২০০৪ এর অগাস্টে চাকরিতে যোগ দেয়ার পর পরই একটা নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে ফেললাম। এক দেড় মাসের মধ্যেই সেটা পেয়ে গেলাম আর তার এস্তেমাল করেছিলাম পরের বছর নভেম্বরে দার্জিলিং সিকিম ভ্রমন করে। যাইহোক পাসপোর্টটা দ্রুত করানোর উদ্দেশ্যটা ছিল আসলে অফিসের কোন ট্রেনিং এর সুযোগ এলে যাতে কোন ঝামেলা না হয় সে জন্য। সে সুযোগটা চলে এল ২০০৬ এর মার্চে। মালয়শিয়ার সাইবারজায়ায় এরিকসন এডুকেশন এ ৯ দিনের একটা ট্রেনিং। ব্যাপক উত্তেজনা অনুভব করলাম, প্রথম কোন সুপরিসর উড়োজাহাজে চড়া এবং উন্নত কোন দেশে ভ্রমনের সম্ভাবনার আনন্দে। নতুন ব্যাগ কেনা হল।
ট্রেনিং এর চেয়ে ঘোরাঘুরির প্ল্যানটাই মূখ্য হয়ে উঠল। যারা আগে গিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করলাম আর ১৪ দিনের একটা ট্যুর প্ল্যান করে ফেললাম। ৯ দিনের ট্রেনিং এ মাঝে দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি, শেষে দুই দিন অফিস থেকে নেয়া ছুটি আর পৌছানোর পর এক দিন এই হল আমার ঘোরার সময়। সাথে আছে আমার ছোট বেলার বন্ধু এবং সহকর্মী, আমরা দুজন এক দিনেই চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম, আবার এক সাথেই ট্রেনিং এ যাচ্ছি।
ফ্লাইট ছিল সম্ভবত রাত সাড়ে বারটায়, মালয়শিয়া এয়ারলাইন্সে। এয়ারপোর্টে ঢুকে লাগেজ স্ক্যান করিয়ে চেক ইন এর দিকে এগুলাম। জীবনে প্রথম আন্তর্জাতিক বহিগ্রমন, মনে একটা চাপা উৎকন্ঠা, কারণ শুনেছিলাম এয়ারপোর্টে এরা নাকি অনেক ঝামেলা করে। ঝামেলা কিছুটা হল, তবে সেটা আমার নয়, আমার বন্ধুর ! ঘটনা কি? আমার বন্ধুর পাসপোর্টে তার পেশা হল Student । চেক ইনে বসা এয়ারলাইন্সের ভদ্রলোক সেটা দেখেই বেকে বসলেন। তার কথা আপনি চাকরি করছেন, কিন্তু আপনার পেশা ছাত্র কেন? আমার বন্ধুর উত্তর, আমি পাসপোর্ট করিয়েছি ছাত্র থাকাকালীন, তাই পেশা এখনো ছাত্রই রয়ে গেছে। যাইহোক, এই জিনিসটা কিন্তু আসলে ইমিগ্রেশনে ধরার কথা। কিন্তু এখানে চেক ইনেই বেচারা মাতব্বরি করা শুরু করেছে !! মানে সূর্যের চেয়ে বালি গরম আরকি!! শেষ পর্যন্ত তাদের বড় সাহেব এসে বলল, ওনার কি রিটার্ণ এয়ার টিকেট আছে? হ্যা আছে। তাহলে ছেড়ে দাও। যেখানে মালয়শিয়ান হাই কমিশন তাকে ভিসা দিয়ে দিয়েছে, সেখানে চেক ইনেই এয়ার লাইন্স কর্মকর্তার বাড়াবাড়ি !
প্লেনে উঠে বিমানবালাদের সৌন্দর্য উপভোগ করার চেষ্টা করলাম। ফ্লাইট আধা ঘন্টা দেরিতে ছেড়েছিল, ভোর বেলা গিয়ে মালয়শিয়া পৌছলাম। রাতের আধারে ভ্রমন করার সুবাদে চার ঘন্টা প্লেনে বসে থেকে মাঝে মাঝে একটু ঘুমানোর অপচেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। আসলে একটু পর পর কেবিন ক্রুরা এটা সেটা নিয়ে হাজির হচ্ছিল। এসব কারণেই আর ঘুমানোর কোন সুযোগ পাচ্ছিলাম না। ভুখা নাংগা টাইপের প্লেন, সামনে কোন ভিডিও ডিসপ্লেও নেই যে একটু মুভি দেখব। খালি গান শোনার একটু ব্যবস্থা ছিল। বাংলাদেশের লেবারদের জন্য এর চেয়ে বেশি আর কি ই বা দরকার??
দুই দেশের ইমিগ্রেশনেই কোন বাজে অভিজ্ঞতা হল না, খুব ভাল লাগল, কারণ শুনেছিলাম, বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে অনেক সময় হয়রানির শিকার হতে হয়। কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট দেখে মুগ্ধ হলাম। রাস্তায় বের হয়ে আরো ভাল লাগল, প্রশস্ত রাস্তা, গাড়ীগুলো দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। মনে মনে বললাম, এইবার সত্যিকারের বিদেশে এলাম! সাথে সাথে মনের মধ্য একটা কষ্ট অনুভব করলাম, আহা আমাদের দেশটা যদি এমন হত!! ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলাম সানওয়ে হোটেল পিরামিড টাওয়ার, একটি চার তারকা হোটেল। বিশাল কমপ্লেক্সে একটি পাচ তারকা হোটেল, একটি চার তারকা হোটেল, লাগোয়া সুবিশাল শপিং মল এবং খুব সুন্দর একটা থিম পার্ক! শপিং মলের নীচ তলায় খুব সুন্দর একটা আইস স্কেটিং গ্রাউন্ড, নানা বয়সের ছেলে মেয়েরা সেখানে স্কেটিং করে চলেছে, কেউ শিখছে আর কেউ কেউ তাদের অসাধারণ নৈপূণ্য প্রদর্শন করে যাচ্ছে! চমৎকৃত হলাম দেখে।
সানওয়ে সিটি, পিরামিড কমপ্লেক্স
সানওয়ে শপিং মলে আইস স্কেটিং
রিসেপশনের স্মার্ট মেয়েটি জানাল, এখন কোন রুম খালি নেই। দুপুর বারটার পর্যন্ত চেক আউট টাইম, তাই বিকেল চারটা নাগাদ রুম পাওয়া যাবে। মাথাই গরম। সারা রাত ঘুমানো হয় নি, ঘুমে মাথা জ্যাম হয়ে আছে। বললাম অন্তত একটা রুম ম্যানেজ করে দাও, দুজনের লাগেজ একটু রাখি। শেষ পর্যন্ত ২/১ ঘন্টা পর একটা রুম মিলল। রিসেপশনেই দেখলাম ওরা কিছু টিকেট রেখে দিয়েছে, হোটেল বোর্ডারদের জন্য সানওয়ে থিম পার্কে ৮/১০ রিংগিত ছাড় আছে। কয়েকটা টিকেট নিয়ে নিলাম আর ভাবলাম এই সুযোগে তাহলে থিম পার্কেই ঘুরে আসি প্রথমে। দুই দোস্ত চলে গেলাম থিম পার্কে। রোলার কোস্টারে চড়লাম, খুব একটা এক্সাইটিং ছিল না। একটা নৌকার রাইডে চড়লাম, চরম লাগল। নৌকাটা পানিতে না, ডাঙ্গায় ! নৌকাটা দুইদিকে দোলনার মত দুলতে থাকল। আমরা বসেছি নৌকার এক প্রান্তে, সুতরাং বুঝতেই পারছেন, একবার আমরা উপরে উঠে যাচ্ছি আর একবার একেবারে নীচে চলে আসছি। এক পর্যায়ে নৌকা পুরো ৩৬০ ডিগ্রী টার্ণ নিয়ে নিল সম্ভবত দুবার। খুবই উত্তেজনাকর অনুভূতি, আর নৌকাটা বেশ বড়ই ছিল। এর পর গেলাম ওয়াটার পার্কে। আমরা দুজনেই ফুল প্যান্ট পরা। একটা স্লিপার টাইপের রাইড আছে না, যে উপর থেকে টিউবের মধ্যে বসে লম্বা প্যাচানো পথ ধরে নীচে চলে আসা, সেটাতে আমাদের উঠতে দিল না, ফুল প্যান্ট পরে থাকার কারণে। মনটা খারাপ হল, এত সুন্দর একটা রাইড ! আমার বন্ধু বেশ ধার্মিক, আমি মিডিয়াম লেভেল ধার্মিক, তাই আমাদের কারো পক্ষেই হাফ প্যান্ট পরা সম্ভব না, এটা ছেলেদের জন্য হারাম। যাইহোক এর পরে কৃত্রিম বীচে চলে গেলাম, কৃত্রিম ঢেউয়ে গা ভাসালাম, সাতার কাটলাম, ভালই লাগল।
সানওয়ে থিম পার্ক
সানওয়ে থিম পার্কের আরেকটি ভিউ
আমাদের হোটেলের সামনেই ছিল বেশ কিছু দোকান পাট, খাওয়ার হোটেল। "তাজ" নামে একটা হোটেল পাওয়া গেল, ইন্ডিয়ান ধাচের। সেখানেই কিছু খেয়ে বিকেলের দিকে আমরা আবার বেরিয়ে পরলাম, উদ্দেশ্য KL Tower দর্শন।
কে এল টাওয়ার
কে এল টাওয়ার আসলে ৪২১ মিটার উচু একটি কমিউনিকেশন টাওয়ার। তবে এতে আছে একটি ওয়াচ টাওয়ার ও ঘূর্ণায়মান হোটেল। এখান থেকে পুরো কুয়ালালামপুর শহর দেখা যায় আর পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার এর খুব কাছের একটা ভিউ পাওয়া যায়।
কে এল টাওয়ার থেকে কুয়ালালামপুর শহরের একটা ভিউ
তাই এমনভাবে প্ল্যান করে গেলাম যাতে আমরা বিকেলে ওখান ঢুকে রাতে বের হব। এতে আমরা দিনের কুয়ালালামপুরের পাশাপাশি রাতের KL এর সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারব। জনপ্রতি প্রবেশ চার্জ ২০ রিঙ্গিত। খুব ভাল লাগল উপরে উঠে। ওখানে দূরবীনের ব্যবস্থা আছে, চারিদিক আরো কাছ থেকে দেখার জন্য। টুইন টাওয়ার দেখে খুব ভাল লাগল। সন্ধ্যার দিকে দেখলাম মেঘ ভেসে যাচ্ছে টুইন টাওয়ারের গা ঘেষে।
টুইন টাওয়ারের চূড়া সহ বিভিন্ন অংশে উজ্জ্বল আলোকসজ্জা আছে যার জন্য টুইন টাওয়ার রাতে আরো আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে! KL Tower এর Observation deck এ কাচে খোদাই করা আছে বিশ্বের বিভিন্ন উচু ভবনের প্রতিকৃতি। লেখা আছে তাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য। যাইহোক, KL Tower থেকে যখন নীচে নেমে এলাম তখন বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। মনে হল মালয়শিয়া এসে প্রথম দিনেই একটা ঝামেলায় পড়ে গেলাম। শেষ পর্যন্ত একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। রাতে ভাল ঘুম হল, পরের দিন সকালেই ট্রেনিং, সকাল আটটায় গাড়ী ধরতে হবে, মিস করলে ট্যাক্সিতে যেতে ৫০ রিংগিত (২০০০ টাকা) গচ্চা যাবে...
হোটেল রুম থেকে আশে পাশের একটা ভিউ
সকালে ঘুম থেকে উঠতে খুব কষ্ট হল। বাইরে মোটামুটি গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়া থাকলেও হোটেলের ভেতর শীতকাল। কম্বল মুড়ি দিয়ে নরম বিছানায় শুয়ে আছি, কার উঠতে মন চায়, বলেন?? লবিতে নেমে রেস্টুরেন্টে গেলাম নাস্তা খেতে। গিয়ে দেখি এলাহি কান্ড ! বুফে নাস্তা, কত রকম খাবার চারিদিকে, অনেক ফলও আছে ! এদিকে হাতে সময় কম, কারণ ঘুম থেকে উঠে গোসল করে রেডি হয়ে নীচে নামতেই অনেক সময় ব্যয় হয়ে গেছে। নাস্তার যেই আয়োজন, অন্তত ১ ঘন্টা প্রয়োজন মনের খায়েশ মিটিয়ে নাস্তা করার জন্য। তারপরও যতদূর পারলাম উদরপূর্তি করলাম। দুধ দিয়ে কর্ণ ফ্লেক্স আর তার সাথে চকলেট ও কিসমিস ছিল আমার খুব প্রিয় একটা আইটেম। এছাড়া সবুজ রঙের একটা নাশপাতিও থাকত, খেতে খুব মজা। হাতে কয়েকটা নাশপাতি আর আপেল নিয়ে দৌড়ে বাসে উঠলাম, এক ঘন্টার যাত্রা, গন্তব্য সাইবারজায়ার এরিকসন এডুকেশন মালয়শিয়া।
এরিকসন মালয়শিয়ার অফিসের প্রবেশ পথ
এরিকসন মালয়শিয়া অফিসের ভেতর
সাইবারজায়া হল একটা অফিশিয়াল আলাকা, এখানে সব বড় বড় কোম্পানির অফিস। সেখানে এরিকসনের অফিস দেখে চমৎকার লাগল। ভবনের স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী দৃষ্টিনন্দন ! ভেতরের ইন্টেরিয়র ও বেশ আকর্ষনীয়। যা দেখছি তাই ভাল লাগছে। ট্রেনিং রুমে ঢুকেই সকালের নাস্তার প্রভাব টের পেলাম। ভরা পেটে ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু। ট্রেনিং আর কি করব, ঝিমুতে ঝিমুতেই সময় গেল। সাড়ে দশটায় refreshment break. আবার খাওয়া দাওয়া। সবচেয়ে লোভনীয় ছিল অফিসের চা, কফি, মাইলোর ভেন্ডিং মেশিনটা। এক গ্লাস গরম মাইলোতে চুমুক দিতে যে কি মজা সেটা আর বলে বোঝানো যাবে না। পুরো ট্রেনিং এ সেই জিনিসের সহি এস্তেমাল করেছি। বিকেল পাচটায় ট্রেনিং শেষ। ফিরতে ফিরতে ছয়টা...
ট্রেনিং শেষে ফ্রেশ হয়ে দুই বন্ধু বেড়িয়ে পড়লাম, গন্তব্য কুয়ালালামপুর শহর। বলা বাহুল্য, আমরা যেখানে থাকতাম, সেটা কুয়ালালামপুর থেকে একটু বাইরে ছিল। উদ্দেশ্য, একটা ক্যামেরা কেনা। বাস এসে থামল কোটারায়াতে। সেখান থেকে আরেক বাসে চেপে চলে গেলাম সুংগাই ওয়াং মার্কেটে, আশে পাশে আরো মার্কেট আছে লো ইয়াট প্লাজা, বুকিত বিনতাং। জমজমাট এলাকা। শেষ পর্যন্ত অনেক দেখে শুনে একটা সনি সাইবারশট T9 কিনে ফেললাম। ট্রেনিং এর দিনগুলোতে মূলত আমরা ট্রেনিং শেষে মূলত KL শহরে চলে আসতাম, এখানকার শপিং মল গুলোতে ঘুরতাম যদিও হাতে সময় খুব কম থাকত। ব্যাপারটা অনেকটা এমন, সাইবারজায়া ট্রেনিং সেন্টার থেকে হোটেলে ফিরতে ১ ঘন্টা সময় লেগে যেত। এর পর সেখান থেকে আবার KL আসতে আরো ১ ঘন্টা। হাতে সময় পেতাম মাত্র দেড় ঘন্টার মত, কারণ মালয়শিয়াতে মার্কেটগুলো সাড়ে আটটার দিকে বন্ধ হয়ে যেত। যাইহোক তারপরেও যতদূর সম্ভব ঘোরার চেষ্টা করতাম। মিড ভ্যালি মেগামল নামে একটা বড় শপিং মল আছে। টুকটাক জিনিসপত্র কিনেছি ওখান থেকে, কিন্তু আসলেই খুব বিশাল একটা মল। রাতের বেলা ইন্ডিপেন্ডেস স্কয়ারে ঘুরে বেরিয়েছি। খুবই আলো ঝলমলে একটা জায়গা। আর রাতের টুইন টাওয়ার তো অসাধারণ !
রাতের টুইন টাওয়ার
টুইন টাওয়ারের লাগোয়া একটা শপিং মল আছে, সুরিয়া KLCC (টুইন টাওয়ার যেখানে সেই জায়গাটাকে KLCC মানে Kuala Lumpur City Center বলা হয়)। সুরিয়া কে এল সি সি’র পেছনে বিশাল একটা পার্ক আর তার মাঝে পানির রিজার্ভার আছে। পানির রিজার্ভারে সুন্দর আলোক সজ্জাসহ বেশ কিছু পানির ফোয়ারাও আছে যেগুলো রাতে যখন চালু করা হয় দেখতে খুব সুন্দর লাগে। কৃত্রিম ফোয়ারার পাশে বসে কিছু সন্ধ্যায় কিছু অলস সময় পার, মন্দ না। এবং সেটা ওখানে প্রবাসী বিভিন্ন দেশের শ্রমিকেরা করেও থাকেন দেখলাম। ম্যান মেইড বিউটির কথা যদি বলা হয়, তাহলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মালয়শিয়া অবশ্যই প্রথম দিকেই অবস্থান করবে। কুয়ালালামপুরে একটা জিনিস খেয়াল করলাম, অধিকাংশ সুউচ্চ ভবনেরই স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী নয়নাভিরাম !! দিনে রাতে যখনই ভবনগুলোকে দেখা হোক না কেন চোখ জুড়িয়ে যায়।
টেলিকম মালয়শিয়া (বর্তমানে আজিয়াটা) এর ভবন
পোস্ট অফিস মালয়শিয়ার ভবন
সুরিয়া KLCC এর ব্যাপারে আরেকটু বলি, শপিং মলটা একটা জটিল শপিং মল। টাকা যদি আপনার কাছে তেজপাতার মত মনে হয় তাহলেই আপনি সেখানে যেতে পারেন। কয়েকটা দোকানে জিনিসপত্রের দাম দেখলাম। মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ, ৪০/৫০ % ডিসকাউন্ট দেয়ার পরেও দেখি দাম বাংলাদেশী টাকায় ৪০/৫০ হাজার টাকার মত !! খালি দেখলাম আর আফসোস করলাম, কেন এই গরীব দেশে জন্মগ্রহণ করলাম !!
যাইহোক, দেখতে দেখতে সপ্তাহ শেষ হল। কি করব সেটা আগেই প্ল্যান করা ছিল। শনিবার আমরা যাব গ্যান্টিং হাইল্যান্ড, দ্য সিটি অফ এন্টারটেইনমেন্ট !! যেভাবে দিনটাকে উপভোগ করব ভেবেছিলা, শেষ পর্যন্ত আর সেভাবে হয় নি। কেন সেটা বলছি। আমরা ছিলাম দু’জন। আমার বন্ধু বিবাহিত। সে তার বউকে সংগেই নিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাবীর আবার তখন অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। তাই উনি আমাদের সঙ্গে শুরু থেকেই আসতে পারেন নি। ওই শনিবার সকালেই ভাবী মালয়শিয়া আসছেন। আমার বন্ধু সকালে উঠে ভাবীকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এল। এরপর স্বাভাবিকভাবেই ভাবী ফ্রেশ হবেন, বিশ্রাম নেবেন। সব কিছু সেরে বের হতে হতে একটু বেলাই হয়ে গেল। বাস স্ট্যান্ডে এসে দেখি আরেক বিড়ম্বনা ! বিকেল আড়াইটার আগে সব বাসের টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। এটা ছিল আমাদের অভিজ্ঞতার অভাব। এই পর্যায়ে গেন্টিং হাইল্যান্ড সম্পর্কে একটু বলে নেই। জায়গাটা KL থেকে ঘন্টা খানেকের একটা পথ এবং ১৭৬০ মিটার উচুতে পাহাড়ের চুড়ায়, সেখানে ওরা খুবই সুন্দর একটা থিম পার্ক এবং বেশ কিছু ফাইভ স্টার হোটেল বানিয়েছে। একটা ক্যাসিনোও আছে। KL আবহাওয়া বেশ গরম এবং আর্দ্র। অপর দিকে গেন্টিং এর আবহাওয়া চমৎকার আরামদায়ক শীতল, তাই KL এর অধিবাসীরা সপ্তাহ শেষে সপরিবারে গেন্টিং ছোটে, একটু আনন্দে সময় কাটানোর জন্য। তাই শনি, রবিবার গেন্টিং এর জন্য সুপার পিক টাইম!
গেন্টিং হাইল্যান্ড - দ্য সিটি অফ এন্টারটেইনমেন্ট
শেষ পর্যন্ত বেলা আড়াইটার বাসেই রওনা হলাম। ব্যাপারটা আগে জানা থাকলে আগের দিন বাসের টিকেট কেটে রাখতাম। বাসের ভাড়া ৭ রিংগিত। ৩ রিংগিত বাস ভাড়া আর ৪ রিংগিত কেবল কারের ভাড়া। গেন্টিং এ যেখানে বাস থামে সেখান থেকে গেন্টিং হাইল্যান্ডের মূল এন্টারটেইনমেন্ট প্লেসে যেতে একটা ৩.৩৮ কি.মি. দীর্ঘ কেবল কার আছে। এটা পথিবীর সবচেয়ে দ্রুততম আর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘতম কেবল কার। পুরোপুরি পাহাড়ী জংগল আর মেঘের মধ্যে দিয়ে এই কেবল কারে ভ্রমনের অনুভূতি সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করার মত না !!
কেবল কারে গেন্টিং হাইল্যান্ড যাত্রা
মেঘে ঢাকা পথ...
মনজিল নজরে এল...
কেউ আবার ইচ্ছে করলে কেবল কারে না গিয়ে সড়ক পথেও ওখানে যেতে পারেন। মূল জায়গায় পৌছে আমরা সময় নষ্ট না করে সরাসরি থিম পার্কের টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম, কারণ হাতে সময় কম। টিকেট জনপ্রতি ৩৩ রিংগিত, পার্কের সব রাইডের জন্য, তবে কিছু কিছু বস টাইপ রাইডের জন্য ভেতরে আলাদা টাকা দিতে হবে। বলে রাখি, গেন্টিং এ বাস থেকে নেমে প্রথমেই আমরা ফিরতি পথের বাসের টিকেট কেটে নিয়েছিলাম, নইলে আরেক বিপদ হতে পারে সেই ভাবনায়। গেন্টিং এ অনেক এক্সাইটিং রাইড ছিল। তার মধ্যে একটা ছিল ফ্লাইং কোস্টার। কিন্তু দেখি সেটা মেরামতের জন্য বন্ধ। ভাল একটা রাইড একটা বাদ গেল। চিন্তা করলাম, সময় যেহেতু খুবই কম আর প্রত্যেকটা রাইডের সামনেই মাশাল্লাহ হাজার হাজার লোকের লাইন, জটিল দু একটা রাইডে চড়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কর্ক স্ক্রু নামে একটা রাইডের সামনে গিয়ে লাইন দিলাম। এটা হল মূলত একটা রোলার কোস্টার, কিন্তু এতে দুটো ৩৬০ ডিগ্রী টার্ণ আছে, এজন্যই এর নাম কর্ক স্ক্রু !
কর্ক স্ক্রু
চড়লাম, জটিল মজা পেলাম। কারণ, রাইডটা ওরা তৈরী করেছে, পাহাড়ের চূড়ায় একেবারে খাড়া ঢালের প্রান্ত ঘেষে। মানে আপনি যখন উপরে উঠবেন, দেখবেন আশে পাশে আর কোন মাটি নেই, একেবারে খাড়া পাহাড় নেমে গেছে, মানে উত্তেজনার চরমে উঠানোর ব্যবস্থা !! যখন ৩৬০ ডিগ্রী টার্ণ নেয় তখন ওরা সবার ছবি তুলে ফেলে। বের হওয়ার পর সেটা যদি কেউ চায় ১০ রিংগিতের বিনিময়ে বিক্রি করে। নিয়ে নিলাম, এমন দুর্লভ একটা স্মৃতি, মিস করাটা ঠিক না।
এর পর আরেকটা রাইডের সামনে লাইন দিলাম, কিন্তু এখানে লাইন খুব বেশী না। কারণ, এইটা একটা সত্যিকারের ভয়ংকর রাইড !! সেইরকম হার্টের জোর না থাকলে কেউ উঠতে পারবে না। রাইডটার নাম সম্ভবত স্কাই ফল বা এ জাতীয় কিছু। জিনিসটা আর কিছুই না, আপনাকে অনেক উচুতে তুলে ফেলা হবে। সেখান থেকে আশে পাশে তাকালে মনে হবে আপনি পাহাড়ের চূড়ারও অনেক উপরে এবং সেখান থেকে আপনাকে ফেলে দেয়া হবে।
স্কাই ফল বা ফ্রি ফল
আমার বিশ্বাস কেউ যদি এখানে একাধিকবার চড়ে তাহলে তার কাছে এটা আর কোন ব্যাপার মনে হবে না, কিন্তু কেউ যদি প্রস্তুত না থাকে তাহলে তার কাছে সেটা চূড়ান্ত এক্সাইটিং হবে। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। যখন উপরে উঠাল, আমি মনের সুখে চারিদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। কারণ এত উপর থেকে আশে পাশের পাহাড়ী পরিবেশ, অসাধারণ! এমনিতেই পাহাড়ের প্রতি আমার একটু দুর্বলতা আছে। হঠাৎ করেই যখন উপর থেকে ছেড়ে দিল, আমি একটা ওজনহীনতা অনুভব করলাম, সত্যি সত্যি আমি কিছুক্ষণের জন্য আমার শরীরের উপর থেকে সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। আমি দেখলাম, আমার মাথাটা আমার শরীরের উপর নেতিয়ে পড়ল। আর হার্টের উপর যে একটা চাপ, সে এক অন্যরকম অনুভূতি !! এত কিছুর পরও আমি এই রাইডটাকেই আমার জীবনের সবচেয়ে এক্সাইটিং রাইড হিসেবে দেখি এবং আবার যদি যাই অবশ্যই সেই রাইডে চড়ব। মজার ব্যাপার হল, আমার বন্ধু আমি ওই রাইডে চড়ার আগে বলছিল, “দোস্ত তোর এত শখ, তুই ওঠ, আমি উঠতেছি না, ভাই জানে মরতে চাই না”। আমি যখন সফলভাবে সেই রাইড শেষ করে আসলাম, তখন সেও গিয়ে ওই রাইডে উঠল (ওর সাথে ওর বউ ছিল, হয়ত মনে মনে ভেবেছিল, বউয়ের সামনে এটা একটা প্রেস্টিজ ইস্যু )। রাইড শেষে বলে আরে ব্যাপার না, একটু রেডি থাকলেই অত ভয় লাগে না, সে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল কি কি উপায়ে এই রাইড ভয় না পেয়ে শেষ করা যায় !!! (একটি খবর বলে যাই, আমার এই বন্ধু আজ তার দ্বিতীয় কন্যার জনক হয়েছে, মা মেয়ের জন্য সবাই দোয়া করবেন... )
সন্ধ্যায় গেন্টিং থেকে ফেরার পথে...
আমাদের গেন্টিং ভ্রমন এই পর্যন্তই হল, আর সময় নেই। ফিরতি বাস চেপে আমরা KL চলে এলাম। আমাদের হোটেলের সামনেই “তাজ” নামক একটা ইন্ডিয়ান টাইপের হোটেলেই আমরা রাতে খেতাম। বেশীর ভাগ সময়ই ফ্রাইড চিকেন বা ফ্রাইড মাছ খেতাম। কারণ অন্যান্য আইটেমে মসলার চোখ পাকানি দেখে ভয় লাগত আদৌ হজম করতে পারব কিনা। এমনকি মাছ ফ্রাইএও অনেক ঝাল দিত, ডাল দিয়ে সেটাকে নিউট্রালাইজ করা লাগত। তারপরেও দূর দেশে এই খাবার পেয়েই শোকরিয়া আদায় করতাম, কারণ মালয়শিয়ান খাবারগুলোতে সম্ভবত মিষ্টি বেশী দেয় যা কিনা আমাদের কাছে খেতে খুব একটা ভাল লাগবে না...
রবিবার, আরেকটা ছুটির দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়েশ করে বুফে নাস্তা সারলাম। আসলে এই ধরনের নাস্তা অন্তত ১ ঘন্টা সময় নিয়ে না করলে যারা এত আয়োজন করেছে তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয় না। ট্রেনিং এর দিনগুলোতে আসলে শান্তি মত নাস্তা করা যায় না। কারণ, ট্রেনিং এর শেষে অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে ঘোরাঘুরি করে ঘুমোতে যেতে অনেক দেরি হয় যায়। ফলাফলে, সকালে খুব কষ্ট করে ঘুম থেকে ওঠা। আর কোন মতে তাড়াহুড়া করে নাস্তা করেই দৌড়ে বাসে ওঠা !!
যাইহোক, আজকের প্ল্যান কুয়ালালামপুর বার্ড পার্ক, বাটার ফ্লাই পার্ক, ইন্ডিপেন্ডেন্স স্কয়ার এবং KL এ বিচ্ছিন্ন ঘোরাঘুরি করা। প্রথমেই চলে গেলাম KL বার্ড পার্কে। খুবই ভাল লাগল। KL এর প্রাণ কেন্দ্রে দুর্দান্ত একটা বার্ড পার্ক করেছে। বড় পাখি গুলো সব খোলা ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুরো পার্কটাই একটা বড় জাল দিয়ে ঢাকা, তাই পাখিগুলো ছাড়া থেকেও আসলে বন্দি। বিশাল এক ময়ূর ঘোরাঘুরি করছে আর আমাদের দেখছে, ওর কত কাছে আমরা যাই হয়ত সেই হিসেব নিকেশ করছে।
বেশী কাছে যাওয়াতে একটু দূরে সরে গেল। তবে যেই মাশাল্লাহ সাইজ ওর, মনে হল ঠোকর দিলে আমার খবর আছে। টিয়া, কাকাতুয়া এই জাতীয় পাখিগুলো খাচায় রাখা। বার্ড পার্ক নিয়ে আর বেশী কিছু বললাম না, ছবিতেই দেখে নিন।
এই বেচারার ছবি তুলতে গেলেই খালি কাছে চলে আসে, আমি আবার দূরে সরে যাই, কারণ আদর কইরা যদি আবার চোখে একটা ঠোকর দিয়ে দেয় তাইলে তো বাপের কালের চোখটা গেল...।
এরা হইল প্রফেশনাল মডেল, পয়সা দেন, ছবি তুইলা বিদায় হন...
বার্ড পার্কের প্রবেশ ফি ছিল ৪০ রিঙ্গিত (২০০৬ এর আপডেট, একটু বেশিই, কি বলেন?? ) এর পর বার্ড পার্ক থেকে একটু দূরেই প্রজাপতি পার্কে চলে গেলাম, প্রবেশ মূল্য ১৫ রিঙ্গিত। ভালই লাগল, নানা রকম প্রজাপতি দেখে।
প্রজাপতি আমার হাতে...
এরপর হাটতে হাটতে চলে গেলাম মালয়শিয়ার জাতীয় মসজিদে। নামাজ পড়লাম।
মালয়শিয়ার জাতীয় মসজিদ
মহিলারা নামায পড়ছেন
দুপুরে খেয়ে দেয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কয়ারে চলে এলাম। জায়গাটা বেশ সুন্দর। বিশাল একটা মাঠ আছে। জাদুঘর টাইপেরও কিছু আছে সেখানে।
কয়েক দিন পরই মালয়শিয়ায় F1 racing হওয়ার কথা ছিল। তাই সেখানে আবার রেসিং কার এর প্রদর্শনী চলছে। ছবি তুললাম সেইসব গাড়ীর সাথে।
এর পর হাটা শুরু করলাম ওদের সংসদ ভবনের দিকে। পথে একটা মনুমেন্ট পড়ল, বন্ধ ছিল তাই ভেতরে ঢুকতে পারিনি, বাইরে থেকেই ছবি নিলাম।
আর একটু এগিয়েই ওদের সংসদ ভবন। দেখে হতাশ হলাম। বড়ই সাদামাটা একটা বহুতল ভবন। বুঝলাম না, ওদের দেশে এত সুন্দর নকশার ভবন, কিন্তু জাতীয় সংসদের এই অবস্থা কেন??
সত্যি কথা কি, বাংলাদেশের সংসদ ভবন দেখার পর হয় আর কোন দেশের সংসদ ভবনই ভাল লাগবে না... আমাদের এই একটি জিনিসই খুবই সুন্দর, যদিও ওর ভেতরে যাদের যাতায়াত তারা কতটুকু সুন্দর সেটা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে... ফিরে এলাম কোটারায়া এলাকায়, আসলে এখান থেকেই আমরা সানওয়ের বাস ধরি, পাশেই চায়না টাউন, ওখানে ঘুরে ফিরে কিছু সুভেনির কিনলাম। চায়না টাউনে যদি কেনাকাটা করেন, একটু বুঝে শুনে কিনবেন। ওদের সাথে ভাল দর কষাকষি করতে হবে, তবে আপনি যখন ওদের কে ও যা চেয়েছে তার কয়েক ভাগের এক ভাগ দাম বলবেন, তখন ওরা বেশ খারাপ ব্যবহারও করবে, কিন্তু আপনি ধৈর্য হারাবেন না, এটাই ওখানকার চাইনিজগুলোর প্রকৃতি। কিন্তু ধৈর্য ধরে কিনে ফেলতে পারেন তবে অন্তত বড় দোকান থেকে বেশ কমে সুভেনিরগুলো কিনতে পারবেন।
এর মধ্যে একদিন রাতে টুইন টাওয়ারেও গিয়েছিলাম। কিছু ছবি শেয়ার করলাম।
Suria KLCC এর পেছনের পার্কে ফোয়ারা...
ট্রেনিং শেষ হল। এরিকসন মালয়শিয়ার এত ঝাক্কাস একটা অফিস ছেড়ে আসতে কষ্টই হচ্ছিল। কিছু ছবি শেয়ার করলাম।
আমি রাতে বাইরে থেকে ফেরার পর প্রায়ই সানওয়ে শপিং মলে দাঁড়িয়ে আইস স্কেটিং দেখতাম। হোটেলে শেষ দিনে আবার গিয়ে দাড়ালাম।
অনেকের পারফরমেন্স দেখেই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ছবিতে যেই কিউট কিশোরীটিকে দেখতে পাচ্ছেন, সে ছিল সেদিন আমার দেখা বেস্ট পারফরমার। অসাধারণ দেহ শৈলী প্রদর্শন করছিল সে। আমি বিভোর হয়ে ওর স্কেটিং উপভোগ করছিলাম। ছবি তোলাটা বেশ কষ্ট সাধ্য ছিল, কারণ সে চলমান ছিল। জুম করে অনেক কসরত করে ওকে এক পর্যায়ে ক্যামেরা বন্দী করলাম।
রাতের বাসের টিকেট কাটা ছিল। পুডুরায়া বাস স্টেশন থেকে রওনা হবে। গন্তব্য পেনাং, সেখানে একদিন থেকে স্বপ্নের দ্বীপ লাংকাউই। বাসগুলো বেশ বিলাসবহুল, স্ক্যানিয়া বাস, প্রতি সারিতে ৩ টা করে আসন, তাই বেশ সুপরিসর। এ প্রসংগে বলে নেই, আমারদের সাথে এরিকসন বাংলাদেশ থেকে দুই ভাইয়াও ট্রেনিং এ ছিলেন। এবার আমরা পাচ জন মিলেই রওনা হয়েছি। রাত সাড়ে বারটার দিকে বাস ছাড়ল। বাসে বসেই টের পাচ্ছিলাম, সেই রকম টানে বাস চলছে, রাস্তা খুবই ভাল। ফলাফলে চার ঘন্টার মাথায় পেনাং পৌছে গেলাম। তখনো চারিদিকে আধার, সুতরাং বাস স্ট্যান্ডে বসার আসনেই ব্যাগের উপর মাথা রেখে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। আলো ফুটলে বের হয়ে বাসে করে শহরে চলে এলাম। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এক হোটেলে নাস্তা করলাম পরটা আর ডিম ভাজি দিয়ে। ভিন দেশে এরকম মেনু পেয়ে আমরা যারপরনাই খুশি। এর পর সময় নষ্ট না করে আমরা বের হলাম একটা বীচের উদ্দেশ্যে, নাম বাটু ফিরিঙ্গি। প্রায় এক দেড় ঘন্টা লোকাল বাসে চড়ে পৌছালাম। প্রচন্ড রোদ, সাইজ হয়ে গিয়েছিলাম। এদের বীচ গুলোতে আমাদের কক্সবাজারের মত ঢেউ নেই, কারণ এগুলো ব্রোকেন বীচ। কিছুক্ষণ বীচে ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম। বিকেলে আরেকটা জায়গায় বেড়াতে গেলাম, জায়গাটার নাম মনে নেই। একটা ছোট ট্রেনে করে পাহাড়ের ওপরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে পেনাং শহর দেখা যায়, আমরা উঠতে উঠতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, তাই রাতের পেনাং দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল।
রাতের পেনাং
রাত পোহালেই আমরা লাংকাউইর উদ্দেশ্যে রওনা করব। আচ্ছা আমার মনে হয় সেই গল্প শেষ পর্বেই বলি, আপনারা কি বলেন???
পরের দিন সকালে উঠেই আমরা লাংকাউই এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। এক ধরনের বড় স্পিড বোটে বা সি ট্রাকে করে রওনা হলাম। আগের দিনই টিকেট কেটে রেখেছিলাম। পেনাং থেকে ভাড়া ৪৫ রিংগিত। জলযানটি বেশ ভাল গতিতে চলে। আর ভেতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং বসার ব্যবস্থা খুবই আরামদায়ক। সব মিলিয়ে ওই সমুদ্র ভ্রমনটা বেশ উপভোগ্য ছিল।
দুই আড়াই ঘন্টায় আমরা লাংকাউই পৌছে গেলাম। কুয়াহ বন্দরে নামলেই হাতের বামে আপনার চোখে পড়বে একটা বিশাল ঈগল পাখির মূর্তি। বেশ সুন্দর। এটার কিছু ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে সম্ভবত, আগ্রহীরা গুগল মামার সাহায্য নিতে পারেন।
লাংকাউইর কুয়াহ বন্দরে ঢুকে খুব ভাল লাগল। ভেতরে ডিউটি ফ্রি শপ আছে, আর যেই জাক জমক, একেবারে এয়ারপোর্টের মত মনে হয়। আপনার ইম্প্রেশনই ভাল হয়ে যাবে। বের হয়েই দালালদের খপ্পরে পড়ে গেলাম। ওখান থেকেই হোটেল বুকিং দিয়ে দিলাম। আমাদের সাথে এরিকসন বাংলাদেশের দুজন ভাইয়া ছিলেন। তার মধ্যে একজন ছিলেন কানাডিয়ান পাসপোর্টধারী অভিবাসী। তো ওনার কানাডিয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল। লাংকাউইতে ইচ্ছে করলে গাড়ী ভাড়া করে নেয়া যায়, ড্রাইভিং ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলে। তো আমরা তাই করলাম, একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করে নিলাম দু’দিনের জন্য। এরপর আমরা আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথের নির্দেশনা দেখে দেখে চলে এলাম হোটেলে। আমাদের হোটেলটি মোটামুটি জনপ্রিয় কিছু বিচের পাশেই ছিল এবং সেটা ছিল আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড এর আশে পাশেই। আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড হল একটা বড় একুরিয়াম যেখানে মিঠা ও নোনা পানির জলজ প্রাণীরা রয়েছে। এটা পান্তাই সেনাং বিচে অবস্থিত, মানে আমরাও আসলে এই বিচের আশে পাশেই ছিলাম। এখানে প্রায় ৫০০০ এর উপরে জলজ প্রজাতি প্রায় ১০০ এর বেশী ট্যাংকে রাখা আছে। এখানে একটা বড় ট্যাংক আছে যার মধ্যে ১৫ মিটার লম্বা একটা সুড়ংগ করে দেয়া আছে, যাতে আপনি সেখানে গেলে একেবারে সমুদ্রের তলদেশে আছেন এমন একটা অনুভূতি পাবেন। আর সেই একুরিয়ামে দানবাকৃতির কিছু মাছও রেখেছে। আরো আছে অনেক সুন্দর সুন্দর সামদ্রিক প্রাণী এবং জীবন্ত প্রবাল ! সব মিলিয়ে খুব সুন্দর একটা সংগ্রহ। ওখানে একটা থিয়েটার হল ও আছে যেখানে সংস্লিষ্ট বিষয়ের উপর ছোট প্রামাণ্য চিত্রও দেখানো হয়। বলা বাহুল্য, হোটেলে একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা প্রথমেই আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড এই ঢু মারি। কিছু ছবি আপনাদের জন্য পেশ করলাম।
এরপর বিকেলে একটু বিচের জলে ঝাপাঝাপি করলাম। যদিও আমাদের কক্সবাজারের মত মজা পাওয়ার কোন উপায় নেই। এখানকার বিচগুলো ছোট হওয়াতে ঢেউ তেমন নেই, তাই মোটামুটি শান্ত বিচ। এরপর আবার মেঘ কালো করে বৃষ্টি এল, বৃষ্টির মধ্যে সমুদ্রে গোসল করতে ভালই লাগল।
পরের দিন সকালে উঠে বেরিয়ে পড়লাম। আজই শেষ দিন লাংকাউইতে। বিকেলেই এই দ্বীপ ছাড়তে হবে। প্রথম গন্তব্য লাংকাউইর সবচেয়ে আকর্ষনীয় স্থান, কেবল কার ! এটা আমার জীবনে চড়া সবচেয়ে আকর্ষনীয় এবং সেরা কেবল কার। জনপ্রতি ২৫ রিঙ্গিত ভাড়া নেবে। কিন্তু টাকা দেয়াটা স্বার্থক। এই কেবল কারটির বিশেষত্ব হল, এটি খুব খাড়াভাবে উঠে গেছে এবং একটা সিংগেল কেবলে সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা কেবল আছে এখানে, মানে দুটো স্টেশনের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ একক কেবল আছে এই কেবল কার সিস্টেমে। যাইহোক, আপনি যখন খাড়াভাবে উপরে উঠে যাবেন, সেই অনুভূতি খুবই রোমাঞ্চকর !! আমার বন্ধু পত্নীতো বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন !! এই কেবল কারটি আপনাকে নিয়ে যাবে Mount Mat Cincang এর চূড়ায় আর সেখান থেকে আপনি পুরো দ্বীপেরই একটি ৩৬০ ডিগ্রী ভিউ পাবেন। কেবল কার সিস্টেমে দুটো ল্যান্ডিং স্টেশন আছে। ল্যান্ডিং স্টেশন দুটো চমৎকার, অনেকটা স্পেস শীপের মত করে বানিয়েছে।
শেষ ল্যান্ডিং স্টেশনের পাশেই ওরা একটা অসাধারণ স্থাপত্য শৈলীর স্কাই ব্রিজ বানিয়েছে যেটা কিনা দাঁড়িয়ে আছে মাত্র একটি পায়ের উপর !!
এক কথায় পুরো পরিবেশ এতটাই মনোমুগ্ধকর যে আপনি নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন। চূড়া থেকে আপনি একপাশে পাবেন সমুদ্রের ভিউ (আন্দামান সাগর), এক দিকে পাহাড়ের ভিউ আর কেবল কার চলার পথেই আপনি একপাশে একটা ঝর্ণার ভিউ পাবেন। লাংকাউই কিন্তু থাইল্যান্ডের একেবারেই সিমান্তবর্তী একটি দ্বীপ, তাই এখান থেকে আপনি থাইল্যান্ডের দ্বীপ এবং একটি প্রদেশের কোস্টাল লাইনও দেখতে পাবেন।
ওহ, আর একটা কথা বলে রাখি, শাহরুখ খানের অভিনীত “ডন” সিনেমার শেষ দৃশ্য এই কেবল কারের শেষ ল্যান্ডিং স্টেশন ও স্কাই ব্রিজেই ধারণ করা হয়েছিল!!!
অসাধারণ কিছু অনুভূতি নিয়ে কেবল কার ছেড়ে আমরা খোজা শুরু করলাম দ্বীপে আর কি কি দেখা যায়। কুমিরের খামার আমাদের তালিকায় ছিল, কিন্তু পথ চিনতে না পারায় সেটা ছেড়ে আমরা গাড়ী নিয়ে এগিয়ে গেলাম। পথে ব্ল্যাক স্যান্ড বিচ বলে এক জায়গায় থামলাম, যদিও তেমন আকর্ষনীয় কিছু বলে মনে হল না। আরো এগিয়ে সাপের পার্কে গেলাম। হরেক রকম সাপ দেখে মুগ্ধ হলাম।
এর পর রাজার বাড়ি টাইপের একটা জায়গায়ও গেলাম, বিস্তারিত মনে পড়ছে না। দ্বীপ ছাড়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। হোটেলে ফিরে এলাম। আবার কুয়াহ জেটি, গাড়ী জমা দিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। পড়ন্ত বিকেলে আবার এক অসাধারণ সমুদ্র যাত্রা, আসলেই অসাধারণ !!
আমরা ফিরেছিলাম আবার পেনাং হয়েই কুয়ালালামপুর। তবে আপনারা যদি কুয়ালা পারলিস হয়ে এখানে আসেন সেক্ষেত্রে আপনাদের সমুদ্র যাত্রার সময়টা কমে যাবে, খরচও বেশ কমবে। আমার তখন না জানার কারণে আবার পেনাং হয়েই ফিরেছি। আরেকটা কথা, যদি লাংকাউই যান, আর কিছু না দেখলেও অবশ্যই কেবল কারটা দেখে আসবেন, আপনার ট্যুরের পয়সা উসুল!! এ ব্যাপারে আমার এক ফুফুর ঘটনা বলি, উনার স্বামী মালয়শিয়ার এক ভার্সিটিতে পিএইচডি করছিল। সেই সুবাদের ওনারা বেশ কয়েক বছর মালয়শিয়াতে ছিল। ওনারাও একবার লাংকাউই গিয়েছিলেন, কিন্তু মজার ব্যাপার হল অনেক জায়গায় ঘুরলেও, কেবল কারেই যান নি। যুক্তিটা হল, “আমরাতো কেবল কার গেন্টিং এই দেখেছি, তাই আর যাইনি।“ মনে মনে ভাবলাম, মক্কার লোক হজ্জ্ব পায় না। :p বললাম, আপনারা লাংকাউইর সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটাই দেখেন নি।
আপনাদের বলে রাখি, মালয়শিয়া গেলে গেন্টিং এবং লাংকাউই দুইটার কেবল কারেই চড়বেন, কারণ দুইটার বিশেষত্ব দুইরকম !! আরো কিছু পরামর্শ, লাংকাউইতেও আইল্যান্ড হপিং, স্নরকেলিং বা স্কুবা ডাইভিং এর ব্যবস্থা আছে, আগ্রহীরা সেগুলোও ট্রাই করতে পারেন, যদিও আমার করা হয়ে ওঠেনি। খাবার দাবার খেয়ে খুব একটা মজা পাই নি। তবে KFC আছে, সেখানেও ঢু দিতে পারেন, আমার ভায়রা ওখানে খেয়েছে, তার কাছে নাকি বেশ ভাল লেগেছে। কেনা কাটার জন্য অনেক শপিং সেন্টার আছে। যদি কখনো মালয়শিয়া বেড়াতে যান, আশা করি খুব সুন্দর ভ্রমনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরবেন... শুভ কামনা রইল...
মালয়শিয়া থেকে ফেরার দিন সকালে শেষবারের মত একবার গিয়েছিলাম পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারে।
ব্লগার মুহাম্মদ জহিরুল ইসলাম এর ব্লগ থেকে লেখাটি কপি (লিংক) করা হয়েছে। লেখকের কোন রকম আপত্তি থাকলে এটি মুছে ফেলা হবে।
0 comments: