মংগলবারে ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দিয়ে বুধবারে বিকেলে পাসপোর্ট হাতে পেয়ে সেদিন রাতেই সোহাগের ভলভোতে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা।
সকাল সকাল সিলেট পৌছে গেলাম। কিন্তু আমাদের আসল গন্তব্য তামাবিল সীমান্ত। একটা সিএনজি অটো রিক্সা ভাড়া করে নিলাম। প্রায় ৬০ কি.মি. রাস্তা। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। একটা কাজ তখনো বাকি, ট্রাভেল ট্যাক্স ! তো তামাবিলের প্রায় ১০/১৫ কি.মি. আগে কোন এক জায়গায় সোনালী ব্যাংকের একটা শাখা আছে, সেখানে গিয়ে ট্রাভেল ট্যাক্স দিতে হবে। ইচ্ছে করলে আমরা ঢাকার সোনালী বা জনতা ব্যাংকের নির্দিষ্ট শাখা হতেও এই ট্যাক্সটা দিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু আমারদের হাতে সেই সময় ছিল না, সেটাতো আপনারা আগেই বুঝেছেন। ভিসা প্রাপ্তির পরই আপনি এই ট্যাক্স দিতে পারবেন। মেইন রোড থেকে নেমে এক পার্শ্ব রাস্তা দিয়ে কিছুদূর গেলাম। এখন ঘটনা হল, আজতো সরকারী ছুটির দিন। ব্যাংকতো বন্ধ ! আশে পাশে জিজ্ঞাসা করে নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বাড়ী খুজে বের করলাম। ভাগ্য ভাল তিনি আশে পাশেই থাকতেন। গিয়ে দেখি তিনি তখনো নাস্তা করছেন। অপেক্ষায় রইলাম। নাস্তা করে রেডি হয়ে তিনি ধীরে সুস্থে ব্যাংকে এসে রশিদ বই বের করে আমাদের ট্যাক্স নিলেন। আর ছুটির দিনে এই বিশেষ সেবা দিয়েছেন বলে তাকে পাসপোর্ট প্রতি ১৫০ টাকা করে বখশিস দিতে হলো। তাতেও আমরা খুশি। সিএনজি নিয়ে এবার দে ছুট। রোড টু তামাবিল।
তামাবিলে এসে দেখলাম শুধু আমরা নই, আরো অনেকেই এসেছেন এই ছুটিতে শিলং বেড়াতে যাবেন বলে। ফরম পূরণ করে পাসপোর্ট জমা দিলাম বাংলাদেশ পুলিশ ইমিগ্রেশনে। কাজ চলছে, উকি দিয়ে দেখলাম কর্মকর্তা পাসপোর্ট প্রতি ৫০ টাকা আদায় করছেন। এইসব দেখলে বরাবরই আমার গা জ্বলে। এর আগে বুড়িমারী স্থল বন্দর ব্যাবহারের অভিজ্ঞতা আছে। সেখানে অবস্থা এমন, যে টাকা না দিয়ে উপায় নেই, একটা সিস্টেম হয়ে গেছে। কিন্তু এখানে আমরা নিজেরাই পাসপোর্ট জমা দিয়েছি, দালালের কোন উৎপাতও নেই। ভাবলাম একটা চান্স নেই। যখন আমারদের পাসপোর্ট এর সময় এল তখন আমি বললাম, “ভাই সবার কাছ থেকেইতো টাকা নিচ্ছেন কিন্তু আমাদের কাছ থেকে কোন টাকা নিয়েন না। “ বেশ কঠিনভাবেই বললাম। বেচারা আমার মুখের দিকে একটা শূন্য দৃষ্টি দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মানে সে আশাই করেনি কেউ এরকম বলবে। অনেক দিন পর কত সুন্দর ইনকাম হচ্ছিল। কিছু না বলে আমাদের তিনটা পাসপোর্টে কোন টাকা ছাড়াই সিল দিয়ে দিল। বর্ডার পার হয়ে ভারতীয় পার্শ্বে এলাম। ভাবলাম দেখি এইবার কি হয়, এইগুলাতো বাংলাদেশ এর চাইতেও খচ্চর হয়। কিন্তু অত্যন্ত অবাক হলাম যে ভারতীয় পার্শ্বে ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমসে কেউ একটা টাকাও চাইল না !! বলতে পারেন, আমি এই পর্যন্ত যতগুলো ভারতীয় স্থল বন্দর পার হয়েছি এটা ছিল সবচাইতে উত্তম। একেবারে পরিচ্ছন্ন। বেশ ভাল লাগল ব্যাপারটা। যেই কর্মকর্তাগুলো বসেছিল তাদের চেহারায়ও ভদ্রতার ছাপ ছিল, খাই খাই কোন ভাব ছিল না।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ ও ভারত এই দুই পার্শ্বেই বেশ খানিকক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। আর এই অপেক্ষার মাঝেই এক কথায় দু কথায় বেশ কিছু বাংলাদেশী পর্যটকের সাথে পরিচয় হয়ে গেল এবং আমরা জানতে পারলাম আমাদের উদ্দেশ্য ও গন্তব্য একই। ছিল দুই বন্ধু, একজন ডাক্তার ও একজন ব্যাংকার। আর ছিল এক পরিবার - আন্টি, তার এক মেয়ে ও এক ছেলে, সুদূর চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন। আমরা তিন জন। সব মিলিয়ে হলাম আট জন। একটা বড় জীপ ভাড়া করে ছুটে চললাম মেঘালয়ের রাজধানী শিলং এর উদ্দেশ্যে। বর্ডারেই কিছু ডলার ভাংগিয়ে নিলাম। ক্ষুধাও লেগে গিয়েছিল। কিছু বিস্কুট কিনে নিলাম। গাড়ি চলতে লাগল। পাহাড়ী পথ বেয়ে। যারা জাফলং গিয়েছেন তারা এই পথের শুরুটা দেখে থাকবেন। জাফলং থেকে নদীর উপর একটা ব্রিজ দেখা যায়, ওই পাশটাকে বলে ডাউকি। তো সেই পথ বেয়েই এগিয়ে চলা। দুই পাশে সবুজ পাহাড়, মনটা ভাল হয়ে যেতে লাগল আর ধীরে ধীরে রোমাঞ্চকর অনুভূতি ভর করতে লাগল।
তামাবিল থেকে শিলং এর পথে...
সম্ভবত ঘন্টা দুয়েকের যাত্রার পর আমরা শিলং পৌছে গেলাম। তখন দুপুর প্রায়। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। কিন্তু ভাবলাম আগে হোটেল ঠিক করে নেই। হোটেল খোজা শুরু করলাম। পছন্দ হয় না। ভাড়া অনেক বেশী কিন্তু নোংরা রুম। সব হোটেলেই কেমন একটা বাজে গন্ধ। আমি আবার এসব ব্যাপারে অনেক Flexible। কিন্তু আমার সাথের দুই ভাই প্রচন্ড নাক উচা। তাদের কোন মতেই পছন্দ হয় না। মনে হয় শিলং এর মেইন টাউনের সব হোটেল দেখে ফেললাম। ক্ষুধায় শরীরের সব শক্তি শেষ! শেষ পর্যন্ত আমাদের দেখার মধ্যে শিলং এর সবচেয়ে দামী হোটেলেই রুম নিলাম। তিন বেডের এক রুম এর ভাড়া ২৭০০ রুপি (ট্যাক্স ছাড়া) !! রুম যে খুব আহামরি তাও না। কিন্তু অন্যগুলোর চেয়ে কিছুটা ভাল। বলে রাখি শিলং এর মূল টাউন খুব একটা বড় নয়। আমি ভারতের অনেক শহরেই ঘুরেছি। এর মধ্যে শিলংকে আমার যথেষ্ট ব্যায়বহুল শহর মনে হল। একটা পাতলা লুচি পরটার দাম ১০ রুপি !! যেটা কিনা ভারতের প্রেক্ষাপটে বেমানান। যাইহোক, বিকেলে এদিক ওদিক হাটাহাটি করলাম, মার্কেট ঘুরে দেখলাম। খুব ইম্প্রেসিভ কিছু ছিল না। তবে রাস্তার মোড় ঘুরলেই একটা মিষ্টির দোকানে মন ভরে গোলাপ জামন খেলাম। ভারতে গেলে গরম গরম গোলাপ জামনটা আমি সাধারণত মিস করি না। সন্ধ্যায় আমরা পরের দিনের জন্য গাড়ী ঠিক করে ফেললাম। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী বৃষ্টিপাতের এলাকা চেরাপুঞ্জি যাব। আর আশে পাশে যা আছে সেটা দেখে আসব। হোটেলের ধারে কাছেই ভাল কিছু খাবার হোটেল ছিল যেগুলোতে আমাদের উপযোগী খাবার পাওয়া যায়। তাই খাওয়া দাওয়া নিয়ে তেমন একটা কষ্ট হল না।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হোটেলের ফ্রি নাশতা খেতে গেলাম। মিনি বুফে বলা চলে। খিচুড়ি টাইপের কিছু ছিল। এক জায়গায় পাতলা করে কাটা সুন্দর গোশতের একটা আইটেম দেখে খুব পছন্দ হল। জিজ্ঞেস করলাম এটা কিসের মাংস। বলল, “বেকন”। বেকন শুনে আমার মনে হল গরু বা খাসি হবে হয়ত। খাওয়া শুরু করলাম। সবজি দিয়ে খিচুড়ি খাচ্ছি। তখনো গোশতে হাত দেই নি। মুখে দিতে যাব, কি যেন মনে হল, ওয়েটারকে ডেকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা এটা কিসের গোশত? আবার বলে বেকন। বলি বেকন মানে কি? বলে, পর্ক (শুকরের মাংস) !! কি?? !! আমার প্লেটে শুকরের মাংস !! আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া আদায় করলাম, ভাগ্যিস মুখে দিয়ে ফেলিনি !! ওরাও বুঝতে পেরে সাথে সাথে আমার প্লেট নিয়ে নিল। নতুন প্লেটে নাস্তা শুরু করলাম।
শিলং থেকে সম্ভবত ঘন্টা দুয়েকের পথ চেরাপুঞ্জি। ওখানে পৌছেই বুঝতে পারলাম কেন এটাকে বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপাতের এলাকা বলে। পুরো পথ কুয়াশাচ্ছন। স্থানে স্থানে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যেই ঘুরে বেড়ালাম।
চেরাপুঞ্জিতে অভিযাত্রীগণ...
ড্রাইভার আমাদের একটা ইকো পার্কে নিয়ে গেল। ওখানে সাতটা ঝর্ণার একটা অর্ধবৃত্তের মত আছে। অনেকটা বড় ফলসের এর মত ভূপ্রকৃতি। খুব ভাল লাগল জায়গাটা।
ঘুরে বেড়ালাম, ফলসের উৎপত্তির দিকেও কিছুদূর গেলাম। ঝর্ণায় তখন অবশ্য খুব বেশি পানি ছিল না কিন্তু সব মিলিয়ে চারপাশ বেশ ভাল লেগেছে।
চারিদিকের অদ্ভুত নীরবতাটাই অনেক উপভোগ্য। এরপর একটা গুহায় প্রবেশ করলাম, শিলং এ অনেক গুহা আছে প্রাচীন রকের তৈরী। অনেক দূর গিয়েছিলাম গুহার ভেতরে, কয়েক জায়গায় বেশ ঝুকিপূর্ণ ছিল পথ, মানে পা ফসকালেই পানিতে পড়ে ভিজে একাকার হতে হত। ভালয় ভালয় বেরিয়ে এসেছিলাম। এরপর ড্রাইভার আমাদের থাংখারাং পার্কে নিয়ে গেল। বেশ সুন্দর একটা পার্ক। পার্ক থেকে আবার দূরের সমতল দেখা যায়।
মেঘালয় রাজ্যের নামটা কিন্তু আসলেই সার্থক একটা নাম, আপনি এখানে অনেক মেঘের লুকোচুরি দেখবেন আপনার আশে পাশেই। সেদিনের মত ঘোরাঘুরি করে শিলং এ ফিরে এলাম।
পরের দিন শিলং শহর দেখতে বের হলাম। প্রথমেই শিলং এর গলফ খেলার মাঠ দেখাতে নিয়ে গেল। এরপর চার্চে নিয়ে গেল, বেশ সুন্দর। চার্চ দেখে চলে গেলাম একটা সুন্দর পার্কে। পার্কের নাম “লেডি হায়দারি পার্ক”। লেডি হায়দারি ছিলেন একজন “ফার্স্ট লেডি”, আসামে গভর্নরের স্ত্রী। পার্কের সাথে আবার চিড়িয়াখানা ফ্রি। ভালই লাগল। বুঝতে পারলাম শিলংবাসী একটু ঘুরতে ফিরতে এখানে আসে। পাহাড়ী এলাকায় পার্ক খুজে পাওয়াতো আসলেই একটা দারুণ ব্যাপার। পরিবারগুলো তাদের শিশুদের নিয়ে এসেছে, ওরা মজা করে খেলছে।
সিস্টেমে পড়ে আমরাও ঢেকি, দোলনা চড়া শুরু করলাম। কি আর করা, আমরাও তো বেড়াতেই এসেছি ! এর পরে আরেকটা ভিউ পয়েন্টে নিয়ে গিয়েছিল, যেটাকে “শিলং পিক” বলে, সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৯৬৫ মিটার উচু। যেখান থেকে পুরো শিলং শহরের খুব সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। কিন্তু কপাল খারাপ, মেঘ মামা চারদিক ঢেকে রাখাতে সুধু সাদা আর সাদা দেখেই মন ভরালাম। সবশেষে একটা ঝর্ণা দেখাতে নিয়ে গেল, নাম “এলিফ্যান্ট ফলস”। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। পেটে প্রচন্ড ক্ষিধে নিয়ে হোটেলে গমন। অর্ডার দিয়ে চাতক পাখির মত সবাই বসে রইলাম, কারণ ওরা খাবার রেধে আমাদের জন্য নিয়ে আসবে।
সেই রাতে আমরা আর শিলং থাকিনি। আমারদের সাথের আন্টি আর ওনার ছেলে মেয়ে শিলং থেকে গেল, পরের দিন ওনারা গুয়াহাটি যাবেন। সেখান থেকে কলকাতা হয়ে বাংলাদেশ যাবেন। আমরা চলে গিয়েছিলাম শিলং থেকে ১৭ কি.মি. দূরে উমিয়াম লেকের ধারে একটা রেস্ট হাউসে। উদ্দেশ্য পরের দিন উমিয়াম লেক বিহার করে বাংলাদেশের পথ ধরা। সকালে একটা নৌকা ভাড়া করে লেকে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম।
চারিদিক শুনশান, প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্য একেবারে আদর্শ! ফেরার জন্য গোছ গাছ শুরু করলাম। এর মধ্যেই শুরু হল ঝুম বৃষ্টি। ভাল লাগা থাকলেও কিছুটা বিরক্তও হলাম। কারণ, ব্যাগপত্র নিয়ে ট্যাক্সি ধরতে হবে। যাইহোক, যাত্রা হল শুরু, এবার ঘরে ফেরা।
ফেরার পথে...
শিলং ছেড়ে আমরা যখন সীমান্তের বেশ কাছাকাছি, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল, ঠিক তখনই এক জায়গায় আমি প্রকৃতির এক অপূর্ব রুপ দেখতে পেলাম ! আমি জানি এই ব্যাপারটা হয়ত অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন, কিন্তু আমার কাছে ছিল পুরোই নতুন এবং অসাধারণ ! রাস্তা থেকে নীচে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে সুন্দর এক রংধনু !
নীচ থেকে উপরে অনেক রংধনু দেখেছি, কিন্তু উপর থেকে নীচে এই প্রথম ! নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। প্রকৃতি আমার জন্য এত সুন্দর একটা উপহার ভ্রমনের শেষ প্রান্তে রেডি করে রেখেছে, শিলং ভ্রমন সার্থক হল ! অদ্ভূত এক ভাল লাগা নিয়ে দেশে ফিরলাম...
ব্লগার মুহাম্মদ জহিরুল ইসলাম এর ব্লগ থেকে লেখাটি কপি (লিংক) করা হয়েছে। লেখকের কোন রকম আপত্তি থাকলে এটি মুছে ফেলা হবে।
0 comments: