শহীদ হারুন-অর-রশীদ কায়সার |
ব্যক্তিগত পরিচয় :
১৯৮৭ সনের ২৫ নভেম্বর, চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার ১০ নং ইউনিয়নের রাঘবপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ হারুন-অর-রশিদ কায়সার। ছোট বেলা থেকেইে তিনি অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, স্বল্পভাষী ও অত্যন্ত শান্ত মেজাজের অধিকারী ছিলেন। সাক্ষাতে সবার সাথে হাসিমুখে সালাম বিনিময় ও কুশল জিজ্ঞেস করতেন। নিজ বাড়ীর আঙ্গিনায় রাঘবপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার পড়ালেখা শুরু হয়।
পড়ালেখায় তার প্রধান সহকারী ছিলেন তার শ্রদ্ধেয় পিতা। নিয়মিত ক্লাসের পড়ালেখা আদায় করে প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাসের প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি। সুশৃংখল, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। প্রতিদিনের কাজ ডায়েরীতে লিখে রাখতেন। ভাল ফলাফল ও আকর্ষণীয় চরিত্রের কারণে পরিবার, প্রতিবেশী, সহপাঠী আর শিক্ষকদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন কায়সার। মেধার স্বাক্ষর রেখে উচ্চ শিক্ষার আশায় ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে। সেখানেও অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর রেখে বিভাগে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। পাশাপাশি সংগঠনের সহচার্যে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীও হয়েছিলেন। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়, কোরআন তেলওয়াত ও পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি নিজের সাধ্যমত অন্যকে সহযোগিতাও করতেন। সকল আতœীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য সবসময় খোঁজ খবর নিতেন। পরিবারের সদস্য, আত্বীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, শিক্ষক আর সহপাঠীদের হৃদয়ে তিনি তার মজবুত অবস্থান তৈরী করে নিয়েছিলেন। এমন একটি ছেলেকে এভাবে হারাতে হবে কেউ ভাবতেও পারেনি। এটাই কি তার অপরাধ যে, তিনি একটি আদর্শে বিশ্বাসী সুন্দর চরিত্রের অধিকারী ছিলেন?
শাহাদাতের ঘটনা :
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলে চোখ ধাঁধানো কারচুপির মাধ্যমে সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী(!) আওয়ামী সরকার। মুখে দেশের তাগিদে অনেক কিছু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও প্রতারণাময় চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি। তাই সরকার গঠনের পর থেকেই দেশ ও ইসলামকে ধ্বংস করার এক একটি নীলনকশা তৈরী করতে থাকে। তাদের সেই নীল নকশার শিকার হন শহীদ নোমানী, শাহিন, রমজান আলী, মহিউদ্দিন মাসুম সর্বশেষ আমাদের এই প্রিয় ভাই হারুন-অর-রশিদ কায়সার। কী ঘটেছিল সেদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ? ঠিক একমাস আগে ১১ ফেব্র“য়ারী- ২০১০ ইসলামী আন্দোলনের আবেগ অনুভূতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মিথ্যা হল দখলের অজুহাত সৃষ্টি করার জন্য নৈরাজ্যপ্রিয় ছাত্রলীগের হাতে নিমর্মভাবে শহীদ হন মাসুম ভাই। এরপর ছাত্রলীগ তাকে নির্লজ্জভাবে নিজেদের কর্মী বলেও দাবী করে। পরবর্তীতে ২৮ মার্চ- ২০১০ ছাত্রলীগের দুই গ্র“পের তুমুল সংঘর্ষ বাঁধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নং গেইটে। থমথমে একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রাতের ট্রেনে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে ছাত্রলীগ নিজেদের ত্র“টি প্রশমনের জন্য, আরেকটি অস্থীতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে মার্কেটিং বিভাগে অধ্যয়নরত ছাত্রশিবিরের কর্মী হারুন-অর-রশীদ কায়সার ভাইকে ট্রেনের বগিতে নির্মমভাবে প্রহার করে। এক পর্যায়ে হায়েনারা কায়সার ভাইকে নিষ্ঠুরভাবে জবাই করে তার লাশ চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেয়। ঘটনাটি যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্য বগিতে অবস্থানরত সবাইকে হত্যার হুমকি দেয় পশুরা। পরদিন তার লাশ চৌধুরীহাট এলাকা থেকে উদ্ধার করার পর পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরপর দুই মাসে দুিট তাজা প্রাণ হারিয়ে এক করুন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
জানাজা ও দাফন :
শাহাদাতের খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করতে পারেনি এমন ছেলেকে কেউ কোনদিন মারবে। শহীদের লাশ বাড়ীতে পৌছলে শত মানুষের ঢল পড়ে যায়। তার জানাজায় উপস্থিতির সংখ্যা সম্পর্কে শহীদের বাবা বলেন এর আগে এত বড় জানাজা কারও হয়নি। শহীদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় তার বাল্যকালের স্মৃতি বিজড়িত রাঘবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। তার জানাজার নামাজের ইমামতি করেন তার স্কুলশিক্ষক মাওলানা গোলাম কিবরিয়া। জানাজার নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাদা-দাদীর পাশে তাকে কবরস্থ করা হয়।
মায়ের প্রতিক্রিয়া :
সন্তান হারানোর বেদনা সন্তান গর্ভে ধারণ করে তিল তিল করে গড়ে তোলা প্রিয় মায়ের চেয়ে বেশী দুনিয়ার আর কারও হতে পারেনা। তারপর কায়সারের মত ছেলে হলে তো কথাই নেই। মা বলেন- কায়সার যখন গর্ভে তখন স্বপ্ন দেখেছিলাম পুরুষ খেজুর গাছে পাকা খেজুর ধরেছে। কায়সারের দাদী ব্যাখ্যা করলেন তোমার কোলে এমন শিশু আসবে যার জন্য তুমি গর্বিত হবে। প্রিয় মা কি কখনো কল্পনা করেছেন এইভাবে মহান আল্লাহ তার সন্তানকে কবুল করে তাকে গর্বিত করবেন। কিন্তু, মা বলে কথা। সংসারের বড় ছেলে, তারপর আবার ফুলের মত যেমন সুন্দর তার চেহারা তেমনি অসাধারণ চরিত্র। সন্তান হারানোর বেদনায় তিনি মাঝে মাঝে খুব বেশী অসুস্থ হয়ে যান। মা বলেন- আমার স্বপ্ন বলতে আর কিছুই নেই, আমার হাতে গড়া এত বড় ফুলের মত ছেলেকে হারানোর ব্যাথা কাউকে বুঝাতে পারছিনা, শত্র“রা কেন আমার সোনামণিকে মারল, সে তো কোনদিন কারো ক্ষতি করেনি। আজ ছাত্রশিবিরের ছেলেদের বুক ভরা ভালবাসাই আমাকে বেঁচে থাকার উপায় যুগিয়েছে।
বাবার প্রতিক্রিয়া :
শহীদের বাবা বলেন- আমার স্কুলের ছাত্র ছিল কায়সার। কোনদিন কেউ তার নামে আমাকে কোন অভিযোগ করেনি। সে এমনভাবে মাটিতে দৃষ্টি রেখে আলতোভাবে পথ চলত যে, তার অনুভূতি এমন মাটি বুঝি ব্যাথা পাচ্ছে। কারও সাথে রাগ করে ধমক দিয়ে কোনদিন কথা বলেনি কায়সার। তাকে হারিয়ে আমার যে আর কোন স্বপ্ন নেই। আজ আমার ছেলে শহীদ হয়ে যে সম্মান আমি পেলাম তা আগে কখনো পাইনি। শিবিরের ছেলেদের আন্তরিকতা আর ছোট ছেলেটিকে আগলে কায়সারকে হারানোর দুঃখ আমি ভুলে আছি। জানিনা শত্র“দের বিচার এই জমিনে হবে কিনা। যদি হত তবে মনে বড় শান্তি পেতাম। এখন একমাত্র মহান আল্লাহর কাছে বিচার চাই।
বোনের প্রতিক্রিয়া :
কায়সারের একমাত্র ছোট বোন তার ভাই সম্পর্কে বলে- আমার ভাইয়ার মত ছেলে আমাদের গ্রামে আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। শত্র“রা কেন আমার ভাইকে মেরেছে তা এখনও আমার বুঝে আসেনা। মাঝেমাঝে মনকে বুঝাতে পারিনা যে, ভাইয়া নেই। আমার প্রথম কন্যাসন্তানটির জন্মের সুখবরটুকুও আমার ভাইয়াকে দিতে পারিনি।
শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া :
কায়সার সম্পর্কে তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা জাহানারা বেগম বলেন, কায়সার খুব শান্ত মেজাজের অন্যরকম ছেলে ছিল। নিয়মিত পড়া শিখে আসতো। কারও সাথে ঝগড়া করত না। নিয়মিত স্কুলে আসতে রাস্তার পাশে তার কবর যখন চোখে পড়ে তখন তার স্মৃতি মনে পড়ে যায়, আল্লাহর কাছে তার মর্যাদার জন্য দোয়া করি। তার অন্য এক স্কুলশিক্ষক জানান, পরীক্ষার রেজাল্ট হলে সবাই যখন আনন্দে উল্লাসিত তখন মসজিদের দিকে কায়সারকে যেতে দেখে অবাক হয়ে যাই। হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাধন চন্দ্র শীলসহ অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও একই কথা এমন ছেলেকে কেউ মারবে তা আমরা ভাবতেও পারিনা। মেধাবী ছাত্র হওয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও সুনজরে ছিলেন কায়সার ভাই।
প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়া :
প্রতিবেশীদেরও একই মন্তব্য, কায়সারের মত ভাল ছেলে শুধু রাঘবপুর কেন সারা বাংলায়ও খুঁজলে খুব বেশী পাওয়া যাবেনা। এই ছেলেকে মারার মত কোন কারণ আমরা খুঁজে পাইনা।
|
0 comments: