যাইহোক, ২০০০ সালের পরও কিন্তু আমি ভারত গিয়েছিলাম ২০০৩ এ কিন্তু তখন ওইদিকটায় যাওয়া হয়নি। প্রসংগ যখন আসল, কয়েকটা কথা বলেই নেই। ভার্সিটিতে ক্লাশ শুরু হওয়ার পর যখন সহ
পাঠীদের সাথে মোটামুটি খাতির হয়ে গেল, তখন আমি সবার প্রতি একটা প্রস্তাব রাখলাম যে, আমরা যেখানে পড়ছি সেখানকার এযাবৎকালের রীতি হল, ছাত্ররা চতুর্থ বর্ষে একটা দশ দিনের শিক্ষা সফর এর সুযোগ পায়, যেটার খরচ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া দেশের বাইরে শিক্ষা সফরের কোন নজির নেই! তো আমি সবাইকে উৎসাহ দিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক জায়গায়ই ছাত্ররা বিভিন্ন স্পন্সর যোগাড় করে আর নিজেরা কিছু টাকা দিয়ে সার্কের অনেক দেশ ভ্রমন করে, আমরাও সেরকম কিছু চিন্তা করতে পারি। আর সেজন্য এখন থেকেই আমরা যদি কিছু টাকা আলাদা করে জমিয়ে রাখতে পারি তাহলে একটা সুন্দর ট্যুর দেয়া সহজ হবে। কিন্তু সমাপণী বর্ষের শুরুর দিকে এসে বুঝলাম, আমার সেই প্রস্তাবনা কল্পনাতেই রয়ে গেছে। এই ধরণের একটা ট্যুর এর জন্য যেই আত্মপ্রণোদনা প্রয়োজন, সেটা আমার অধিকাংশ বন্ধুর মধ্যেই নেই।
কিন্তু আমাকেতো কিছু একটা করতেই হবে! কি করি ?? শেষ পর্যন্ত আমার রুমমেটকে বললাম, দোস্ত চল একটা ইন্ডিয়া ট্যুর দেই, তুই যা টাকা যোগাড় করতে পারিস, বাকিটা আমি তোকে ধার দেব, তবুও তুই চল। ও রাজি হল। বলেছিলাম, তুই এখন টাকা না দিরে পারলে চাকরি পেলে তারপর শোধ দিবি। ও সত্যিই আমাকে চাকরি পেয়ে টাকা শোধ দিয়েছিল। আমার সেই বন্ধুটি এখন সুদূর ইরানের তেহরানে কর্মরত !!
তো সেবার কলকাতা হয়ে চেন্নাই, পন্ডিচেরি, উটি, ব্যাংগালোর, গোয়া, মুম্বাই, দিল্লী, আগ্রা, জয়পুর ঘুরে একরকম ক্লান্ত হয়ে দেশে ফিরেছিলাম।তবে যেই আনন্দ পেয়েছিলাম সেটার কাছে ক্লান্তি কিছুই না। সেবারও একটা অতৃপ্তি নিয়ে ফিরেছিলাম, সিমলা, মানালি না দেখে ফেরার কষ্ট ! ২২ দিন টানা ঘুরেছিলাম, কারণ বুঝতাম, চাকরি জীবন থেকে সময় বের করে হয়ত এত জায়গা দেখার সুযোগ হবে না। এখন সেটার সার্থকতা বুঝতে পারি !!!
যাহোক, আসল গল্পে ফিরে আসি। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে একটা চাকরি পেয়ে গেলাম ২০০৪ সালের শেষ দিকে। তক্কে তক্কে থাকি কখন একটা সপ্তাহ খানেকের ছুটি চাওয়া যায়। নতুন নতুন আবার লম্বা ছুটিও চাওয়া যায় না। ম্যানেজারদের ভাব দেখে মনে হত, ছুটি চাওয়াটাই একটা অপরাধ। শেষ পর্যন্ত বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে সপ্তাহ খানেকের ছুটি মিলে গেল। মানে আগে পড়ে শুক্র শনি মিলিয়ে ৯ দিন। গন্তব্য দার্জিলিং আর যদি চান্স পাই তাহলে সিকিম।
আমার সংগী আমার এক স্কুল বন্ধু। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যথারীতি নাইট কোচে রওনা দিলাম লালমনিরহাট জেলার সীমান্ত বুড়িমাড়ী স্থল বন্দর। বর্ডার পার হওয়ার সময় পুরনো ঢাকার একদল আমাদের বয়সি ছেলের সাথে দেখা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কথা বার্তার পর বন্ধুত্বও হয়ে গেল। ফলাফল, সবাই দল বেধে একটা জিপ ভাড়া করে শিলিগুড়ি রওনা। সেই সময় একটা ভ্রমনের সময় হওয়ার বর্ডারে অনেক ভীড় ছিল আর আমাদের ইমিগ্রেশন সারতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। তাই আমরা যখন শিলিগুড়ী পৌছালাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। নিয়মিত জিপ সার্ভিস বন্ধ, পাহাড়ী এলাকায় সাধারণত ওরা পাবলিক সার্ভিস রাতে চালায় না। আমরা সময় নষ্ট করতে চাইলাম না, কারণ একরাত শিলিগুড়ি থাকা মানে একরাতই লস। একটা জীপ পেয়ে গেলাম একটু বেশী ভাড়ায়। দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা হল শুরু। যেতে যেতে এক জায়গায় দেখলাম, পুরো শিলিগুড়ী শহরটাকে দেখা যাচ্ছে, খুব সুন্দর লাগল। বৈদ্যুতিক বাতিতে জ্বলজ্বল করছে একটি শহর, ঠিক যেমন উড়োজাহাজ যখন আকাশে নীচুতে থাকে তখন যেমন নীচের শহর দেখা যায় !!
দার্জিলিং যখন পৌছালাম, রাত প্রায় সাড়ে আটটা, গাড়ী থেকে নেমেই দেখি কন কনে শীত। উফ্ কি ঠান্ডা !! কাপতে কাপতে জীপের উপরে থাকা ব্যাগ থেকে প্রথমেই জ্যাকেট বের করলাম।আমার বন্ধুর পরিচিত এক হোটেলে উঠলাম, মোটামুটি মানের, কিন্তু এই রাতের কনকনে ঠান্ডায় কে যাবে হোটেল খুজতে??
পরদিন সকালে উঠেই বেরিয়ে পরলাম ঘুরতে। মনটা প্রথমেই ভাল হয়ে গেল দূরে বিস্তৃত হিমালয় পর্বতমালা দেখে। আমাদের কপাল ভাল ছিল, আবহাওয়া ছিল চমৎকার, আকাশে ছিল না কোন মেঘ। দার্জিলিং আসা সার্থক হল!
জীপ ভাড়া করলাম, সেভেন পয়েন্ট দেখব বলে। রক গার্ডেন, গঙ্গামায়া পার্ক, চিড়িয়াখানা, চা বাগান, Himalayan Mountaineering Institue (HMI), একটা ওয়াল যেখানে পর্বতারোহণ চর্চা করা যায়, ঘোড়দৌড় ময়দান। যাক ৭টা জায়গার নাম মনে আছে তাহলে !! রক গার্ডেন, গঙ্গামায়া পার্ক দুটোই পাহাড়ের বুকে গড়া, ঘুরতে ভালই লাগল।
রক গার্ডেনে স্থানীয় উপজাতিদের নাচ গান
গঙ্গামায়া পার্ক
চিড়িয়াখানায় কয়েকটা বিরল প্রাণী দেখলাম। HMI দেখে ভালই লাগল। আমাদের মূসা ইব্রাহীমও কিন্তু এখানেই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। যাদুঘরে অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি দেখলাম। অডিটরিয়ামে একটা শর্ট ফিল্মও দেখলাম। সবই পর্বতারোহণ বিষয়ক।
Himalayan Mountaineering Institute (HMI)
বিকেলে চা বাগানে এসে গাড়ী থামল আর সেখান থেকে হিমালয়ের এক অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম। বিকেলের তির্যক আলোতে হিমালয়ের ঈষৎ রক্তিম রুপ আপনারাও দেখুন।
আরেকটা সুন্দর স্কুলও দেখেছিলাম, ওই যে যেই স্কুলটাতে “ম্যায় হু না” সিনেমার শুটিং হয়েছিল!!
সন্ধ্যায় আইনক্স সিনেপ্লেক্সে একটা সিনেমা দেখলাম। জায়গাটা আমাদের স্টার সিনেপ্লেক্সের মতই। এক কম্পাউন্ডে ৩ টা হল। খুবই মজার একটা সিনেমা দেখলাম, যদিও জানতাম না মুভিটা এত হাসির হবে। “Garam Masala -– গারাম মাসালা। অক্ষয় কুমার আর জন আব্রাহামের বিটলামি আর সাথে আছে পরেশ রাওয়াল। হাসতে হাসতে জান শেষ। যারা দেখেছেন, জানি না তাদের কেমন লেগেছে। আমার কিন্তু খুব মজা লেগেছে। ফুল অফ কমেডি। দেশে আমি যখনই টিভিতে সিনেমাটি চলতে দেখেছি সময় থাকলে দেখতে বসে গেছি। প্রতিবারই ভাল লেগেছে।
পরের দিনের সূচী, ভোরে উঠে টাইগার হিলে যেতে হবে। দার্জিলিং শহর থেকে ১০-১২ কিমি দূরত্ব। ওখানে সূর্য মামাকে পাহাড়ের নীচ থেকে উঠতে দেখা যায়। পর্যটকদের জন্য এক দুর্লভ দৃশ্য। সূর্যোদয়ের কয়েক ঘন্টা আগে গিয়ে পজিশন নিতে হবে। আমাদের কপালটা একটু খারাপ ছিল। পাহাড়ে এক গাদা মেঘ জমে ছিল। তাই আমরা সূর্য মামাকে ঠিক পাহাড়ের নীচ থেকে উঠতে না দেখে মেঘের নীচ থেকে উঠতে দেখলাম। আপনারাও দেখুন।
আর সূর্য উঠে যাওয়ার পর তার উল্টা পাশে হিমালয়ের ঈষৎ রক্তিম সৌন্দর্য!!
মজার ব্যাপার আমাদের এই টাইগার হিল আগমনে আমরা ছিলাম মাত্র তিন জন। বাকি চারজন, লেপ মুড়ী দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তারা নাকি এত শীতে বের হতে পারবে না এবং সেদিন সকালে উঠেই বাংলাদেশে চলে যাবে। হায়রে পর্যটক!!
টাইগার হিল থেকে ফেরার পথে বাতাসীয়া লুপে যাত্রা বিরতি। এখানে দার্জিলিং এর টয় ট্রেন ৩৬০ ডিগ্রী টার্ণ নেয়। আর এখানে আছে একটা ওয়ার মেমোরিয়াল। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে আমি হিমালয়ের যেই অসাধারণ স্নিগ্ধ একটি রুপ দেখেছি সেটা আমার মনে সারা জীবন গেথে থাকবে।
উপরের ছবিতে আপনারা হিমালয়ের যেই অংশটি দেখছেন, সেখানে সবচেয়ে উচু চূড়াটির নাম, কাঞ্চনজংঘা। বাকি সব চূড়ারই নির্দিষ্ট নাম আছে। এই ছবিটি আমার তোলা শ্রেষ্ঠ ছবিগুলোর একটি।
সকাল দশটার মধ্যেই আমরা দার্জিলিং এর মূল শহরে। এরপর আমরা নিজেরাই একটু ঘোরাঘুরি করলাম। ম্যাল রোড বরাবর হাটতে লাগলাম। পাহাড়ি এলাকায় সাধারণত একটা সমতল মিলনস্থল থাকে যেটাকে ম্যাল বলে। ম্যালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানও হয়।সব সময় এখানে লোক জনের সমাগম থাকে, অনেক কবুতর উড়ে, কেউবা তাদের খাবার দিচ্ছে।
ম্যালের একপাশ থেকে একটা বৃত্তাকার পথ ঘুরে এসে ম্যালের আরেক প্রান্তে যুক্ত হয়েছে, এই পথ ধরে হাটলে আপনি শুধুই দূর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন আর মনটা কেমন যেন উদাসী আর অলস হয়ে যাবে। ম্যালের এক পাশের রাস্তায় একটা খুব সুন্দর চার্চ টাইপের ভবন দেখলাম, ভাবলাম ভেতরে গিয়ে ছবি তুলি। পরে দেখি ওটা একটা গার্লস কলেজ। ভাগ্যিস বেশি ভিতরে যাই নি, তাহলে বেইজ্জতি হতে হত !!
সেদিন সন্ধ্যায় সিনেপ্লেক্সে আরেকটা ছবি দেখলাম, শাদী নাম্বার ওয়ান। একটু জোর করে হাসানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু সিনেমা হলের হাই কোয়ালিটির কারণে সময়টা ভালই কাটল। দার্জিলিং এর ঐতিহ্যবাহী পিঠা টাইপের খাবার মোমো। ভাপ দিয়ে তৈরী করে। খেতে ভালই। শুকরের মাংস দিয়েই বেশী তৈরী করে। তাই আমরা কয়েকটা মুসলিম খাবারের হোটেল খুজে বের করেছিলাম। খুব ঘিঞ্জি পরিবেশ কিন্তু খাওয়া খারাপ না। মানে ওই দূর দেশে ওইটাই সই। সেখানে চিকেন মোমো খেয়েছিলাম। এছাড়া অন্যান্য হোটেলে দক্ষিণ ভারতীয় খাবার মাসালা দোসা খেয়েছি। অনেক রকম খাবারই থাকে কিন্তু সব ট্রাই করতে সাহস হয় না। আর পাহাড়ের কোলে সুন্দর কোন রেস্টুরেন্টে বসে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কফি বা গরম চকোলেট খাওয়ার আমেজটাই আলাদা!!!
পাঠক দীর্ঘ লেখা পড়তে পড়তে নিশ্চয় ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন। আমার অবস্থাও আসলে তাই, বসে থাকতে থাকতে কোমড় ব্যাথা হয়ে গেছে।আসলে আমার দার্জিলিং এর কাহিনীও প্রায় শেষ। আমাদের এর পরের গন্তব্য ছিল সিকিম, যাকে অনেকে ইন্ডিয়ার সুইজারল্যান্ড বলে ডাকে। বলে রাখি, সিকিম কিন্তু বাংলাদেশীদের জন্য নিষিদ্ধ একটি জায়গা
দার্জিলিং ভ্রমন শেষে ঠিক করলাম সিকিম যাওয়ার একটা চান্স নিতে হবে। ছোট বেলা সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার গল্প পড়েছি “"গ্যাংটকে গন্ডগোল"”। তখন থেকেই গ্যাংটক নামটা মনের মধ্যে বিশেষ দ্যোতনা সৃষ্টি করত। গ্যাংটক সিকিমের রাজধানী। তার আগে একটু বলে নেই, সিকিম বাংলাদেশীদের জন্য কেন নিষিদ্ধ।
আসলে একটা সময়, সিকিম বিদেশীদের জন্যই নিষিদ্ধ ছিল। কারণ, ব্রিটিশ আমলে সিকিম ছিল ব্রিটিশদের একটি আশ্রিত রাজ্য (protectorate)। দেশ বিভাগের পর ১৯৫০ সালে সিকিম এক চুক্তির মাধ্যমে ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। কিন্তু চীন সেটা মেনে নিতে পারেনি, তাদের বক্তব্য ছিল, ভারত জোর করে সিকিমকে তার সাথে একিভূত করছে। এই নিয়ে ভারত ও চীন ১৯৬২ সালে যুদ্ধও করে আর তার পর থেকেই দু'দেশের মধ্যে যোগাযোগের পথ "নাথুলা পাস" বন্ধ করে দেয়া হয়। চীন বহুদিন পর্যন্ত সিকিমকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তাদের ম্যাপে দেখিয়েছে। তো গন্ডগোলটা এটা নিয়েই। ফলাফলে, পুরো সিকিম ভার্চুয়ালি একটা ক্যান্টনমেন্ট হয়ে গেল। এবং এখনো সেই রকমই আছে, যদিও ২০০৬ সালে বছর আগে চীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষনা দিয়ে সিকিমকে ভারতের অংগরাজ্য হিসেবে মেনে নিয়েছে। আমি যখনকার কথা লিখছি, তখন সিকিমে সব ধরনের বিদেশী নাগরিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তবে এখন পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ সহ এরকম অনেক, বিশেষ করে মুসলিম দেশের নাগরিকরা সিকিমে নিষিদ্ধ !! সাদা চামড়ার বেশ কিছু দেশের জন্য তারা এখন প্রবেশাধিকার দিয়েছে !! যেহেতু সিকিম একটা ক্রিটিক্যাল এরিয়া, তাই এখানকার বাজেট বরাদ্দ মনে হয় বেশী, তাই রাস্তা ঘাট এবং অন্যান্য অবকাঠামো পাহাড়ী এলাকা হিসেবে বেশ ভাল।
যাইহোক, দার্জিলিং থেকে সরাসরিই গ্যাংটক যাওয়া যায়। কিন্তু আমরা যেহেতু নিষিদ্ধ আর কে যেন বলল ওই রাস্তাটা একটু অনিরাপদ, আমরা শিলিগুড়ির দিকেই রওনা হলাম। যদিও বাংলাদেশীরা নিষিদ্ধ, কিন্তু অনেক বাংলাদেশীই ভারতীয় বাংগালি হিসেবে সিকিম গিয়ে থাকেন, এটাও আবার ওপেন সিক্রেট। শিলিগুড়ি এসে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে দাড়ালাম। যথারীতি গাড়ীর হেল্পার বুঝে গেল, আমরা বাংলাদেশী মফিজ। তাই আমাদের ধরে নিয়ে গেল একটা ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে, বলল এখান থেকেই হোটেল বুকিং দিয়ে যান, নইলে ওখানে গিয়ে হোটেল ফাকা পাবেন না। বলল, আমরা বলে দিচ্ছি গ্যাংটকে, আপনারা যে বাংলাদেশী, পুলিশ রেইডে এলে এটা ওরা ম্যানেজ করবে। এরকম অনেক হাঙ্কি পাঙ্কি বোঝালো। যেহেতু মনের দিক থেকে একটু দুর্বল, তাই আমরাও রাজি হয়ে গেলাম। একটাই আশা যদি সিকিম ঘুরে আসতে পারি। এদের এখান থেকেই আমরা সিকিমে ঘোরার প্যাকেজও বুকিং দিয়ে ফেললাম। কারণ, ওরা আমাদের যখন এলবাম বের করে সিকিমের বিভিন্ন জায়গার ছবি দেখালো, তখন ভাবলাম, যা আছে কপালে, সব বুকিং দিয়েই যাই !! তবে এটা বলে রাখি, গ্যাংটকে গিয়ে একটু যাচাই করে বুকিং দেয়াই ভাল, নইলে টাকা পয়সায় ভালই ঠকে যেতে পারেন।
গাড়ী রওনা হল। সেই একই পথে, যেই পথে দার্জিলিং যায়। তবে একটা জায়গায় এসে যে যার পথ বেছে নেয়, মানে গ্যাংটকের পথ আলাদা হয়ে যায়। সিকিম রাজ্যের বর্ডারে একটা পুলিশ চেকিং হয়। তো আমরা তিন বন্ধু মিলে ঠিক করেছি পুলিশ জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দেব। বন্ধুদের মধ্য একজন আমার বাল্য বন্ধু। তার হিন্দী জ্ঞ্যান অতি সীমিত। হু হা টাইপের। আর আরেকজন ছিল আমাদের ভ্রমন বন্ধু, মানে ওর সাথে বাংলাদেশ বর্ডারে পরিচয়, পুরনো ঢাকা গ্রুপের। যেহেতু সে পুরনো ঢাকার বাসিন্দা, হিন্দি ভাষায় তার দক্ষতা বেশ ভাল। আর ব্যবসার কারণে তার কোলকাতায় যাতায়াত আছে। কোলকাতার ইকবালপুরের খিদিরপুরে তার বাবার এক বন্ধুর বাসা আছে। আমরা ঠিক করলাম পুলিশ জিজ্ঞেস করলে বলব আমরা কোলকাতার ইকবালপুরের খিদিরপুরে থাকি। বলে রাখি আমার হিন্দি ভাষাজ্ঞ্যান মোটমুটি চলন সই। সারা রাস্তা জপতে জপতে গেলাম, "“ম্যায় কলকাতা সে আয়া হু। উধার ম্যায় ইকবালপুর কি খিদিরপুরমে রেহতা হু”।" অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতির মধ্য দিয়ে তিস্তা নদীর পাড় ঘেষে পাহাড়ী আকা বাকা পথ বেয়ে গাড়ী এগিয়ে চলেছে। আমার মাথায় চিন্তা কখন সিকিম বর্ডার আসবে! গ্যাংটক যেতে পারব তো? পড়ন্ত বিকেলে গাড়ী এসে সিকিম সীমান্তে থামল।
তিস্তা নদীর ওপরে একটা ব্রিজ। ব্রিজের একপাশে পশ্চিমবংগ, আরেক পাশে সিকিম। জীপ গাড়ীর মাঝের সারিতে বসা আমরা তিন বন্ধু। আমি সর্ব বামে, তারপর আমার বাল্য বন্ধু হালিম যে কিনা হিন্দিতে খুব কাচা। তারপর আমার পুরনো ঢাকার বন্ধুটি। পুলিশ সামনের সিটের যাত্রীকে জিজ্ঞেস করছে, "“কিধার সে আয়া হো?" যাত্রী উত্তর দিল। "“ওয়াহা কিধার রেহতে হো?" মানে কোন শহর এবং শহরের কোন এলাকা থেকে এসেছ? আমার হার্ট বিট আরো বেড়ে যাচ্ছে। জানি না সাথের বন্ধুদের কি অবস্থা ! প্রথম সিটের দুইজনকে জিজ্ঞেস করে পুলিশ আমার কাছে এল।
“"কিধার সে আয়া হো?"
উত্তর দিলাম, “"ম্যায় ক্যালকাটা সে আয়া হু"”
“"ওয়াহা কিধার রেহতে হো?"
ব্যাস, কি যে হল আমার !! মাথা থেকে ইকবালপুর আর খিদিরপুর শব্দ দুটো পুরো হাওয়া হয়ে গেল। আমি প্রমাদ গুনতে থাকি। মনে মনে বলি, "‘মনে আয়, মনে আয়, সারা রাস্তাতো এই জিনিস মুখস্ত করতে করতে আসলাম”"। পুলিশ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলতে পারছি না। যা বোঝার সে বুঝে নিল। সেই মুহুর্তে আমার মনে পড়ল “খিদিরপুর” শব্দটা ! ইকবালপুর ব্রেইন থেকে কমপ্লিটলি হাওয়া ! আমি বলে ফেললাম, “"ওয়াহা খিদিরপুরমে রেহতা হু”।"
পুলিশ ভাই বলল, “"আই কার্ড দিখাও”"। মানে জাতীয় পরিচয় পত্র দেখাও। ওখানে সবারই জাতীয় পরিচয় পত্র আছে। আমি পকেটে একটু খোজা-খুজির ভঙ্গি করে বললাম, “ "ও তো ম্যায় ঘার ছোড় আয়া" ”, মানে বাড়ী ফেলে এসেছি। আমি বুঝলাম ধরা খেয়ে গেছি। ভাবলাম, ধরা যখন খেয়েছি, তিন জনকেই খেতে হবে। পুলিশ আমার বন্ধুকে প্রশ্ন করতে উদ্যত হতেই বলে ফেললাম, “ "হাম তিন এক সাথ হ্যায়। হাম ট্যুরিস্ট হ্যায় ”"। পুলিশ আমার পাশের বন্ধুকে বলল, "“তুমহারা আই কার্ড দিখাও”"। আমার বন্ধু হালিম সিম্পলি মুর্দার মত চুপ। মনে হল ওর বাক শক্তি চিরতরে হারিয়ে গেছে ! পুলিশ তারপর আমাদের তৃতীয় বন্ধু যে কিনা পুরান ঢাকার তাকে জিজ্ঞেস করল, “"তুমহারা আই কার্ড হ্যায়?"” বেচারার উত্তরও একই, “ "ও তো ম্যায় ঘার ছোড় আয়া হু "
“"তিনো আদমি আই কার্ড ঘার ছোড় আয়া???”"
পুলিশ কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কি মনে করে ড্রাইভারকে ইশারা করল, যাও। ওই মুহুর্তে খাচা থেকে ছাড়া পাওয়া পাখির মত আনন্দ অনুভব করলাম। মনে হল যেন বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে গেল। গাড়ীর লোকজন আমাদের ফিরে ফিরে দেখছে। আমরা যেন কোন অদ্ভুত প্রাণী !! যাইহোক, এপারে এসেই অনেক হোটেল রেস্তোরা, সেখানে গাড়ী যাত্রা বিরতি দেয়। কিন্তু আমার মন আর ওখানে বসে না। মনে হচ্ছে এই জায়গাটা ছাড়তে পারলেই বাচি। উফ গাড়ী কখন ছাড়বে ! কারণ কয়েক হাত দূরেই বর্ডারের পুলিশগুলো ঘোরাঘুরি করছে। “"চোরের মন পুলিশ পুলিশ"” প্রবাদটার সার্থকতা সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।
গ্যাংটক যখন পৌছালাম, তখন রাতের আধার নেমে এসেছে। হোটেলে গিয়ে উঠলাম। বেশ ভাল হোটেল। বিছানা পত্র, টয়লেট বেশ পরিস্কার। আমি ভারতের অনেক শহরে ঘুরেছি। কিন্তু গ্যাংটকের মত সহনশীল দামে এত ভাল হোটেল আর কোথাও দেখিনি। অন্যান্য জায়গায় পয়সা অনেক নিয়ে নেয়, কিন্তু হোটেল সেই মানের হয় না। হোটেলে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলাম। কোলকাতার ঠিকানা দিয়ে। কর্মচারীদের ভাব এমন যে, ওরা আমাদের খুব সেইফ করছে। একটা ফিস ফাস অবস্থা। পরে বুঝেছিলাম, এসব কোন ঘটনাই না, এখানে প্রচুর বাংলাদেশী আসে এটা সবাই জানে। আমরা মফিজ ছিলাম বলে আমাদের সাথে এত কিছু। রাতের খাবার হোটেলেই খেলাম। বাঙ্গালী খাবারই খেয়েছিলাম, কারণ হোটেলটা মালিক কলকাতার ছিল।
পরের দিনের সূচী, আমরা একটা একদিনের ভ্রমনে বের হব। সাঙ্গু লেইক হয়ে নাথুলা পাস (চীন ও ভুটান বর্ডার)। আগের দিনই আর্মির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাখতে হয়। আমাদের সবার নাম নিয়ে গেল।একটু বলে রাখি, গ্যাংটকে তেমন কিছু দেখার নেই। সুন্দর একটা ছিমছাম পাহাড়ী শহর। কিন্তু আসল মজা হল, এখান থেকে বিভিন্ন প্যাকেজ নিয়ে উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম সিকিমের খুব নয়নাভিরাম কিছু লোকেশনে ঘুরতে যাওয়া যায়। সিকিমের এই অংশগুলো আসলে আপনাকে একেবারে হিমালয় পর্বতমালার ভেতরে বা একেবারে কাছাকাছি নিয়ে যাবে। তো আমাদের প্রথম দিনের ট্যুরটা হল পূর্ব সিকিমের দিকে। সকাল বেলা জীপে করে রওনা হলাম তিন বন্ধু। গাড়ীতে আমরা বেশি একটা কথা বলি না, বা নীচু স্বরে কথা বলি, পাছে কেউ বুঝে ফেলে আমরা বাংলাদেশী। পরে অবশ্য অনেক সহজ হয়ে গেলাম, কারণ গাড়ীতে কোলকাতার কোন বাঙ্গালী ছিল না। পাঞ্জাবী সহযাত্রী পাশে পেলাম। অনেক গল্প হল। এর মধ্যেই আমরা এগিয়ে চলেছি আকাবাকা পাহাড়ী পথ বেয়ে।
আকাবাকা পাহাড়ী পথ বেয়ে সাঙ্গু লেকের পথে...
একপাশে পাহাড় আর আরেক পাশে পাহাড়ের অপার সৌন্দর্য। ভাষায় বর্ণনা করা খুব কঠিন। আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি, সিকিম হল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটা কারখানা।
সাঙ্গু লেইক
১২৪০০ ফুট উচ্চতায় সাঙ্গু লেইকে পৌছে গেলাম। পাহাড়ের উপর খুব সুন্দর একটা প্রাকৃতিক লেইক। নভেম্বর মাস থেকে জানুয়ারী পর্যন্ত বরফে ঢাকা থাকে। আমরা গিয়েছিলাম নভেম্বরের প্রথমে, তখনো লেইকের উপর বরফ জমে নি। পাশের পাথুরে পাহাড়ের গায়ে মাত্র হালকা বরফ জমা শুরু হয়েছে।
পাহাড়ে একটু একটু করে বরফ জমছে...
সাঙ্গু লেইক পেছনে ফেলে আমরা আরো উপরে উঠতে থাকলাম। পথে কোন এক বাবার মন্দিরে কিছুক্ষণ দাড়ালো। এর পরে আরো ওঠা শুরু করলাম। নাথুলা পাসের ঠিক ৫ কি.মি. আগে আর্মি চেক পোস্ট। সেখানে আমাদের সবার কাছ থেকে ক্যামেরা রেখে দিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কৌশলগত অবস্থান, তাই ছবি তোলা নিষেধ। সেজন্য আপনাদের ওখানকার কোন ছবি দেখাতে পারব না।সমুদ্র পিষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪৫০০ ফিট উচ্চতায় নাথুলা পাস এ পৌছে বিমোহিত হয়ে গেলাম। চারপাশ বরফে ঢাকা। জীবনে প্রথম বরফ দেখলাম, ছুলাম! সেই অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না। ভারতীয় সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। সোজা চীনের পাহাড় আর ডান দিকে ভুটানের পাহাড়। তিন দেশের বর্ডার এখানে এসে মিশেছে। দূরে চীনের বর্ডার গার্ডের চেক পোস্ট দেখা যায়। খুব সুন্দর করে তৈরী করা এবং ওয়েল পলিশড।বরফে ঢেকে আছে। ছবির মত লাগে। সেই তুলনায় ভারতীয় সিমান্ত রক্ষীদের স্থাপনাগুলো অনেকটাই সাদামাটা, অযত্ন অবহেলায় মলিন হয়ে যাওয়া। এক জায়গায় কাটা তারের বেড়া দেয়া। তার ওপাশে চীনা সৈনিকরা ঘোরাফেরা করছে। এপাশের ভারতীয় পর্যটকদের সাথে করমর্দন করছে। আমরাও করলাম। কথা বললাম। যথারীতি এদের ইংরেজির অবস্থা খুব খারাপ, ইশারাতেই বেশী কথা বলে। এটাও পর্যটকদের জন্য মনে হল একটা আকর্ষণ। ফেরার পথে আরেকটা সুন্দর অভিজ্ঞতা হল। এক পর্যায়ে দেখি চার পাশ মেঘে ঢাকা। চারিদিকে কিছুই দেখা যায় না, শুধু সাদা মেঘ আর মেঘ।
মেঘের ভেতর পথ চলা...
মেঘের ভেতর চলতে চলতেই একটা পাহাড়ি ঝর্ণায় এসে দাড়ালাম। ছবি তুললাম। বলতে ভুলে গেছি, সিকিমের প্রকৃতি আরো একটা জিনিসের ফ্যাক্টরি। সেটা হল প্রাকৃতিক পাহাড়ি ঝর্ণা! কত যে ঝর্ণা দেখেছি সিকিমে!!
পথে পথে পাহাড়ী ঝর্ণা...
গ্যাংটক পৌছে গেলাম। গ্যাংটকে একট কেবল কার আছে। শহরের একটা অংশ থেকে আরেক অংশে নিয়ে যায়। ড্রাইভারকে বললাম, আমাদের কেবল কার স্টেশনে নামিয়ে দিন। কেবল কারে চড়ে শহরের একটা মেইন রোডের ঠিক ওপর দিয়ে আরেক প্রান্তে চলে আসলাম। এরপর হাটতে হাটতেই হোটেলের এলাকায় চলে এলাম। দিনটা খুব উপভোগ করেছি।
গ্যাংটকে কেবল কার...
তো আমাদের পরের দিনের প্যাকেজ ছিল, ২ দিন ১ রাতের একটি প্যাকেজ। এটাকে বলা হচ্ছে, ইয়ুমথাং ভ্যালির প্যাকেজ, উত্তর সিকিমে। ওটা ছিল আমার জীবনের অসাধারণ একটা ট্যুর। আমি আজও ভুলতে পারি না। উফ আল্লাহ এই দুনিয়াতে কত সুন্দর জায়গা তৈরী করে রেখেছেন !!
সেদিন ফেরার পর সন্ধ্যায় গ্যাংটকে মার্কেটগুলো একটু ঘুরেফিরে দেখলাম। মার্কেটগুলো যেখানে সেই মূল রাস্তাটায় বিকেলের পর থেকে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয় যাতে পর্যটকরা নিরাপদে ঘুরেফিরে দেখতে পারে। একটা জিনিস আমার খুব ভাল লাগে, ভারতের সব জায়গায়ই ভারতীয় বাংগালীদের দেখা মেলে। তারা ঘুরতে খুব পছন্দ করেন। বরাবরের মত গ্যাংটকেও প্রচুর বাংগালী পর্যটকদের দেখা মিলল এবং তারা আসেন সপরিবারে, পরিবারের সব বয়সের সদস্যদের নিয়েই। ভারতে বেড়াতে গেলে আমি আরেকটা জিনিস করি, সেটা হল এক গাদা চকলেট কিনি, সব সময় আমার পকেটে চকলেট থাকে, কারণ, আমাদের দেশেতো ক্যাডবেরি বা পার্ক পুরো দ্বিগুন দামে বিক্রি করে! সুতরাং, ভারতে যেহেতু এসেছি, চকলেট আর লেইস চিপসটা একটু প্রাণ ভরে খেয়ে না যাই কেন !!!
নাথুলা পাসে আমরা তিনজন গিয়েছিলাম। কিন্তু পরদিন একজন কমে গেল, আমরা দুজন হয়ে গেলাম। আমার বাল্যবন্ধু হালিম ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। ও উত্তরাতে একটা ইংলিশ মিডিয়ামের কোচিং সেন্টারে পড়াত। আমরা সবাই ঈদের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওর কোচিং সেন্টার যেহেতু খুলে যাচ্ছে তাই ওকে ফিরে যেতেই হবে, সে আবার কাজে খুব মনোযোগী, তাই কোন ভাবেই রাখতে পারলাম না। পরে যখন ও ছবিগুলো দেখেছিল, বুঝতে পেরেছিল, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর একটা ভ্রমন সে হাতছাড়া করেছে। আফসোসটা আরো বেড়ে গিয়েছিল, যখন দেশে গিয়ে দেখে হরতাল না যে কি কারণে ওর কোচিং আরো দু’একদিন বন্ধ ছিল!
পরদিন আমরা সকালে হোটেল ছেড়ে বেরুলাম। আমাদের গন্তব্য উত্তর সিকিমের ইয়ুমথাং ভেলি, ২ দিন এক রাতের প্যাকেজ। বিভিন্ন জায়গা থেকে যাত্রী সংগ্রহ করার কারণে রওনা দিতে প্রায় ১০/১১ টা বেজে গেল। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, চারিদিক ঝকঝকে, চমৎকার আবহাওয়া !! এখানে আমাদের গাড়ীর চালকই আমাদের সুপারভাইজর কাম গাইড। আমরা ৮৬১০ ফিট উচ্চতায় লাচুং নামে একটা জায়গায় রাতে থাকব। তো আমাদের থাকাকালীন যেসব খাবার প্রয়োজন হবে সেই বাজার সদাই সব গ্যাংটক থেকেই জীপের উপরে বোঝাই করা হল। ওখানে হোটেলে আমাদের এইসব বাজার ওরা রান্না করে দিবে। গাড়ী চলতে শুরু করল। আবারও সেই অপূর্ব প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে পথ চলা। পথে পথে পাহাড়ী ঝর্ণা। আগেও বলেছি, আবারও বলছি, সিকিম হল পাহাড়ী ঝর্ণার কারখানা !! দু’একটা বড় ঝর্ণায় আমাদের গাড়ী যাত্রা বিরতি করেছে্ আমরা সেখানে ছবি তুলেছি।
রাস্তার অবস্থা মোটামুটি, আসলে পাহাড়ে বিভিন্ন সময় ধ্বস নামে, এইসব কারণে রাস্তা ভাল রাখাটাও একটু কষ্টসাধ্য। তারপরেও বলব, যেই জীপগুলোতে ওরা নিয়ে যায় সেগুলোর কারণে ঝাকি কিছুটা কম লাগে। কিন্তু, মোটের উপর আপনাকে ভালই ঝাকাঝাকি করা হবে রাস্তায়। কিন্তু, এডভেঞ্চারাস একটা মন নিয়ে চললে এইসব ঝাকি খুব একটা প্রভাব ফেলবে না।
যাইহোক, অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে থাকলাম গন্তব্যের দিকে। আসলে এই সৌন্দর্য ভাষায় পুরোপুরি বর্ণনা করা সম্ভব না, নিজেকে গিয়েই দেখে আসতে হবে। সারাদিন ভ্রমন করার পর বিকেলের দিকে আমরা চুংথাং পৌছালাম। সেখানে তিস্তা নদীর উপর একটা ব্রিজ আছে, তার উপর হাটাহাটি করলাম, ছবি তুললাম।
চুংথাং এ তিস্তা নদী, ব্রিজের উপর থেকে...
লোকজন চা নাস্তা খেল। আমি মূলত লেইস চিপস আর বিস্কুটের উপরেই থাকতাম।এর পর আরও ২১ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আমরা সন্ধ্যা নাগাদ লাচুং পৌছে গেলাম। মোটামুটি সাধারণ মানের একটা হোটেলে জায়গা হল। আধার নেমে যাওয়াতে আশপাশ নজরে এল না। তবে অনবরত পানির কলকল ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। আসলে জায়গাটা ছিল নদীর ধার ঘেষেই। ঈষৎ চাদের আলোতে দূরে সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া নজরে এল। আমরা যে আছি একেবারে পাহাড়ের কোলেই !! পেছনে পাহাড় আর সামনে নদী, সাথে জম্পেশ ঠান্ডা ! সেইরকম একটা পরিবেশ। গরম গরম খাবার পরিবেশন করা হল, খাওয়া গেল মোটামুটি কারণ, আমাদের কথা মাথায় রেখেই রান্নার চেষ্টা হয়েছিল। খাবার পরিবশনকারী যেই মেয়েটি ছিল, সে আবার বেশ মজার। কথা একটু বেশী বলছিল, কিন্তু লাভ কি? সে বাংলা বা হিন্দি কোনটাই পারে না ! সম্ভবত ওর ভাষা ছিল “ভুটিয়া” বা এই জাতীয় কিছু। সুতরাং ওর কাছ থেকে ইশারা এবং বিভিন্ন মিশ্র ভাষায় খাবার চেয়ে নিতে বেশ হাস্যরসই হচ্ছিল। পরে ওর কাছ থেকে কিছু ভুটিয়া ভাষা সেখার চেষ্টা করলাম। যদ্দুর মনে পড়ে, ভাতকে বলে "“ত”", রুটিকে “"খ"” আর পানিকে "“চোছো”"। যাইহোক, সেইরকম মজা পেলাম!! রাতে ঘুমাতে গেলাম দুটো লেপ গায়ে দিয়ে, কিন্তু যতই রাত বাড়ে, মনে হল ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। উহ,কি কঠিন শীত রে বাবা !! ঘরের ভেতর মনে হল আরো বেশী শীত। এভাবেই রাত পার করলাম, কিন্তু ঘুমটা হয়েছিল জম্পেশ, বোঝেনইতো সারাদিন ছেচা খাওয়ার পর ভাল ঘুম না হয়ে কি উপায় আছে ???
সকালে উঠে নাস্তা করে বেরিয়ে পরলাম। আমাদের গন্তব্য স্বপ্নের ইউমথাং ভ্যালি! লাচুং থেকে ২৪ কি.মি. দূরত্বে ১১৮০০ ফিট উচ্চতায় এই উপত্যকা।এক দেড় ঘন্টায় আমরা পৌছে গেলাম। জায়গাটা অদ্ভুত সুন্দর। আর কনকনে ঠান্ডা বাতাস। ডিসেম্বরে যখন তুষারপাত শুরু হয় তখন এই এলাকাটি অচেনা এক রূপ ধারণ করে যে ছবি আমরা ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে দেখেছি। যাইহোক, এই জায়গার সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব না। কয়েকটা ছবি দিলাম। আপনারাই দেখুন।
তো আমাদের ট্যুরের কন্ট্রাক্ট কিন্তু এই পর্যন্তই। কিন্তু জানা গেল, এখান থেকে ৩২ কি.মি. দূরে ১৫৩০০ ফিট উচ্চতায় ইউমিসমডং নামে একটা জায়গা আছে যাকে “জিরো পয়েন্ট” বলে, সেটা নাকি আরেকটি খুব সুন্দর জায়গা। সবাই একমত হলাম, যেহেতু ছেচা খেয়ে এতদূর এসেছি ওইটাও দেখেই যাব। এইজন্য ড্রাইভারকে জনপ্রতি ২০০ রুপি করে দিতে হবে। তাই সই। সেখানে গিয়ে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! যদিও নাথুলা পাসেই জীবনে প্রথম বরফ ছুয়েছিলাম, কিন্তু ইউমিসমডং এ তো পুরা এলাহি কান্ড!! আমি কোথায়? ভারতে না সুইজারল্যান্ডে ??!! ভেতরে ভেতরে আনন্দের সীমা ছাড়িয়ে গেলেও সেটা এই উপত্যকা ছেড়ে আর কোথাও যেতে পারছিল না। চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ, সাদা আর সাদা। আমরা বরফে লুটোপুটি খাচ্ছি, বরফ মুখে দিচ্ছি, একে অপরকে ছুড়ে মারছি! মুম্বাই থেকে আসা কিশোর বয়সী দুভাই আমাদের সংগী হল। আমরা হাটতে হাটতে অনেক দূরে পানির ধারে চলে গেলাম। দেখলাম পাথরের ফাকে ফাকে কিভাবে বরফের বিশাল খন্ড জমে আছে! এই জায়গায় এসে মনে হল আমাদের ট্যুরটা পরিপূর্ণ হল। আর বেশী না বলে আপনাদের কিছু ছবি দেখাই, তাহলেই বুঝবেন।
আমরা সেই পাহাড়ী স্রোতধারার কাছ থেকে ফিরে দেখি সবাই চলে গেছে শুধু আমাদের গাড়ী অপেক্ষা করছে। আর আমাদের ভ্রমনসংগীদের মধ্যে কলকাতার এর পরিবারও ছিল, তাদের সাথে খুব ছোট এক বাচ্চা। সেই বাচ্চাটি আবার ঠান্ডায় খুব কষ্ট পাচ্ছিল। সুতরাং মায়ের বকুনিটা বেশ ভালই শুনতে হল। আচ্ছা, আপনারাই বলুন, এই প্রচন্ড শীতে আর সমুদ্র পিষ্ঠ হতে এত উচু জায়গাতে ওনারাইবা এত ছোট বাচ্চা নিয়ে কেন আসতে গেলেন??
যাইহোক, এভাবেই শেষ হল আমাদের অসাধারণ এবং চির স্মরণীয় একটা ভ্রমন। পরের কাহিনী হল শুধুই গ্যাংটকে ফিরে চলা। সারাদিন ভ্রমন করে সন্ধ্যায় হোটেলে ফেরা। পরের দিন সকালে উঠে ঢাকার পথে যাত্রা। আবার সেই ব্যস্ত জীবন আর ছকে বাধা অফিসের হাতছানি। আমার মন কিন্তু পড়ে রইল ওই পাহাড়ের মাঝেই, ইয়ুমথাং ভ্যালি আর ইউমিসমডং এই…
ব্লগার মুহাম্মদ জহিরুল ইসলাম এর ব্লগ থেকে লেখাটি কপি (লিংক) করা হয়েছে। লেখকের কোন রকম আপত্তি থাকলে এটি মুছে ফেলা হবে।
0 comments: