গোপন রাষ্ট্রীয় তথ্য ও দলিলপত্র ফাঁস করার মধ্য দিয়ে দুনিয়া কাঁপানো ‘উইকিলিকস’ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট অনেক তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করতে শুরু করেছে। যেমন ‘উইকিলিকস’-এর সর্বশেষ ফাঁস করা এক তথ্যে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির কাছে অঙ্গীকার করেছিলেন, মার্কিন কোম্পানিকে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হবে। সে অঙ্গীকার অনুযায়ীই সম্প্রতি জাতীয় স্বার্থকে তিগ্রস্ত করে কনোকো ফিলিপ্স-এর সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। এর পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এদেশের কোনো এক বিশেষজনের পুত্রও জড়িত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
ফাঁস করার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি আলোড়ন উঠেছে পিলখানা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত কিছু তথ্যের পরিপ্রেেিত। এসব তথ্য প্রথমে প্রকাশিত হয়েছে ভারতের পত্রপত্রিকায়। ‘উইকিলিকস’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে গত ২৭ মার্চ ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’ এবং ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত তথ্যগুলোকে এভাবে সাজানো যায় :
১. পিলখানায় কথিত বিডিআর বিদ্রোহের পর ‘সাহায্য চেয়ে’ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে টেলিফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২. তিনি ঠিক কোন ধরনের ‘সাহায্য’ চেয়েছিলেন তার উল্লেখ না করলেও খবরে বলা হয়েছে, প্রণব মুখার্জি ‘ইতিবাচক সাড়া’ দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রয়োজন অনুযায়ী’ সাহায়তা করা হবে।
৩. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেলিফোন পাওয়ার পরই প্রণব মুখার্জি বিষয়টি নিয়ে লন্ডন, বেইজিং এবং টোকিওর সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
৪. ২০০৯ সালের ফেব্র“য়ারি মাসের শেষ শনিবার (২৬ ফেব্র“য়ারি) অর্থাৎ হত্যাকাণ্ডের পরদিনই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শিবশংকর মেনন নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স স্টিভেন হোয়াইটকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। মার্কিন দূত ল করেছিলেন, শেখ হাসিনার নতুন সরকারের ওপর বিদ্রোহের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল ভারত সরকার।
৫. পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলোচনার বিস্তারিত বিবরণসহ ২০০৯ সালের ২ মার্চ ওয়াশিংটনে পাঠানো ১৯৪৬৬১ নম্বর গোপনীয় তারবার্তায় মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জানিয়েছিলেন, ভারতের ভয় ছিল, বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করতে পারে। কারণ, ২০০৮ সালের ডিসম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল এবং আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া কার্যক্রমে জামায়াত ‘নাখোশ’ ছিল। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেছিলেন, এই বিদ্রোহের পেছনে ছিল দীর্ঘ পরিকল্পনা, যদিও ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত সময় ‘দীর্ঘ’ হতে পারে না।
৬. ভারতের দ্বিতীয় ভয় ছিল, বিদ্রোহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সম্পর্কে অবনতি ঘটতে পারে। পররাষ্ট্র সচিব অবশ্য একটি কারণে আশাবাদী ছিলেন। কারণটি ছিল, পরিস্থিতি ‘স্থিতিশীল করতে’ সেনাপ্রধান (জেনারেল মইন উ আহমেদ) সরকারের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠভাবে’ কাজ করছিলেন।
৭. ২০০৯ সালের ১৩ ও ১৪ এপ্রিল ঢাকা সফরের পর পররাষ্ট্র সচিব শিবশংকর মেনন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার বার্গিলের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। ১৬ এপ্রিলের ২০২৬১৫ নম্বর তারবার্তায় মার্কিন দূতাবাস জানায়, ভারতের ভয়ের কারণ জানাতে গিয়ে মেনন বলেছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন যে, জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সরকারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে এবং ভারতে আক্রমণ চালানোর মতো ‘ফ্রি হ্যান্ড’ বা অবাধ সুযোগ নিতে পারে। অর্থাৎ এরা ভারতের ভেতরে ঢুকে আক্রমণ চালাতে পারে।
৮. জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর পরিচিতি দিতে গিয়ে শিবশংকর মেনন জামায়াতে ইসলামীর মতো রাজনৈতিক দল এবং হরকাতুল জেহাদ আল ইসলামী বা হুজি’র মতো মৌলবাদী গ্র“পের কথা জানিয়েছিলেন।
‘দ্য হিন্দু’ এবং ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত খবরে এসবের বাইরে আর কিছু জানানো হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে পড়লে মনে হতে পারে যেন বিদ্রোহের আড়ালে সেনা অফিসারদের হত্যাকাণ্ডে ভারতের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না, ভারতীয়রাও ছিল অন্ধকারে। অন্যদিকে ঘটনাপ্রবাহে কিন্তু অন্য রকম তথ্যই প্রাধান্যে এসেছিল। এখানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের কথা উল্লেখ করা দরকার। বাংলাদেশের কোনো মানুষ জানার, এমনকি কল্পনা করারও অনেক আগে, বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর পর বেলা ১২টার দিকেই ভারতীয় টিভি চ্যানেল সিএএন-আইবিএন ও এনডিটিভি প্রচার করেছিল, বিডিআরের ডিজি ও তার স্ত্রী নিহত হয়েছেন। এটা এমন কারো পইে শুধু জানা সম্ভব, যারা মূল পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকে। খবরের ‘সূত্র’ও ছিল যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ। ভারতীয়দের প্রত্যেকেই খবর পেয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা ‘সূত্রে’। সেকথা তারা উল্লেখও করেছিল। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছিল, ঘটনাপ্রবাহে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গভীরভাবেই জড়িত ছিল।
দ্বিতীয়ত, উইকিলিকস ভারতের ‘সাহায্য’ চেয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধ জানানোর কথা প্রকাশ করেছে সত্য কিন্তু জানায়নি, ‘সাহায্য’ করার জন্য ভারত ঠিক কোন ধরনের পদপে নিয়েছিল। প্রকাশিত তথ্যগুলো পড়লে মনে হতে পারে যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করার এবং মুখে মুখে ‘ইতিবাচক সাড়া’ দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন প্রণব মুখার্জি। অন্যদিকে সত্য হলো, ঢাকা থেকে সাহায্যের জন্য ‘সুনির্দিষ্ট অনুরোধ’ যাওয়ার পর রাতারাতি ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারাস্যুট রেজিমেন্টকে আগ্রা থেকে পশ্চিম বঙ্গের কালাইকুন্ডে নিয়ে আসা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে এই রেজিমেন্টের সেনাদেরই বিমানযোগে বাংলাদেশে নামানো হয়েছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশ ছিল তাদের ‘নখদর্পণে’। ওদিকে পশ্চিম বঙ্গের পাশাপাশি আসামেও ‘প্রস্তুত’ ছিল ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোমারু বিমান। এসব খবর সে সময় ভারতের সংবাদ মাধ্যমই জানিয়েছিল। অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারকে ‘সাহায্য’ করার জন্য ভারত রীতিমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল।
হঠাৎ উইকিলিকস’-এর ফাঁস করা তথ্যগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়ার কারণ তৈরি করেছেন ভারতের ‘বিশিষ্ট পন্ডিত’ ভাস্কর রায়। পিলখানায় দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের হত্যাকাণ্ডের ঠিক পরপর প্রথমবারের মতো দৃশ্যপটে এসেছিলেন এই পন্ডিত। সেটা এমন এক সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের মিডিয়া ভয়ংকর রকমের তথ্যযুদ্ধ শুরু করেছিল। ভারতীয়রা তখন কেবল নিত্য নতুন তথ্যই ‘আবিষ্কার’ করেনি, একই সাথে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও হাজির করেছে। ভারতীয় টিভি চ্যানেল ও দৈনিকগুলোর সঙ্গে থিংক ট্যাংকের মুখপত্র নামধারী কিছু সাময়িকীও সে তথ্যযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এরকম একটি সাময়িকীর মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো হাজির হয়েছিলেন ভাস্কর রায়। তার সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে বলা হয়েছিল, তিনি শুধু পন্ডিত নন, ‘অভিজ্ঞ’ বিশ্লেষকওÑ বাংলাদেশের ব্যাপারে যার ‘প্রচুর পড়াশোনা’ রয়েছে এবং যিনি বাংলাদেশের ব্যাপারে ‘নিয়মিত’ খোঁজ-খবর রাখেন!
‘খোঁজ-খবর’ রাখার নমুনা পাওয়া গিয়েছিল ‘সাউথ এশিয়ান অ্যানালিসিসে’ প্রকাশিত এক নিবন্ধে। নিজের এক ‘মহাআবিষ্কারের’ আলোকে বিশ্লেষণ দিতে গিয়ে ভাস্কর রায় বলেছিলেন, বিডিআরের কথিত বিদ্রোহ সফল হলে নাকি ‘ডানপন্থী’ বিএনপি ও ‘ইসলামপন্থী’ জামায়াতে ইসলামীর জোট মতায় ফিরে আসতো। বিডিআর বিদ্রোহের ‘ষড়যন্ত্র’ নাকি সে উদ্দেশ্যেই ‘অত্যন্ত যতœ ও সতর্কতার সঙ্গে’ তৈরি করা হয়েছিল এবং ষড়যন্ত্রের নাকি দীর্ঘমেয়াদী ও বৃহত্তর ‘গেম প্ল্যান’ও ছিল! নিজের এই বিচিত্র তত্ত্বকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে ভাস্কর রায় বাংলাদেশ ও ভারতের কারো কারো বরাতে এমন কিছু তথ্যের উল্লেখ করেছিলেন, যেগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষই কিছু জানতো না। আর না জানার কারণ, ভারতের এই পন্ডিত প্রবর বাংলাদেশের ভারতীয় ঘরানার এমন দু-একটি দৈনিককে সূত্র হিসেবে অবলম্বন করেছিলেন, গল্প ফেঁদে বসার জন্য যে দৈনিকগুলোর বিশেষ কুখ্যাতি রয়েছে।
অতি সম্প্রতিও নতুন করে কিছু পাণ্ডিত্যপূর্ণ কথা শুনিয়েছেন খোঁজ-খবর ‘রাখনেওয়ালা’ ভাস্কর রায় (দেখুন : সেন্টার ফর চায়না স্টাডিজ, সি৩এস পেপার নম্বর ৮০১)। ‘লেট বাংলাদেশ সল্ভ ইট্স ওন পলিটিক্যাল ইস্যুস’ শিরোনামে ৪ জুন লেখা এক নিবন্ধে তিনি জানিয়েছেন, গত মাস মে’তে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় মার্কিন কর্মকর্তারা নাকি বেগম খালেদা জিয়াকে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার যদি ড. মুহম্মদ ইউনূসের বিষয়টি সম্মানজনকভাবে মীমাংসা না করে তাহলে ওয়াশিংটন বাংলাদেশকে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট অ্যাকাউন্টস (এমডিএ)-এর প্রতিশ্র“ত সাহায্য স্থগিত করবে। এরও আগে রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টিসহ ঢাকা সফরকারী মার্কিন কর্তাব্যক্তিরাও নাকি আওয়ামী লীগ সরকারকে সম্পর্কে অবনতি ঘটানোর একই হুমকি শুনিয়েছেন। অথচ সত্য হচ্ছে, ভাস্কর রায় যে এমডিএ-র কথা বলেছেন, তার ৩০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য ওয়াশিংটন গত বছরের ডিসেম্বরেই স্থগিত ঘোষণা করেছে। এর সঙ্গে খালেদা জিয়ার যুক্তরাষ্ট্র সফরের কোনো সম্পর্ক নেই।
খালেদা জিয়াকে দিয়ে শুরু করলেও ভাস্কর রায় তার মূলকথাগুলো বলেছেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসকে কেন্দ্র করে। বিশেষ ইঙ্গিত দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, ড. ইউনূসের উত্থান নাকি বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে ঘটেছিল। খ্যাতিও তিনি নাকি জোট সরকারের বদৌলতেই পেয়েছিলেন। বড়কথা, ড. ইউনূসের নাকি বিএনপির সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ ছিল, এখনও আছে। ভাস্কর রায় লিখেছেন, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটের মতো ইসলামী দলগুলো নাকি নারীদের উন্নয়নের ব্যাপারে ড. ইউনূসের নীতি ও কার্যক্রমের ঘোর বিরোধী। কারণ, ইসলামের সামাজিক আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে নারীদের সুযোগবঞ্চিত অবস্থায় রাখাই ইসলামী এই দলগুলোর উদ্দেশ্য! বিএনপির সঙ্গে ড. মুহম্মদ ইউনূসের ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে জানানোই অবশ্য মিস্টার রায়ের উদ্দেশ্য নয়। কিছুদিন আগে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছে কলকাতাস্থ মার্কিন কনস্যুলেটের পাঠানো একটি তারবার্তার উল্লেখ করে ভাস্কর রায় বলেছেন, এতে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ড. ইউনূসকে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিকল্প ও তৃতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়ার চেষ্টা করছে। ‘উইকিলিকস’-এর ফাঁস করা তারবার্তাটিতে নাকি বলা হয়েছে, ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের এ পরিকল্পনায় ‘সম্মত’ হয়েছেন। ভাস্কর রায় লিখেছেন, এর অর্থ অবশ্য এমন নয় যে, ওয়াশিংটন খালেদা জিয়াকে সমর্থন জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও কৌশল অবশ্যই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের স্বার্থবিরোধী।
ভাস্কর রায় লিখেছেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ড. ইউনূসকে প্রথমে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একজন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, গ্রামীণ জনগণের মধ্যে ড. ইউনূসের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক আদর্শ বা মতবাদ না থাকায় ড. ইউনূসকে বিকল্প নেতা হিসেবে দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। মিস্টার রায়ের মতে ড. ইউনূসের পে জাতিকে রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়। সে কারণে বিএনপি ও আওয়ামী লীগে ভাঙন ঘটিয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে তৃতীয় কোনো দল গঠন করা গেলেও এবং তার ওপর ওয়াশিংটনের কঠিন নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকলেও সে দলটিকে দিয়ে মার্কিন স্বার্থ উদ্ধার করানো যাবে না। মিস্টার রায় লিখেছেন, ড. ইউনূসের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থানের পরিপ্রেেিত বিএনপি যথেষ্ট উল্লসিত হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু খালেদা জিয়া ও জামায়াতসহ তার সহযোগীরা বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারকে মতাচ্যুত করার এক দফা কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তারা জানেন না, ওয়াশিংটন কখন তার ‘হট পট্যাটো’টি ছুঁড়ে দেবে। শাসনকালের দুর্নীতি এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি সমর্থনের কারণে বিএনপি নিজেও যে ওয়াশিংটনের ‘গুডবুকে’ নেই সে কথা জানাতেও ভুল হয়নি এই পন্ডিতের।
অনেকাংশে নসিহত করার স্টাইলে ভাস্কর রায় লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝতে হবে, বাংলাদেশে ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা রাষ্ট্রমতায় পরিবর্তন ঘটানো কিংবা একেবারে নতুন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে মতায় বসানোর চিন্তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদজনক। অনেক বাস্তব এবং কল্পিত কারণেই আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করা যেতে পারে কিন্তু একথাও স্বীকার করতে হবে, প্রবল প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও শেখ হাসিনার সরকার উচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে এবং সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের মাধ্যমে এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের রাষ্ট্রমতায় পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করে তাহলে আওয়ামী লীগ সরকার এ পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যা কিছু অর্জন ও সংহত করেছে তার সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশকে পেছন দিকে নিয়ে যাবে এবং তার ফলে এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও নানাভাবে তির সম্মুখীন হতে থাকবে। মিস্টার রায় সতর্ক করতে গিয়ে বলেছেন, একটি বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় রাখা দরকার। সেটা হলো, মার্কিনবিরোধী বিদেশী ইসলামী জঙ্গী ও জেহাদীরা এখনও জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী গ্র“পের সহযোগিতায় বাংলাদেশে নিজেদের ভিত্তি সংহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং আওয়ামী লীগ সরকার তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে যুদ্ধ করছে। ওয়াশিংটন নিশ্চয়ই চাইবে না, বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদীদের ‘নিরাপদ স্বর্গ’ তৈরি হোক।
এভাবেই কথার মারপ্যাঁচে ভাস্কর রায় বলতে চেয়েছেন, কথিত ইসলামী জঙ্গী-জেহাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের দমন ও ধ্বংস করতে হলে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের চাইতে নির্ভরযোগ্য আর কোনো সরকার হতে পারে না। সুতরাং ড. মুহম্মদ ইউনূসকে পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং বিএনপি-জামায়াতের সমর্থন নিয়ে তাকে মতায় আনার চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের নিজের জন্যই তিকর হয়ে উঠবে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আওয়ামী লীগকেই মতায় টিকিয়ে রাখা!
পান্ডিত্যপূর্ণ মনে হলেও ভাস্কর রায় কিন্তু তার এ তত্ত্বটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর কারণ, বিশ্লেষণে দেখা যাবে, মিস্টার রায়ের নিজের বিভিন্ন তথ্য ও কথার মধ্যেই স্ববিরোধিতা রয়েছে। যেমন ড. ইউনূস সম্পর্কে জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর মনোভাব নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। বলেছেন, ইসলামী দলগুলো নাকি নারী উন্নয়নের ব্যাপারে ড. ইউনূসের নীতি ও কার্যক্রমের ঘোর বিরোধী। তা-ই যদি সত্য হয় তাহলে এই দলগুলো আবার ড. ইউনূসকে সমর্থন জানায় কি করে? তেমন েেত্র ড. ইউনূসের প্রতি বিএনপির সমর্থন নিয়েও তো প্রশ্ন ওঠে। কারণ, ভাস্কর রায়ের মতে শেখ হাসিনার শুধু নয়, যুক্তরাষ্ট্র ড. ইউনূসকে একই সঙ্গে খালেদা জিয়ারও প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। এটা সত্য হলে খালেদা জিয়ার মতো একজন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় নেত্রী কিভাবে ড. ইউনূসের পে দাঁড়াতে পারেনÑ বিশেষ করে ড. ইউনূসকেই যেখানে মতায় আনার জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে? খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই নিজের পায়ে নিজে ‘কুড়াল’ মারতে চাইবেন না। অতীতের মতো কথিত ইসলামী জঙ্গী ও জেহাদীদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক আবিষ্কার করেও হাসিরই খোড়াক যুগিয়েছেন ভাস্কর রায়। কারণ, বহুবার বহুভাবে চেষ্টা করেও কথিত জঙ্গিদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক থাকার বিষয়টি এ পর্যন্ত কেউই প্রমাণ করতে পারেনি।
বানোয়াট তথ্য ও বিশ্লেষণ হাজির করলেও ভারতের এই পন্ডিতের মূলকথাগুলোকে গভীর গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া দরকার। কারণ, ভাস্কর রায় সাধারণত বিশেষ বিশেষ সময়ে দৃশ্যপটে এসে থাকেন-যেমনটি এসেছিলেন পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঠিক পর পর। তার মন্তব্য ও বিশ্লেষণও ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পেছনে তিনি নিজে থেকে বিএনপি-জামায়াতের ‘কালোহাত’ ও ‘ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করেননি। তার এ আবিষ্কারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এ ব্যাপারে জানা গেছে ‘উইকিলিক্স’-এরই ফাঁস করা বিভিন্ন তথ্যে। এরকম একটি তথ্য হলো, বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে ‘নাখোশ’ জামায়াতে ইসলামী ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করতে পারে বলে ভারত ভয় পেয়েছিল। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবও ভাস্কর রায়ের মতোই মার্কিন দূতকে বলেছিলেন, ওই বিদ্রোহের পেছনে ছিল ‘দীর্ঘ পরিকল্পনা’। ভাস্কর রায়ের প্রাঙ্গিক মন্তব্যটুকুও স্মরণ করা দরকার। তিনি লিখেছিলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল ‘দীর্ঘমেয়াদী ষড়যন্ত্র’ ও বৃহত্তর ‘গেম প্ল্যান’ এবং ওই বিদ্রোহ সফল হলে ‘ডানপন্থী’ বিএনপি ও ‘ইসলামপন্থী’ জামায়াতে ইসলামীর জোট মতায় ফিরে আসতো! শিবশংকর মেনন মার্কিন দূতকে জানিয়েছিলেন, বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সম্পর্কে অবনতি ঘটতে পারে। কথাটা ভাস্কর রায়ও সে সময় লিখেছিলেন।
এভাবে একটির পর একটি তথ্য সাজিয়ে দেখলে পরিষ্কার হয়ে যাবে, ভাস্কর রায় একজন ব্যক্তি মাত্র নন। তাকে দিয়ে আসলে ভারত সরকারই কথা বলিয়ে থাকে। বর্তমান পর্যায়েও ভারত সরকারের হয়েই তিনি দৃশ্যপটে এসেছেন কি না সে প্রশ্ন তাই গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করা দরকার। বেশি দরকার ড. মুহম্মদ ইউনূসকে হঠাৎ সামনে নিয়ে আসার এবং বাতাসে গুজব ভাসিয়ে দেয়ার কারণ সম্পর্কে চিন্তা করা। একই সঙ্গে বিএনপিকে টেনে আনার কারণে তো বটেই, কথিত ইসলামী জঙ্গী-জেহাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে আবারও জামায়াতে ইসলামীকে যুক্ত করার পেছনে কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে-সে প্রশ্নের উত্তর নিয়েও চিন্তা করা দরকার।
0 comments: