শিক্ষার গুরুত্ব ও কুশিক্ষার বিপদ
মানুষ মূলত তাই যা সে শিক্ষা থেকে পেয়ে থাকে। প্রস্তর যুগের আদিম মানুষটির সাথে আধুনিক মানুষের যে পার্থক্য সেটি দৈহিক নয়, বরং শিক্ষাগত। শিক্ষার কারণেই ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এবং জাতিতে জাতিতে ভিন্নতা সৃষ্টি হয়। তবে সুশিক্ষার ন্যায় প্রতি সমাজে প্রচণ্ড কুশিক্ষাও আছে। কুশিক্ষার কারণেই ধর্মের নামে অধর্ম, নীতির নামে দূর্নীতি এবং আচারের নামে অনাচার বেঁচে আছে। এবং সংস্কৃতির নামে বেঁচে আছে আদিম অপসংস্কৃতি। সুশিক্ষার কারণে মানুষ যেমন সঠিক পথ পায়, তেমনি কুশিক্ষার কারণে পথভ্রষ্ট বা জাহান্নামমুখি হয়। আজকের মুসলমানদের ভয়ানক ব্যর্থতাটি কৃষি, শিল্পে বা বাণিজ্যে নয়, বরং সেটি শিক্ষায়। শিক্ষাক্ষেত্রে এ ব্যর্থতা থেকেই জন্ম নিয়েছে অন্যান্য নানাবিধ ব্যর্থতা। ভূলিয়ে দিয়েছে মানব-সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যটি। ফলে মুসলমান ব্যর্থ হচ্ছে তার উপর অর্পিত খেলাফতের দায়িত্ব পালনে। অনেকেই ফিরে গিছে প্রাগ-ইসলামিক যুগের জাহিলিয়াতে। এরূপ পিছু হটাতে মুসলিম ভূমিতে মহান আল্লাহর শরিয়তি বিধানের বদলে জেঁকে বসেছে কুফরি আইন। বিলুপ্ত হয়েছে প্যান-ইসলামিক ভাতৃত্ব; প্রতিষ্ঠা পেয়েছে গোত্র, বর্ণ, ভাষা ও ভূগোলভিত্তিক রক্তাত্ব বিভক্তি। এবং বেড়েছে আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ফলে শত্রুশক্তিকে মুসলিম ভূমিতে আজ আর কোন যুদ্ধই লড়তে হচ্ছে না। সে যুদ্ধটি মুসলিমরাই লড়ে দিচ্ছে। ইসলাম বেঁচে আছে
প্রাণহীন ও অঙ্গিকারহীন আনুষ্ঠিকতা রূপে। সংজ্ঞাহীন মুমুর্ষ রোগীর দেহে যেমন মাতম থাকে না, তেমনি মাতম নাই পরাজিত ও বিপর্যস্ত এ মুসলমানদেরও। কোন জাতির জীবনে এরচেয়ে ভয়ানক ব্যর্থতা আর কি হতে পারে?
ঈমান বাঁচাতে সত্যকে লাগাতর জানাটি যেমন জরুরী, তেমনি মিথ্যাকে প্রতি মুহুর্তে পরিহার করাও জরুরী। নইলে ঈমান বাঁচে না। প্রতিদিনের জ্ঞানার্জন তো সে কাজটিই করে। নবীজী (সাঃ) বলেছেন, “সে ব্যক্তির জন্য বিপদ, যার জীবনে দুটি দিন অতিবাহিত হলো অথচ তার তার জ্ঞানের ভাণ্ডারে কোন বৃদ্ধি ঘটলো না।” ঈমানদারের মনে আল্লাহর ভয় তো এভাবেই লাগাতর বেঁচে থাকে। মহান আল্লাহর সাথে মু’মিনের সম্পর্ক এভাবেই নবপ্রাণ পায়। নইলে দৈহিক ভাবে বেঁচে থাকলেও ব্যক্তির াবেআধ্যাত্মীক মৃত্যু ঘটে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায, মাসব্যাপী রোযা, হজ, যাকাত, নিয়মিত কোরআন পাঠ ও দানখয়রাত –এগুলো মূলত মানুষকে আধ্যাত্মীক ভাবে বাঁচিয়ে রাখা ও শক্তিশালী করার বিধান। তবে মিথ্যা ও অধর্মকে বাঁচিয়ে শয়তানেরও নিজস্ব বিধান ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মদ্যপান, পতিতাবৃত্তি, সূদ, জুয়া, অশ্লিলতা, ব্যাভিচার, পর্ণগ্রাফি, নাচ-গান এগুলো হলো শয়তানের সনাতন বিধান। তবে শয়তানের হাতে সবচেয়ে বৃহৎ ও আধুনিক হাতিয়ার হলো সেক্যুলার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। এজন্য মুসলিম দেশে যতই বাড়ছে সেক্যুলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ততই বাড়ছে ইসলাম থেকে মুসলমানদের দূরে সরানোর কাজ। বাড়ছে ডি-ইসলামাইজেশন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বদৌলতেই মুসলিম দেশে জাতিয়তাবাদ, গোত্রবাদ, সামন্তবাদ, সেক্যুলারিজম ও পুঁজিবাদের ন্যায় জাহিলিয়াত দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে সরে মানুষ দ্রুত জাহান্নামমুখি হচ্ছে। বাড়ছে সূদ, ঘুষ, অশ্লিলতা, উলঙ্গতা, ব্যাভিচার, হত্যা, গুম ও নানারূপ পাপাচারের সংস্কৃতি।
সবচেয়ে বড় বেঈমানি
মুসলমানদের আজকের বিভ্রান্তি এতটাই প্রকট যে, পৃথিবীতে তারা যে মহান আল্লাহর খলিফা সে ধারণাটিও অধিকাংশের চেতনা থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। পলায়নপর সৈন্য শুধু রণাঙ্গনই ছাড়ে না, সৈনিকের পোষাক এবং নিজ দলের ঝাণ্ডাও ছেড়ে দেয়। তেমনি আজকের মুসলমানগণও ইসলামের ঝাণ্ডা ফেলে দিয়ে জাতিয়তাবাদ, সমাজবাদ, পুঁজিবাদ ও সেক্যুলারিজমের ঝাণ্ডা তুলে নিয়েছে। এভাবে পরিণত হয়েছে শয়তানের সৈনিকে। মুসলিম ভূমিতে আল্লাহর শরিয়তী বিধান প্রতিষ্ঠা রুখতে তাই কোন কাফের সৈনিকদের মুসলিম দেশে নামতে হচ্ছে না, সে কাজটি তারা নিজেরাই করে দিচ্ছে। ফলে আল্লাহর কোরআনী বিধান আজ প্রায় প্রতি মুসলিম দেশে পরাজিত। মহান আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় বেঈমানি, কোরআনের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় অবমাননা আর কি হতে পারে?
“মুসলিম” শব্দটি কোন বংশীয় খেতাব নয়, বরং একটি বিপ্লবী বিশ্বাস ও চেতনার বাহক। কোন কাফেরের সন্তান যেমন মুসলিম হতে পারে, তেমনি মুসলিমের সন্তানও কট্টোর অমুসলিম হতে পারে। সমগ্র মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপ্লবটি এনেছিল সে বিশ্বাস। সে অটল বিশ্বাসটি হলো মহান আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও কোরআনের উপর। তবে মুসলমান হওয়ার অর্থ শুধু বিশ্বাসী হওয়া নয়, বরং সে বিশ্বাসের পক্ষে নিষ্ঠাবান কর্মী হয়াও। তাই মুসলিম তার বিশ্বাসকে কখনোই চেতনায় বন্দী রাখে না; বরং কর্ম, আচরণ, রাজনীতি¸ অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও যুদ্ধবিগ্রহসহ সকল ক্ষেত্রে সে বিশ্বাসের প্রকাশও ঘটায়। তার বিশ্বাস ও কর্মে থাকে এক সামগ্রীক রাষ্ট্র বিপ্লবের সুর। ১৪ শত বছর পূর্বে নবীজী (সাঃ) এবং তাঁর অনুসারি প্রতিটি মুসলমান সে বিশ্বাস নিয়ে নিজ নিজ ভূমিকা রেখেছিলেন। নিজেদের বিশ্বাস ও ধর্মকর্মকে তাঁরা মসজিদে সীমিত রাখেননি, বরং সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে বিপ্লবও এনেছিলেন। সর্বকালের মুসলমানদের জন্য আজও সেটিই অনুকরণীয় আদর্শ। এবং সে আদর্শের অনুসরণের মধ্যেই দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ। অন্যথায় যেটি ঘটে সেটি আল্লাহর বিরুদ্ধে অবাধ্যতা; তাতে অনিবার্য হয় জাহান্নামের আযাব।
শিক্ষাদান, শিক্ষালয় ও শিক্ষার মাধ্যম হলো মানব-সভ্যতার শ্রেষ্ঠতম আবিস্কার। মানব-সংস্কৃতির এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ অলংকার। সে সমাজে শিক্ষা নেই সে সমাজে সংস্কৃতিও নাই। শিক্ষার বলেই মানুষ পশু থেকে ভিন্নতর হয়। চেতনা, চরিত্র ও কর্মে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যে বিপুল তারতম্য দেখা যায় সেটিও শিক্ষা ভেদে। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ জানতে পারে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব। জ্ঞানার্জন এজন্যই ইসলামে অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এ ইবাদতের ব্যর্থতায় ব্যক্তির অন্যান্য ইবাদতেও ভয়ানক সমস্যা থেকে যায়। তখন ব্যর্থ হয় সমগ্র জীবন। শিক্ষাদানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাই মানব সমাজে দ্বিতীয়টি নেই। নবীরাসূলদের এটিই শ্রেষ্ঠতম সূন্নত। মানুষ কতটা মানুষ এবং আল্লাহর খলিফা রূপে বেড়ে উঠবে তা নির্ভর করে সে মহান সূন্নত কতটা সঠিক ভাবে পালিত হয়েছে তার উপর। কিন্তু ইসলামের পরাজিত দশা, মূসলমানদের পথভ্রষ্টতা এবং সমাজে পাপাচার ও কুফরির জয়জয়াকার দেখে এ কথা নিশ্চিত বলা যায় মুসলিম বিশ্বে সে সূন্নত পালিত হয়নি। এটিই হলো মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। অন্যান্য ব্যর্থতা হলো তার ডালপালা। মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়লেও ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলো তুলে ধরার ক্ষেত্রে সেগুলো সফলতা দেখাতে পারিনি। ফল দাঁড়িয়েছে, যে ইসলাম নিয়ে আজকের মুসলমানদের ধর্মকর্ম ও বসবাস তা নবীজী (সাঃ)র আমলের ইসলাম থেকে ভিন্নতর। নবীজী (সাঃ)র ইসলামে ইসলামী রাষ্ট্র ছিল, সে রাষ্ট্রে শরিয়তের প্রতিষ্টা ছিল, দ্বীনের প্রচার ছিল, নানা ভাষাভাষী মুসলমানের মাঝে অটুট ভাতৃত্ব ছিল এবং শত্রুর বিরুদ্ধে লাগাতর জিহাদও ছিল। কিন্তু আজ সেগুলো শুধু কিতাবেই রয়ে গেছে। ফলে বিজয় এবং গৌরবের পথ থেকে তারা বহু দূরে। বরং ধেয়ে চলেছে অধঃপতনের দিকে। আযাব এবং জিল্লতিও ধেয়ে আসছে তাদের দিকে।
সেক্যুলারিজমের বিপদ
সেক্যুলারিজম সর্বার্থেই প্রচণ্ড ইসলাম বিরোধী। সেটি যেমন তত্ত্বে, তেমনি রাজনৈতিক এজেণ্ডায়। মুসলমান শুধু দুনিয়ার কল্যাণ নিয়ে ভাবে না, বরং বেশী ভাবে আখেরাতের কল্যাণ নিয়ে। কারণ আখেরাত মৃত্যুহীন ও অন্তহীন। অথচ সেক্যুলারিস্টদের চেতনায় আখেরাত নাই, ফলে তা নিয়ে ভাবনাও নাই। তাদের সামনে স্রেফ পার্থিব জীবনে সফল হওয়ার ভাবনা। তারা ইহলৌকিক, আখেরাতের ভাবনা নিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, বিচার-আচার ও সংস্কৃতিকে তারা কুপমন্ডকতা ভাবে। সেক্যুলারিস্টদের সাথে ঈমানদারদের মূল দ্বন্দটি এখানেই। মুসলমানকে জান্নাত লাভের চিন্তায় মহান আল্লাহর প্রতিটি হুকুম পালনে একান্ত অনুগত হতে হয়। কারণ, কোনরূপ অবাধ্যতা তাকে জাহান্নামে নিয়ে পৌঁছায়। ঈমানদারের জীবনে ইসলামি রাষ্ট্র বিপ্লব ও রাষ্ট্রে শরিয়তের পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠার প্রেরণা তো জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচার ভাবনা থেকেই। কারণ সে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় সুস্পষ্ট হুকুম এসেছে মহান আল্লাহ থেকে। কিন্তু সেক্যুলারিস্টদের জীবনে সে ভয় নাই, ভাবনাও নেই। আল্লাহর হুকুম পালনে তাই আগ্রহও নেই। ফলে নামে মুসলমান হলেও সেক্যুলারিস্টদের মনে ইসলামী রাষ্ট্র বিপ্লবের মিশন নেই। বরং তাদের কাজ হলো, সে জান্নাতমুখি মিশনে মুসলমানদেরকে অমনযোগী করা এবং সে সাথে ধীরে ধীরে দূরে সরানো। একাজে তাদের মূল হাতিয়ারটি রাজনীতি নয়। সেনাবাহিনী বা প্রশাসনও নয়। বরং সেটি সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার মাধ্যমেই তারা মানুষের চেতনা রাজ্যে পরিবর্তন আনে, ভূলিয়ে দেয় ইসলামের মূল মিশন ও ভিশনটি। আখেরাতের ভাবনা ভূলিয়ে ইহকালীন সুখ-সমৃদ্ধি বাড়াতে যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ একমাত্র তাতেই তারা আগ্রহ বাড়ায়। মনের ভূবনে এভাবেই তারা দুনিয়ামুখি পরিবর্তন আনে। আর সে দুনিয়ামুখিতাই হলো সেক্যুলারিজম। সেক্যুলারিজমের মূল বিপদটি এখানেই। মুর্তিপুঁজা, শাপশকুন পুঁজার চেয়ে এ বিপদ কোন অংশে কম নয়।
তবে এরূপ দুনিয়ামুখিতা মানব ইতিহাসে নতুন নয়। সেক্যুলারিজম তাই আধুনিকও নয়। বরং মুর্তিপুজার মত সনাতম অজ্ঞতার ন্যায় এটিও সনাতন। একই রোগ বাসা বেঁধেছিল প্রাগ-ইসলামিক আরব পৌত্তলিকদের মনেও। তারা যে আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করতো, তা নয়। তারা বরং নিজ সন্তানের নাম আব্দুল্লাহ, আব্দুর রাহমানও রাখতো। ক্বাবা যে আল্লাহর ঘর সেটিও তারা বিশ্বাস করতো। বরং এ কথাও বিশ্বাস করতো, ক্বাবা ঘরটি নির্মান করেছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ), এবং তাঁকে সহায়তা দিয়েছিলেন পুত্র ইসমাঈল (আঃ)। কিন্তু তারা বিশ্বাস করতো না পরকালে। জান্নাত ও জাহান্নামের কোন ধারণা তাদের মনে ছিল না। ফলে পরকালের জবাবদেহীতাও ছিল না। আখেরাতের ভয় ব্যক্তির জীবনে পাপরোধে লাগামের কাজ করে, কিন্তু সে ভয় না থাকায় তারা পাপাচারে লিপ্ত হতো কোনরূপ ভয়ভীতি ছাড়াই। ফলে তৎকালীন আরবভূমি নিমজ্জিত ছিল পাপাচারে। সেক্যুলারিস্টগণ আজও একই বিপদ আনছে দেশে দেশে। তারা যেখানে বিজয়ী হচ্ছে সেখানেই পাপাচার ও দুর্নীতিতে প্লাবন আনছে। তাদের কুকীর্তির বড় স্বাক্ষর হলো আজকের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যেভাবে দুনীর্তিতে ৫ বার বিশ্ব রেকর্ড করলো তা কোন মোল্লা-মৌলবীর কাজ নয়। গ্রামের কৃষক-শ্রমিক-তাঁতীর কাজও নয়। বরং আখেরাতে ভয়শূন্যহীন সেক্যুলারিস্ট দুর্বৃত্তদের কারণে –যাদের হাতে অধিকৃত দেশের শিক্ষা, আইন-আদালত, প্রশাসন ও রাজনীতি।
প্যারাডাইম শিফ্ট
তবে আরবদের আর্থসামাজিক পশ্চাদপদতা নিয়ে ইসলামের শেষনবী (সাঃ) কোন রাজনৈতিক এজেণ্ডা বানাননি। তাদেরকে তিনি অর্থনৈতিক বিপ্লবের প্রতিশ্রুতিও দেননি। বরং বিপ্লব এনেছিলেন তাদের চেতনা রাজ্যে। সেটি ১৮০ডিগ্রির। চেতনায় আখেরাতের জবাবদেহীতার ধারণাটি তিনি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। ভাল কাজের প্রতিদান আছে এবং খারাপ কাজের শাস্তি আছে, মৃত্যুর পর জান্নাত ও দোজখ আছে এবং সেখানে মৃত্যুহীন অনন্ত জীবন আছে -সে বিষয়গুলো তিনি তাদের মনে দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। এতেই শুরু হয় ধর্মকর্মের সাথে তাদের চিন্তা-চরিত্র, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মীকতায় আমূল বিপ্লব। মনজগতের এরূপ বিপ্লবকেই বলা হয় প্যারাডাইম শিফ্ট। যে কোন সমাজ বিপ্লবের এ হলো পূর্বশর্ত্ব। নবদীক্ষিত এ মানুষগুলো পরিণত হন নবীজী (সাঃ)র একান্ত অনুগত সাহাবায়। তাদের হাতেই শুরু হয় সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে মহাবিপ্লব। দুনিয়ার এ জীবনকে তারা গ্রহণ করে পরীক্ষা ক্ষেত্র এবং সে সাথে আখেরাতে পুরস্কার বৃদ্ধির ক্ষেত্র রূপে। তাদের জীবনে বাঁচা-মরা ও লড়াই-সংগ্যামের একমাত্র লক্ষ্য হয় আল্লাহকে খুশি করা। ফলে মিশন হয়, সর্বপ্রকার পাপ থেকে বাঁচা এবং প্রতিটি মুহুর্তকে নেক আমলে ব্যয় করা। শুরু হয় আল্লাহর মাগফেরাত লাগে প্রচণ্ড তাড়াহুড়া –যেমনটি বলা হয়েছে পবিত্র কোরআনে। মাগফেরাত লাভের সে প্রতিযোগিতায় সে যুগের মুসলমানগণ নিজেদের সময়, সম্পদ, শক্তি এমনকি প্রাণের কোরবানী পেশেও কৃপণতা করেনি। ফলে আখেরাতমুখি সে তাড়াহুড়ায় দ্রুত নির্মিত হয়েছে ইসলামি রাষ্ট্র ও সভ্যতা। সমগ্র মানব ইতিহাসে মানবতা নিয়ে উপরে উঠার সেটিই সর্বোচ্চ রেকর্ড।
দুনিয়া ও দুনিয়াবাসীদের নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার কি অভিপ্রায় -সেটি তিনি গোপন রাখেননি। পবিত্র কোরআনে সেটি বার বার ঘোষিত হয়েছে। বলা হয়েছে, “তিনিই সেই মহান সত্ত্বা যিনি পথনির্দেশনা ও সত্য দ্বীনসহ তাঁর রাসূলকে পাঠিয়েছেন, সেটি এজন্য যে সকল ধর্মের উপর তা বিজয়ী হবে।” -( সুরা আস-সাফ, আয়াত ৯, সুরা ফাতাহ, আয়াদ:২৮; সুরা তাওবাহ, আয়াত ৩৩)। এটিই মহান আল্লাহর ভিশন। মুসলমান হওয়ার অর্থ শুধু মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলে বিশ্বাসী হওয়া নয়, বরং মহান আল্লাহর এ ভিশনের সাথে পরিপূর্ণ একাত্ম হয়ে যাওয়া। মু’মিনের প্রকৃত ঈমানদারি যাচাই হয় কতটুকু সে একাত্ম হলো তার উপর। সে একাত্মতার কারণেই মু’মিনের জীবনে শুরু হয় খেলাফতের দায়িত্বপালনের দায়ভার। কিন্তু যারা জাতি, গোত্র, বর্ণ ও ভাষার বন্ধনে আবন্ধ তারা সে মহান মিশনে একাত্ম হতে পারে না। তাই ইসলামকে বিজয়ী করার লড়াইয়ে জাতিয়তাবাদী, সমাজবাদী, পুঁজিবাদীদের দেখা যায় না। তারা বরং অবস্থান নেয় ইসলামের বিপক্ষে। এবং সেটিই স্বাভাবিক।
মুসলমানের শিক্ষালাভের মূল উদ্দেশ্য হলো খেলাফতের সে দায়িত্বপালনে নিজেকে যোগ্যবান করে গড়ে তোলা। এজন্যই মুসলমান ও অমুসলমানের শিক্ষাগত প্রয়োজনটা কখনোই এক নয়। মুসলমান ও অমুসলমান একই আলোবাতাসে শারীরীক ভাবে বেড়ে উঠতে পারে, কিন্তু একই শিক্ষা ব্যবস্থায় বেড়ে উঠতে পারে না। কারণ, বেঈমান যে শিক্ষায় তার চেতনায় পুষ্টি পায়, মুসলমান তা পায় না। বরং সে শিক্ষায় মৃত্যু ঘটে তার ঈমানী চেতনার। তাই শুরু থেকেই মুসলমানগণ নিজ নিজ সন্তানদের শিক্ষাভার কখনই কাফেরদের হাতে দেয়নি। কাফেরদের থেকে চাল-ডাল, আলু-পটল কেনা যায়, কিন্তু শিক্ষা নয়।শিক্ষা ধর্মান্তরের বা সাংস্কৃতিক কনভার্শনের অতি শক্তিশালী হাতিয়ার। কাফেরগণ মুসলিম দেশে মিশনারি স্কুল-কলেজ খুলেছে শুধু ধর্মান্তর করার লক্ষ্যে নয়, বরং সাংস্কৃতিক কনভার্শন বাড়াতে। কুশিক্ষার হাত ধরেই মগজে কুফরি ঢুকে। তাই শুধু হারাম পানাহারে সতর্ক হলে চলে না, হারাম শিক্ষা থেকেও সতর্ক হতে হয়। কিন্তু সেক্যুলারিজম সে হারাম শিক্ষাকেই মুসলিম দেশগুলোতে সহজলভ্য করেছে।
শিক্ষা যেভাবে বিপর্যয় আনে
মুসলমানদের পরাজয়ের শুরু মূলত তখনই শুরু হয় যখন শিক্ষার ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তারা নিজ দায়িত্বে না নিয়ে কাফের ও তাদের সেক্যুলারিস্ট মিত্রদের হাতে ছেড়ে দেয়। এবং যখন শিক্ষাদানের ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও আলেমদের কাছে গুরুত্ব হারায়। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণেই ভেঙ্গে গেছে মুসলমানদের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র উসমানিয়া খেলাফত। অথচ এ বিশাল রাষ্ট্রটি শত শত বছর ধরে মুসলমানদের জানমাল, ইজ্জত-আবরু ও ধর্মীয় বিশ্বাসের হেফাজত করেছে। বিশাল সে উসমানিয়া খেলাফতে তুর্কী, আরব, কুর্দি, মুর, আলবানিয়ান, কসোভান, বসনিয়ানগণ শত শত বছর একত্রে শান্তিতে বসবাস করেছে। ভাষাগত, বর্ণগত ও আঞ্চলিকতার বিভেদ ইউরোপকে শত বছরের যুদ্ধ ও যুদ্ধ শেষে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্তি উপহার দিলেও উসমানিয়া খেলাফতে তেমন দুর্যোগ দেখা দেয়নি। ভাষাগত, বর্ণগত ও আঞ্চলিক জাতিয়তাবাদ হলো মূলত ইউরোপীয় জাহিলিয়াত। সে জাহিলিয়াতের ভাইরাস থেকে মুসলিম ভূমি শত শত বছর মূক্ত ছিল। আলেমদের মাঝে নানা বিষয়ে মতভেদ তাকলেও জাতিয়তাবাদ, বর্ণবাদ ও আঞ্চলিকতা যে হারাম তা নিয়ে কোন কালেই কোন বিরোধ ছিল না। ইসলামে অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অধিকার আছে, কিন্তু ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে যুদ্ধ, বিভক্তি ও দেশভাঙ্গার অনুমতি নেই। রাষ্ট্রের সার্বভৌম মালিকানা একমাত্র মহান আল্লাহর, শাসক খলিফা বা আল্লাহর প্রতিনিধি মাত্র। তাই মুসলিম রাষ্ট্রের খণ্ডিত করার যে কোন উদ্যোগই মূলত আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সে যুদ্ধের শাস্তিও তাই অতি কঠোর। তাই উমাইয়া, আব্বাসী ও উসমানিয়া খেলাফতে শতবার খলিফার বদল হলেও ভৌগলিক অখণ্ডতায় হাজার বছরেও তেমন পরিবর্তন আসেনি। সৈন্যরা লড়েছে সীমান্তে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে। কিন্তু বিদ্যাশিক্ষার নামে তুর্কি, আরব,কুর্দিগণ যখন ইউরোপে পা রাখে তখন থেকেই তারা বিভক্তির ভাইরাস নিয়ে দেশে ফিরাও শুরু করে। তখন অসম্ভব হয়ে উঠে তুর্কি,আরব,কুর্দি এরূপ নানা ভাষাভাষী মুসলমানদের পক্ষে এক রাষ্ট্রে বসবাস করা। শুরু হয় ভাষা ও আঞ্চলিকতার নামে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ফলে মুসলমানদের পরাজিত করতে শত্রুদের যুদ্ধ করতে হয়নি, সে যুদ্ধগুলো এসব জাতিয়তাবাদীরাই লড়ে দিয়েছে। এবং এখনও লড়ছে। এদের কারণেই তুরস্ক ভেঙ্গে জন্ম নিয়েছে প্রায় তিরিশটি রাষ্ট্র। এবং বিভক্তির পরপরই অধিকৃত হয়েছে ব্রিটিশ, ফরাসী, মার্কিনী ও ইসরাইলীদের হাতে। অথচ বিশাল খেলাফতভূক্ত থাকার কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানগণ ইউরোপের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে রেহাই পেয়েছিল –অথচ সে সৌভাগ্য বাংলাদেশীদের জুটেনি। তাদের প্রায় দেড় শত বছর আগেই বাংলা ব্রিটিশের গোলাম হয়েছে। তাদের বিপদের শুরু তো উসমানিয়া খেলাফতের বিলুপ্তির পর।
সেক্যুলারিস্টদের প্রতরণা ও অপরাধ
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় পরাজয়টি রণাঙ্গণে হয়নি। সেটি হয়েছে শিক্ষার ময়দানে। ইসলাম সর্বপ্রথম দখলদারি হারিয়েছে মুসলমানদের চেতনার মানচিত্রে, ভূগোলের উপর দখলদারি হারিয়েছে তার পরে। এবং সেটি ঘটেছে মুসলিম দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সেক্যুলারাইজেশনের কারণে। অভিধানিক অর্থে সেক্যুলারিজম হলো সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষাব্যবস্থার এমন এক বিধান যা ধর্মকে নাগরিক জীবনের বিষয়াদীতে ভূমিকা পালনে বাধা দেয়। –(Collins COBUILD Advanced Learner’s Dictionary). সুতরাং সেক্যুলারিজমের লক্ষ্য, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকাকে নিয়ন্ত্রিত করা। অর্থাৎ সেক্যুলারিস্টদের হাতে বন্দিদশা নেমে আসে খোদ ধর্মের উপর। তাদের অবস্থান তাই ধর্মের বিরুদ্ধে। ফলে সেক্যুলারিজমকে ধর্মনিরেপক্ষতা বলা নিছক প্রতারণা। অথচ মুসলিম দেশে তারা সে প্রতারণাটিই চালিয়ে আসছে। এভাবেই তারা অসম্ভব করে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা।
মানব-কল্যাণে ইসলামের মিশনটি সর্বমুখি। সেটি যেমন ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতীক ক্ষেত্রে, তেমনি শিক্ষার ক্ষেত্রেও। তাই সে সর্বমুখি মিশনকে সীমিত করলে ইসলাম তখন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কার্যকরি ক্ষমতা হারায়। বরং ইসলামের প্রকৃত কল্যাণ পেতে হলে ইসলামী বিধানের সর্বক্ষেত্রে পূর্ণ প্রয়োগটি জরুরী। অথচ সেটিই সেক্যুলারিস্টগণ মুসলিম দেশে হতে দিতে রাজী নয়। এভাবে ইসলামকে তারা অকার্যকর করছে। ফলে মুসলমানগণ ব্যর্থ হচ্ছে ইসলামের প্রকৃত কল্যাণ পেতে। সেক্যুলারিস্টদের এটি এক বড় অপরাধ। ইসলামের বিরুদ্ধে ছাত্রদের মনকে ইম্যুনাইজড করার কাজে শিক্ষাকে তারা হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে। এমন শিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্রদের মনে ইসলামী ধ্যানধারণার প্রবেশ তখন কঠিন হয়ে পড়ে। অপরদিকে ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও আঞ্চলিকতার নামে তারা যে দেয়াল গড়ে তোলে সেটিও সীমিত করে ফেলে প্যান-ইসলামি শিক্ষার দুনিয়াবব্যাপী প্রসার। ফলে নামে মুসলিম হলেও মুসলিম ভূমিতে তারা খাটছে ইসলামের প্রকৃত দুষমন রূপে। যারা ধর্মপালন ও ইসলামের বিজয়ে আগ্রহী ইসলামের শত্রুদের এ ষড়যন্ত্রকে অবশ্যই তাদের বুঝতে হবে।
লেখা: ফিরোজ মাহবুব কামাল
0 comments: