সেনাসমর্থিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিদেশে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে কারাগার থেকে মুক্তি না দেয়ার জন্য সরকারের কাছে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছিলেন দলটির তত্কালীন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু। এমনকি আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে তিনি প্রচারণাও চালিয়েছিলেন। দুর্নীতির মামলায় শেখ হাসিনার সাজা হওয়ার ওপর তার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নির্ভর করছে বলেও মন্তব্য করেন।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ওয়াশিংটনে পাঠানো গোপন তারবার্তায় এসব কথা উল্লেখ করেছেন। ২০০৮ সালের ১৮ জুন তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ওয়াশিংটনে ওই গোপন তারবার্তাটি পাঠান। সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকস এ তারবার্তাটি ফাঁস করেছে।
মার্কিন তারবার্তায় বলা হয়েছে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনা যেদিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন, সেদিন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক দফতরকে বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব চালিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে দলের স্থানীয় কর্মীদের মধ্যে তিনি প্রচারণা চালাবেন। আমু মার্কিন দূতাবাসকে জানান, তিনি দীর্ঘ সময় হাসিনার সঙ্গে কাজ করবেন না। আমু নিশ্চিত করেন, তিনি হাসিনার কারামুক্তি ও দেশ ত্যাগ করার মধ্যবর্তী সময়ে হাসিনার সঙ্গে কথা বলবেন না।
তারবার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে, আমু মার্কিন দূতাবাসের কাছে স্বীকার করেন, অনেকগুলো দুর্নীতি মামলার মধ্যে কমপক্ষে একটিতে শেখ হাসিনার সাজা হওয়ার ওপর এখন তার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নির্ভর করছে।
প্রেসিডেন্ট ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান উপদেষ্টা থেকে পদত্যাগের চাপ দিয়েছিলেন মইনসহ সামরিক কর্মকর্তারা : সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মইন উ. আহমেদ, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ তিন বাহিনীর প্রধানরা ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি স্থানীয় সময় বিকাল প্রায় ৫টায় প্রেসিডেন্ট ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। ওই সাক্ষাতে তারা প্রেসিডেন্টকে কোনো সময় না দিয়ে তাকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলেন। একই সঙ্গে তারা একজন নতুন প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে বলেন। ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করতে এবং সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি নতুন নির্বাচনী শিডিউল দিতে বলেন। এ সময় প্রেসিডেন্টকে কোনো সময় দেয়া হয়নি। কারণ, তাতে তিনি বেঁকে বসতে পারেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এদিন জরুরি অবস্থা জারির সেনাবাহিনীর প্রস্তাব মেনে নেন। অন্যদিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানানো হলে তিনি সে প্রস্তাবে রাজি হননি। ঢাকায় নিযুক্ত তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস ওয়াশিংটনে পাঠানো গোপন তারবার্তায় এসব কথা উল্লেখ করেন। গত ৩০ আগস্ট উইকিলিকসে ফাস হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক গোপন তারবার্তা থেকে এসব জানা যায়।
তারবার্তায় বলা হয়, ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স কাউন্টার টেররিজম প্রধান ব্রিগেডিয়ার এটিএম আমিন ১২ জানুয়ারি সাক্ষাত্ করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। তারবার্তায় বলা হয়েছে, এটিএম আমিনের মতে, তিন বাহিনী প্রধান ও আর্মি চিফ অব স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মইন উ আহমেদ ১১ জানুয়ারি বিকাল প্রায় ৫টার দিকে প্রেসিডেন্ট ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। ওই বৈঠকে তারা প্রেসিডেন্টকে কোনো সময় না দিয়ে উপরের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে বলেন। আমিন দাবি করেন, প্রেসিডেন্ট সেসব দাবি মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের প্রাক্কালে ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের ডাইরেক্টর জেনারেল মেজর জেনারেল মো. রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তবে তখনও নিশ্চিত খবর পাওয়া যায়নি যে, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা।
আমিন বলেন, মেজর হায়দারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং তাকে অবসরে যেতে বাধ্য করা হতে পারে। (বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে বলে অনেকেই মনে করেন)। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে আমিন বলেন, আমরা এ বিষয়টি দেখব। আমিন আরও বলেন, প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব এম. মোখলেসুর রহমান চৌধুরীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে তাকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। রাষ্ট্রদূতকে আমিন বলেন, এমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্টের কাছে যেতে সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্তকে দু’টি বিষয় প্রভাবিত করেছিল।
সেনাবাহিনী যদি একপক্ষীয় নির্বাচনে সমর্থন দিয়ে কাজ করে তাহলে তা নিয়ে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের অব্যাহত অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশের ওপর একটি বিবৃতি। জাতিসংঘের স্থানীয় প্রতিনিধির জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনও নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সমর্থনকে সম্পর্কিত করে বিবৃতি দেয়। তাতে নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সমর্থনের বিষয়টি উঠে আসে। শুরুতেই জেনারেল মইন জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ করেন, যাতে জাতিসংঘ একটি চিঠি ইস্যু করে। তিনি ওই চিঠি নিয়ে প্রেসিডেন্টকে রাজি করাতে পারেন যে, যদি রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান না করা যায় তাহলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন বাধাগ্রস্ত হবে।
0 comments: