শহীদ মু. মাহমুদুল হাসান
১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৯৷ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়, রক্তাক্ত একটি স্মৃতি৷ এদিন পবিত্র রমজান মাস হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্বাভাবিকভাবে হলে অবস্থান করে, যার যার পড়ালেখা ও ইবাদত বন্দেগীতে ব্যসত্ম ছিল৷ ঠিক সে মুহূর্তে আওয়ামীলীগের সোনার ছেলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সোহরাওয়ার্দী হল দখলের পরিকল্পনা করে৷ এরই অংশ হিসেবে তত্কালীন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি কলিমের নেতৃত্বে বাহার, মেজবাহ, রায়হান, তানভীরসহ চিহ্নিত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা একে-৪৭, এস.এম.জি কাটা রাইফেলসহ মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল আক্রমণ করে৷ সেদিন শত শত পুলিশের উপস্থিতিতে তারা ফিল্মি কায়দায় ব্রাশ ফায়ার করতে করতে সোহরাওয়ার্দী হলে প্রবেশ করার চেষ্টা করে৷ ছাত্রলীগের এ অভিযানে সংবাদ পেয়ে তখন আলাওল ও এ.এফ রহমান হলে অবস্থানরত ছাত্রশিবির নেতাকর্মীলা 'নারায়ে তাকবীর-আলস্নাহু আকবার' শেস্নাগান দিতে দিতে সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসে৷ আলস্নাহর অকুতোভয় সৈনিকরা যখন সম্পূর্ণ আলস্নাহর উপর ভরসা রেখে ইসলামী আন্দোলনের এ ঘাঁটিকে রৰায় এগিয়ে আসেন ঠিক তখন শয়তানের প্রেতাত্মা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা শিবিরের মিছিল লৰ্য করে বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ করতে থাকে৷ সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে লুটিয়ে পড়েন ইসলামী আন্দোলনের দুই মর্দে মুজাহিদ৷ সেদিন ঘটনাস্থলেই শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মেধাবী ছাত্র ফতেপুর শাখার সেক্রেটারি রহিম উদ্দীন ও ফাইন্যান্স বিভাগের মেধাবী ছাত্র মাহমুদুল হাসান৷ পায়ে বুলেট বিদ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন শিবির নেতা আবদুস শাকুর৷
সেদিন চরদখলের মত ক্যাম্পাস দখলের নেশায় আবু জেহেল- আবু লাহাবের উত্তরসূরিরা ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে দুই শিবির নেতাকে৷ মিষ্টভাষী ও সদা হাস্যোজ্জ্বল শহীদ রহিম উদ্দীন ছিলেন শানত্মশিষ্ট৷ তিনি ইসলামী আন্দোলনের এক অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন৷ তার ভয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আতঙ্কে থাকতো৷ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা শিবিরের মিছিলে একে-৪৭ এবং এস.এম.জির ব্রাশ ফায়ার করে শিবিরকে নিশ্চিহ্ন করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের সন্ত্রাসের আখড়া বানাতে চেয়েছিল৷ তখন ইসলামের খাদেম এ দুই তরম্নণ নিজেদের বুক পেতে দিয়ে সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করেছিল৷ কিন্তু আওয়ামী প্রশাসনের নির্লজ্জ হাত সেদিনও অতীতের ধারাবাহিকতায় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি৷ তারা ক্যাম্পাসবাসীকে এবং দুই শহীদের সাথীদেরকে ক্যাম্পাসে শহীদের জানাযা পর্যনত্ম পড়তে দেয়নি৷ ছাত্র-ছাত্রীদের আহাজারির প্রতি কর্ণপাত করেননি কর্তৃপক্ষ।
মেধাবী ছাত্র শহীদ রহিম উদ্দীন এবং মাহমুদুল হাসান দৰিণাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ এ বিদ্যাপীঠে এসেছিলেন সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করতে৷ তারা চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী অর্জন করে দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করবেন৷ কিন্তু হায়েনাদের নির্মম ব্রাশ ফায়ার তাদের সে স্বপ্নকে ধুলিস্মাত্ করে দেয়৷ সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে পড়ে থাকা নিসত্মব্ধ রহিম, নিথর হাসানের নির্বাক দৃষ্টিতে একটিই প্রশ্ন ছিল, কী অপরাধ আমাদের? আমরা কি সন্ত্রাসী? চোর-ডাকাকত? কেন তোমরা আমাদের হত্যা করলে? আমাদেরও তো স্বপ্ন ছিল সবার মত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিয়ে মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার ৷ জবাব চাই আওয়ামী সরকার ও প্রশাসন৷ আজকে রহিম, হাসান, জোবায়েরের সাথীদেরও জিজ্ঞাসা- 'কী ছিল তাদের অপরাধ? কেন আওয়ামী দুর্বত্তরা বিনা দ্বিধায় পাখির মত গুলি করে তাঁদেরকে হত্যা করল?'
শহীদ মাহমুদুল হাসানের মায়ের অনুভূতি
মাহমুদ ছোটবেলা থেকে চটপটে ছিল৷ সবাই তাকে অনেক আদর করতো৷ পাড়া প্রতিবেশিদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল খুব গভীর৷ সে যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি আসতো, আশে পাশের সবার সাথে দেখা করতো৷ যতদূর মনে পড়ে মাহমুদ শাহাদাতের আগে টাকা চেয়ে চিঠি লিখেছিল৷ চিঠি পাওয়ার পর আমরা তার জন্য কিছু টাকা পাঠাই৷ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা ভাল ছিল না৷ তার শাহাদাতের কিছু দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে একবার খুব আহত হয়েছিল৷ একটু সুস্থ হওয়ার পর বাড়িতে আসলে ছেলের দিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ি৷ ওরা আমর ছেলেকে রড দিয়ে পিঠে ও গায়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করে ফেলে৷ আমি তখন তাকে বলেছিলাম বাবা তুই কিছু দিনের জন্য বাড়ি আয়৷ তখন সে বলল রমজান মাসের ১০ তারিখে আসবে৷ আমি তাকে বললাম সাবধানে থাকিস৷ সে বলল মা শহীদের মৃতু্য সবচেয়ে মর্যাদার মৃতু্য, এই মৃতু্য কয়জনের ভাগ্যে জোটে৷ তুমি দোয়া করো যেন আল্লাহর পথে বীরের বেশে শহীদ হতে পারি৷ তার কথাগুলো শুনে আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম৷ আর ভাবলাম সত্যি সত্যিই কি সে শহীদ হয়ে যাবে? আমার বাবা ১০ তারিখে বাড়িতে এসেছে, তবে জীবিত নয় শহীদ হয়ে৷ আমার ছেলের কী অপরাধ? কেন তারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে? সেতো কখনো কারো সাথে খারাপ আচরণ করেনি৷ শুধু ইসলামী আন্দোলন করার কারণেই তারা আমার মাহমুদকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়েছে৷
তার শাহাদাতের পরে তার বাবার কন্ঠ বন্ধ হয়ে যায় এবং ৬ মাস পরে তিনি মারা যান৷ আমার কোনো দুঃখ নেই৷ আল্লাহ আমাকে মাহমুদকে দিয়েছেন আবার তাকে শহীদী মর্যাদা দিয়ে নিয়ে গেছেন এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রেরণা৷ আমি শহীদের একজন গর্বিত মা৷ দোয়া করি আল্লাহ যেন আমার ছেলের সাথীদেরকে হেফাজত করেন৷ আমীন !
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অভিমত
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের চেয়াম্যান প্রফেসর হারম্ননুর রশীদ শহীদ মাহমুদুল হাসানের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন; শুরম্ন থেকে চটপটে হওয়ার কারণে ক্লাসে অন্য কারও চেয়ে কয়েকজন ছাত্রের সাথে একটু বেশি বোঝাপড়া হয়৷ তাদের সাথে মাহমুদ তার স্বভাবসুলভ চঞ্চলতার পাশাপাশি ভাল ছাত্র হওয়ায় শুধু আমার কাছে নয়- পরে জানতে পারি অন্যান্য শিৰক ও বন্ধুদের কাছে খুবই প্রিয়৷ প্রথম বর্ষ থেকে একটু স্নেহ পাওয়ায় সে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো৷ বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সকল দায়িত্ব নিজে করার কারণে ছাত্র শিৰক সকলের তার প্রতি আলাদা দুর্বলতা ছিল৷ দীর্ঘ চার বছরে হেসে খেলে সবার হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া মাহমুদ এভাবে হঠাত্ চলে যাবে ভাবতে কষ্ট হয়৷ মুক্তিযোদ্ধা ছিলা বলে নিজের প্রতি এতটা প্রচণ্ড ৰোব জন্মাল, একটি দেশে এভাবে প্রকাশ্যে দুজন ছাত্রকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করল অথচ কোন প্রতিকার নেই, বিচার নেই৷ এমনকি যে ক্যাম্পাসে দীর্ঘ সময় এ ছেলেটি, সেই ক্যাম্পাসবাসীকে জানাযা পর্যনত্ম পড়তে দেয়া হল না৷ আজও খুব কষ্ট পাই আমার প্রিয় ছাত্রটির জানাযা পড়তে পারিনি বলে৷ আলস্নাহর কাছে প্রার্থনা, চোখের সামনে যেন আর কোনো শিৰককে ছাত্রের লাশ দেখতে না হয়৷ এবং যারা এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী তদনত্মপূর্বক তাদের বিচারের মুখামুখি করতে প্রশাসন ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি৷
পুরো নাম
|
মু. মাহমুদুল হাসান
|
বাবার নাম
|
মু. আবদুজ জাহের
|
স্থায়ী ঠিকানা
|
চরমনসা, ভবানীগঞ্জ, সদর, লক্ষীপুর৷
|
সাংগঠনিক মান
|
সাথী
|
সর্বশেষ পড়াশোনা
|
অনার্স চতুর্থ বর্ষ (ফিন্যান্স)
|
সর্বশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
|
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
|
ভাই-বোন
|
৩ ভাই, ৩ বোন
|
শহীদের অবস্থান
|
ভাইদের মাঝে ২য়
|
পরিবারের মোট সদস্য
|
৮ জন
|
আহত হওয়ার স্থান
|
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে
|
আঘাতের ধরন
|
মাথায় গুলি
|
যাদের আঘাতে শহীদ
|
মুজিববাদী ছাত্রলীগের ব্রাশ ফায়ারে
|
শাহাদাতের তারিখ
|
১৯.১২.১৯৯৯ ইং, রবিবার
|
0 comments: