উইকিলিকসের তথ্য : একাত্তরের পর প্রথম মুশকিলে জামায়াত
'১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী যে কোনো সময়ের চেয়ে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিকভাবে ভীষণ বেকায়দায় পড়েছে। দলটি খুব মুশকিলে আছে। উচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়া এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় জামায়াতে ইসলামী এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।'
জামায়াত নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির এক বৈঠক এবং অন্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ মন্তব্য করা হয়। ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এ 'মন্তব্য করা' কূটনৈতিক তারবার্তাটি রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি ওয়াশিংটনে পাঠান। এর বরাত দিয়ে গত ৩০ আগস্ট উইকিলিকস এ তথ্য প্রকাশ করেছে।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের গোপন তারবার্তায় বলা হয়, ২০১০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘটিত সাম্প্রতিক রক্তাক্ত সংঘাত নিয়ে কথা হয়। ডরমিটরিতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের কর্মীদের মধ্যে সৃষ্ট তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ওই সংঘাত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। ওই ঘটনায় ৩ জন নিহত হয়। রাজ্জাক স্বীকার করেন ছাত্রদের মধ্যে এ ধরনের প্রাণঘাতী সংঘাত সমর্থনযোগ্য নয়, নিন্দনীয়। তার দল এ সংঘর্ষে ইন্ধন জোগায়নি বরং তদন্তে সহায়তা করবে।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টিকে বলেন, সরকার দেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কায়েম করতে চায়। সে কারণেই সরকারের ইচ্ছামাফিক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে। ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের মতে, দেশের শীর্ষ আদালতের (হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট) স্বাধীন ইচ্ছায় এ রায় দেওয়া হয়নি। এ রায়ে আদালত সাংবিধানিক আইনের ধার ধারেনি। এ রায়ের মাধ্যমে সরকার এখন জামায়াত ইসলামীসহ সব ইসলামী দল নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। আবদুর রাজ্জাক বলেন, তার দল গণতন্ত্র ও আইনের শাসনে বিশ্বাস করে। তাই সরকার যদি দেশে ধর্মভিত্তিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে দেয় তা হলে জামায়াতে ইসলামী নাম পরিবর্তন করবে। গঠনতন্ত্র সংশোধন করে দলের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রবণতা বা ঘোষণা বাদ দেবে। কারণ, জামায়াত আদালতের রায় মেনে চলতে আগ্রহী।
আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দল থাকার নজির আছে। যেমন আছে তুরস্কে।' তিনি রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টিকে স্মরণ করিয়ে দেন ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যারা যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে হামলা চালিয়েছে তারা কেউই গণতান্ত্রিক দেশের লোক নন। তাদের বেড়ে ওঠা স্বৈরতান্ত্রিক সমাজে। নিজামীর মতে, বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে ইসলামী চরমপন্থি মাথাচাড়া দেবে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গ : এ সম্পর্কে ব্যারিস্টার রাজ্জাক রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টিকে বলেন, 'এক. এ ইস্যু ইতিমধ্যেই মীমাংসিত। দুই. রাজনৈতিক কারণে পুরনো এ ইস্যু আবার সামনে আনা হয়েছে। তিন. যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্য দেশে যে আইন বলবৎ আছে তা আন্তর্জাতিক মানের নয়।' তারা দু'জনই একমত হন ১৯৭৩ সালে প্রণীত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচার করার জন্য পূর্ণাঙ্গ নয়। রাজ্জাক ও মরিয়ার্টি একমত হন যে, 'যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে হলে ১৯৭৩ সালের আইনটি যুগোপযোগী করতে হবে। তা না হলে নতুন আইন করতে হবে। পাশাপাশি এ বিচারের সময় আইনের শাসন ও আন্তর্জাতিক মানের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।'
মরিয়ার্টির ওই বার্তায় মন্তব্য কলামে আরও বলা হয়, ব্যারিস্টার রাজ্জাক যদিও বলছেন জামায়াতে ইসলামী 'আইনের শাসন' মেনে চলবে; কিন্তু তার পার্টির কট্টরপন্থিরা এ রকম কিছু গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে শাসক দল আওয়ামী লীগের কট্টর জামায়াতবিরোধীরা এখনই জামায়াত ও অন্য ইসলামী দলগুলোকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবছে কি-না তা এখনও পরিষ্কার নয়। এ বিষয়ে সংশয় রয়েছে।
0 comments: