বিতর্কিত এই মতবাদটি সম্পর্কে সূচনাতেই বলে নিতে চাই, ইংরেজি 'সেক্যুলারিজম' শব্দের বাংলা অনুবাদ হলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য অথবা না বুঝে বলে থাকেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। আসলে বিষয়টি এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থই হলো ধর্মহীনতা। ধর্মনিরপেক্ষতার একমাত্র অর্থ ধর্মহীনতা, কোনো ধর্মের অন্তর্গত না থাকা বা ধর্মদ্রোহীতা। ধর্মনিরপেক্ষতার এসব অর্থ ব্যতীত অন্য কোনো অর্থ বা সংজ্ঞা পৃথিবীর কোনো ডিকশনারীতে নেই। ধর্মীয় আচরণকে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ রেখে সমাজ জীবনের প্রত্যেক স্তর থেকে ধর্মকে মুক্ত রাখতে হবে এবং সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ধর্মকে পরিত্যাগ করাই এ মতবাদের লক্ষ্য। এ জন্যে এই মতবাদকে ‘ধর্মহীনতা’ বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
কারণ, ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের মূল কথাই হলো, রাষ্ট্র ও রাজনীতির সাথে ধর্ম সংযুক্ত থাকবে না, ধর্ম থাকবে ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত পরিমন্ডলে সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনোভাবেই ধর্মকে বিবেচনা করা যাবে না। মুসলিম বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ইসলাম মুক্ত শাসন, ইসলামকে ব্যক্তির জীবনে সীমাবদ্ধ রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। রাজনীতি, অর্থনীতি, তথা সকল কিছুকে ধর্মহীন তথা ইসলাম মুক্ত করা।
ধর্মনিরপেক্ষতা বিশ্ববাসীর জন্য এক মারাত্মক ক্ষতিকর মতবাদ যা প্রত্যেকে ধর্মের মানুষকে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার ব্যাপারে অনীহা সৃষ্টি করে। এই মতবাদের প্রচার ও প্রসারের অর্থই মানবতার অকল্যাণ এবং ইসলাম ও মুসলমানের ক্ষতি। ধর্মনিরপেক্ষতা মুসলিম ঐক্য এবং পারস্পরিক সম্পর্কই শুধু বিনষ্ট করে না, বরং প্রত্যেক ধর্মের মূলে কুঠারাঘাত হানে। এমনকি দেশের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। সুতরাং যে কোনো ধর্মাবলম্বীর পক্ষেই ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।
সমস্যা হলো আমাদের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও কবি-সাহিত্যিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ফ্রয়েড, মার্কস, হেগেল, প্লেটো, ডারউইন, কোপার্নিকাস, কেপলার, লেনিন, মাও সেতুঙ, হোচিমিন থেকে শুরু করে রাজা রামমোহন রায় বা করম চাঁদ গান্ধী পর্যন্ত যেভাবে পড়েছেন-জেনেছেন, তার শত ভাগের এক ভাগও আল্লাহ-রাসূল, কুরআন-হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্র সম্পর্কে পড়তে বা জানতে চেষ্টা করেনি। না ছাত্র জীবনে না রাজনৈতিক জীবনে। ফলে নিরপেক্ষতাও যে একটি পক্ষ তা বুঝতে সক্ষম হননি। যারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী তারা নিঃসন্দেহে নিজেকে প্রতারিত করছেন। কারণ, ধর্মে বিশ্বাসী কোনো মানুষ কখনোই ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ হতে পারে না। ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থই হচ্ছে পক্ষেও নয়- বিপক্ষেও নয়।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে মুসলমান তো দূরের কথা- অন্য কোনো ধর্মের অনুসারীও ধর্মনিপেক্ষ হতে পারে না। নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করার অর্থ নিজের সাথেই নিজেই প্রতারণা করার শামিল। আমার এ কথার স্বপক্ষে বাস্তব কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করুনঃ-
একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ যখন পরনে ধুতী, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, গায়ে নামাবলী ও পৈতা জড়িয়ে, মাথায় টিকি, সিঁথিতে সিঁদুর ও হাতে শাখা পরেন, বার মাসে তের পূজা এবং তেত্রিশ কোটি দেবতায় বিশ্বাস করে প্রত্যেহ মন্দিরে গিয়ে দেবতার পদপাদ্যে অর্ঘ-নৈবদ্য নিবেদন করেন, তখন তিনি কি আর ধর্মনিরপেক্ষ রইলেন? তিনি তো ধর্মের পক্ষেই চলে গেলেন।
একজন শিখ যখন গুরু নানকের অনুসারী হয়ে দাড়ি না কেটে মাথায় পাগড়ী পরেন এবং হাতে বালা ও কৃপাণ ধারণ করেন, গুরুদুয়ারায় গিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেন তখন তো তিনি ধর্মের পক্ষেই থাকলেন। একজন বৌদ্ধ যখন গৌতম বুদ্ধের অহিংসা পরমধর্ম ও জীব হত্যা মহাপাপ নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে গেরুয়া বসন পরিধান করে আত্মার মহানির্বাণ লাভের জন্যে কৃচ্ছ্র-সাধন করেন, বোধিবৃক্ষকে পবিত্র জ্ঞান করে প্যাগোডায় যান তিনিও তো ধর্মের পক্ষই অবলম্বন করলেন।
একজন খৃস্টান যখন যিশুখৃস্টকে তাদের ত্রাণকর্তা প্রভু বলে বিশ্বাস করেন, গলায় ক্রুশ ঝুলান, ত্রিত্ববাদ ও বাইবেলে বিশ্বাস করেন, মুখে যিশুর নাম উচ্চারণ করে প্রতি রোববার গির্জায় প্রার্থনা করেন, আমেরিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যখন বাইবেল স্পর্শ করে প্রেসিডেন্টের শপথ নেন এবং তাদের প্রতিটি ডলারে যখন ছাপার অক্ষরে লেখা থাকে 'ইন গড উই ট্রাস্ট' তখন তারাও তো আর ধর্মনিরপেক্ষ রইলেন না, ধর্মের পক্ষেই এলেন।
একজন মুসলিম পুরুষ যখন মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি এবং লম্বা জামা পরেন, নামায-রোযা, হজ্জ ও উমরাহ পালন করেন, মুসলিম নারী যখন শালীন পোশাক তথা পর্দা করেন, হিজাব পরিধান করেন, আল্লাহ-রাসূল, কুরআন-হাদীস, পরকাল, জান্নাত-জাহান্নামে বিশ্বাস করেন, তিনিও তো ধর্মের পক্ষেই অবস্থান নিলেন। এটাই যখন অটল বাস্তবতা, তাহলে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রইলো কে? প্রকৃত বিষয় হচ্ছে ধর্মে বিশ্বাসী কোনো মানুষই ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না।
(ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা একটা আয়াত প্রায়ই ফলাবার চেষ্টা করে
'যার যার ধর্ম তার তার কাছে' )
বিষয়টি আরো একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতা’য়ালা ধর্মের ব্যাপারে কি বলছেন, ‘নিশ্চয়ই জীবন বিধান হিসেবে আল্লাহর নিকট ইসলামই একমাত্র মনোনীত দ্বীন।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং- ১৯ এর ব্যাখ্যা দেখুন)
পবিত্র কুরআনের ত্রিশতম পারায় সূরা কাফিরুনে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর নবীকে দিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, তোমাদের দ্বীন (ধর্ম) তোমাদের জন্য, আমাদের দ্বীন (ধর্ম) আমাদের জন্য।’ এখানেও ধর্মের পক্ষের কথা। অর্থাত তোমরা যে ধর্মেরই অনুসারী হও ধর্মকে মিশ্রণ করা যাবে না, ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকা যাবে না, তোমরা তোমাদের ধর্মের পক্ষে থাকো আমরা আমাদের ধর্মের পক্ষে থাকি। বিশেষ করে একজন মুসলমানের জন্য ইসলামকে সাম্প্রদায়িক ভাবার এবং নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারী বানানোর অধিকার থাকতে পারে না। এটা তার ঈমানের সাথে একেবারেই সাংঘর্ষিক বা বেঈমানী।
ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যদি পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পরধর্মের অধিকার, তাদের প্রতি উদারতা, সহিষ্ণুতা হয় তাহলে এর কোন বিষয়টি ইসলাম অমুসলিমদেরকে দেয়নি? সুতরাং নিজে গোলাম হয়ে প্রভুর আইনে নাক গলানো হচ্ছে কোন সাহসে? ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা লক্ষ্য করুনঃ-
১। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে অমুসলিমদের উপাসনালয় ভাংতে এবং তাদের উপাস্য দেবদেবীদের সম্পর্কে কটুক্তি করতে নিষেধ করেছেন।
২। বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সাঃ) ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সদাচারণ করতেন। তাদের গীবত করা, স্বার্থহানী, অর্থ-সম্পদ আত্মসাত ও নষ্ট করা এবং তাদের প্রতি জুলুম করা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এর ব্যতিক্রম করা হলে নবী করীম (সাঃ) কিয়ামতের ময়দানে মজলুম অমুসলিমদের পক্ষাবলম্বন করবেন বলে মুসলমানদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন। (হাদীস)
৩। তাদের নিজেদের পরিমণ্ডলে শূকর পালন ও মদ উৎপাদন, মদের ক্রয়-বিক্রয় ও তা খাওয়া পান করায় কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করেননি। এমনকি কোনো মুসলমান কোনো অমুসলিমদের মদ-শূকরের ক্ষতি সাধন করলে তার ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
৪। অমুসলিমদের পারিবারিক কর্মকাণ্ড, তাদের বিয়ে-শাদী, পূজা-পার্বণ, উপাসনালয় নির্মাণ, সংস্কার-সংরক্ষণে তাদের ধর্ম অনুযায়ী পালিত হবে তাতে কেউ বাধা দিতে পারবে না।
৫। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তাদের মৌলিক মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার একজন মুসলিম নাগরিকের মতোই সংরক্ষিত হবে।
উল্লেখিত কথাগুলোর একটিও আমার মন-মস্তিষ্ক প্রসূত নয়। প্রমাণ হিসেবে দেখুন, ফাতহুল বয়ান, ৪র্থ খণ্ড, ৯৩ পৃষ্ঠা, ফতহুল কাদীর, ৪র্থ খণ্ড, ৩৮১ পৃষ্ঠা, আল মাবসুত, ১৩শ’ খণ্ড, ৩৭ পৃষ্ঠা, শরহে সিয়ারুল কবীর, ৩য় খণ্ড, ২৫১ পৃষ্ঠা, বাদায়ে আছ ছানায়ে, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১১৩ পৃষ্ঠা, দুররুল মোখতার, ৭ম খণ্ড, ১১২ পৃষ্ঠা, কিতাবুল খারাজ, ৮২ পৃষ্ঠা।
লেখা: হাসান তারিক
1 comments:
সঠিক ধর্মনিরপেক্ষতা যানতে হলে? ক্লিক করুন www.um-af.com এবং সেখান থেকে ফ্রি ডাউনলোড করুন ?“আল-কোরআনের দৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও দ্বীন ইসলাম এবং গণতন্ত্র” তবেই সত্যিকার ধর্মনিরপেক্ষতা যানতে পাবেন?