২০০৩ সালে আমি বেশ লম্বা সময়ের জন্য ভারত ভ্রমনে বের হই, ২২ দিনে প্রায় ১০ টি শহর ঘুরি। সেবার খুব ইচ্ছে ছিল সিমলা এবং মানালি ঘোরার। সিমলা, মানালি এই নাম দুটোই আমার মনে অন্যরকম একটা একটা অনুভূতি সৃষ্টি করত। কিন্তু, ২০ দিন টানা ঘোরার পর সিমলা যাওয়ার আর শক্তি বা ধৈর্য্য কোনটাই অবশিষ্ট ছিল না। আমার যাও বা একটু ছিল, আমার বন্ধুর একেবারেই ছিল না।
তো সেই স্বপ্ন পূরণের পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত বাস্তবে এল ২০০৭ এর ফেব্রুয়ারি মাসে। আমাদের অফিসে কিছু যন্ত্রপাতি ভারতীয় এক কোম্পানী সাপ্লাই দিয়েছিল। তো সেটার মেইনট্যানেন্সের জন্য দিল্লীর এক দাদা বাংলাদেশে আসত। সেই যন্ত্র আবার অফিসে আমিই দেখাশোনা করতাম, তাই তার সাথে বেশ সখ্যতা জমেছিল। বড় একটা উপকার তিনি করলেন আমার। আমার এবং আমার বন্ধুর জন্য কলকাতা-দিল্লী’র ট্রেন টিকেট কেটে দিলেন অনলাইনে। রাজধানী এক্সপ্রেস, থ্রি টায়ার, এসি কামরা, ভাড়া ১৫০০ রুপী। দেশে কোন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে এই টিকেট কাটতে গেলে আরো অনেক বেশী খরচ পরত। এখান থেকে আপনাদের জন্য টিপস, যদি ভারতীয় কোন বন্ধু থাকে, তার মাধ্যমে টিকেট কাটান, ভারতে গিয়ে তার পয়সা পরিশোধ করে দেবেন।
২০ ফেব্রুয়ারী রাতে আমি এবং আমার বন্ধু সোহাগ পরিবহণের এসি বাসে চড়ে রওনা হলাম বেনাপোলের উদ্দেশ্যে। ফেরি ঘাটে গিয়ে দেখি গাড়ী নড়েই না। কুয়াশার কারণে সম্ভবত ফেরি চলাচলে বিঘ্ন। চিন্তায় পড়ে গেলাম। কারণ, পর দিন বিকেল পাচটায় কোলকাতা থেকে দিল্লীর ট্রেন। যাহোক, শেষ পর্যন্ত দুপুর দু’টা নাগাদ কোলকাতা গিয়ে পৌছালাম। পড়ি মরি করে কোনমতে দু’টো মুখে দিয়ে আর ডলার ভাংগিয়ে একটা ট্যাক্সি করে হাওড়া রেল স্টেশন দৌড় লাগালাম। ট্রেন ছাড়ার ২০/২৫ মিনিট আগে পৌছে প্ল্যাটফর্ম খুজে বগির সন্ধানে নেমে পড়লাম। ব্যাটা ট্রেন এত লম্বা, বগি আর খুজেই পাই না। প্রায় শেষ মাথায় গিয়ে বগি খুজে পেলাম। যাক, শেষ পর্যন্ত দিল্লী’র উদ্দেশ্যে যাত্রা !
এ প্রসংগে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একদা আমি রাজশাহী থেকে ঢাকা আসছিলাম, সিল্ক সিটি ট্রেনে চড়ে। তো ট্রেনে এক বাংলাদেশী মেডিক্যাল ছাত্রীর সংগে তার সহপাঠী এক ভারতীয় মেয়ে এবং তার পরিবারও ঢাকা আসছিল। পথে টাংগাইলের দিকে ট্রেন থামলে বাংলাদেশী মেয়েটি ওই ভারতীয় মেয়ের বাবা-মা’কে বলছিল, “"এই স্টেশনতো তেমন একটা বড় না, ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন অনেক বড় ! "
কথাটা শুনে আমি মনে মনে হাসছিলাম। আহা, বাংলাদেশী সেই ছাত্রী যদি জানত, ভারতীয় রেল স্টেশনগুলো কত বড় আর সেখানে কতগুলো প্ল্যাটফর্ম !!
আরামদায়ক এক ট্রেন ভ্রমন শেষে আমরা দিল্লী পৌছালাম ২২ ফেব্রুয়ারী সকাল ১১ টায়। ট্রেন থেকে নেমেই চলে গেলাম ফিরতি ট্রেনের টিকেট কাটতে। এই ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে ট্রেনের টিকেট অনেকটা সোনার হরিণের মত! পুরো ট্যুর প্ল্যান আমার আগে থেকেই করা ছিল, অন্ততঃ ফেরার তারিখ আগেই ঠিক, কারণ কোলকাতা থেকে ঢাকার বাসের ফিরতি টিকেটতো আগেই কাটা। ফরেন ট্যুরিস্ট রিজার্ভেশন কাউন্টারে গিয়ে প্রায় ৭/৮ দিন পরের টিকেট চেয়ে কনফার্ম টিকেট পেলাম একটা ! আরেকটা ওয়েটিং ! মানে এর মধ্যে যদি কেউ যাত্রা বাতিল করে, তবে সিরিয়াল অনুসারে আমাদের ওয়েটিং টিকেট কনফার্ম হয়ে যাবে। কাউন্টার ম্যান আশ্বাসও দিল, যে হয়ে যাবে, চিন্তা করবেন না।
স্টেশন থেকে বেরিয়েই পড়ে গেলাম দালালের খপ্পরে। এটা একেবারেই একটা কমন ব্যাপার এখানে। এবং এরা অনেকটা কাঠালের আঠার মত। আপনাকে ওদের অফিসে নিয়েই ছাড়বে। ২০০৩ সালে আমি যখন মুম্বাই থেকে দিল্লী এসে নামি, রাত তখন প্রায় নয়টা। নতুন শহর আর রাত হয়ে গেছে, সেবার যখন দালাল ধরল, ওদের অফিসে যেতেই হল। কারণ, হোটেল বা ট্যুর প্যাকেজ তো আমারো প্রয়োজন। অন্ততঃ জানা তো যাবে, হোটেলগুলো কোথায় বা কি কি দেখার আছে এখানে ! দালাল যে ট্যুর এবং ট্রাভেল এজেন্সিতে নিয়ে গিয়েছিল সেটার নাম ছিল “কণার্ক ট্যুর এন্ড ট্রাভেল এজেন্সি”। গিয়ে দেখি এক অতিশয় চালবাজ চেহারার লোক বসে আছে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনেই বাংলায় কথা বলা শুরু করল। বলে, ওর পরদাদারা নাকি নোয়াখালির বাসিন্দা ছিল। তো সে হোটেল দেখানো শুরু করল, ট্যুর প্যাকেজ দেয়া শুরু করল। যে প্যাকেজ দিচ্ছিল, সেটা বহন করার মত অর্থ তখন আমাদের দু’জনের কাছে নেই। বললাম, “ভাই আমরা যাই। আমাদের এত দামী হোটেল দরকার নাই।“ বলে, "“আরে দাদা যাচ্ছেন কোথায় বসুন।"“ এবার অন্য হোটেল, অন্য কম্বিনেশন। দাম কম। মানে সে আমাদের হোটেল/ট্যুর প্যাকেজ দিয়েই ছাড়বে ! সত্যি বলছি, আমি আমার জীবনে এমন কাঠালের আঠা কখনো দেখিনি ! শেষ পর্যন্ত বহু দর কষাকষি তার কাছ থেকেই হোটেল এবং ট্যুর প্যাকেজ নিতে হল !!
তো এবার ২০০৭ সালে দালাল যখন এজেন্সির অফিসে নিয়ে গেল, গিয়ে দেখি, ওমা এতো সেই কণার্ক ! সেই একই ব্যাক্তি বসে আছে ! চাপাবাজি আনলিমিটেড চলছেই ! মনে মনে বলি, “"বাছা, তুমি হয়ত আমাকে চেন নি, কিন্তু আমিতো জানি তুমি কি জিনিস ! এইবার আমি তোমারে সেই ভাবেই হ্যান্ডেল করব!! “"
প্রায় ঘন্টাখানেক চরম দর কষাকষির পর, যে প্যাকেজ ঠিক হল সেটা অনেকটা এরকম। টাটা ইন্ডিকা গাড়ীতে দিল্লী থেকে সিমলা এবং মানালি যাওয়া আসা, সিমলায় দু’রাত, মানালিতে তিন রাত, এরপর দিল্লী এসে তিন রাত, সিমলা মানালিতে ঘোরাঘুরি, দিল্লীতে অর্ধ দিবস সিটি ট্যুর এবং আগ্রা তাজমহলে এক দিনের ট্যুর, এই পুরো প্যাকেজ হল ১৬,০০০ রুপি ! ভারতীয় লোকজন শুনেও বলেছে, “খাসা একটা প্যাকেজ বাগিয়েছেন! “
সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের গাড়ী রওনা হল সিমলার উদ্দেশ্যে। দিল্লীতে তেমন একটা শীত ছিল না। রাত একটায় যখন সিমলা গিয়ে পৌছালাম, তখন সেখানে কন কনে ঠান্ডা ! হোটেলের মান সন্তোষজনক ছিল। রুমে ঢুকে টিভির চ্যানেল ঘোরাতে হঠাৎ দেখি চ্যানেল আই ! আজব ব্যাপার !
হিমাচল প্রদেশের রাজধানী শিমলা। বেশ পরিচ্ছন্ন। বাড়ি ঘরগুলো পাহাড়ের কোলে বেশ সুন্দরভাবে বানানো।
শহরের পরিচ্ছন্নতা সত্যিই প্রশংসনীয়...
অভিনেত্রী প্রিতী জিনতা’র বাড়ী কিন্তু এই সিমলাতেই। যে জায়গাতে ড্রাইভার আমাদের নিয়ে গিয়েছিল, সে জায়গার নাম মনে নেই। গাড়ী যখন পথ ধরে চলছিল, দু’ধারে তখন ভারী বরফের স্তুপ। বোঝা গেল, প্রচন্ড তুষারপাত হয়েছে কদিন আগে। যদিও আগে বরফ দেখেছি সিকিমের ইউমিসমডং এ, কিন্তু এখানকার বরফের ব্যাপ্তি খুব বেশী। তাই অন্যরকম ভাল লাগছিল। মনে হচ্ছিল ইউরোপে আছি। দিনটা যেহেতু খুব রৌদ্রোজ্জ্বল ছিল, ঘুরেও আরাম পাওয়া যাচ্ছিল।
এবার ছবিতেই দেখুন আমাদের ঘোরাফেরা।
বরফ ঢাকা চারিদিক...
এরকম বরফ ঢাকা পথে ঘোড়ায় চড়ে যেতে হয়...
পাহাড়ের ওপরে ওরা কার ড্রাইভিং ট্র্যাক বানিয়েছে...
বহু দূরে বরফ ঢাকা পাহাড়...
সিমলা গিয়ে যে সমস্যাটা হয়েছিল, সেটা হল এখানে অনেক হিডেন কস্ট আছে যেটা যারা আগে ওখানে গিয়েছে তারা বলে নি। ধরুণ, আপনাকে ওরা এক জায়গায় নিয়ে গেল, কিন্তু মূল জায়গায় যেতে হলে আপনাকে ঘোড়ার পিঠে চড়তে হবে, সেটার চার্জ ধরুন ৪০০ রুপি। পায়ে গাম্বুট পড়তে হবে বা গায়ে এক্সট্রা কোট চাপাতে হবে, সেটার চার্জ ধরুন ৩০০ রুপি। রাস্তার অবস্থা ঘোড়া চলাচলের কারণে এমন কাদা মাটি পূর্ণ থাকে যে আপনি চাইলেও হেটে যেতে পারবেন না। এই ঘোড়ার খরচের কারণেই সিমলার আরেকটা জায়গায় গিয়েও আর ঢুকিনি। ট্যুরের শেষে এই অতিরিক্ত খরচের কারণে একেবারেই খালি হাত হয়ে গিয়েছিলাম।
বিকেলে দু বন্ধু মিলে সিমলার পথে পথে ঘুরেছি। পাহাড়ী শহর আমার সবসময়ই পছন্দ।
পড়ন্ত বিকেলে সিমলা...
হিমাচল রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার প্রতিকৃতি...
ব্লগার মুহাম্মদ জহিরুল ইসলাম এর ব্লগ থেকে লেখাটি কপি (লিংক) করা হয়েছে। লেখকের কোন রকম আপত্তি থাকলে এটি মুছে ফেলা হবে।
0 comments: