরব দেশের মানুষের কাছে খুবই প্রিয় বোঝা গেল। তাদের জন্য পুরা আরবি ভাষায় ডিজিটাল বোর্ডসহ আলাদা বিশাল কাউন্টার আছে। সাদা আলখাল্লা পরা আরব দেশের পুরুষ আর কালো বোরখা পরা নারীদের দেখা প্রচুর মিলল। আমার শ্বাশুড়ীর চিকিৎসার বেশ কিছু টেস্ট ইন্ডিয়া থেকে করানো হয়েছিল। ডাক্তার ওই রিপোর্টগুলো দেখে বললেন, এই মুহুর্তে চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন নেই আর নতুন করে টেস্ট করারও দরকার নেই। দেশে গিয়ে একজন ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থেকে কিছু টেস্ট ফলো আপ করে সেই মত ব্যবস্থা নিলেই চলবে। বলা বাহুল্য থাইল্যান্ডে চিকিৎসা বেশ ব্যায়বহুল। ডাক্তারের ভিজিট ছিল বাংলা টাকায় প্রায় ৩৫০০ !!
পথে পথে ফলের দোকান
রামবুটান, খুব মজার একটা ফল
থাইল্যান্ড কিন্তু ফলের জন্য বেশ বিখ্যাত। দেখবেন রাস্তায় রাস্তায় ওরা ভ্যানে করে ফল বিক্রি করছে। দেখতে খুব সুন্দর লাগে, হরেক রকম ফল, রংবেরং এর। বিচি ছাড়া পেয়ারা, ড্রাগন ফল, আম, পেপে, কলা, তরমুজ, লংগান, রামবুটান, এরকম অনেক ফল দেখবেন। তবে আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছি রামবুটান ফলটি। এটা আপনি দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পাবেন। ফলটি দেখতে একটু জংলী কিন্তু খেতে খুবই মজা। ভেতরটা অনেকটা লিচুর মত। আমি সাধারনত দুই কেজি কিনতাম ২৫ বাথ দিয়ে, যতক্ষন পেট না ভরত খেতে থাকতাম। আগোরায় এই ফল বিক্রি করে সম্ভবত ৪০০ টাকা কেজি যেটা কিনা, থাইল্যান্ড মালয়শিয়ার সবচে সস্তা ফল। আর বাকি সব ফলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।
যাইহোক, যেহেতু শ্বাশুড়ীর চিকিৎসা করানো লাগবে না, সামনে ৫/৬ দিন ফাকা পেয়ে গেলাম। ভাবলাম, ফুকেট ঘুরে আসি। শুনেছি জায়গাটা নাকি খুব সুন্দর।ভাবলাম হাতে সময় আছে, বাসেই যাই। ওরা বলল আজ রাতে রওনা দিলে কাল সকাল ১০/১১ টায় পৌছে যাব। কিন্তু বাসে রওনা দিয়ে বুঝতে পারলাম জীবনের সবচেয়ে বড় একটা ভুল করলাম। বলা বাহুল্য আমার সাথে আমার শ্বশুড় শ্বাশুড়ীও আছেন। ভাই পাক্কা ২৪ ঘন্টা লেগেছিল যেতে। বাস প্রথমে ছাড়তেই চায় না। এইখানে ওইখানে লোক টোকায়। আর এর মধ্যে বাসে যারা উঠছে, আর তাদের যা ড্রেস আপ তা দেখে আমাদের তিনজনকে বাসে একরকম চিড়িয়াই লাগছিল। এর মধ্যে আমার শ্বশুড়ের ভাগিনা যে কিনা তখন সস্ত্রীক ব্যাংককেই ছিল আমাদের সাথে একই হোটেলে, আমি বাসের টিকিট কাটার পর বলল যে, ফুকেটের সৈকতেতো প্রচুর “টপ লেস” থাকে। শুনেতো আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। এরপর বাসের সহযাত্রীদের দেখে চিন্তাটা আরো গাঢ় হল। বাস ছাড়ার আগে একপর্যায়ে শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীকে বলেই ফেললাম, চলেন আপনাদের হোটেলে পাঠিয়ে দেই, কারণ এটাও বুঝতে পারছিলাম, যে জার্নিটাও খুব একটা আরামদায়ক হবে না। কিন্তু আমার শ্বশুড় বললেন, রওয়ানা দিয়েছি যখন চল যাই।সে এক অসহ্য যাত্রা, পথই ফুরায় না, বাস লেইট করে। শ্বশুড়কে বললাম, আপনি বাংলাদেশকেও হয়ত এত ভাল ভাবে দেখেন নি, যেই পরিমাণ থাইল্যান্ডকে দেখলেন !!!
যাইহোক, ফুকেট পৌছে হোটেলে উঠে প্রথমেই আমি একা বিচ বরাবর একটা হাটা দিলাম এবং মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।আমরা ফুকেটের মেইন বিচ “পাতং” এই ছিলাম। সম্ভবত তখন অফ পিক সিজন বলে ভিড় একটু কম, আর বিচে একটাও টপ লেস খুজে পেলাম না !!
এর আগে একটা মজার ঘটনা হয়েছে। ফুকেটে পৌছার একটু আগে গাড়ী একটা এজেন্সির সামনে থামল। ড্রাইভার বলল আপনারা যারা চান এখান থেকে হোটেলের বুকিং দিতে পারেন। আমি আর আমার শ্বশুড় নামলাম। একজন লেডি বয় (হিজড়া) কাউন্টারে বসে আছে। একটা হোটেল বুকিং দিলাম। বুকিং এর সময় এক পর্যায়ে এজেন্ট বলল, “No lady charge” থাই ইংলিশ আবার এক জটিল ইংলিশ। আমি প্রথমে বুঝতে পারলাম না। ও দ্বিতীয়বার বলার পর আমি বুঝে গেলাম, আর চেপে গেলাম সাথে সাথে। জানি না আমার শ্বশুড় বুঝতে পেরেছিল কিনা। হোটেলে এসে দেখি রিসেপশনের দেয়ালে বড় বড় করে লেখা “Lady charge = 300 Bath”। মানে আপনি যদি বাইরে থেকে কোন মেয়ে নিয়ে আসেন, তাহলে ৩০০ বাথ চার্জ দিতে হবে, কিন্তু এখন অফ পিক বলে “No lady charge”। হা হা….
যাইহোক পাতং বিচ কিন্ত খুব ছোট। আপনি দেখে হতাশ হবেন। ভাববেন, এত পয়সা খরচ করে এখানে এসে কি লাভ। হোটেলগুলো সব বিচের ধারে গড়ে উঠেছে। ফুকেটের আসল মজা হল, এখান থেকে আপনি অনেকগুলো আইল্যান্ড হপিং ট্যুর নিতে পারবেন যেগুলো অসাধারণ !! আমার হাতে একদিন সময় ছিল। আমাকে বলল আপনি “ফি ফি আইল্যান্ড” ট্যুরটা নেন। এই প্যাকেজে আমরা মায়া বে, মাংকি বিচ, ফি ফি আইল্যান্ড, খাই নক আইল্যান্ড, পিলেহ লেগুন দেখব। আর দুই জায়গায় আমরা স্নরকেলিং (snorkeling) করব। স্নরকেলিং যে এতো exiting সেটা কল্পনাও করতে পারবেন না। এটা হচ্ছে চোখে গগলস পরে, মুখে একটা পাইপ লাগিয়ে, পানির উপর দিয়ে ভেসে পানির নিচে দেখা। পানির নিচের জগৎকে এক অন্য জগৎ মনে হয়। রংবেরং এর প্রবাল আর মাছ সব আপনার গা ঘেষে চলে যাচ্ছে, ভেবে দেখুনতো একবার!! আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা অভিজ্ঞতা।পুরো দিনটাই আমি এনজয় করেছি। পানি, সমুদ্র, সৈকত, আকাশ সবই অদ্ভুত সুন্দর। আর ট্যুর অপারেটরদের সার্ভিসও খুব ভাল, একটু পর পর ঠান্ডা পানি, কোক; ভরদুপুরে সুস্বাদু এবং ঠান্ডা তরমুজ আর আনারস খাওয়ালো, কি যে শান্তি লেগেছিল সেই তপ্ত আবহাওয়ায়। বলা বাহুল্য, থাইল্যান্ড মোটামুটি গরম এলাকা, কিন্তু আর্দ্রতা একটু কম হওয়াতে মোটামুটি সহ্য করা যায়।
মায়া বে
মাংকি বিচ
পিলেহ লেগুন, আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে
ফি ফি আইল্যান্ড, খুব সুন্দর একটা ভিউ, এখানে আমরা দুপুরে লাঞ্চ করেছি।
ফি ফি আইল্যান্ড বিচ
ফি ফি দ্বীপে দুপুরের খাবার
আমাদের ট্যুর গাইড এর নাম তানিয়া। শুরুতে সে আমাদের সবাইকে এক অদ্ভুত থাই ইংরেজিতে কিছু কথা বলল। বলে রাখি, প্রথমেই আমাদের সবার হাতে একটা গোলাপী সুতা বেধে দেয়া হয়েছিল। এটা আমাদের টিম আইডেনটিটি। ওর অনেক কথার মধ্যে কষ্টকরে বুঝলাম, যখন সে “পি থি” বলে ডাকবে তখন আমাদের সবাইকে নৌকায় চলে আসতে হবে। এক পর্যায়ে ওকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা এই “পি থি” মানে কি? আমি ভেবেছিলাম এটা মনে হয় কোন থাই ভাষা হবে। পরে অনেক কষ্টে ও আমাকে বোঝালো, সে বলেছে, “পিংক টিম”, মানে গোলাপী দল। আমার তো হাসতে হাসতে জান শেষ!!! হায়রে ইংরেজি উচ্চারণ !!
আইল্যান্ড হপিং
রাতে হোটেলে ফিরে ভাবলাম, হোটেল রিসেপশনের সুন্দরী মেয়েটার সাথে একটু বিটলামী করি। মেয়েটার নাম নাদিয়া। বেশ শান্ত শিষ্ট ভদ্র মেয়ে মনে হল। জিজ্ঞেস করলাম, এই যে “Lady charge 300 Bath” লিখে রেখেছ, এটা কি জিনিস। ও আমাকে বোঝাল। বললাম, তো এই lady কই পাব? তোমরা কি supply দাও নাকি? বলে না আমরা তো দেই না, তবে আপনি যদি বাংলা রোডে যান, সেখানে পাবেন। ওখান থেকে নিয়ে আসতে পারেন। আমরতো চক্ষু চড়কগাছ !! বলে কি, বাংলা রোড, বাংগালীরা এইখানে এসে কোন আকাম কুকাম করে এই নাম রাখলো নাকি!! পরে ম্যাপে নামটার বানান দেখলাম। ওটা হল Bang La রোড। নামটা থাই ভাষাতেই, যাক বাচা গেলো !!
ফুকেট থেকে ব্যাংকক ফিরলাম প্লেনেই, ব্যাংকক এয়ার ওয়েজে। সার্ভিস বেশ ভাল, ভাড়া বেশ কম। মাত্র ১৩৫০ বাথ প্রতিজন। যেখানে বাসে আমাদের ১১০০ বাথের মত পড়েছিল। এয়ারপোর্টে ব্যাংকক এয়ারওয়েজের লাউঞ্জে ফ্রি স্ন্যাক্স, জুস এর ব্যবস্থা। খুবই ভাল লেগেছে।
একটা জিনিস বলে রাখি, এইযে ট্যুর প্যাকেজ নিলাম, প্লেনের টিকেট কাটলাম, এর জন্য কিন্তু আপনাকে ভাল যাচাই এবং দর কষাকষি করতে হবে, নইলে অনেক ঠকে যাবেন। সেই ক্ষেত্রে আমি বেশ ভাল একটা ট্রাভেল এজেন্ট পেয়েছিলাম যার কাছে সব কিছুই বেশ কমে পেয়েছিলাম। ট্রাভেল এজেন্টটার নাম ছিল Royal Friendly Tour Company Limited, নামে এবং কাজে খুবই মিল ছিল। কাউন্টারের মহিলা খুবই বন্ধুসুলভ ছিল এবং সার্ভিস খুব ভাল ছিল। এখানে ছোট্ট একটা ঘটনা বলে ফেলি। ফি ফি আইল্যান্ড ট্যুরটা শেষ করে বিকেলে যখন আমি হোটেলে গাড়ী থেকে নেমে গেছি, ভুলে আমার মোবাইলটা গাড়ীতে ফেলে আসি। রুমে ঢুকে তো মাথা গরম। কাল সকাল ৭ টায় ব্যাংককে যাবার ফ্লাইট। সাথে সাথে ফ্রেন্ডলি ট্যুর কোম্পানির দিকে ছুটলাম। ততক্ষণে আমাকে নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে ১৫ কি.মি. দূরে ফুকেট শহরে তার মূল অফিসে গাড়ী পার্ক করে চলে গেছে। ফ্রেন্ডলি মহিলাকে ঘটনাটা বলতেই সে সাথে সাথে যে কোম্পানী ট্যুর অপারেট করেছে তাদের ফোন দিল। ওরা বলল যে হ্যা গাড়ীর ভেতর ফোনটা আছে এবং রাতে আমার হোটেলে পৌছে দেবে। আমার আত্মায় পানি পেলাম কারণ ফোনটাতে অনেক জরুরী কন্ট্যাক্ট আছে। জানিনা আমাদের দেশে হলে ফোনটা পেতাম কিনা, ওরা রাত নয়টার দিকে আমাকে হোটেলে মোবাইল পৌছে দিয়ে গেছে।
সবশেষে একটা কথা বলি, থাইল্যান্ড কিন্তু উন্মুক্ত যৌনাচারের দেশ। এখানকার সব ট্যাক্সি এবং টুকটুক (অটোরিক্সা) ড্রাইভারই কিন্তু দালাল, তবে সৎ দালাল, আপনাকে বিপদে ফেলবে না, সার্ভিস দিয়েই টাকা নেবে। সুতরাং থাইল্যান্ডে গেলে একটু সতর্ক থাকতে হবে, যাতে আপনি কোন প্ররোচনায় পড়ে পথভ্রষ্ট না হন।
সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট এর পথে, বিদায় থাইল্যান্ড
ব্লগার মুহাম্মদ জহিরুল ইসলাম এর ব্লগ থেকে লেখাটি কপি (লিংক) করা হয়েছে। লেখকের কোন রকম আপত্তি থাকলে এটি মুছে ফেলা হবে।
0 comments: